কাঠের ছাতি

কাঠের ছাতি

মুশলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। জামা কাপড় ভিজে একশা। ছিপছিপে ভেজা জামায় বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালো মাধবী। হাতের বই খাতাও ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। বারান্দায় ভেজা বইখাতা রেখে কামিজের নিচটা মুচড়ে কিছু পানি নিঙরে নিলো। মা আজ নির্ঘাত অনেক বকবে। সকালে আকাশে কালো মেঘ দেখে মা অনেক করে বলেছিলো কলেজে যাওয়ার সময় ছাতা নিয়ে যেতে। কিন্তু মাধবীর কাঠের ডাটির ছাতা নিয়ে কলেজে যেতে লজ্জা লাগে। সবাই কত সুন্দর সুন্দর ছাতা নিয়ে যায়।

ঘরে ঢুকে ভেজা কাপড় ছেড়ে গোসল করে বের হলো। আজ ওর বিশেষ একটা দিন। বইখাতা ভিজে যাওয়ায়ও ওর মনে কোনো দুঃখ হচ্ছে না। বার বার কোমরের কাছে হাত দিয়ে সেই স্পর্শটা অনুভব করতে চাইছে। আজই প্রথম ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছে মানবেন্দ্র। চুমু খাওয়ার সময় খামচে ধরেছিলো কোমর। অথচ মাধবীকে চুমুর কোনো অনুভূতি এখন আর আন্দোলিত করছে। ওর সারা শরীরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে কোমর খামচে ধরার অনুভূতি।

বাবা ডাকপিয়নের চাকরি করেন। ছেলেমেয়েদের অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করাচ্ছেন। উনি চান না নিজের মতো ছেলেমেয়েদের ভাগ্যটা খারাপ হোক। ভাগ্যের চাকা ঘুরাবার জন্য এক ডাকপিয়ন জীবন সংগ্রামটা চালিয়ে যাচ্ছেন খুব নিরবে। খুব ধীরে। রাতে ভাত খাওয়ার পরে মেয়েকে ডাক দিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘তুই বলে আইজকা কলেজ থেইক্যা ভিজা ভিজা আইছোস। বই খাতা ভিজাই ফেলাইছোস। এখন তোর বই লাগলে আমি তো কিনা দিতে পারুম না। ছাতি নিয়া গেলি না ক্যান?’ ‘ঐ ছাতি নিয়া যাইতে আমার লজ্জা লাগে বাবা।’ ‘তুই যে ডাকপিয়নের মাইয়্যা এইডা কইতেও কি তোর লজ্জা লাগে মানুষের কাছে?’

মাধবী চুপ করে থাকে। ওর আসলেও লজ্জা লাগে। নতুন কারো সাথে পরিচয় হলে মিথ্যা বলে। পোস্টমাস্টার বলে বা অন্য কিছু। কিন্তু ডাকপিয়ন বলতে ওর লজ্জা লাগে। মাধবীর বাবা ওর কাছে এসে হাত ধরে বারান্দায় নিলে এলেন। একটা মোড়ায় বসতে বলবো মাধবীকে। উনি দাঁড়িয়ে থাকলেন। বাইরে তখনো একটানা বৃষ্টি পড়ছে। হালকা বাতাসে বৃষ্টির ছাঁট আসছে। একটু পর পর আকাশ উজ্জ্বল করে দিয়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই বিদ্যুৎ চমকে ডাকপিয়ন সাহেবের কপালে স্পষ্ট ফুটে উঠছে অসহায়ত্ব।

মাধবীর মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘দেখ মা! আমি গরীব মানুষ। তোগোরে ঠিক মতো চালাইতে পারি না। ভালো কাপড় চোপড় দিতে পারি না। তুই কলেজে যাবি তার জন্য একটা ব্যাগও কিনা দিতে পারি না। একটা নতুন ছাতা কিনা দিতে পারি না। একটা ছাতির আর কয়টাকা দাম। কিন্তু ঐটাকা খরচ করার সামর্থ্য আমার নাই রে মা।’

‘বাবা আমার ছাতা লাগবো না।’ ‘এইডা তোর রাগের কথা মা। আমারো খারাপ লাগে তোগোরে ঠিক মতো কিছু দিতে না পারলে। তোগো চাইতেও বেশি খারাপ লাগে। তোরা হয়তো ভাবোস, কেমন বাবার ঘরে জন্মাইলাম কোনো শখ আহ্লাদ পূরণ করতে পারে না। ঠিক মতো চালাইতে পারে না। আমার পেশা নিয়াও তোরা লজ্জা পাইস মানুষের কাছে কইতে।’ ‘না বাবা এমন কিছু না।’

‘মা তোরে একটা কথা কওয়ার জন্য বাইরে নিয়া আইছি। তুই আমার বড় মাইয়্যা। আমার মা তুই। তোর আরো তিনটা ছোট ভাই বোইন আছে। ওগোরে দেইখা রাখার দায়িত্বও তোর। তোগোরে পড়ালেখা বানাইয়া শিক্ষিত বানাইতে চাইতাছি যেন আমার মতো তোগো জীবন না হয়। তোগো পেশা নিয়া যেন তোগো পোলা মাইয়্যারা লজ্জা না পায়। যেন গর্ব কইতে পারে। আমি মূর্খ মানুষ। পড়ালেখা তেমন নাই বইলা ভালো চাকরি পাই নাই। কিন্তু মা, আমি অতো মূর্খ না যে যত মূর্খ হইলে পোলা মাইয়্যারে পড়ালেখা করানো যায় না। মানুষ হয়তো মূর্খ হইতে পারে। কিন্তু বাবা মা কখনো মূর্খ হয় না।

আমাগো কিন্তু তোগোরে জন্ম দিতে। তোগোরে হাত ধইরা দাড় করাইতে অতো শিক্ষিত হওয়া লাগে নাই৷ কোনো বাবা মায়েরই লাগে না। তুই পড়ালেখা শিখতাছিস। খালি মুখস্ত কইরা পরীক্ষার খাতায় লেইখা দিয়া ভালো পাশ করলেই শিক্ষিত হওয়া যায় না মা। বাবার পেশারে যেদিন সম্মান করতে পারবি সেদিনই শিক্ষিত হইতে পারবি। বাবার পেশা যত ছোট হোক সেইটা কইতে যেদিন লজ্জা পাইবি না সেইদিনই মানুষ হইতে পারবি। পড়ালেখা কইরা শিক্ষিত না মানুষ হওয়ার চেষ্টা কর। নিজেরে সম্মান করতে শিখ। তাইলে মানুষরে সম্মান করতে পারবি। দুনিয়ার কাছেও সম্মান পাবি। এই দুনিয়ায় তোরা চাইর ভাইবোইন ছাড়া আমাগো আর কোনো জোর নাই। আমাগো বুকের সাহস তোরা। মানুষ হ মা। তোরা আমাগো খুটি। আমাগোরে হাইরা হাইতে দিস না মা।’

কথা গুলো বলে উনি চলে গেলেন। মাধবী নিশ্চুপ বসে আছে বারান্দায়। বিদুৎ চমকের সাথে সাথে ওর বুকেও কেমন যেন চমকে চমকে উঠছে বাবার কথা গুলো। এতো সাধারণ বাবাটা কি বলে গেলো ওকে। নিজের প্রতি লজ্জা হচ্ছে এখন। বাবা ওদের জন্য এতো কষ্ট করছেন। আর ও কিনা বাবার পেশা নিয়ে লজ্জা পায়। কলেজ ফাঁকি দিয়ে প্রেম করছে। মনে মনে ঠিক করলো মাধবী; আগামীকাল কলেজে গিয়ে মানবেন্দ্রকে বলবে- মাধবী ওকে ভালবাসে। ওকেই ভালবাসবে। কিন্তু প্রেম করে পড়ালেখার ক্ষতি করতে পারবে না। এই সময়টা ওকেও ওর বাবার সাথে স্ট্রাগল করতে হবে। প্রেম ভালবাসা জীবনে আসবেই। কিন্তু সেটা যদি জীবন গড়ায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তাহলে সেই ভালবাসা জীবনকে পথে নামিয়ে ছাড়বে। মাধবী জীবনকে ছাড়তে পারবে না। ভালবাসাকেও ছাড়তে পারবে না। ও শুধু দুইটার মাঝে একটা সামঞ্জস্য রাখতে চায়। তার জন্য মানবেন্দ্রর সাহায্য ওর এখন খুব করে প্রয়োজন। মানুষ খারাপ সময়ে ভালবাসার মানুষকেই পাশে পেতে চায়।

সকালে ঘুম ভাঙ্গলো অনেক জোরে বজ্রপাতের শব্দে। উঠে হাত মুখে ধুয়ে কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো মাধবী৷ ওর ভাইবোনরাও উঠে গেছে। ওর বাবা তখনও ঘুমে। কিছু খাবার মুখে দিয়েই মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কাঠের ডাটির ছাতাটা নিয়ে কলেজের দিকে পা বাড়ালো। মাধবীর আজ সব অন্যরকম লাগছে। কেমন যেন প্রাণবন্ত লাগছে সব। বাবার কাল রাতের কথা গুলো এতোটাই সাহস দিচ্ছে ওর বুকে, যেন কোনো বাধাই ওর কাছে আর বাধা নয়। সব বাধা ও ছিন্ন করে এগিয়ে যেতে পারবে। মাধবী মনে মনে বলেই যাচ্ছে। আমি আমার বাবার মেয়ে। ডাকপিয়ন বাবার মেয়ে আমি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত