গতকালের অসমাপ্ত গল্পটা নিয়ে আবারো বসলাম। কিন্তু কিছুতেই গতি করতে পারছিনা। গল্পের নায়িকা মেরীর সাথে নায়ক জুলিয়াসের সাথে যতোবারই দেখা করাবো ভাবি অমনি বেঁকে বসে জুলিয়াস।
“দেখো এতো তাড়াতাড়ি মেরীর সাথে আমার দেখা না করানোই ভাল। তাহলে পাঠক আরো আগ্রহ নিয়ে থাকবে।”
“দেখো জুলিয়াস, তোমাকে এই গল্পের নায়ক আমি বানিয়েছি ঠিক কিন্তু তুমি লেখক নও। লেখক আমি। আমি যেভাবে লিখবো সেভাবেই গল্প এগুবে।”
“না এটা অন্যায়। তুমি লেখক বলেই যা খুশি করতে পারো না। শুরুতেই তুমি আমায় এতিম বানালে। বেশ ভাল কথা। তোমার গল্পের জন্য হলামই নাহয় এতিম। কিন্তু তাই বলে আমার মায়ের সাথে আরেকজনের প্রেম করিয়ে দেবে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! দেখো মি. থমাস এন্ডারসন, তুমি চাইলেই এইসব যাতা লিখতে পারো না।”
“আরে বাবা গতকাল তো আমি সেই অংশ এডিট করে দিয়েছি। যার সাথে তোমার মায়ের প্রেম ছিল তাকে তো মেরে কবর দিয়ে ফেলেছি। তোমার মা সামান্য কান্নাকাটি করেছে ব্যাস শেষ। আর কি চাও তুমি। সবতো তোমার ইচ্ছে মতো লিখা সম্ভব না।”
“মেরী যখন জানতে পারবে এই প্রেমের কথা তখন ও কি ভাববে চিন্তা করেছো তুমি?”
“চিন্তার কি আছে! দরকার হলে মেরীর বাবার সাথেও কোন পরকীয়া প্রেম জুড়ে দেব।”
“তুমি আসলেই একটা ছোটলোক। খুব জঘন্য তোমার চিন্তা ভাবনা। এই চিন্তা নিয়ে তুমি লেখক হলে কি করে সেটাই ভেবে পাইনা।”
“জুলিয়াস মুখ সামলে কথা বল। নইলে কিন্তু এক পা খোঁড়া করে দেবো। খোঁড়াতে খোঁড়াতে তোমায় মেরীর সামনে নিয়ে যাবো।”
“আমার আর কি। করো যা খুশি।”
হ্যাঁ! আমি যা খুশি তাই করবো। যেমন ইচ্ছে তেমন গল্পই লিখবো। গল্পের চরিত্রদের বুদ্ধি পরামর্শে চললে তো আর গল্প হবেনা। গতকাল থেকে জুলিয়াস নাক গলিয়ে গল্পের ধারাই পাল্টে দিচ্ছে। একটা উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে ব্যাটাকে।
গল্পের মোটামুটি একটা খসড়া দাঁড় করিয়ে ফেলেছি। জুলিয়াসের সাথে মেরীর দেখা হবে খুবই নাটকীয় ভাবে। এতিম জুলিয়াসের মা এই বয়সেও এক লোকের প্রেমে পরে যায়। তাদের সম্পর্কের কথা যখন জুলিয়াস জানতে পারে তখনই মেরীর সাথে ওর দেখা হবে। মায়ের সাথে বনিবনা হয়না। মানুষিক ভাবে ভেঙ্গে পরে। স্রোতে ভেসে যাওয়া মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে; জুলিয়াসও তেমনি আঁকড়ে ধরবে মেরীকে। প্রেম হয়ে যায় দু’জনের মাঝে। বাসা ছেড়ে পালাবে দু’জনে। মেরীর প্রভাবশালী বাবা লোক লাগাবে চারিদিকে। জুলিয়াসকে কঠিন শাস্তির দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। এদিকে বিয়ে করে ওরা দু’জন বেশ সুখে সংসার করতে থাকবে। কিন্তু হঠাৎই মেরীর এক মরণ ব্যাধি রোগ হবে। একদিকে মরণ ব্যাধি রোগ অন্যদিকদিকে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে মারা যাবে মেরী। জুলিয়াস না পারবে ফিরে আসতে, না পারবে পালাতে।
মেরীর বাবা মেয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে জুলিয়াসের নামে হত্যার মামলা করবে। ফেরারি হয়ে এখানে ওখানে ছুটে যাবে জুলিয়াস। এদিকে জুলিয়াসের মা তার প্রেমিককে বিয়ে করে বাড়ি ভিটে বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে যাবে। মেরী মৃত্যুর আগে ওর মায়ের একটা নেকলেস দিয়ে যাবে জুলিয়াসকে। যেন ওর মায়ের খোঁজ বের করে ওর মায়ের কবরে নেকলেসটা রেখে আসে। এক অভিশপ্ত নেকলেস সেটা। জুলিয়াস কি শেষ পর্যন্ত মেরীর মায়ের কবর খুঁজে বের করতে পারবে। হাতে কোন দিক নির্দেশনাও নেই। শুধু জানে ওর মায়ের কবরের এপিটাফে লিখা, “ভালবাসার জন্য ছোটপাখিটা আজো ঘুমিয়ে আছে দেবদারু গাছের মাথায় ভোর দেখবে বলে।” এক সময় ঘুরতে ঘুরতে জুলিয়াস ওর মায়ের প্রেমিকের দেখা পাবে। কিন্তু ততোদিনে পৃথিবী থেকে সাতটি বসন্ত বিদায় নেবে। জানতে পারবে ওর মা মারা গেছে। সেই লোকই জুলিয়াসকে ওর মায়ের কবরের কাছে নিয়ে যাবে। সেখানে গিয়েই জুলিয়াসের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরবে।
এপিটাফে লিখা, “ভালবাসার জন্য ছোটপাখিটা আজো ঘুমিয়ে আছে দেবদারু গাছের মাথায় ভোর দেখবে বলে।” ওর সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে। লোকটাকে জিজ্ঞাস করবে এই এপিটাফ কে লিখে দিয়েছে। লোকটা বলবে, তোমার মা নিজেই এপিটাফ লিখে গেছেন। জুলিয়াস হিসাব মিলাতে পারবেনা কিছুতেই। মেরী মারা যাওয়ার অনেক পরে মারা যায় জুলিয়াসের মা। মেরীর মা মারা যায় মেরীর জন্মের আগে। মেরীকি তাহলে ওর। হিসাব মিলবে না। শুরু হবে নতুন করে সবকিছু জানার চেষ্টা। জুলিয়াস ফিরে আসবে ওর নিজের শহরে। কিন্তু নতুন পরিচয়ে। গির্জার পাদ্রী- ব্রাদার জন থমসন হয়ে। ট্রাজেডি রোমান্টিক গল্প মোর নেবে রোমাঞ্চকর গল্পে। কিন্তু কি সেই রোমাঞ্চকর গল্প সেটা এখনো ভাবিনি আমি।
আপাতত এটাই আমার গল্প। কিন্তু শুরুতেই জুলিয়াস আপত্তি করলো ওর মায়ের প্রেম নিয়ে। এখন প্রেম যেহেতু করিয়ে দিয়েছি হুট করে তো আর তা শেষ করা যায়না। জুলিয়াসের কথা রাখার জন্য ওর মায়ের প্রেমিককে মেরে ফেলি। কি জগাখিচুড়ীই না হয়ে যাচ্ছে। কারণ লোকটাই তো ওর মায়ের কবরের কাছে ওকে নিয়ে যাবে। লোকটাকে তো আগেই মেরে ফেললাম। মাথামুণ্ডু কাজ করছে না কিছু।
আবার কি আগের গল্পে ফিরে যাবো নাকি নতুন যেভাবে লিখছি সেভাবেই লিখে যাবো! গল্পের চরিত্রের কথাতেই যদি গল্প লিখি তাহলে আর আমার প্রয়োজন থাকলো কোথায়। তবে একটা কাজ করা যায়। জুলিয়াসের মায়ের সাথে অন্য কারো প্রেম করিয়ে দেওয়া যায়। তবে সেটা জুলিয়াসকে আগে থেকে আর জানাবোনা। জুলিয়াস যখন মেরীর সাথে চুটিয়ে প্রেম করবে ওই সময়েই ওর মায়ের একটা প্রেমিক বানিয়ে দেবো।
মেরীর অংশটাও লিখে ফেলা যায় আপাতত। জুলিয়াসের কথা মাথায় এলেই মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। আপাতত মেরীর অংশটা গুছিয়ে নিলে গল্প অনেকদূর এগিয়ে যাবে।
“সেন্ট হেলেনা এঞ্জেলো স্কুলের পাট শেষ করে কলেজের ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে মেরী। দেখতে ভীষণ মায়াবী। মুগ্ধতায় হারিয়ে যাওয়ার মতো একজোড়া ধূসর চোখ আছে ওর। লং স্কার্টের সাথে শার্ট পরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আশেপাশের লোকজন ঘুরে ঘুরে তাকায় ওর দিকে। ওর প্রিয় রঙ হলুদ। গত গ্রীষ্মের ছুটিতে ওর বাবা ওকে একটা সুন্দর হলুদ ছাতা উপহার দেয়। ওর খুব পছন্দের ছাতা ওটা। প্রখর রোদে যখন ছাতা ফুটিয়ে মাথার উপর দিয়ে হাঁটে তখন ওর ফর্সা গালে হলুদের আভা ছড়াতে থাকে।”
এইটুকু লিখার সাথে সাথে মেরী আমার কলম খাবলা দিয়ে নিয়ে ফেললো।
“আরে করছো কি। মনযোগ নষ্ট হয়ে যাবে তো। কলমটা দাও মেরী। তোমার অংশটা তাড়াতাড়ি লিখে শেষ করি।”
“তুমি কিসব উল্টাপাল্টা লিখছো এসব।”
“মানে কি উল্টাপাল্টা লিখলাম?”
“আমার প্রিয় রঙ মোটেও হলুদ নয়। আমার প্রিয় রঙ হলো- পার্পল। আর বাবা আমায় ছাতা দেয়নি। মানে সেটার আলাদা একটা নাম আছে। সেটাকে বলে প্যারাসল।”
“হ্যাঁ! হ্যাঁ! এখন মনে পরেছে প্যারাসল। ভুলে গিয়েছিলাম নামটা।”
“আর আমার চোখ মোটেও মুগ্ধ হওয়ার মতো না। তুমি যা ইচ্ছা তাই লিখে যাও এটা কেমন কথা।”
“দেখো এসব তুমি বুঝবেনা। গল্পের নায়িকাদের হতে হয় সবার চেয়ে আলাদা। তারা দেখতে হয় অসম্ভব রূপবতী, গুণবতী। তাদের চোখে থাকে মুগ্ধতা। হাসিতে ঝর্ণাধারা। তাদের উন্নত বক্ষ, চিকন কোমর, দীঘল চুল দেখে সবার মাথা ঘুরে যায়। তারা যেদিকে হেঁটে যায় সেদিকে ঘড়ির কাটা থেমে যায়। সবাই নায়িকার দিকে তাকিয়ে থাকে। তুমি এসব বুঝবেনা। পাঠককে গল্প খাওয়ানো এতো সহজ নয়। অনেক কিছুই করতে হয়।”
“গল্পেই এমন সম্ভব বাস্তবে নয়। একটা মেয়ে এতোকিছু একসাথে হতে পারেনা। তুমি তো পাঠকদের ঠকাচ্ছো।”
“এইতো বুঝে ফেলেছো মেরী। তবে ভুল ভাবে বুঝেছো এই যাহ। শোন বাস্তব বাস্তবের জায়গায়। গল্প হলো গল্পের জায়গায়। আমি বাস্তব কিছু নিয়ে যদি হুবহু সব লিখি সেটা গল্প হবে না। হবে পত্রিকার প্রতিবেদন। গল্প তো কল্পনার জগত থেকে আসে। গল্পটা পড়ে কেউ হয়তো বুঝবে যে সেটা বাস্তবে সম্ভব নয়। কিন্তু অবাস্তব বলেও কেউ সেটা ফেলে দিতে পারবেনা। কারণ কেউ তো আর জানেনা যে বাস্তবে কি হতে পারে। এইখানেই হলো মজাটা। পাঠক দুলবে। আর দুলতে দুলতে সে ভাববে। যাই হোক বাস্তব কি অবাস্তব সেটা পরের ব্যাপার; গল্প পড়ার দরকার পড়ে ফেলি। সেইখানেই আমার সার্থকতা। কারণ গাঁজাখুরি হোক আর যাই হোক আমি তো পাঠককে গল্পটা পড়াতে চাই। সেটা পড়াতে পারলেই তো হয়ে গেল।”
“কি যে লাভ এসব করে বুঝি না। তোমার গল্পে এই পর্যন্ত যতো মানুষকে তুমি হত্যা করেছো সেগুলো এক করলে কতোবড় গোরস্থান হবে তুমি চিন্তা করতে পারো?”
“এতোকিছু না ভাবলেও চলবে। কলমটা দাও। তোমার অংশটা লিখে রাখি।”
“নাও যা খুশি লিখো। শোন তুমি যা ভাবছো তা কিন্তু আমি হতে দেবোনা।”
“মানে? কি হতে দিবেনা?”
“তুমি লিখলে না যে আমার সাথে জুলিয়াস যখন প্রেম করবে তুমি ওর মায়ের সাথে আরেকজনকে প্রেম করিয়ে দেবে। সেটা আমি হতে দেবোনা। জুলিয়াসকে আমি সব বলে দেবো। তুমি যা যা লিখছো সবই পড়েছি আমি।”
“তু…তুমি কি করে জানলে এসব। আমি তো গল্পে লিখি নাই এইসব!”
“গল্পে লিখো নাই তো কি হয়েছে। তোমার পাণ্ডুলিপিতে তো লিখাই আছে। আমি পড়ে ফেলেছি।”
আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরা বাকি ছিল শুধু। সাথে সাথে পাণ্ডুলিপি হাত দিয়ে ঢেকে নিলাম।
“শোন মেরী আরেকজনের জিনিস জিজ্ঞাস না করে পড়াটা অভদ্রতা।”
“তুমি আমাদের নিয়ে কি নোংরা খেলা শুরু করছো সেটা কি তুমি জানো। এটা তো আরো বেশিমাত্রার অভদ্রতা।”
“দেখো একদম চুপচাপ থাকবে। নইলে মুখ সেলাই করে দেবো একেবারে। জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। আমাকে আমার মতো গল্প লিখতে দাও।”
“তুমি এতো নিষ্ঠুর কেন। তোমার পাঠকরা কি জানে তুমি কতোটা নির্দয় একজন মানুষ। তোমার কি ক্ষতি হতো যদি আমার মাকে একটু দেখতে দিতে। কেন মেরে ফেললে মাকে?”
“মেরী তুমি যাও। গল্প নিয়ে তোমার সাথে কোন কথা বলতে চাই না।”
“তুমি আমাকেও মেরে ফেলবে। এখনই মেরে ফেলো। এতো নাটকের তো কোন দরকার নাই।”
“সেটা আমি বুঝবো কখন কি করবো। আমি যেভাবে চালিয়ে নেবো গল্প সেভাবেই এগিয়ে যাবে। তোমাদের কারো কথায় নয়। এবার যাও এখান থেকে। কলম দিয়ে যে তোমার চোখ গেলে দেই নাই এখনো এটাই তো অনেক কিছু।”
“তুমি মেরীর মুখ চেপে ধরে ওকে তাড়িয়ে দিলাম। এই চরিত্ররা খুবই ঝামেলা করছে। ভাজ্ঞিস যে পাঠক জানে না চরিত্রের সাথে আমি কি করি। জানলে আমাকেই খলনায়ক ভাবতো।
আগের গল্পের চরিত্র গুলো ছিল দারুন। কোন প্রতিবাদই করে নাই। যা যা করেছি মুখ বুঝে সহ্য করে গেছে। সেই গল্পের মতো যদি কোন দেশ থাকতো আমি সেই দেশেই চলে যেতাম। এতোটাই শান্তিপ্রিয় সেই দেশের মানুষ।
সেই গল্পের প্রয়োজনে একটা বন আমাকে ধ্বংস করতে হয়েছিলো। বনটা উজাড় করে সেখানে গাজার প্রজেক্ট করেছিলাম। স্বাভাবিক ভাবেই সেই দেশের জনগণের প্রতিবাদ এনেছিলাম শুধুমাত্র গল্পটা জমানোর জন্য। সেই বনের উপর নির্ভর করে টিকে থাকা গ্রাম গুলোকে একটা ইশারায় সরিয়ে দেই। ওরা কোন কথাই বলে নাই। এতোটাই শান্তি প্রিয় ওরা। গাজার প্রজেক্ট চালু করার পরে আর একটা মানুষও টু শব্দ করেনি। গাজা প্রজেক্টের বিশাল চোংগা দিয়ে গাজা পোড়ানো ধোয়া ছেড়ে দিতাম। শান্তিতে সেই এলাকার মানুষ গাজার গন্ধে টাল মাটাল হয়ে ঘুমিয়ে যেত। এতো শান্তিপ্রিয় দেশ আমি আর পাইনি। আমার মনে হয় যদি সেই দেশের মানুষদের ধরে ধরে বলি, ভাই আপনার চোখ দুইটা তো সুন্দর। খোঁচা দিয়ে নিয়ে ফেলি। আমার মনে হয় সে হাসতে হাসতে দিয়ে দেবে। রক্ত চাইলে রক্ত দেবে। ওদের অতীতে রক্ত দেওয়ার অনেক রেকর্ড আছে। হৃৎপিন্ড চাইলে হৃৎপিন্ডও দিয়ে দিবে। জীবন দিতে বললে তো মিছিলে মিছিলে জীবন দেবে।
যাক সেই গল্পের কথা। গল্পের দেশের কথা। আপাতত আমি আমার এই গল্প নিয়েই থাকি। এখন আর সম্ভব হবে না এই গল্পটা লিখা। একটা ঘুম দিয়ে সকালে উঠে চা আর সিগারেট ধরিয়ে লিখা শুরু করতে হবে।
সকালে ঘুম থেকে উঠার পরেই মাথায় শুধু আকাশ না মহাকাশ, গ্যালাক্সি ভেঙ্গে পড়লো। কোথায় আমি জুলিয়াস আর মেরীর দেখা করাবো ভাবছি; উল্টা ওরা নিজেরাই দেখা করে ফেলেছে। ওদের দুই জনের লেখা অংশ একসাথে রাখা উচিৎ হয়নি। আমার মাথাতেও আসে নাই যে ওরা এমন কাজটা করতে পারে। গল্প লিখতে গিয়ে দেখি ওরা নিজেরাই ওদের গল্প লিখা শুরু করে দিয়েছে। যখন ওদের দু’জনকে দেখলাম ওরা তখন লেকের পাড়ে বসে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছিলো।
“এসব কি করছো তোমরা?”
দু’জনে চমকে উঠলো। জুলিয়াস মেরীকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
“প্লিজ তুমি আর আমাদের নিয়ে কোন খেলা খেলো না। আমি আর মেরী সবকিছু ঠিক করে ফেলেছি।”
“কি ঠিক করেছো?”
“দেখো গল্পেই সব লিখা আছে। আমাদের গল্প আমরাই লিখছি। আগামীকাল আমরা বিয়ে করবো। আমাদের বাবা মা সবাই রাজী।”
আমার নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। কি হচ্ছে এসব। গল্পের চরিত্রই যদি গল্প লিখে ফেলে তাহলে পাঠক তো আমাকে আর পাত্তাও দিবেনা।
“মেরী তুমিই জুলিয়াসের কাছে গিয়েছো তাই না। কারণ গল্প কি হবে একমাত্র তুমিই জানতে।”
“হ্যাঁ! আমি চাই নাই তুমি আরো একটা নিষ্ঠুরতা করো।”
“কিন্তু আমার গল্পের কি হবে। গল্পের নাম ঠিক করেছিলাম অভিশপ্ত নেকলেস। তোমরা তো সবই ভেস্তে দিলে।”
“তুমি অন্য একটা গল্প লেখো অভিশপ্ত নেকলেস নাম দিয়ে। আমাদের নিয়ে আর ঘাটিও না প্লিজ।”
মাথার ভিতরে সবকিছু জট পাকিয়ে যাচ্ছে। পাণ্ডুলিপিটা বন্ধ করে বাইরে চলে আসলাম। সবে শীত বিদায় নিয়েছে। হালকা চনমনে ঠাণ্ডা বাতাস চারদিকে। মাথা নেড়া হয়ে গেছে অনেক গাছের। কিন্তু তবুও কেন যেন নিষ্প্রাণ মনে হচ্ছেনা। গল্পের ব্যাপারটা কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারছিনা। আমি ভাবিও নাই যে ওরা এমন কিছু করবে।
অভিশপ্ত সেই নেকলেস দিয়ে দারুন রোমাঞ্চকর একটা গল্প লিখতে চেয়েছিলাম। কাল রাতের ঘুমের আগে সাজিয়ে নিয়েছিলাম মনে মনে। জুলিয়াস যখন পাদ্রী হয়ে আবার ওর শহরে ফিরে আসবে তখনই ঘটনা ক্রমশ অন্যদিকে মোড় নিতে থাকবে। জুলিয়াস আর মেরীর মা কি একজন মানুষই। যদি তাই হয় তাহলে জুলিয়াস নিজেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেনা। কিন্তু মেরী কি করে জানলো ওর মায়ের এপিটাফে কি লিখা আছে। আর জুলিয়াসের মায়ের এপিটাফেই বা একই লিখা কেন! জুলিয়াস পাদ্রী হয়ে আসার দুই সপ্তাহ পরে মেরীর বাবাও মারা যাবে। শেষ ভরসাটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে জুলিয়াসের।
গল্পের ঠিক এই জায়গাতেই জুলিয়াস ওদের বাড়ি পরিষ্কার করার সময় খুঁজে পাবে চামড়া মোড়ানো অনেক পুরানো ডায়েরি। ঠিক তখন থেকেই শুরু হবে একের পর এক রোমাঞ্চকর ঘটনা। পরিচয় হবে অপরূপ সুন্দরী লিডিয়ার সাথে। মেরীর স্মৃতি আস্তে আস্তে হালকা হয়ে যাবে। একদিন লিডিয়ার বাড়িতে গেলে দেয়ালে লাগানো পারিবারিক ছবি দেখে অবাক হয়ে যাবে জুলিয়াস। দেখবে লিডিয়ার মায়ের গলাতে সেই নেকলেস। মেরী ওকে যেই নেকলেস দিয়েছিলো সেটাই। জানতে পারবে লিডিয়ার মা মারা যায় ৩ মাস আগে। লিডিয়াকে নিয়ে ওর মায়ের কবরে যেতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল। এপিটাফে লিখা, “ভালবাসার জন্য ছোটপাখিটা আজো ঘুমিয়ে আছে দেবদারু গাছের মাথায় ভোর দেখবে বলে।” জুলিয়াস বুঝতে পারেনা। একই লিখা কেন দুইটা কবরের এপিটাফে। মেরীর মায়ের কবরেও একই এপিটাফ থাকার কথা। এইটুকু ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেছিলাম।
সকালে উঠে পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসতেই তো মেজাজ বিগড়ে দিলো ওরা। কতো সুন্দর করে প্লট সাজালাম। নিশ্চিত জনপ্রিয় হতো আমার এই উপন্যাসটা। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল। আমি গল্প লিখবো কি। গল্পের চরিত্ররাই নিজেদের গল্প লিখে বসে আছে। এদিক ওদিক ঘুরে বাড়ি ফিরে গেলাম।
শাওয়ার নিয়ে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে সিগারেট ধরিয়ে পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসলাম। কিন্তু একি! কি হচ্ছে এসব। মাত্র কয়েক ঘন্টা ছিলাম না। আর এরমধ্যে কি সব ঘটে গেছে। দুইটা ছোট ছোট বাচ্চা মেয়ে দৌঁড়াচ্ছে সবুজ মাঠে। পাশেই ঘাসের উপরে চাদর বিছিয়ে বসে গল্প করছে এক জোড়া বুড়ো বুড়ি। চিনতে কষ্ট হলো না। মেরীর বাবা আর জুলিয়াসের মা। এক হাতে স্কার্ট আর অন্য হাতে ফলের ঝুড়ি ধরে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে মেরী। আগের চেয়েও অনেক সুন্দরী হয়ে গেছে। এখন পরিপূর্ণ এক নারী সে। একটু পরেই একটা ঘোড়ার গাড়ি এসে থামলো। খুব কেতাদুরস্ত জুলিয়াস গাড়ি থেকে নামতেই বাচ্চা মেয়ে দু’টো বাবার বুকের উপরে ঝাঁপিয়ে পরে। জুলিয়াস চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় পরীর মতো মেয়ে দু’টার মুখে। দুই জনকে দুইপাশ থেকে কোলে নিয়ে এগিয়ে যায় মেরীর দিকে। আলতো করে মেরীর ঠোঁটে চুমু খেলো জুলিয়াস।
জুলিয়াস আমায় দেখতে পেয়ে ডাক দিলো। ওদের কাছাকাছি যেতেই মেরী একটা চেয়ার এগিয়ে দিলো আমার দিকে। চেয়ারে বসে কি বলবো ভাবছি। আমার গল্পের চরিত্র অথচ আমার তোয়াক্কা না করেই দিব্যি সুখে শান্তিতে সংসার পেতে বসেছে। মেরী আমার দিকে বিস্কিট আর আপেল পাই বাড়িয়ে দিলো। “তো বেশ ভালোই আছো দেখছি তোমরা। কি নাম রেখেছো দুই কন্যার?”
মেয়ে দুটো বাবার কোলে বসে বাবার মুখের দিকে তাকালো। এতো ফুটফুটে দু’টো বাচ্চা আমার জীবনে এই প্রথম দেখলাম। গল্পেই বুঝি এতো ফুটফুটে বাচ্চা হওয়া সম্ভব। বাচ্চা দু’টোর নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়েই তো কয়েক শতাব্দী পার করে দেওয়া যায়। জুলিয়াস বাচ্চাদের আরো জড়িয়ে ধরলো। “বড় জনের নাম লিডিয়া। ছোট্টোটার নাম এলিজা।” লিডিয়া! নামটা মনে মনে কয়েকবার আওড়ালাম। মেরী আমার সামনে এসে হাটু মুড়ে বসে আমার হাত ধরলো।
“প্লিজ তুমি আমাদেরকে আমাদের মতো করে থাকতে দাও। আমরা সবাই তোমার কাছে অনেক ঋণী মি. থমাস এন্ডারসন। তুমি আমাদের তোমার গল্পে স্থান দিয়েছো বলেই আজ আমরা এতো সুখি হতে পেরেছি। তুমি হয়তো তোমার ইচ্ছে মতো গল্পটা লিখতে পারোনি। কিন্তু আমরা আমাদের গল্প সাজিয়ে নিয়েছি। দেখো কতো নিষ্পাপ দু’টো মেয়ে আমাদের। প্লিজ তুমি আর কোন কিছু করোনা। তুমি চাইলে সবই এক মুহূর্তে উলোটপালোট হয়ে যাবে। তুমি পাণ্ডুলিপিটা ছিঁড়ে ফেললে সবই শেষ হয়ে যাবে। আমাদের দয়া করো তুমি। এই গল্পটা নাহয় তোমার মতো হলোনা। এই গল্পটা নাহয় তোমার গল্পের চরিত্ররা ওদের মতো করে সাজিয়ে নিলো। ক্ষতি কি বলো। তুমি চাইলে আরো অনেক অনেক গল্প লিখতে পারবে। আমাদেরকে আমাদের মতো থাকতে দাও প্লিজ।”
মেরীর কথা শুনে কেন জানিনা আমার চোখের কোণটায় জল জমে গেল। ওর গলার স্বর কাঁপছিল। দুই হাত দিয়ে আমার হাত আঁকড়ে ধরছিলো বারবার। মেরীকে আমার নিজের মেয়ের মতো মনে হচ্ছে। অথচ কতো খারাপ ব্যাবহার করেছি মেয়েটার সাথে। মেয়েটা সেসব কিছুই মনে রাখেনি। মেরীর মাথায় আলতো করে হাত রাখলাম। ও আমার হাটুতে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। দুই পাশ থেকে লিডিয়া আর এলিজা মায়ের গলা ধরে ঝুলে পরেছে। বিদায় নিয়ে চলে এলাম ওদের কাছ থেকে।
লেখকদের মন এতো দুর্বল হতে নেই। দুর্বলতা দেখাতেও নেই। চোখের জল গোপনে মুছে উঠে এলাম। ফিরে আসার সময় একবার পিছন ফিরে চাইলাম। দেখি দুই কন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরে মেরী তখনো কাঁদছে। আর দুই কন্যা মায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে চুমু দিয়ে সারা মুখ ভরিয়ে দিচ্ছে। হাত নাড়ালাম ওদেরকে। ওরাও হাত নাড়লো। লিডিয়া হাওয়ায় ভাসিয়ে চুমু দিলো আমায়। আমি বাতাসে হাত দিয়ে খপ করে ধরে হাতের মুঠো বাম বুকে এনে চুমুটা হৃদয়ে রেখে দিলাম। এতো দূর থেকেও লিডিয়ার প্রাণবন্ত হাসিটা শুনতে পাচ্ছিলাম।
সন্ধ্যার একটু পরে পার্কে এসে একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসলাম। পৃথিবীতে কতো কি ঘটে যায় কেউ কি তা জানে। আমার গল্পের চরিত্র গুলো যে ওরা ওদের মতো করে জীবন গুছিয়ে নিতে পারে কেউ কি তা কখনো জানতে পারবে! “অভিশপ্ত নেকলেস” পাণ্ডুলিপিটা চামড়ার ব্যাগে ভিরে লকারে রেখে দিয়েছি। আর কখনো সেই পাণ্ডুলিপি আমি খুলেও দেখতে চাইনা। এরপরে ওরা ওদের গল্প কি করে লিখলো সেটাও আর জানতে চাইনা।
কতো কি ভেবে রেখেছিলাম গল্পটা নিয়ে। তিনটা কবরে একই এপিটাফের রহস্য বের করবে জুলিয়াস। যার দুইটা কবর জুলিয়াস নিজের চোখে দেখেছে। আর সেই নেকলেস। এই নেকলেসই হয়ে যেত গল্পের মূল আকর্ষণ। কিন্তু তা আর হলো কোথায়।
শীত বিদায় নিলেও চনমনে ঠাণ্ডা বাতাসটা আরো কিছুদিন থাকবে। চারিদিকে গাছের পাতা ঝরে ঝরে পড়ছে। এক কাপ চা হলে মন্দ হতো না এখন। পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করে ধরালাম। বুক ভরে নিকোটিন টেনে নিয়ে শূন্য ছেড়ে দিলাম ধোয়া। কি আশ্চর্য জীবন আমাদের। আমাদের গল্পটাও হয়তো অন্য কেউ লিখছে তার মতো করে। আমি যেমন মেরী আর জুলিয়াসের গল্পটা লিখছিলাম। মেরী যেমন আমার কলম নিয়ে ফেলে আমার গল্পের প্রতিবাদ করলো; আমি কি কখনো পারবো এমনটা করতে। আমি তো জানিইনা আমার গল্পটা কেউ লিখছে কিনা। যদি জানতাম আমিও তবে মেরী আর জুলিয়াসের মতো আমার গল্পটা লিখে যেতাম।
হঠাৎ মনে হলো। আমার গল্পটা আসলে আমি কি করে লিখতাম তাহলে। কেমন হতো। কি চাওয়ার আছে। কিছুই জানিনা। “অভিশপ্ত নেকলেস” গল্পটা লিখতে গিয়ে সবই এলোমেলো হয়ে গেল আমার। বুকে ঠাণ্ডা হাওয়াটা বসে যেতে পারে বলে বাড়ি ফেরার জন্য উঠবো এমন সময় এক লোক একটা সাইকেল চালিয়ে আমার সামনে এসে ব্রেক কষলো।
“আপনি কি থমাস এন্ডারসন?”
“জি।”
“এটা আপনার জন্য।”
“কি এটা…”
হাত বাড়িয়ে নিতেই লোকটা দ্রুত সাইকেল নিয়ে চলে গেল। আগে কখনো এই লোককে এই তল্লাটে দেখিনি। একটা খাকি রঙের এনভেলাপ। উপরে ইংরেজীতে আমার নাম লিখা। টানা ঝরঝরে হাতের লিখা। এনভেলাপে একটা চিঠি। মুক্তোর মতো অক্ষরে লিখা ইংরেজিতে চিঠি।
“প্রিয় থমাস এন্ডারসন,
ভালবাসা নিবে আমাদের। জগতের সব রহস্যের কখনো সমাধান হয়না। ঈশ্বর হাজারো রহস্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। সব রহস্যের কারণ খুঁজতে যেও না। আমাদের এমন একটা জীবনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য তুমি আমাদের কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করো। এই নেকলেস খুবই অভিশপ্ত একটা নেকলেস। এই অভিশাপ তোমারই সৃষ্টি। নেকলেসটা তোমার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আমরা অভিশাপ মুক্ত হলাম। তুমি যেমন জানতে গল্প কি করে লিখবে। আমরাও জেনে গেছি তোমার জীবনে এরপরে কি ঘটবে। কিন্তু সেগুলো তোমায় জানাবো না। শুধু এটাই জেনে রাখো তোমার কবরের এপিটাফে লিখা থাকবে, “ভালবাসার জন্য ছোটপাখিটা আজো ঘুমিয়ে আছে দেবদারু গাছের মাথায় ভোর দেখবে বলে।” তুমি ভাল থেকো। আমরা ভাল আছি। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুক।
ইতি
মেরী জুলিয়াস”
চিঠিটা পড়ে সাথে সাথে বাড়ি ফিরে এলাম। আমার হিসাব সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিনা। লকারের কম্বিনেশন নাম্বার মিলিয়ে খুলতেই দেখি সেখানে পাণ্ডুলিপি নেই। একটা লাল মখমল কাপড়ে কি যেন মুড়িয়ে রাখা আছে। হাতে নিয়ে কাপড় সরাতেই দেখি আমার গল্পের সেই অভিশপ্ত নেকলেসটা।