বাবা

বাবা

স্বপ্নার লাল রং খুব পছন্দ। লাল রংয়ের জামদানি শাড়ি দেখলেই কিনে ফেলতে ইচ্ছা করে। যদিও এ পর্যন্ত একটাও কেনা হয়ে ওঠেনি। কারণটা অর্থনৈতিক। এতটা সামর্থ্য ওর বাবার নেই। তাছাড়া স্বপ্নার তো এখনো বিয়েও হয়নি খামাখা লাল শাড়ি দিয়ে কি হবে? অন্য সব মেয়েদের‌ই মায়ের দুয়েকটা লাল শাড়ি থাকে। স্বপ্নার তাও নেই। ওর মৃতা মায়ের কোন বিয়ের শাড়ি ছিল না। তাদের বিয়েটা হুট করেই হয়ে গিয়েছিলো। সেই কাহিনী বলা যেতে পারে,

স্বপ্নার মা প্রচন্ড রকমের সুন্দরী‌ ছিলেন। তাদের গ্রামে ওর মায়ের চেয়ে বেশী সুন্দরী আর কেউ ছিল না। এক বন্ধুর নানাবাড়ি বেড়াতে আসার সুবাদে স্বপ্নার বাবা মোত্তালিব চৌধুরী সেই গ্রামে আসেন। তিনদিন গ্রামে কাটিয়ে ফিরে যাবার দিন ভ্যানে উঠে সবেমাত্র যাত্রা শুরু করেছেন এমন সময় স্বপ্নার মাকে তিনি দেখতে পান। পুকুর থেকে কলসি কাঁখে পানি নিয়ে আসছে।

মোত্তালিব সাহেব সেখানেই ভ্যান থামিয়ে নেমে পড়েন। মেয়েটার পেছন পেছন তার বাড়িতে যান। এর ঠিক সাড়ে চার ঘণ্টার মাথায় কাজী ডেকে তাদের বিয়ে হয়ে যায়। সেই সময়ে স্বপ্নার বাবা ভালো চাকরি করতেন। যুদ্ধের সময় চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে পালিয়ে আসেন। এরপর যুদ্ধ শেষে হাজার চেষ্টা করেও নতুন আর কোনো চাকরী জোগাড় করতে পারেননি।

ততদিনে স্বপ্নার জন্ম হয়েছে। স্বপ্নাকে জন্ম দিতে গিয়েই তার মা মারা গিয়েছে। গ্রামের কিছু জমিজমা আর একটা মুদির দোকান সম্বল করে ওর বাবা স্বপ্নাকে নিয়ে কোনোমতে দিনাতিপাত করছেন। স্বপ্নার কলেজে ভর্তির সময়ে অনেকখানি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পুরোটা জায়গা জমি বিক্রি করে দেন ওর বাবা। এ ছাড়া আর উপায় ছিল না। ওর বাবার আশা ছিল স্বপ্না একদিন অনেক বড় হবে। সেদিন আর ওদের কোন দুঃখকষ্ট থাকবে না।

শহরে একটা দুই রুমের টিনের ঘর ভাড়া করে স্বপ্নাদের জীবন কাটতে থাকে। পড়াশোনার পাশাপাশি প্রাইভেট টিউশনি করে কোনোমতে দিন কাটায় স্বপ্না। ভালো রেজাল্টের সুবাদে অনার্স শেষ করতেই একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরিও পেয়ে যায়। এরমধ্যে লাল শাড়ি পরার স্বপ্ন বা বিয়ের স্বপ্ন কোনোটাই দেখা ওর পক্ষে সম্ভব না। ওর বাবার যে ও ছাড়া কেউ নেই!

সারাদিন স্কুল ও প্রাইভেট টিউশনি শেষ করে স্বপ্না যখন বাসায় আসে ওর বাবা ভাত ঘরদোর গুছিয়ে ভাত চড়িয়ে ওর জন্য বসে থাকে। স্বপ্না টিউশন শেষে বাজার থেকে কোনো এক পদের তরকারী কিনে নিয়ে এসে রান্না করে। ভাত খেতে খেতে বাবা-মেয়ে খানিকক্ষণ গল্প করে। সারাদিনে স্বপ্না কি কি করলো মোত্তালিব সাহেব আগ্রহ করে শোনেন,

-আমার যে ফাইভে পড়া স্টুডেন্টটা আছে না বাবা? তানিশা! ও যে এত দুষ্টু হয়েছে কি বলবো!পড়াতে গিয়ে কখনো একবারে ওকে টেবিলে পাবো না। কখনো খাটের তলে তো কখনো আলমারির মধ্যে। আর বাংলা বানান একটাও ঠিক করে লিখতে জানে না। শুধু বানান ভুল করে।

মোত্তালিব সাহেব হাসেন। বলেন, সবাই কি আর তোর মতো হয়? তুইতো ছোটবেলা থেকে নিজে থেকেই সন্ধ্যা হলে ব‌ই নিয়ে বসে যেতিস। পড়া শেষ না করে খেতে ডাকলেও খেতিস না। স্বপ্না মৃদু হেসে বলে, আমি কি আর ওদের মতো আহ্লাদে মানুষ বাবা! আমি পড়াশোনা না করলে আমাদের চলবে কিভাবে! আমিই তো তোমার একমাত্র আশা। মোত্তালিব সাহেব মলিন মুখে হাসেন। স্বপ্নার জন্য প্রায়ই এটা সেটা সম্বন্ধ আসে। তিনি সরাসরি তাদের না করে দেন। স্বপ্নাকে জানান না।

হ্যাঁ, এটা অন্যায়। কিন্তু তিনিই বা কি করবেন। মেয়েটা ছাড়া তার তো আর কোনো আশা নেই। স্বপ্না তার মায়ের মতো সুন্দরী হয়েছে। প্রস্তাব আসা তো আটকানো‌ যাবে না। একসময় হয়তো আর না করতেও পারবেন না। কিন্তু তিনি কখনো ভাবতেও পারেন না স্বপ্না চলে গেলে তার কি হবে।

পরদিন সকালে আবার ক্লাস আছে স্বপ্নার। সে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু মোত্তালিব সাহেবের ঘুম আসে না। তিনি মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থাকেন। একধরনের অপরাধবোধ মাঝেমাঝে তাকে ছেঁকে ধরে। স্বপ্নার বিয়ে তিনি হতে দিচ্ছেন না। এটা অন্যায়,বড় ধরনের অন্যায়।

ঠিক এক‌ই সময়ে নিউইয়র্কের রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়ায় এক তরুণ। মোত্তালিব সাহেবের মতো সেও স্বপ্নার কথা ভাবে। স্বপ্নার সাথে ওর পরিচয় কলেজে পড়ার সময়ে।‌ সেই সময় স্বপ্না ওর ভালোবাসার প্রস্তাব কঠিনভাবে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলো, আমি তোমাদের মতো না। আমার জীবন‌ও তোমাদের মতো না। আমার কাঁধে আমার বাবার দায়িত্ব।

যাকের তবুও স্বপ্নাকে ভুলতে পারে না। বাংলাদেশের বন্ধুদের দিয়ে বারবার খোঁজ নেয়ায় স্বপ্নার বিয়ে হয়েছে কি না। যখন শোনে, এখনো বিয়ে হয়নি ওর হৃদয়ে একটা আশা দোলা দিয়ে যায় যে হয়তো সৃষ্টিকর্তা স্বপ্নাকে ওর জন্য‌ই লিখে রেখেছেন। যাকের এখন নিউইয়র্কে ভালো চাকরি করে, অনেক ইনকাম করে। “একবার স্বপ্নার বাবাকে প্রস্তাব দিয়ে দেখলে কেমন হয়?” এসব ভাবনা যাকেরকেও ঘুমাতে দেয় না। মোত্তালিব সাহেবের মতো সেও স্বপ্নার কথা ভেবে ভেবে রাত জাগে।

আজ শুক্রবার। স্বপ্না সকাল থেকেই ঘরদোর পরিস্কার করছে,ঝুল ঝাড়ু দিয়ে বারান্দার মাকড়সার জাল পরিস্কার করছে এমন সময় কলিংবেল বাজল। কোমর থেকে শাড়ির গিঁট খুলে স্বপ্না গেট খুলে হতবাক হয়ে গেল। যাকের দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে অল্প হাসলো। স্বপ্না অবাক হয়ে বললো, তুমি! যাকের আবার মাথা নিচু করে হাসলো।

স্বপ্নার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে যাকের। এটা শুনে স্বপ্না এবার আর আগের মতো কঠিনভাবে না বলে দিতে পারলো না। এতদিন এতকিছুর পরেও যাকের ওকে মনে রেখেছে এটাই ওকে মুগ্ধ করছে বারবার। যাকেরের চোখেমুখে এখনো সেই কলেজে পড়া সময়ের মতোই মুগ্ধতা। বিদেশ গিয়েও ভালোবাসা ফিকে হয়নি তার।

এদিকে মোত্তালিব সাহেবের কথা কি আর বলবো! তিনি আড়চোখে স্বপ্নার দিকে তাকিয়ে যাকেরকে বললেন, স্বপ্না রাজি থাকলে আমার আপত্তি কিসে? এর আগের যতো প্রস্তাব তিনি মানা করে দিয়েছেন সব স্বপ্নার আড়ালে। আজকে তো ওর সামনে এই ছেলেকে কিছু বলতেও পারছেন না। তাছাড়া যতদূর মনে হচ্ছে স্বপ্নার‌ও এই ছেলেকে খুব অপছন্দ না।

দুপুরে বিরিয়ানি রান্না হলো। যাকের ওদের সাথে ভাত খেল। চা খেল। স্বপ্নার বাবার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করলো। অনেক বয়স হয়ে গেছে কিন্তু মোত্তালিব সাহেবের কোনো রোগবালাই নেই এটা নিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করলো। এই বয়সে যাকেরের বাবার কতরকম অসুখ ছিল সেটা নিয়েও অনেকক্ষণ কথা বললো। তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে জানালো যে, সে দেশে এসেছে শুধুমাত্র স্বপ্নার জন্য। ওর যদি অমত না থাকে বিয়েটা করেই চলে যাবে। স্বপ্না এখানেই থাকবে। যাকের ওদেশে গিয়ে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে পার্মানেন্টলি এদেশে চলে আসবে। আফটার অল, স্বপ্না ছাড়া যে ওর বাবার কেউ নেই তা যাকের জানে। শেষ কথাটা শুনে মোত্তালিব সাহেব খুশী হলেন। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন স্বপ্নাকে আর কখনো দেখতে পাবেন না। সে বিদেশ চলে যাবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এরকম কিছু হবে না। তিনি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

যাকের কথা রাখলো না। বিয়ে হয়ে যাওয়া মাত্রই, “চলে তো আসবোই! স্বপ্নাকে নিয়ে যাই। ও বিদেশ দেখুক!” বলে স্বপ্নাকে সাথে নিয়েই নিউইয়র্ক চলে গেল। আর ফিরে এলো না। কয়েক বছর কেটে গেল। প্রতি মাসের শেষে একটা মানি অর্ডার পেয়ে যান স্বপ্নার বৃদ্ধ বাবা। যে ভয়ে স্বপ্নাকে তিনি বিয়ে দিতে চাইতেন না সেই ভয়‌ই সত্যি হয়েছে। গত ছয় বছর ধরে মেয়েকে তিনি চোখেও দেখেননি। স্বপ্নার একটা ছেলেও হয়েছে। তাকেও তিনি চোখে দেখেননি। সে কি দেখতে স্বপ্নার মতো হয়েছে না যাকেরের মতো? স্বপ্নার মতো গায়ের রং কি পেয়েছে? স্বপ্নার নাকটা আবার হালকা বোঁচা। ওর ছেলের‌ও তাই কি না কে জানে!

বহুদিন পর একবার স্বপ্নার সাথে তার ফোনে কথা হয়। এবারে কথা বলার সময়ে বলেছিলেন, মা রে! ছেলেটাকে নিয়ে একবার আয়! যদি মরেটরে যাই নাতিকে একটাবার দেখি! স্বপ্না বলে, বাবা! পাগল হয়েছো! ওর এখন স্কুল আছে না? এখানকার পড়াশোনা অনেক টাফ। সামারে ট্রাই করবো। ফোনটা কেটে দিয়ে এপাশ থেকে স্বপ্না ফুঁপিয়ে কাঁদে। ওর এখন লাল শাড়ির অভাব নেই। অভাব শুধু বাবার।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত