বিকেলে বসে আছি রুমে। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ একজন বলল,
— দেখ তো এই সেই কানের দুল জোড়া কিনা? কানের দুল দেখে আমি এতটা খুশি হয়েছি আবার পরক্ষণে ই মনে পড়ল আরে এটার তো অনেক দাম ৫৭০ টাকা। এত টাকা দিয়ে ভাবি এই দুল জোড়া কিনে আনলে তুমি?
— আরে, ধুর পাগলি। এ আর এমন কি। আজকে তোর জন্মদিনে কিছু দিব না এমন কি হয় !
কিন্তু আমি তো জানি ভাবি এই টাকা টা কত কষ্ট করে জমিয়েছে। ভাইয়ার কাছে চাইলে ই পাবে না। আর আমার জন্য চাইলে তো আরো না। ভাইয়া ছোটখাট একটা চাকরি করে কোনো রকম টেনেটুনে ঘর চলে। একদিন খুব ইচ্ছা করছিল সরষে ইলিশ খেতে কি জানি একটা কথায় কথায় ভাবিকে বলেছিলাম। অনেক দিন হল খাই না গ্রামে নানাবাড়ি গেলে খেতাম সে তো ৪/৫ বছর আগে। তখন ভাবি নতুন বউ। ভাইয়াকে বলেন আমার ইচ্ছার কথা।
ভাইয়া মুখের উপর বলে দেন, এসব মজার মজার খাবার খেতে হলে পড়ালেখা বাদ দিতে হবে। সবকিছু পূরণ করতে পারবে না ভাইয়া। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম কথা টা শুনে পাশের রুমে ছিলাম আমি আমাকে শুনিয়ে ই কথাটা বলেছে। তবে, এরকম করার যথেষ্ট কারণ আছে। আমি ভাইয়ার সৎ বোন আমাদের বাবা এক মা দুজন। ভাইয়া মনে করে আমার মায়ের জন্য ই নাকি বড়মা মারা গেছেন। উনার আরো একটা ধারণা পর কখনো আপন হয় না। সৎ বোন সৎ বোন ই। আমি পারতাম বাবা মা মারা যাওয়ার পর নানাবাড়ি চলে যেতে। কিন্তু আমি কেন যাব আমার ভাই আছে আমি তো তাকে ভাই বলে মানি। আর বাবা মারা যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেছেন যেন কখনো এমন না করি। পরে মা’ও স্টোক করে মারা যান।
এর একমাস পর ভাবি বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন কিন্তু ৭ দিনের জায়গায় ২য় দিন বিকেলে হুট করে তিনি চলে আসেন। হাতে একটা বাক্স দেখলাম। আমাকে রান্না ঘরের টেবিলে এনে বসিয়ে প্লেটে ভাত দিয়ে বললেন, রিনি তুই না বলেছিলি সরষে ইলিশ খাবি। বাবা আজ এনেছে মা রান্না করেছে। কিন্তু খেতে গিয়ে তোর কথা মনে পড়ল খেতে পারলাম না। ভাবলাম একসাথে বসে দুজন মিলে খাব। তাই চলে এলাম। কিছু মনে করিস না ঐ দিনের জন্য। আমি ভাবির কথা শুনে চোখের জল আটকে রাখতে পারলাম না। ভাবি চোখ মুছে দিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিল। ভাবির বাড়ির আর্থিক অবস্থাটাও তেমন ভালো না তারপরও কোনোকিছু না ভেবে আমার জন্য বক্স টা ভর্তি করে নিয়ে এল। মা মারা যাওয়ার পর ভুলে ই গিয়েছিলাম, মা’য়ের আদর কেমন হয় কিন্তু এই ভাবি আসার পর থেকে ই সেটা আবার অনুভব করি।
এরকম ছোটখাট ইচ্ছাগুলো ভাবি এমন ভাবে পূরণ করত যা বলার ভাষা আমার থাকত না। একটা টিউশনি করি। সেখান থেকে কলেজ যাতায়াতের খরচ আর মাঝে মাঝে ভাবি ননদ মিলে ফুচকা খাওয়া, কাচের চুড়ি কেনা আর পড়ালেখার টুকটাক জিনিষ কিনি। সব তো আর ভাইয়া কে বলতে পারি না ! তবে খুব কষ্ট লাগত, ভাইয়া যখন ভাবিকে অকথ্য ভাষায় কথা বলত গালি দিত ছোটখাট ভুলের জন্য। ভাই’টা কেমন জানি মুখে একটুও মিষ্টি নেই। ভাবি চুপ করে সহ্য করত। কেন এত সহ্য করত জানি না। হয়ত স্ত্রী ধর্ম পালনে ব্রত। আমি দেখতাম মাঝে মাঝে ভাবি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত। আমি সামনে গেলে ই আবার নরমাল হয়ে যেত। এভাবে আমার প্রতিটি জন্মদিনে ভাবি যতটুকু পারে চেষ্টা করত আমাকে আমার পছন্দের কিছু দিতে। আমিও জড়িয়ে ধরে তাকে হারিয়ে যাওয়া কিছু অনুভব করতাম। জানি না কি কপাল করে এসেছিলাম মা বাবা নেই কিন্তু এমন এক ভাবি পেয়েছি।
বেশ কিছু দিন পর ভাইয়া হটাৎ করে দুপুরে বাসায় চলে আসল। সাধারণত এরকম হয় না। সন্ধ্যায় ফিরে। শরীর খারাপ লাগছিল তাই। ক্রমে ভাইয়ার শারীরিক অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগল। অনেক ডাক্তারের কাছে যাওয়া হল কেউ কিছু ধরতে পারছে না । এদিকে ভাবি জায়নামাজে বসে দু চোখের পানি এক করে দিচ্ছে। একে তো ভাইয়ার অবস্থা দেখে ভালো লাগছিল না আর অন্যদিকে ভাবির চোখের পানি যেন সহ্য হচ্ছিল না। হয়ত কোনো প্রিয়জনের চোখের পানি সহ্য করার মত ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা কাউকে দেন নি।ইচ্ছে করছিল যদি আমি এমন কিছু করতে পারতাম যাতে ভাবি এভাবে আর কান্না না করে ! অনেক পরিক্ষা নিরীক্ষকার পর জানা গেল ভাইয়ার কিডনি ড্যামেজ। একটা পুরোপুরি ড্যামেজ অন্যটাতেও অনেকটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। ৪০% ভালো আছে অন্যটার কিন্তু তাতে একটা মানুষ ভালো হবে না।
এসব কথা শোনার পর কেমন জানি ব্যথা লাগল। অন্যদিকে ভাবি আরো ভেঙে পরল কারণ তখন ভাবি অন্তঃসত্ত্বা। কি হবে কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। ভাইয়ার সাথে ভাবিকেও যেন দিন দিন হারিয়ে ফেলছি মুখে কিছু না বললেও উনার নিরব কান্নাটা আমি দেখতে পাই। আমার পরিবারের নতুন সদস্য আসছে আর এরকম একটা অবস্থা মেনে নিতে পারছি না। ভাবিও কোনো দিক দিশা পাচ্ছে না। রাতে একটু জোড়ে ভাবির কান্না শুনলাম। উপরওয়ালার কাছে সন্তানের বাবা ভিক্ষে চাইছেন। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। সাতদিন পর ভাইয়ার অপারেশন টা করা হল। আমি আমার একটা কিডনি ভাইয়া কে দিয়ে দিলাম। বাবা আমার বিয়ের জন্য রেখে যাওয়া টাকা টা অপারেশনের জন্য খরচ করলাম। নাহ ভাইয়ার জন্য নয় আমার আরেক মায়ের জন্য তার সন্তানের জন্য। এতটুকু তো করতে ই পারি। যে জীবনে প্রিয় মানুষটার হাসিমুখ দেখতে পাব না সে জীবনের মূল্য কি..!
দিয়ে দিলাম কিডনি ভাইয়াকে। যত ই হোক ভাই তো। সেদিন ভাবির মুখের হাসিটা দেখে যেন আমার মন ভরে গেল।
কতবার জড়িয়ে ধরে আদর করেছে হিসেব নেই। ভাইয়া তার ভুল বুঝতে পারল। আমি বললাম, পর তো আপন হয় না ঠিক তবে আপন কি কখনো পর হতে পারে। যত ই বল রক্ত তো কথা বলে। ভাইয়া প্রথম বার সেদিন বোন বলে বুকে নিলেন। আজ যেন মনে হচ্ছিল বাবা আদরটাও পেয়ে গেছি। একটু ত্যাগে যদি এমন ভালোবাসা পাই ক্ষতি কি…! এভাবে নতুন অতিথির আগমনের দিন গুণতে লাগলাম আমরা। সাঁজাতে লাগলাম সবকিছু। ভাবি কত খুশি ভাইয়াকে এমন দেখে। আজ ভাবির ডেলিভারী। কিন্তু ডাক্তার এখন এসে যা বলে গেল নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। ভাবি নেই। আমার আরেক মা নেই। সন্তান জন্ম দিতে মারা গেছে।
আমার আরেকটা প্রিয় জিনিষকে হারালাম। সৃষ্টিকর্তা ছিনিয়ে নিলেন। কেন এমন হল। বুক ফেটে আর্তনাদ করতে লাগলাম যেন কেউ আমার হৃদপিন্ড টা নিয়ে নিছে। ভাবির মুখ দেখে কলিজাটা কেমন জানি ছিড়ে যাচ্ছিল।
মেনে নিতে পারছিলাম না, আমার সব আবদার কোথায় বলব। কে আদর করবে মায়ের মত করে। কে করবে..? সামলাতে পারছিলাম না নিজেকে। ভাইয়া এক হাতে ভাবির শেষ চিহ্ন টাকে নিয়ে আমাকে বুকে নিয়ে বললেন,” আমি আছি তো।