রিধিতা

রিধিতা

অফিস থেকে বাসায় এসে শার্ট টা হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখতে যাবো এমন সময় রহিমা খালা বললো এসে পড়েছ বাবা। জবাবে কিছু না বলে রহিমা খালা কে বললাম খালা আজ কি রান্না করলে? ফ্রীজে গরুর গোস্ত ছিলো সাথে পোলাও চাল রান্না করেছি বাবা। খালা পোলাও চাল রান্না করবে সকালে বলবে তো, আসার সময় শসা লেবু আর টমেটো নিয়ে আসতাম। ছালাত বানানোর জন্য। মুচকি হেসে খালা বললেন মনে ছিলো না বাবা। খালা তোমার স্মরণ শক্তি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে কিন্তু। রহিমা খালা ভাত তরকারি রেখে চলে গেলেন। আমিও গোসল করতে বাথরুমে চলে গেলাম। গোসল সেরে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুচতে ছিলাম। রহিমা খালা দরজা সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

–খালা কিছু বলবে? টাকার দরকার নাকি?
–না বাবা টাকা লাগবে না, তোমায় একটা কথা বলবো ভাবছিলাম?
–বলেন
–কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না বাবা
–সংকোচ কেন করতেছো খালা, বলো কি বলবে
–আমি জানি তুমি ব্যস্ত মানুষ সারাদিন অফিসে খাটাখাটুনি করে আসো।
–বিয়ে করার কথা বলতে চাচ্ছেন নাকি খালা
–না বাবা, আমি বলতে চাচ্ছিলাম তুমি যদি আমার মেয়েটাকে পড়াতে তাহলে খুশী হতাম। বিনিময়ে তোমার রান্না করার জন্য কোন টাকা লাগবে না আমার।
–খালা তোমার মেয়ে আছে আগে বলো নি তো? আর টাকার কথা এখানে কেন আসছে!
–বাহিরে পড়াতে চেয়েছিলাম তারা অনেক টাকা চায় যা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না বাবা।
–খালা তোমার মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে?
–সিক্সে ভর্তি হয়েছে এবার, পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খাই আবার প্রাইভেটের টাকা কোথ থেকে দিবো।
–খালা টেনশন করো না, শোনো আমি তো শিফ্টিং ডিউটি করি দু সপ্তাহ পড়াতে পারবো এতে হবে, যখন বি শিফট চলে তখন বাসায় থাকবো না।

–একটু সময় দিলে হবে বাবা, আমার মেয়ে মেধাবী।
–খালা তাহলে বিকেল থেকে আসতে বলো কেমন?
–আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক বাবা। এই বলে রহিমা খালা চলে যাচ্ছিলেন। আমি আবার ডাক দিয়ে বললাম খালা শোনো তো

–কি বাবা
–বাসায় ভাত তরকারী নিয়ে যাও এখান থেকে
–লাগবে না বাবা
–আহ খালা নিয়ে যাও তো
–তোমাদের জন্য পরিমাণ মতো রান্না করেছি, আমি নিয়ে গেলে তোমাদের দুজনকে হবে না বাবা
–খালা সোহান আজ আসবে না ছুটিতে গেছে এটাও ভুলে গেছো, আগেই বলেছিলাম তোমার স্মৃতি শক্তি কমে যাচ্ছে। আসো খাবার নিয়ে যাও।

নিজের জন্য খাবার বেঁড়ে বাকি গুলো খালাকে দিয়ে দিলাম। আর খালা মুখে এক পশলা হাসি রেখে চলে যাচ্ছেন। ঢাকা শহরে এখন বুয়া পাওয়া হলো সরকারি চাকরির মতো। অনেক কাঠগড় পোয়াতে হয়। আমার কলিগ আদিলের মাধ্যমে রহিমা খালার সন্ধান পেয়েছিলাম। আগে অন্যের বাসায় কাজ করতেন। মাস শেষে যা পেতেন তা দিয়ে সংসার চলতো। হঠাৎ রহিমা খালার স্বামী আগত হওয়ায় সংসার নিয়ে টানাপড়নে পড়ে যান। তাই বাধ্য হয়ে ব্যাচেলর ছেলেদের রান্না শুরু করেন। বিকেল বেলা রহিমা খালা সাথে একটা মেয়ে এসেছে বয়স এগারো কি বারো হবে। মেয়েটির হাতে বই আছে কতগুলো, এবার বুঝলাম এটাই রহিমা খালার মেয়ে। রহিমা খালা আমাকে ডাক দিয়ে বললো বাবা এই হলো আমার মেয়ে রিধিতা। খালা নাম বলতেই রিধিতা সালাম দিলো। সালামের উত্তর দিয়ে রিধিতা কে বললাম টেবিলে গিয়ে বসতে। রহিমা খালা রান্না করার জন্য তরকারি কাঁটা শুরু করলেন। ফ্রেস হয়ে রিধিতার সামনে চেয়ারে এসে বসলাম।

–কেমন আছো রিধিতা?
–ভালো স্যার
–এই শোন আমাকে স্যার স্যার বলবে না, ভাইয়া বলে ডাকবে কেমন?
–জ্বী স্যার না ভাইয়া
–আচ্ছা তোমার কিসে সমস্যা শুনি?
–ভাইয়া অংক বইতে কিছু ইংলিশ অংক আছে এগুলো বুঝিনা, প্রাইমারি স্কুলে তো এমন অংক দেখিনি!
–ইংলিশ অংক গুলো কে বলে বীজ গনিত,

প্রাইমারি স্কুলে যেমন অংক করে এসেছো এইখানে এগুলো কে বলা হয় পাটি গণিত। আর যতো উপরের ক্লাসে যাবে দেখবে পাটি গণিত থেকে বীজগণিত একদম সহজ।
তোমাকে প্রয়োজনীয় সুত্র লিখে দিচ্ছি এগুলো মুখস্থ রাখবে, তাহলে অংক করতে তোমার জন্য সুবিধা হবে।

–জ্বী
–আর কোন সাবজেক্টে সমস্যা আছে তোমার?
–না স্যার ইংরেজী দ্বিতীয় পত্রটা কম বুঝি একটু
–ওটা আমিও কম বুঝি, তারপরও যতটুকু পারি তোমাকে বুঝিয়ে দিবো। দুই সপ্তাহ পড়ানোর পরে রিধিতা বললো
–ভাইয়া পরশু থেকে তো আর পড়াবেন না তাই না
–কেন
–আম্মু বলেছে এই সময় আপনি নাকি অফিসে থাকেন, অনেক রাত করে বাসায় আসেন।
–হ্যাঁ তা ঠিক বলেছে, এক কাজ করো তুমি সকালে আসতে পারবে সাতটার দিকে
–পারবো ভাইয়া।

রিধিতার মন একটু খারাপ ছিলো মনে হয় পরের সপ্তাহ পড়তে পারবে না বলে! কিন্তু সকালে আসতে বলাতে মুখটা হাস্যোজ্জ্বল হয়ে গেলো। মাত্র একমাসে রিধিতা পড়াশোনায় অনেক উন্নতি করেছে, বিশেষ করে অংকে।। স্যালারি হওয়ার পরের দিন রহিমা খালা রান্না করতেছিলো

–খালা যাওয়ার সময় টাকা নিয়ে যাইয়ো
–লাগবে না বাবা
–কেন খালা, গুপ্ত ধন পেয়েছো নাকি?
–না তুমি আমার মেয়েকে পড়াইতেছো না, টাকা কেন নিবো বাবা
–খালা এটা কিন্তু বেশি বলে ফেললে আমি কি তোমাকে বলেছিলাম আমি টাকার জন্য রিধিতাকে পড়াইতেছি। আমার ছোট বোন থাকলে কি পড়াইতাম না। তুমি যদি টাকা না নাও তাও আজ রিধিতাকে নিষেধ করে দিও না আসতে।

–এটা তুমি বলতে পারলে
–পেরেছি, টাকা রান্না করতেছো টাকা নিবে না কেন? আর শোনো রিধিতার স্কুলে পরীক্ষার ফিস আমার থেকে নিয়ে যেতে বলো, তোমায় কষ্ট করে আর ওর টাকা দিতে হবে না।
–এগুলো কেন করতেছো বাবা
–আমার বোন থাকলে কি করতাম না

রহিমা খালা আঁচল দিয়ে চোখের পানি টা মুচে নিলো, রান্নায় মনোযোগ দিলো। রিধিতার বার্ষিক পরীক্ষা চলে আসে, সুন্দর মতো পরীক্ষা ও দিয়ে আসে। এর মাঝে বিয়ে করার জন্য আমি বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। বিয়ের পরে প্রায় পনের দিন পর ঢাকা আসি। সোহান কে ফোন করে বলে দিয়েছে সন্ধ্যায় বাসায় আসবো পরেরদিন সকালে ডিউটি আছে। রুলস অনুযায়ী ডিউটি থেকে দুপুরে বাসায় আসলাম। খালাকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছে। হুট করে রিধিতা দৌড়ে আসলো, হাত থেকে কাটুনের ক্যাপ খুলে একটা মিষ্টি মুখের সামনে ধরলো

–ভাইয়া মিষ্টি খাও
–আরে রিধিতা যে কেমন আছো? এগুলো কিসের মিষ্টি?
–ভাইয়া আমি পাস করেছি, তাই আম্মুকে বলে তোমার জন্য মিষ্টি নিয়ে আসছি।
–খালা এটা কেন করতে গেলে
–আমাদের মতো গরিবের সাধ্যে যা কুলায় তাই তো করি বাবা,

ওর রেজাল্ট শুনে এতো যে খুশি হয়েছি বলে বুঝাতে পারবো না। বাপে তো আমাদের বকলম রেখেছিলো, মেয়ের পড়াশোনার আগ্রহ দেখে না করিনি, রেজাল্টের পর আনন্দ অশ্রু কেমন হয় তা কখনো জানা ছিলো না। সংসারে এদিক সেদিক করতে হয়তো পেরে উঠিনা, তারপরও আমার স্বপ্ন, ও একদিন অনেক বড় হবে। দোয়া করো বাবা আমার মেয়েটার জন্য।

–অনেক দোয়া রইলো খালা, আর টেনশন করো না, আমি এখানে যতোদিন আছি রিধিতার পড়াশোনার খরচ আমিই দিবো। আর রিধিতা শোনো আজ বিকেলে আমার সাথে যাবে তোমার জন্য শপিং করবো।
–না ভাইয়া আমি যাবো না
–আম্মুর নিষেধ আছে নাকি
–(রিধিতা চুপ ০)
–খালা রিধিতাকে বিকেলে পাঠিয়ে দিও তো, সন্ধার আগে চলে আসবো।

খালা কিছু না বলে সম্মতি জ্ঞাপন করলো। এভাবে চারটি বছর কেঁটে যায়। রিধিতা বড় হয়েছে। জেএসসি এসএসসি দুটোতেই এপ্লাস পেয়েছে। রিধিতার এসএসসি পরীক্ষার পরই বদলি হয়ে চট্টগ্রাম চলে আসি।

যতোদিন ঢাকা ছিলাম রহিমা খালা রান্না করে দিতো। এদিকে ঢাকা যাওয়ার জন্য (নিশিতা আমার বৌ) অনেক কান্না করছিলো, ওকে ঢাকা নেওয়ার জন্য রাজি হতাম না। কারণ আমাদের রান্না করে রহিমা খালা যা পায় তা দিয়ে কোনমতে সংসার টা টেনে নিয়ে যেতো। যদি বৌ নিয়ে ঢাকা যেতাম রহিমা খালার আয়ের উৎস টা বন্ধ হয়ে যেতো।
যেদিন চট্টগ্রাম চলে আসবো সেদিন রহিমা খালা আর রিধিতা অনেক কান্না করেছিলো। এ কান্না আয়ের উৎস হারানোর নয়, এতো বছর কাছাকাছি থাকতে পরিবারের মতো একট মায়া তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। যা ছিন্ন করা খুব কষ্টের ছিলো। রিধিতাকে শুভ কামনা জানিয়ে চলে আসলাম। এভাবে কেঁটে গেলো সাতটা বছর। আমার ওয়াইফ নিশিতা প্রেগন্যান্ট হলো। আল্ট্রা করানোর জন্য চট্টগ্রামে একটা হাসপাতালে যাই। নিশিতাকে নিয়ে ভেতরে যেতে

–আরে ভাইয়া তুমি, কতো বছর পর দেখা তোমার সাথে
–সরি
–এই কে উনি (নিশিতা আমাকে উদ্দেশ্য করে)
–ভাইয়া আমি রিধিতা, আমাকে ছিনতে পারছো না?
–কোন রিধিতা
–তুমি আমাদের ভুলে গেলে ভাইয়া, ঢাকা থাকতে যাকে তুমি পড়িয়েছিলে
–ও তুমি রহিমা খালার মেয়ে, আসলে অনেক বছর হয়ে গেছে তো, ভুলে গিয়েছি, আর তুমিও অনেক পরিবর্তন হয়েছো, চশমা দেওয়াতে তাই ছিনতে পারিনি।

–আমি জানতাম তুমি ভুলে যাবে।
–রিধিতা এই হলো নিশিতা তোমার ভাবি
–তা তো দেখতে পাচ্ছি, শোনো আম্মু আছে এখানে, ভাবিকে নিয়ে আমাদের বাসায় দুপুরে লাঞ্চ করবে?
–আমাদের ফিরার তাড়া আছে, যেতে পারবো
–না আমি শুনবো না কোন কথা, আর আমরা এখানে এসেছি মাস ছয়েক হলো, আম্মু এখনো তোমার কথা বলে।
–আচ্ছা নিশিতা কে চেক করে দেখো
–তুমি ঘুরে আসো বাহির থেকে, আমি ভাবির সাথে কথা বলতেছি। সিগারেটের নেশা উঠেছে তাই বাহিরে চলে আসলাম। সিগারেট শেষ করে রিধিতার চেম্বারে আসলাম।

–ভাইয়া চলো আজ আর রোগী দেখবো না।
–তোর ভাবির কি অবস্থা
–ভাবি ভালো আছে, বাচ্চার অবস্থা ও ভালো চলো তো এখন।
–রোগী আসলে
–কাল আসতে বলে দিতে বলবো, এতো বছর পর তোমার সাথে দেখা, বাসায় চলো সারা বিকেল গল্প করবো।

আমরা তিনজন রিধিতার গাড়িতে উঠেছি, সেই ছোট্ট রিধিতা আর আজকের রিধিতার মধ্যে তফাৎ আকাশ পাতাল ব্যবধান। রিধিতা নিশিতাকে জড়িয়ে ধরে সেই জীবন সংগ্রামের একের পর এক সফলতার গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে। আমিও শ্রোতা হয়ে শুনতেছি রিধিতার গল্প। যে অধ্যবসায়ের মাধ্যমে রিধিতা আজ এই অবস্থানে। পরিশেষে পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত