অর্থীর নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার সামনে সুমিত দাঁড়িয়ে। খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। মুখে শয়তানি হাসি। সুমিত অর্থীর দিকে এক পা এগিয়ে আসল। ভয়ে অর্থীর হাত-পা জমে যাচ্ছে। বিছানা থেকে এক ফোটাও নড়তে পারছে না। তার এখন ইচ্ছা করছে তার সামনে থাকা ছেলেটাকে কয়েকটা থাপ্পড় দিতে। অর্থী বালিশ শক্ত করে ধরে বসল। সুমিত ঝাপ দিয়ে বিছানায় উঠে পড়ল। বাঘের মত খামচে ধরল অর্থীকে।
অর্থী একটু অস্ফুষ্ট শব্দ করে উঠে বসল। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বাম পাশের টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিল। টেবিল থেকে বোতলটা নিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিল। কিছুদিন থেকে অর্থী এমন ভয়ানক স্বপ্ন দেখছে। প্রতিটা স্বপ্নে সুমিত থাকে। তীব্র ঘৃণা থেকে এমনটা হচ্ছে বলে অর্থীর ধারণা। সুমিত অর্থীর বড় ভাইয়ের বন্ধু। তারা দুজন একসাথে স্কুল শেষ করেছে,বাসা কাছাকাছি হওয়ায় দুজনের আসাযাওয়া হয় প্রতিদিনই। হালকা শীত লাগছে অর্থীর। পানির বোতল’টা টেবিলে রেখে লাইট অফ না করেই শুয়ে পড়ল। সে যানে আজ রাতে তার ঘুম হবেনা আর। পাশের ঘর থেকে অভীর গোঙানির শব্দ আসছে। অর্থীর অসহ্য লাগছে। ইদানীং প্রায় সবকিছুই তারকাছে অসহ্য লাগছে,সবকিছুতেই যেন সুমিতের ছায়া লেগে আছে।
কনক সাহেবের ঘুম সকাল সকাল ভেঙে যায়। ঘুম থেকে উঠেই তার এক কাপ চা লাগে। চা করার মত মানুষ এ বাড়িতে একজনই আছে,সে– অর্থী। অভী ভালো চা করতে পারত। হোস্টেলে যখন থাকত তখন শিখেছে। রাত দুটা পর্যন্ত জেগে গল্পের বই পড়ত,ঘুম এড়ানোর জন্য চা রোগ বাধিয়ে ফেলেছিল। দিনে প্রায় বিশ কাপ চা তার লাগতোই। অভীকে চায়ের জন্য বলা যাবেনা। তিন মাস থেকে সে বিছানায় পড়া। বাস এক্সিডেন্টে পা এমন ভাবে ভেঙেছে যে ডাক্তাররাও অবাক হয়ে গেছে। কারো পায়ে এতো যায়গায় ভাঙতে দেখেনি তারা কোনদিন। পায়ের অবস্থা দেখে প্রথমেই তারা বলে দিয়েছে অভী আর কোনদিন হাঁটতে পারবেনা। তবে অবস্থা ভালোর দিকে এগোচ্ছে বলে সুমিতের ধারণা। অভী এখন পায়ের তিনটা আঙুল নাড়াতে পারে।
চায়ের জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলোনা কনক সাহেবের। ইজিচেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে খবরের কাগজ মুখের সামনে রেখে কিছুক্ষণ বসে থাকার পরই অর্থী চা নিয়ে এলো। তার চোখ ফোলা। চোখের নিচে কালি পড়েছে। যাদের চোখ হালকা নীলচে হয় তাদের চোখের নিচে কালি পড়লে সুন্দর লাগে অনেক। অর্থীর চোখ হালকা নীলচে। তাকে অনেক সুন্দর লাগছে এভাবে। কনক সাহেব লজ্জায় পড়ে গেলেন হঠাৎ। নিজের মেয়েকে নিয়ে এসব কি ভাবছেন তিনি। খবরের কাগজ ভাজ করে কোলে রেখে চায়ের কাপ হাতে নিলেন কনক সাহেব। অর্থী বলল, আর কিছু লাগবে বাবা? নারে মা আর কিছু লাগবেনা। আচ্ছা। অভীকে ডেকে দে তো। ও বোধহয় এখনো ঘুমাচ্ছে। আমার শার্টের পকেটে দেখ দশ টাকার নোট আছে একটা। সিফাতকে পাঠিয়ে ব্লেট আনতে বল তো দুটো। বাগানের গাছ গুলোর কলম করি। আচ্ছা আমি বলছি।
আর শোন,সুমিত আসলে ওকে বলিস বাগান থেকে লাল গোলাপের একটা গাছ যেন নিয়ে যায়। অর্থী কিছু না বলে চলে গেল। সুমিত নাম টা শুনলেই তার কেমন যেন লাগে। অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে যায় সে। ট্রে তে করে দুই কাপ চা নিয়ে অভীর ঘরের দিকে গেল অর্থী। একটা কাপে দুধ চা,অন্যটায় আদা চা। অভী আদা চা পছন্দ করে। অভীর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অর্থী বলল, অদ্ভুত তো! সকাল সকাল এসেছেন বিরক্ত করতে। সুমিত অর্থীর দিকে তাকালো। মুখে হালকা হাসি নিয়ে বলল, হ্যাঁ কাজ ছিল একটু। দে চা দে আমার। আমি আবার দুধ চা ছাড়া খেতে পারিনা জানিসই তো। দুধ চা এনেছিস তো! দেখেন আমি আগেও বলেছি আবারও বলছি। আপনার মুখ দেখতেও আমার ভালো লাগেনা। এ বাড়িতে আসবেন ভালো কথা। সকাল সকাল এসে বসে থাকবেন না। সম্পূর্ণ দিন নষ্ট হয়ে যায় আমার।
আচ্ছা আর আসবো না। দে এখন আমার চা দে। অর্থী ট্রে টেবিলে নামিয়ে রেখে চলে গেল। দোতলায় ওঠবার আগেই তার মনে পড়ল বাবা সুমিতকে গোলাপ গাছ নিতে বলেছিলেন। অর্থী একটু দ্রুত এগিয়ে গেল অভীর ঘরের দিকে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সুমিতের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা আপনাকে বাগান থেকে গোলাপ গাছ নিতে বলেছে। বাবা বাগানেই আছে,দেখা করে যাবেন। আর এটা কি পড়েছেন। রঙ নষ্ট হয়ে গেছে শার্টের,তবুও এটাই পড়তে হবে? এ বাড়িতে আসতে হলে ভালো জামাকাপড় পড়ে আসবেন।
অর্থী চলে যাওয়ার সময় খেয়াল করল সুমিত আর অভী বেশ জোর গলায় হাসছে। হাসির কারণটা কি সে নিজে? অর্থী ভ্রু কুচকে ফেলল। ধির পায়ে সে নিজের ঘরের দিকে এগোতে লাগল। বাসায় গিয়ে সুমিত সোজা নিজের ঘরে চলে গেল। ছাদের সিঁড়ির পাশে ছোট ইটের দেয়ালের ঘর। সময়ের আর অর্থের সল্পতায় প্লাস্টার করা হয়ে উঠেনি। জং ধরা টিনের চাল। বৃষ্টি হলে ঝমঝম শব্দ হয়। কয়েক জায়গায় ফুঁটো আছে,সারানো দরকার। ঘরের মাঝখানে দামি খাট। খাটটা এই ঘরের সাথে মানানোর কথা ছিল না। কিন্তু কোনভাবে মানিয়ে গেছে। খাটের পেছনে একটু ফাকা যায়গা আছে। জায়গাটা কাজে লেগেছে। ছোট ভাইয়ের কেরাম সেখানে যত্ন করে রেখে দেওয়া হয়েছে।
তবে সুমিতের ধারণা সেটা এখন ঘুণের পাওডার হয়ে গেছে। মেয়েদের মেকাপ আর ঘুণের গুড়ার মাঝে পার্থক্য খুব কম। একটু সুগন্ধি মিশিয়ে বাজারে ছেড়ে দেওয়া যাবে। প্রচার হবে “ঘুণের গুড়ার মেকাপ” নামে। ঘরের বাকি জিনিসগুলো কখনো তেমন ব্যাবহার হয়নি। গিটারটা শুধু প্রতিদিন হাতের ছোঁয়া পায়।
ঘরে ঢুকে জানালার কাছে একটা কাঠের তক্তা লাগালো সুমিত। ভালো করে দেখে নিল শক্ত হয়েছে কিনা। যাচাই বাছাই শেষে গোলাপ গাছের টবটা সেখানে রেখে দিল। সুমিত ভাবছে অন্য কিছু গাছ এনে এখানে রেখে দিলে ভালো হয়। ‘ফুলের গন্ধে,স্নিগ্ধতা ছেয়ে যাবে রন্ধে রন্ধে’ দুপুরে খাবারের পর সুজিত সাহেব সুমিতের ঘরে আসলেন। ঘরের অবস্থা দেখে আশাহত দৃষ্টিতে সুমিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি অবস্থা করেছিস? সুমিত গায়ের উপর থেকে কাথা সরিয়ে বলল, ঠিক করে ফেলব। কিছু বলবে বাবা? না তেমন কিছুনা। ও ডাক্তার কি ভুল বলেছিল রে? কোন ব্যাপারে?
তোর কাছে আর ছয় মাসে আছে বলেছিল। ছয় মাসের বেশি হয়ে গেছে। ডাক্তার দেখানো দরকার না আবার? চিন্তা হয় রে তোর জন্য। কিভাবে কি হয়ে গেল! কিছু হয়নি। হয়তো ক্যান্সার সেরে গেছে। কত অদ্ভুত জিনিস হচ্ছে আশেপাশে। এটা আর এমন কি। তবুও কাল দেখিয়ে আসি ডাক্তারকে,চল। যাবি? আচ্ছা যাবো। সন্ধ্যায় একটু বসার ঘরে আসিস। সুজিত সাহেব চলে গেলেন। সুমিত আবার ব্যস্ত হয়ে গেল চুপচাপ বসে থাকতে। জিনিসটা সে কিছুদিন আগেই শিখেছে। চুপচাপ ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। এসময় অদ্ভুত সব চিন্তা মাথায় আসে,সেগুলো যদি বাস্তব হতো তাহলে তার পক্ষে ভালো হতো।
বিকেলের দিকে সুমিত ছাদে এসে বসল। পা ঝুলিয়ে দিয়ে ছাদের কিনারে এসে বসল। হাতে গিটার। সুমিত গিটারে হাত রাখল। টুং টাং করে সুর তুলতে লাগল। অর্থী টেবিলে বসে আছে। মন দিয়ে চিঠি লিখছে সে। চিঠিটা সুমিতকে নিয়ে। অর্থী প্রায় প্রতিদিনই এমন চিঠি লেখে,কিন্তু সুমিতকে দিতে পারেনা। এমন না যে চিঠিতেও সে রাগ দেখিয়ে কিছু লেখে। চিঠিতে গোপন ভাবে রাগ দেখিয়ে ভালোবাসাময় লেখা অর্থী লিখতে পারেনা। একবার লেখার চেষ্টা করেছিল। পরে সে চিঠি পড়ে সে নিজেই রেগে যায়। এমন খারাপ কথা লেখা ঠিক না। ছেলেটা ভালো। অনেকটাই ভালো। অর্থী আজকের চিঠিতে লিখছে–
অপ্রিয় সুমিত ভাইয়া, আমি আগেও বলেছিলাম আপনাকে– ভালো দেখে একটা শার্ট পড়ে এখানে আসতে। আপনি ওই ময়লা,ছেড়া শার্ট পড়েই আসেন প্রতিবার। জানেন আমি আপনার সাথে খারাপ ব্যাবহার করতে চাই না। কিন্তু কেন যে বারবার ওইভাবে কথা বলি জানিনা। আগে প্রতিদিন আপনাকে স্বপ্নে দেখতাম,স্বপ্নে যা দেখতাম তা আপনাকে বলতাম মাঝে মাঝে। এখনো আপনাকে স্বপ্নে দেখি। কিন্তু সেগুলো আপনাকে বলব না। স্বপ্ন গুলো খারাপ। আপনি স্বপ্ন গুলোর মত না।
মনে আছে একদিন আপনার সাথে ধাক্কা লেগেছিল আমার? না একদিন না,ভুল বললাম। অনেকবার লেগেছিল। কিন্তু শেষ যেদিন ধাক্কা লাগে আপনি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর বোকাবোকা মুখ করে বললেন, কিরে বুচি! তোর তো বিরাট শক্তি। ধাক্কা খেয়ে পড়েই গিয়েছিলাম। অভী কই রে? আপনি কি শুধু অভীর জন্য এই বাড়িতে আসেন? আমার জন্য না? আমি খুব বেশিই খারাপ ব্যাবহার করি আমি জানি। কিন্তু আমার দোষ নেই। আমি প্রতিদিনই ভাবি..
এইটুকু লিখে অর্থী থেমে গেল। চিঠিটা একবার পড়ে নিল। কোন বানান ভুল আছে নাকি দেখে নিল ভালো করে। চা হয়ে গেছে। টুটু করে শব্দ হচ্ছে। কনক সাহেব জিনিসটা নতুন এনেছে। চা পাতি,জল,চিনি,দুধ সবকিছু দিয়ে প্লাগ লাগিয়ে সুইচ টিপে দিলেই কাজ শেষ! চা হয়ে গেলে টুটু করে শব্দ করে। তবে চা খেতে ভালো হয় না। একেক সময় একেক ধরণের স্বাদ পাওয়া যায়। তিনি মনে মনে বলেন– টাকা গুলো চায়ে গেল! অর্থী চিঠিটা ছিঁড়ে বেলকনি দিয়ে বাইরে ফেলে দিল। তাড়াতাড়ি করে চা আনতে গেল। বেশি দেড়ি করলে চা ভালো লাগেনা একদমই
রাতের দিকে সুমিতের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। বাসার সবাই ধরাধরি করে হসপিটালে নিয়ে গেল। বাসার অনেকে জানেই না কি হয়েছে। ব্যাপার টা শুধু সুমিতের বাবা আর মায়ের মধ্যেই আটকে আছে। আর কেও জানেনা।
সুমিতের অবস্থা দেখে সবার মুখ ফেকাসে হয়ে গেল। চোখ মুখ উলটে আসছে তার। মুখ কেমন যেন নীল বর্ণ ধারণ করেছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বুক ভরে শ্বাস নিচ্চে,তাতেও যেন হচ্ছেনা। ডাক্তাররা সবাইকে বাইরে যেতে বলল। এমন ভিড়ের মাঝে কিভাবে কি হবে!
সুমিত নার্সকে ডেকে অনেক কষ্টে টেনে টেনে বলল, একটা কলম আর কাগজ দিতে পারবেন? নার্স হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। এমন অবস্থায় কেও খাতা-কলম চাইবে নাকি। নার্স একটা পেট আর কলম দিয়ে অক্সিজেনের ব্যাবস্থা করল। সুমিত অনেক কষ্টে কয়েক লাইন লিখল– ‘অর্থী! মাফ করে দিস। তোকে হয়ত অনেক জালিয়েছি। তোকে না দেখলে ভালো লাগত না আমার। তাই প্রতিদিন কয়েকবার করে চলে যেতাম। আমি তোকে কতটুক ভালোবাসি তা যদি তোকে নিজের মুখে বলতে পারতাম তাহলে ভালো হতো। ভালো থাকিস। আমার গোলাপ গাছটার যত্ন নিস একটু।’
কিছুক্ষণ পর সুমিতের অবস্থা একটু ভালো হলো। দেখা করার জন্য তার বাবা-মা কে ভেতরে যেতে দিলেন। ডাক্তাররা জানেন এই রোগী আর বাঁচবেনা। মৃত্যুপথযাত্রীকে একটু ছাড় দিতে হয়,তাই তারা সবার সাথে একটু ভালো ব্যাবহার করার চেষ্টা করছে। সুমিতের অবস্থা অভীকে জানানো হয়। তখন রাত এগারোটা বাজে। কনক সাহেব ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে তাকে ডেকেও লাভ নেই। অভী যেতে পারবেনা। অর্থী জানতে পেরে যেভাবে ছিল ওইভাবেই ছুটে গেলো হসপিটালে। সুমিত সবাইকে বাইরে চলে যেতে বলল। তখন ভেতরে অর্থী ঢুকলো। অর্থীকে নিয়ে সবাই বাইরে চলে যাচ্ছিল। সুমিত আটকে দিল অর্থীকে। কেও কোন কথা না বলে বাইরে চলে গেল।
অর্থী সুমিতের পাশে বসে আছে। তার চোখে কালি পড়েছে। চোখে জল টলমল করছে। সুমিত অর্থীর হাত শক্ত করে ধরে একটা মুচকি হাসি দিল। এই হাসির মানে কি তা সে নিজেও জানেনা। সুমিত বুঝতে পারছে আর কিছুক্ষণ আছে তার কাছে। তার এক হাতে অর্থীকে নিয়ে লেখা চিরকুট। অন্য হাতে অর্থীর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। সুমিতের খুব করে বলতে ইচ্ছা করছে– বুচি! তোর চোখ অনেক সুন্দর রে। চোখের নিচে কালি পড়লে এতো সুন্দর লাগে জানতাম না। সুমিত বলতে পারলোনা। কোন এক অদৃশ্য জিনিস টাকে আটকে দিল।