আজ ইন্টার টেস্ট পরীক্ষা। আবার সবচেয়ে কঠিন বিষয়টাই আজকে! আমিও কম যাই না। সারা রাত না খেয়ে আর সারা দিন না ঘুমিয়ে ধুম পড়াশোনা করেছি। আমার গোল্ডেন ঠেকায় কে! তবে এইবার আব্বু ওয়ার্নিং দিয়ে দিছেন, দু সাবজেক্টের বেশি ফেইল করলে আর প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে কেঁদে কেঁদে রিকুয়েস্ট করতে পারবেন না। আব্বুরও নাকি প্রেস্টিজে লাগে! মনে মনে বলি, ফেইল করি আমি আর প্রেস্টিজ যায় আপনের! আব্বুকে আজ পর্যন্ত বুঝাতেই পারলাম না যে, ফেইল করাতে আমার কোনো ভুল নেই, সব আমার কপালের দোষ। MCQ তে অন্যরাও বৃত্ত ভরাট করে আমিও করি, উত্তর পত্রে অন্যরাও লিখে আমিও লিখি। পার্থক্য হল– ওদেরগুলো সঠিক হয়, আর কেনো যেন আমার গুলোই ভুল হয়! এটা কি আমার দোষ না কপালের? এই কথা কে আব্বুকে বুঝাবে? যে জীবনে ফেইল করে নাই, সে কীভাবে ফেইল করার মর্ম বুঝবে? যাইহোক! পরীক্ষার দিন এসব মনে করে মন খারাপ করতে চাই না। তারচেয়ে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করে ফেলি।
আমি– আসতে পারি ম্যাম? ম্যাম আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন– আবারো ফেইল করবি!
আর আমি শুনলাম– আবারো পিক তুলবি?
খুশি হয়ে বললাম– ইয়েস! ইয়েস! থ্যাংকু ম্যাম!
আমার কথা শুনে অন্যান্য পরীক্ষার্থীরা হেসে লুটিয়ে পড়ছে। দেখলাম, নীল রঙের কাপড় পড়া মেয়েটিও হাসছে। সবাই বলে আমি নাকি কানে উল্টাপাল্টা শুনি। আচ্ছা এই মাত্র যে ম্যাম আমার সাথে পিক তুলতে চাইলেন, এটা কি ভুল শুনেছি? যাইহোক! ম্যামের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি হলেন আমাদের ইংরেজি ম্যাম। খুব ভাল ইংরেজি পড়ান, কিন্তু আমি কিছুই বুঝি না। সবাই ভাল বলে, তাই আমিও ভাল বলি। তবে আজ পর্যন্ত আমাকে কোন প্রশ্ন করে আটকাতে পারেননি। প্রথম প্রথম যখন উনি ক্লাসে আসতেন, আমাকে জিজ্ঞেস করতেন– পার্ট অব স্পীচ কত প্রকার?
আমি– পাঁচ প্রকার। একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন– ‘নাউন’ কাকে বলে?
আমি– যেখানে দামী দামী দোকান পাট আর অসংখ্য গাড়ি থাকে, তাকে ‘টাউন’ বলে।
ম্যাম– ‘ইন্টার জেকশন’ কাকে বলে?
আমি– যেই শিনিস দ্বারা ডাক্তাররা রোগীদের শরীরে ঔষধ দিয়ে থাকেন, তাকে ‘ইঞ্জেকশন’ বলে।
তারপর ম্যাম বোর্ডে ‘Junior’ শব্দটা লিখে বললেন– শব্দটার উচ্চারণ কর। আমি ঠাস করে বললাম– ‘জানোয়ার’, এটা কী এমন কঠিন শব্দ? আমার উত্তরগুলো শুনে ম্যাম স্তব্ধ হয়ে যান। এরপর থেকে তিনি আর কোনোদিন আমাকে পড়া ধরেননি। সম্ভবত বুঝে গেছেন, আমি ভাল ইংরেজি পাড়ি। কিন্তু সেদিনও কেনো যে অন্য ছাত্র ছাত্রীরা হাসছিল, আজো বুঝলাম না। আসলে আমি এতো ভালো পাড়িতো, এটা তারা সহ্য করতে পারে না। প্রশ্ন দিয়ে দিয়েছে, আজ ইংরেজি পরীক্ষা। ইংরেজি আমার কাছে খুবই কঠিন হলেও পরীক্ষাটা অনেক সহজ লাগে। কারণ, প্রশ্নের যেখানেই তাকাই সেখানেই A B C D ইংরেজি বর্ণমালা। যেগুলোর সবই তো পাড়ি।
তবে আজকে আমার খুশিতে লাফাতে ইচ্ছে করছে। প্রশ্নে যা এসেছে সবই কমন! যেমন:- রচনা এসেছে “নিউজ প্যাপার”। আমি লিখবো– ” নিউজ পেপার ইজ দ্যা পেপার ফর দ্যা পেপার বাই দ্য পেপার।” নিউজ পেপারের সংজ্ঞাই যদি এতো সুন্দর পারি তাহলে পুরো রচনাটা কি পারবো না? না পাড়লে এই সংজ্ঞা দিয়েই দশ পৃষ্ঠা ভরে ফেলবো! প্রশ্নে দেখা যাচ্ছে শূন্যস্থানও এসেছে। একটা হলো– “মাই ফাদার এ্যা ডগ।” এটাও তো পারি। শূন্যস্থানে সুন্দর করে লিখে দিবো– মাই ফাদার “হেড” এ্যা ডগ। সবই তো পারি, এবার দেখবো আমার পাশ কেমনে ঠেকায়! সবাই আমাকে আত্মভোলা বলে ডাকে। কিন্তু আমার তো সবই মনে থাকে, পরীক্ষা না দিলে হয়ত বুঝতেই পারতাম না। আরে! আমার মোবাইল ফোনটা কাঁপছে কেনো? নিশ্চয় কেউ কল করেছে। ভেতরে কথা বলা যাবে না, বাহিরে যেতে হবে। ম্যামের অনুমতি নিয়ে বাহিরে আসলাম। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি আম্মুর কল। রিসিভ করতেই আম্মু বললেন– কী রে! তুই কোথায়?
আমি– কেনো আম্মু?
আম্মু– জলদি বাসায় আয়।
আমি– কেনো, কী হয়েছে?
আম্মু– তোর আব্বুর জ্বালায় হয়ত আর বাঁচবো না। তুই বাসায় চলে আয়।
নিশ্চয় আব্বু কোনো অঘটন ঘটিয়েছে! এখন আমার সমাধান করতে হবে। না জানি আব্বু কী করেছে! নানান প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এক দৌড়ে কলেজ থেকে বাসায় চলে এলাম। খুঁজতে খুঁজতে আম্মুকে পাওয়া গেল রান্না ঘরে। দেখলাম আম্মু গুরা মাছ কাটছেন। আমার কিছু বলার আগেই আম্মু কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন– দেখলি তোর বাপের কাণ্ড? রাতে একটু ঝগড়া করেছি বলে সকালে গুরা মাছ নিয়ে এসেছে। কী নীরব শাস্তি! এতো মাছ আমি কাটবো কেমনে? আমি আম্মুর সাথে মাছ কাটতে কাটতে বললাম– জানো আম্মু! আব্বুটা না এমনই। কোনো কিছু বুঝে না। দুনিয়ার মূর্খ! কেনো যে এই লোকটাকে বিয়ে করতে গেলে! আব্বু আজকে আসুক, আমি এই অনাচারের তীব্র নিন্দা জানাবো। কোনো ভয় পাবো না। দেখিয়ে দেবো, আমারো সাহস আছে!
এমন সময় আব্বু এসে হাজির। আমি আব্বুর বিপক্ষে ভাষণ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। তখন আব্বু এক রাশ বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে বললেন– কী রে বলদ! আজ না তোর পরীক্ষা! তুই বাসায় কী করছ? আমি যেন আসমান থেকে পড়লাম। চিন্তা করে দেখলাম, ঠিকই তো! আমার তো আজ ইংরেজি পরীক্ষা। তাহলে আমি বাসায় কীভাবে এলাম! দেখলাম আব্বু বিশাল ডান্ডা নিয়ে তেড়ে আসছেন। আর বলছেন– নবাবের ছেলে, পরীক্ষা না দিয়ে বাসায় কী করছ? আজ তোর একদিন কি আমার তিন বেলা। আব্বু দিলেন দৌড়ানি। তাড়া খেয়ে দৌড়ছি আর ভাবছি, আমি নবাবের ছেলে! তার মানে আব্বু নবাব! জানতামই না!