তোমাতেই

তোমাতেই

যেদিন তাকে প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই তাকে আমার ভাল লাগে। বৃষ্টির কারণে স্কুল থেকে ফিরতে কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টি শেষ হলে বাড়িতে ফিরে দেখি আমার আগে সে হাজির। যার কথা বলছি সে আমার প্রাইভেট টিউটর ছিল। শান মধ্যবিও ফ্যামিলির দুই ভাই বোনের মধ্যে ছোট সে। কোন এক সরকারি কলেজে গ্র্যাজোয়েশন করছিল সে।

সেদিন প্রথম সে আমাকে পড়াতে আসে। তখন আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী আর কিছুদিন পরেই আমার পরীক্ষা। তাই ভালভাবে সিলেবাস কমপ্লিট করার জন্য স্কুল আর কোচিং এর পর বাবা আমার জন্য প্রাইভেট টিউটর এর ব্যবস্হা করে। কিন্তু যখনই স্কুল ছুটি হল তখনই বিপওি বাঁধল ঝুম বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টি শেষে কাকভেজা হয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বাড়িতে ফিরে মায়ের কথামত জলদি গোসল সেড়ে না খেয়েই পরতে চলে গেলাম। বাড়ি ফিরতেই মা জানিয়ে দিল টিচার বৃষ্টির আগেই চলে এসেছে। অনেকক্ষন ধরে বসে আছে তাই যা করার তাড়াতাড়ি কর। মায়ের কথা শুনে না খেয়েই শুধু গোসল করে পড়তে চলে গেলাম। সেদিন কালো প্যান্ট আর কালো রঙের টি শার্টে ফর্সা মানুষ টাকে আমার কাছে একদম হিরোর মত লাগছিল। হয়তো বয়স কমের কারণও হতে পারে। তাকে দেখেই আমার গলা শুকিয়ে আসছিল। সে আমার দিকে একনজর তাকিয়ে আর তাকাল না। আমি কিছু বলার ভাষাও যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাই আগেই সালাম না দিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করে ফেললাম

-কেমন আছেন? সে ও এতটা আমলে না নিয়ে নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল
-ভাল।

সেদিন থেকে সে আমাকে পড়াতে শুরু করল আর তার প্রতি আমার ভাল লাগাটাও দিনকে দিন বেড়েই চলল।
তার কথাবলার ধরন, হাসি, ব্যবহার এমনকি চোখের পাতা ফেলাটাও আমার কাছে ভালো লাগত। পড়ানোর সারাটাক্ষন আমি যেন তাকে ঘিরেই হাজার জল্পনা কল্পনা বুনে যেতাম এমনকি আমার ডেইলি রুটিন এর মধ্যেও তাকে নিয়ে সারাদিন ভাবা আর সবার সাথে পড়তে বসে কি কথা হল না হল এসব নিয়ে কথা বলাটাও যোগ হয়ে গিয়েছিল। এসএসসি পরীক্ষার আগে সপ্তাহে সাত দিনই সে আমাকে পড়াত একদিনও মিস দিত না এমনকি শুক্রবারও। তাতে যেন সে আমার মাথায় আরও জেঁকে বসল।

দেখতে দেখতে পরীক্ষা চলে এল । পরীক্ষার মাঝে আর তেমন দেখা হয়নি। আমিও পরীক্ষার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস ছিলাম কিন্তু তার মাঝেও সে আমার ভাবনা থেকে সরেনি। পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হওয়ার পর কোথায় ভর্তি হব তা নিয়ে নিজের মধ্যে একটা টানাপোড়ন চলছে। যেহেতু মেয়ে ছিলাম তাই বাবা মা দূরে কোথাও পাঠাতে চাইল না। শেষমেষ কাছের একটা কলেজে ভর্তি হলাম। আবারও তার কাছে পড়া শুরু। আমার বাবা- মাও তার প্রতি বেশ ডিপেন্ডেবল হয়ে পড়েছিল। এমনকি আমার পড়াশোনা বা যে কোন ব্যাপারে তার মতামতও শুনা হত। হঠাৎ তার মধ্যেও আমি চেঞ্জ ফিল করতাম। সে কি আকার ইঙ্গিতে আমাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করত নাকি বুঝতে পারতাম না। নাকি সবই আমার মনের ভুল? সেটা আজ পর্যন্তও বুঝি নি।

পড়তে বসলে অনেক কথাই হত। ধীরে ধীরে তা আরো প্রসারিত হতে থাকল। একপর্যায়ে আমরা খুব ফ্রেন্ডলি হয়েও উঠেছিলাম। হাসি ঠাট্টা করতে করতে করতে কখন যে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে দিলাম টেরই পেলাম না। তারপর আমি অনার্স করতে দূরে চলে এলাম। ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমে যায়। দূরত্বটাও বাড়তে থাকে কিন্তু আমার মনে তার জায়গাটা আগের মতই স্বচ্ছ এবং স্হির। মেয়ে বড় হয়েছে বিয়ে দিতে হবে ভাবনাটা বাবা – মা’ র মধ্যে চলে এল। তারা তাদের পছন্দ সই পাএও পেয়ে গেল। বিয়ে ঠিক,, কিন্তু আমি যে তাকে ভুলতে পারছি না আমার মনে হয় তাকে ভুলার সাধ্যও আমার নেই।

আস্তে আস্তে আমার বিয়ের দিনও ঘনিয়ে আসছে। বাবা মা খুব খুব খুশি। কারন আমার হবু বর প্রশাসনে সদ্য বি সি এস ক্যাডার হয়েছে। তার সাথে সুদর্শন ত বটেই!! এত ভাল ছেলে আমার মত নরমাল অনার্সে পড়া মেয়েকে বিয়ে করছে এটাই ত বেশি। সেদিন আমিও কিছু বলতে পারি নি। কার ভরসায়ই’বা বলব সে ত কখনো আমাকে কিছু বলেই নি। তাই একপ্রকার অভিমান থেকে আমিও বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। অবশেষে সেই দিন আমার বিয়ে হয়ে গেল। আমি অন্য কারো হয়ে গেলাম। একটা টুকটুকে লাল বেনারসি পড়ে আমার বরের সাথে স্টেজে বসে আছি। হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে সে একটা নীল পাঞ্জাবি পড়ে একগাল হাসি দিয়ে আমার কাছে এসে একটা উপহারের বক্স এগিয়ে দিল। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল

“ভাল থেকো” কথাটা বলে সে আর পিছু ফিরে তাকাল না ,, চলে গেল। যুগ যুগান্তরের জন্য আমার জীবন থেকে সম্পূর্নভাবে চলে গেল শুধু আমার কাছে পড়ে রইল তার দেয়া উপহার আর তার সাথে কাটানো সুন্দর কিছু স্মৃতি। কেন জানি না সেদিন কথাটা বলার সময় আমার মনে হল সে কাঁদছে। আমি তার সব ধরনের কথা বুঝি হাসির এমনকি কান্নারও। বিদায় নেয়ার সময় সেদিন আমার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও পড়ে নি। সেদিন আমি হেসেছিলাম বিশ্ব জয়ের হাসি। আর হাসব নাই বা কেন যাকে আমি এতটা ভালবাসি তার মনেও যে আমার জন্য কিছু ছিল সেটা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে সে না বল্লেও আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

আজ আমার বিয়ের ২০ তম অ্যানিভার্সারি। এখন আমি পুরোপুরিভাবে সংসারি। আমার হাসবেন্ড বিরাটভাবে প্রতি বছর এই দিনটিপালন করে। প্রচুর গিফট করে। আজও তার ব্যতিক্রম হবে না। কিন্তু সেদিনের তার সেই উপহারের কাছে সব কিছু তুচ্ছ। ও হ্যাঁ তার সেদিনের দেয়া উপহারটা আজও আমি খুলিনি। আমার আলমারিতে সযত্নে ওভাবেই রয়েছে। ওটা খুলে দেখার মত সাহস আমার নেই। হয়তো ওটা খুলে এমন কিছু দেখব যা দেখে তার কাছে জানতে ইচ্ছে করবে – কেন আমাকে তার ভালবাসার কথা জানায়নি? কেন সবকিছু থেকে আমাকে বঞ্চিত করল???

আজও আমার মনের সেই জায়গায় সযত্নে সে আছে তার জায়গাটা কেউ নিতে পারে নি। আমি একজন বেস্ট ওয়াইফ, সফল মা কিন্তু দিনশেষে সেই সুন্দর দিনগুলো মনে করে কোথাও না কোথাও চাপা কষ্ট অনুভব হয় আর চোখের কোনায় পানি ঝরে। হয়ত আমাকে ভালবেসে সেও আর বিয়ে করতে পারে নি। আমি ত চলার পথে হাত ধরার মত একজন সঙ্গী পেয়েছি কিন্তু সে তার সেদিনের ব্যর্থতার জন্য নিজের জীবনে কখনও কাউকে জড়ায় নি বা হয়তো সারাজীবন আমার স্মৃতি নিয়ে ই বেঁচে থাকতে চায় তাই কাউকে জড়ায় নি। কথাগুলো তানিশা তার ডায়েরিতে লিখছে আর তার দুচোখ ভেসে যাচ্ছে পানিতে। বিয়ের এত বছর পরও সে তার ভালবাসার মানুষ টাকে এখনও ভুলতে পারে নি।

আসলে ভালবাসা এমনি হয়। ভালবাসার মানুষ পাশে না থাকলেও তার প্রতিটি স্মৃতি বুকে আগলে রেখেই বেঁচে থাকার নামই ভালবাসা। শান আর তানিশার মত অসংখ্য ভালবাসা পরিস্থিতি- পরিবেশ এর কবলে পরে কখনও পূর্ণতা পায় না। শুধু দুটি মানুষ দুপ্রান্তে দুজনকে আজীবন এভাবেই ভালবেসে বেঁচে থাকে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত