নীলকুঠি: ২৬-৩০. ঘরের মধ্যে ঢুকতেই চোখাচোখি

নীলকুঠি: ২৬-৩০. ঘরের মধ্যে ঢুকতেই চোখাচোখি

২৬-৩০. ঘরের মধ্যে ঢুকতেই চোখাচোখি

ঘরের মধ্যে ঢুকতেই চোখাচোখি হয়ে গেল প্রতুলবাবুর সঙ্গে।

প্রতুলবাবু বোধ হয় কিছুক্ষণ আগে এসেছেন, ঐ ঘরে ইন্সপেক্টারের অপেক্ষায় বসেছিলেন।

প্রতুলবাবুর পাশেইচেয়ারেস্যুট পরিহিত সুশ্রী আর একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোবসেছিলেন।

এই যে প্রতুলবাবু! কতক্ষণ এসেছেন?

এই কিছুক্ষণ হল। আলাপ করিয়ে দিই ইন্সপেক্টার সাহেব, ইনি মিঃ চট্টরাজ, বিনয়েন্দ্রবাবুর অ্যাটর্নী। আর ইনি ইন্সপেক্টার মিঃ প্রশান্ত বসাক।

উভয়ে উভয়কে নমস্কার জানান।

কথা বললেন তারপর প্রথমে মিঃ চট্টরাজই, আমাকে আপনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন মিঃ বসাক?

হ্যাঁ। বিনয়েন্দ্রবাবুর কোন উইল আছে কিনা সেইটাই আমি জানবার জন্য আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম মিঃ চট্টরাজ।

না। উইল তিনি কোন কিছু করে যাননি।

কোন উইলই নেই?

না।

উইলের কোন কথাবার্তাও হয়নি কখনও তাঁর সঙ্গে আপনার?

মাস পাঁচ-ছয় আগে একবার তিনি আমাদের অফিসে যান, সেই সময় কথায় কথায় একবার বলেছিলেন উইল একটা তিনি করবেন—

সে উইল কী ভাবে হবে সে সম্পর্কে কোন কথাবার্তা হয়নি?

হ্যাঁ, বলেছিলেন, তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি একমাত্র হাজার দশেক নগদ টাকা ছাড়া তিনি তাঁর ভাইঝি কে এক সুজাতাদেবীকেই নাকি দিয়ে যেতে চান।

একমাত্র দশ হাজার টাকা ব্যতীত সব কিছু সুজাতাদেবীকেই দিয়ে যাবেন বলেছিলেন?

হ্যাঁ।

রজতবাবু তাঁর একমাত্র ভাইপোর সম্পর্কে কোন ব্যবস্থাই করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি?

হ্যাঁ, করেছিলেন, ঐ নগদ দশ হাজার টাকা মাত্র। আর কিছু নয়।

হুঁ। ক্ষণকাল চুপচাপ বসে কি যেন ভাবলেন মিঃ বসাক, তারপর মৃদু কণ্ঠে বললেন, একটা কথা মিঃ চট্টরাজ, বিনয়েন্দ্রবাবুর প্রপার্টির ভ্যালুয়েশন কত হবে নিশ্চয়ই জানেন?

ইদানীং অনেককিছুইহস্তান্তরিত হয়েছিল। কলকাতার তিনখানা বাড়ি, ফিক্সড ডিপোজিটের সুদ বাবদ যা পেয়েছেন সবই গিয়েছিল খরচ হয়ে তালেও এখনও যা প্রপার্টি আছে তার ভ্যালুয়েশন তা ধরুন, লাখ দুয়েক তো হবেই। তাছাড়া ব্যাঙ্কেও নগদ হাজার পঞ্চাশ এখনও আছে।

সম্পত্তির পরিমাণ তাহলে নেহাত কম নয়। বেশ লোভনীয়ই যে যে-কোন ব্যক্তির পক্ষে।

মিঃ চট্টরাজ বললেন, এ আর কি, একদিন চক্রবর্তীদের সম্পত্তির পরিমাণ পনের বিশ লাখ টাকা ছিল; যা কাগজপত্রে পাওয়া যায়। নানা ভাবে কমতে কমতে এখন কলকাতার পার্ক স্ট্রীটের বাড়ি, এই নীলকুঠি ও টালিগঞ্জ অঞ্চলে কিছু জমি ও ব্যাঙ্কে যা নগদ আছে।

এখন তাহলে বিনয়েন্দ্রবাবুর সমস্ত সম্পত্তি কে পাচ্ছে মিঃ চট্টরাজ?

উইল যখন কিছু নেই তখন রজতবাবু ও সুজাতাদেবীই সব সমান ভাগে পাবেন; কেন একমাত্র ওঁরাই দুজনে আজ বিনয়েন্দ্রবাবুর সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী।

রেবতী এসে ঘরে প্রবেশ করল এবং প্রতুলবাবুকে সম্বোধন করে বললে, বাবু চাল ডাল তেল ঘির ব্যবস্থা করে দিয়ে যাবেন।

এতদিন, এমন কি কাল রাত পর্যন্তও রামচরণের ঘাড়েই ঐ সব কিছুর দায়িত্ব গত বিশ বছর ধরে চাপানো ছিল। এখন অন্য কোন রকম ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত রেবতীকেই চালাতে হবে।

প্রতুলবাবু বললেন, যাবার আগে টাকা দিয়ে যাব। এখন যা যা দরকার মতি স্টোর্স থেকে এ বাড়ির অ্যাকাউন্টে গিয়ে নিয়ে আয়।

রেবতী মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

প্রতুলবাবু তখন চট্টরাজকে সম্বোধন করে বললেন, টাকার ব্যবস্থা কিছু আপনাকে শীগগিরই করতে হবে মিঃ চট্টরাজ। আমার ক্যাশেও সামান্যই আছে আর।

সামনের মাসের টাকাটা এ মাসের দশ তারিখেই তুলে রেখেছিলাম ব্যাঙ্ক থেকে। কাল সে টাকাটা পাঠিয়ে দেব। তারপর রেবতীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, এঁদের চা দাও রেবতী।

রেবতী বললে, চা প্রায় হয়ে এসেছে। এখুনি আনছে।

রেবতী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

প্রতি মাসে সাধারণতঃ কত সংসার-খরচ বলে আসত মিঃ চট্টরাজ?

কলকাতার পার্ক স্ট্রীটের ফ্ল্যাট সিস্টেমের বাড়িটা থেকে ভাড়া বাবদ ৬০০ টাকা পাওয়া যায় আর ব্যাঙ্ক থেকে ৬০০ টাকা। এই বারশত করে প্রতি মাসে আসত।

তাছাড়া ৪০০ টাকা/৫০০ টাকা প্রতি মাসেই বেশী চেয়ে পাঠাতেন যেটা আবার তুলে দেওয়া হত ব্যাঙ্ক থেকেই।

ব্যাঙ্ক থেকে অত টাকা তুলতেন প্রতি মাসে? প্রশান্ত বসাক প্রশ্ন করেন চট্টরাজকে।

হ্যাঁ, ইদানীং বছর দেড়েক থেকেই তো অমনি টাকা খরচ হচ্ছিল।

তার আগে?

বাড়িভাড়ার টাকাতেই চলে যেত।

তা ইদানীং বছর দেড়েক ধরে এমন কি খরচ বেড়েছিল মিঃ চট্টরাজ, যে বিনয়েন্দ্রবাবুর অত টাকার প্রয়োজন হত?

তা কেমন করে বলব বলুন। টাকা তিনি চাইতেন, আমরা পাঠিয়ে দিতাম মাত্র। তাঁর অর্থ তিনি ব্যয় করবেন তাতে আমাদের কি বলবার থাকতে পারে বলুন? শুধু ঐ কেন, গত এক বছরের মধ্যেই তো তাঁর কলকাতায় আরও যে দুখানা ছোট বাড়ি ছিল তাও তিনি বিক্রি করেছেন।

এবার মিঃ বসাক ঘুরে তাকালেন প্রতুলবাবুর মুখের দিকে এবং প্রশ্ন করলেন, কেন অত টাকার প্রয়োজন হত ইদানীং তাঁর, সে সম্পর্কে আপনি কিছু বলতে পারেন প্রতুলবাবু?

আজ্ঞে না, তাঁর একান্ত নিজস্ব ব্যাপার কেউ ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে পেত না। কাউকে তিনি কিছু বলতেনও না।

আচ্ছা মিঃ চট্টরাজ, বিনয়েন্দ্রবাবুর সঙ্গে আপনার কি রকম পরিচয় ছিল?

বিশেষ কিছুই না বলতে গেলে। বেশীর ভাগ তাঁর যা কিছু বলবার তিনি চিঠিতে বা ফোনেই জানাতেন।

এ বাড়িতে ফোন আছে নাকি? কই দেখিনি তো! বললেন প্রশান্ত বসাক।

জবাব দিলেন প্রতুলবাবু, আছে ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যে।

বাইরে এমন সময় জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। পুরন্দর চৌধুরী এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।

আসুন পুরন্দরবাবু, বিশ্রাম নেওয়া হল?

হ্যাঁ। আমাকে তাহলে অনুগ্রহ করে এবারে যাবার অনুমতি দিন ইন্সপেক্টার। কথা দিচ্ছি আপনাকে আমি, ডাকামাত্রই আবার আমি এসে হাজির হব।

আমি এখুনি একবার কলকাতায় যাব। ফিরে এসে আপনাকে বলব কখন আপনাকে ছেড়ে দিতে পারব মিঃ চৌধুরী। জবাব দিলেন ইন্সপেক্টার।

রেবতী চায়ের ট্রে হাতে ঘরে এসে প্রবেশ করল।

.

২৭.

লালবাজারে কিছু কাজ ছিল, সে কাজ শেষ করে মিঃ বসাক সোজা সেখান থেকে কিরীটীর টালিগঞ্জ ভবনে এসে হাজির হলেন।

কিরীটী তার দোতলার বসবার ঘরে আলো জ্বেলে বসে একখানা জ্যোতিষ-চর্চার বই নিয়ে পড়ছিল।

জংলী এসে সংবাদ দিল, ইন্সপেক্টার বসাক এসেছেন।

নিয়ে আয় এই ঘরেই। বই থেকে মুখ না তুলেই কিরীটী বললে।

একটু পরে প্রশান্ত বসাকের পদশব্দে পূর্ববং বই হতে মুখ না তুলেই একটা সাদা কাগজের বুকে একটা কুষ্ঠির ছকের পাশে কি সব লিখতে লিখতে আহ্বান জানাল কিরীটী, আসুন মিঃ বসাক, বসুন। সপ্তম স্থানে রাহু, অষ্টমে বুধ।

মিঃ বসাক বসতে বসতে বললেন, জ্যোতিষ চর্চা আবার শুরু করলেন কবে থেকে?

ভারতের বহু পুরাতন ও অবহেলিত অদ্ভুত সায়েন্স এই জ্যোতিষচচার ব্যাপার মিঃ বসাক। এবং সময় ও নক্ষত্র যদি ঠিক ঠিক হয় তো অনেক কিছুই দেখবেন, নির্ভুল পাবেন আপনি গণনায়। অঙ্ক শাস্ত্রের মত ঠিক হলে শুদ্ধ উত্তর ঠিক আপনি পাবেনই।

জ্যোতিষ চচটিাকে সত্যি সত্যিই তাহলে আপনি বিশ্বাস করেন মিঃ রায়?

নিশ্চয়ই, এ একটা অত্যাশ্চর্য সায়েন্স। আর বিশ্বাসের কথা বলছেন, এ তো আপনি বিশ্বাস করেন যে চন্দ্রের কলাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নদীর জোয়ার-ভাঁটার পরিবর্তন হয়?

তা অবিশ্যি করি।

তবে কেন আপনার বিশ্বাস করতে বাধে মানুষের দেহের উপরেও গ্রহ-উপগ্রহের প্রভাব আছে? জানেন না আপনি, ভৃগুর কি অসাধারণ ক্ষমতা। আমি এ যতই পড়ছিএবং যতই মনে মনে বিশ্লেষণ করছি ততই বিস্ময় যেন আমার বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। কুষ্টির ছকটা আর কিছুই নয়, মানুষের বহু বিচিত্র রহস্যময় অজ্ঞাত জীবনের কতকগুলো সত্য ও অবধারিত সূত্র একত্রে গ্রথিত একটা সংকেত মাত্র। সূত্রগুলির সঠিক পাঠোদ্ধার করতে পারলে আপনি সুনিশ্চিত পৌঁছবেন সেই অজানিত সংকেতের নির্ভুল মীমাংসায়। আজ উত্তরপাড়ার নীলকুঠির যে হত্যা-রহস্য আপনাকে চিন্তিত করে—

বাধা দিলেন ইন্সপেক্টার, আশ্চর্য, কি করে জানলেন যে সেই ব্যাপারেই আপনার কাছে আমি এসেছি।

কিছুটা শুনেছি আজ দুপুরে, আপনাদের হেডকোয়ার্টারে গিয়েছিলাম, সেখানেই। শুনলাম, নীলকুঠির মার্ডারের মোটামুটি কাহিনীটা এবং সেখানেই শুনলাম আপনিই সেই ঘটনাটা তদন্ত করছেন বর্তমানে। তার পরই অকস্মাৎ আপনার আমার কাছে আগমন। ব্যস, একেবারে অঙ্কশাস্ত্রের যোগ-বিয়োগ—উত্তর মিলে গেল।

সত্যি! সেই কারণেই আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি মিঃ রায় এই সময়ে।

না না—এর মধ্যে বিরক্তির কী আছে। বলুন, শোনা যাক।

প্রশান্ত বসাক সেই একেবারে গোড়া থেকেই সব বলে যেতে লাগলেন।

কিরীটী সোফাটার উপর গা এলিয়ে দু চক্ষু বুজে একটা ফুরোট. টানতে টানতে শুনতে লাগল।

কাহিনী যখন শেষ হল, কিরীটী তখনও চোখ বুজে পূর্ববং সোফার উপরে হেলান দিয়েই বসে আছে।

ঘরের মধ্যে একটা স্তব্ধতা যেন থমথথ করছে।

ওয়াল-ক্লকটা ঢং ঢং করে রাত্রি নটা ঘোষণা করল।

সময় সংকেতের সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় কিরীটী চোখ মেলে তাকাল, এবং মৃদু কণ্ঠে এই সর্বপ্রথম প্রশ্ন করল, আপনি যা বললেন, তার মধ্যে কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে।

কী বলুন তো?

প্রথমত ধরুন, সিঙ্গাপুরী মুক্তা।

কিন্তু সিঙ্গাপুরী মুক্তার ব্যাপারটা তো–

হ্যাঁ। যতটুকু মুক্তা সম্পর্কে আপনি জেনেছেন, আমার মনে হচ্ছে, সেটাই সব নয়, আংশিক মাত্র। দ্বিতীয়ত সেই রহস্যময়ী নারীলতা। লতা শব্দের আর একটি অর্থ জানেন তো, সাপ, এবং সেই সাপই শুধুনয়, ইউ. পি. থেকে আগত সেই আগন্তুকের কথাটাও আপনাকে স্মরণ রাখতে হবে। যেমন করে হোক ঐ দুটি ব্যক্তিবিশেষের খুঁটিনাটি কিছু সংবাদ বা পরিচয় আপনাকে জানতে হবে। আর আপনার মুখে সমস্ত কথা শোনবার পর, মনে মনে আমি। যে ছকটি গড়ে তুলেছি তা যদি ভুল না হয়, অর্থাৎ আমার অনুমান যদি ভুল না হয়ে থাকে তো জানবেন, এ ক্ষেত্রে হত্যার কারণ বা মোটিভ প্রেমঘটিত।

প্রেমঘটিত!

হ্যাঁ, প্রেমেরই যে সর্বাপেক্ষা বিচিত্র গতি। এবং যে প্রেম ক্ষেত্রবিশেষে নিঃস্ব করে আপনাকে বিলিয়ে দিতে পারে, মনে রাখবেন, সেই প্রেমই আবার ভয়াবহ গরল উদগীরণ করতে পারে।

আচ্ছা মিঃ রায়, আপনার কি মনে হয় হত্যাকারী কোন পুরুষ বা নারী?

পুরুষও হতে পারেন, নারীও হতে পারেন। অথবা উভয়ের একত্রে মিলিত প্রচেষ্টাও থাকতে পারে। কিন্তু সে তো শেষ কথা বর্তমান রহস্যের। তার পূর্বে সে সূত্রগুলি ধরে আপনি অগ্রসর হবেন সেগুলো হচ্ছে, এক নম্বর, প্রত্যেকেরই গত চার-পাঁচ বছরের জীবনের অতীত ইতিহাস। বিনয়েন্দ্র, রজত, সুজাতাদেবী ও পুরন্দর চৌধুরীর। দুনম্বর,সেই ছায়ামূর্তির অন্বেষণ। যে ছায়ামূর্তিকে ইদানীং বিনয়েন্দ্র রাত্রে নীলকুঠিতে ঘন ঘন দেখতেন এবং রামচরণ ও ড্রাইভার করালীও দেখেছে বলে জানা যায়। তিন নম্বর, সেই শ্রীমতী রহস্যময়ী লতা। তাঁকেও খুঁজে বের করতে হবে, এবং সেই সঙ্গে জানতে হবে সেই লতা বিনয়েন্দ্রর কুমার জীবনে কতখানি ঘনিষ্ঠ হয়ে এসেছিল। চার নম্বর, বিনয়েন্দ্রর শয়নকক্ষ ও গবেষণা ঘরটি আর একবার পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আপনাকে দেখতে হবে। এই চারটি প্রশ্নের মধ্যেই বিনয়েন্দ্রর হত্যার কারণ বা মোটিভটি জড়িয়ে আছে জানবেন।

প্রশান্ত বসাক গভীর মনোযোগ সহকারে কিরীটীর কথাগুলো শুনতে থাকেন।

কিরীটী একটু থেমে আবার বললে, এবারে হত্যা করা সম্পর্কে যা আমার মনে হচ্ছে, বিনয়েন্দ্রর হত্যার ব্যাপারটি হচ্ছে pre-arranged, premeditative and a well planned murder। খুব ধীরে-সুস্থে, সময় নিয়ে, প্ল্যান করে, এবং ক্ষেত্র তৈরি করে তারপর হত্যা করা হয়েছে বেচারীকে। এবং খুব সম্ভবত, তার কিছুটা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে বেচারী রামচরণ জানতে পারায় হত্যাকারী রামচরণকেও সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে। অতএব সেটাও ইচ্ছাকৃত হত্যা। দুটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের যিনি হোতা, জানবেন, তিনি যেমন ধূর্ত তেমনি সতর্ক, তেমনি শয়তানী বুদ্ধিতে পরিপক। এবং সম্ভবত আজ কাল বা দু-চারদিনের মধ্যেই হোক, হত্যাকারী আবার হানবে তার মৃত্যু-ছোবল।

কিরীটীর কথায় প্রশান্ত বসাক যেন চমকে ওঠেন, বলেন, কি বলছেন আপনি মিঃ রায়!

ঠিকই বলছি। আমার calculation যদি মিথ্যা না হয় তো শীঘ্রই আবার একটি বা ততোধিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবে। অতএব সাবধান। খুব সাবধান। কিন্তু যাক সে কথা, এবারে আসা যাক আপনার সূত্রগুলির মধ্যে। ১নং, ভাঙা ঘড়ি। ২নং, অপহৃত বিনয়েন্দ্রর রবারের চপ্পল জোড়া। ৩নং, রামচরণের ঘরে তার নিত্যব্যবহার্য চিরুনিতে প্রাপ্ত কয়েকগাছি নারীর কেশ। ৪নং, তিনখানি চিঠি।

.

২৮.

প্রশান্ত বসাক কিরীটীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, শুভরাত্রি জানিয়ে নিজের গাড়িতে এসে যখন বসলেন, রাত তখন সোয়া দশটা।

ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন উত্তরপাড়া যাবার জন্য।

চলন্ত গাড়ির মধ্যে বসে আর একবার সমস্ত ব্যাপারটা ও কিরীটীর কথাগুলো মনে মনে পর্যালোচনা করতে লাগলেন প্রশান্ত বসাক।

নীলকুঠিতে যখন এসে পৌঁছলেন রাত্রি তখন প্রায় পৌনে এগারটা।

সিঁড়ির মুখেই রেবতীর সঙ্গে প্রশান্ত বসাকের দেখা হয়ে গেল।

এবং রেবতীর কাছেই শুনলেন, এতক্ষণ সকলে ওর জন্য অপেক্ষা করে এই সবে খেতে বসেছেন।

রজতবাবুরাত আটটা নাগাদ ফিরে এসেছেন এবং আরও একটি সংবাদ পেলেন, সুন্দরলাল নামে এক ভদ্রলোক রায়পুর থেকে এসেছেন।

প্রশান্ত বসাক সোজা একেবারে খাবার ঘরেই এসে প্রবেশ করলেন। ঘরের মধ্যে টেবিলের সামনে বসে সবেমাত্র সকলে তখন আহার শুরু করেছেন।

ঘরের মধ্যে উপস্থিত চারটি প্রাণী-সুজাতা, রজত, পুরন্দর চৌধুরী ওঁদের তো চেনেনই প্রশান্ত বসাক, চেনেন না কেবল চতুর্থ ব্যক্তিকে। পরিধানে তাঁর সুট, মাথায় পাঞ্জাবীদের মত পাগড়ি এবং চোখে কালো লেন্সের চশমা। বুঝলেন, উনিই আগন্তুক সুন্দরলাল।

প্রশান্ত বসাকের পদশব্দে সকলেই মুখ ফিরিয়ে তাকালেন।

রজত ও সুজাতা পাশাপাশি একদিকে ও অন্যদিকে টেবিলের পাশাপাশি বসে পুরন্দর চৌধুরী ও সুন্দরলাল।

প্রশান্ত বসাক ঘরে প্রবেশের মুখেই লক্ষ্য করেছিলেন, রজত ও সুজাতা নিম্নকণ্ঠে পরস্পরের সঙ্গে কী যেন কথাবার্তা বলছে। আর সুন্দরলাল ও পুরন্দর চৌধুরী দুজনে কথাবার্তা বলছেন। ইন্সপেক্টারকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সর্বাগ্রে রজতই তাঁকে আহ্বান জানাল, আসুন মিঃ বসাক, আপনার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করে থেকে এইমাত্র আমরা সকলে বসলাম।

না না—তাতে কি হয়েছে, বেশ করেছেন। বলতে বলতে এগিয়ে এসে একটা খালি চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন প্রশান্ত বসাক, তারপর বললেন, দাহ হয়ে গেল।

হ্যাঁ। রেবতী এসে ইন্সপেক্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বললে, আপনার খাবার দিতে বলি? হ্যাঁ, বল। ওকে আপনি বোধ হয় চিনতে পারছেন না মিঃ বসাক? সুন্দরলালকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে প্রশ্ন করল রজত।

না। মানে—

সুন্দরলালই জবাব দিলেন ইংরাজীতে, My name is Sundarlal Jha।

সুস্পষ্ট শুদ্ধ উচ্চারণ। কোথাও এতটুকু জড়তা নেই, এবং গলাটা সরু ও মিষ্টি।

হ্যাঁ, রেবতীই বলছিল আপনার এখানে আসবার কথা এইমাত্র। তা আপনি—

বিনয়েন্দ্রবাবু আমার বিশেষ বন্ধু ছিলেন। আমি তাঁর সঙ্গেই দেখা করতে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে পৌঁছে এঁদের মুখে সব শুনে তো একেবারে তাজ্জব বনে গেছি ইন্সপেক্টার, how horrible, how absurd!

ইন্সপেক্টার কিন্তু কোন জবাব দেন না। তাঁর মনে পড়ে ঘণ্টাখানেক আগে কিরীটীর সেই কথাগুলো-pre-arranged, pre-meditative and a well planned murder!

সুন্দরলাল আবার বললেন, এতক্ষণ আমি চলেই যেতাম, কেবল আপনার সঙ্গে দেখা করব বলেই যাইনি। তাছাড়া ওঁরা বিশেষ করে বললেন ডিনারটা খেয়ে যেতে সে তো ভালই করেছেন, মৃদুকণ্ঠে ইন্সপেক্টার বলেন, তা উঠেছেন কোথায়?

কলকাতায়, তাজ হোটেলে।

আপনি যখন বিনয়েন্দ্রবাবুর বিশেষ পরিচিত তখন হয়তো তাঁর সম্পর্কে একটু খোঁজখবরও পাব আপনার কাছে। প্রশান্ত বসাক বললেন।

তাঁর সঙ্গে আলাপ আমার ইদানীং ঘনিষ্ঠ হলেও পরিচয় আমার তাঁর সঙ্গে একপক্ষে তাঁর থার্ড ইয়ারে ছাত্রজীবনে কয়েক মাস সহপাঠী হিসাবেই হয়। তারপর পড়া ছেড়ে দিয়ে আমার এক আত্মীয়ের কাছে নাগপুরে গিয়ে ব্যবসা শুরু করি। দীর্ঘকাল পরে আবার তাঁর সঙ্গে আমার দেখা এই কলকাতায়ই একটা বিজ্ঞান সভায়। তারপর বার দু-তিন নাগপুর থেকে কলকাতায় এলেই আমি এখানে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে যেতাম। সেদিক দিয়ে তাঁর পার্সোন্যাল ব্যাপারের বিশেষ তেমন কিছুই আমি জানি না। তাই সেরকম সাহায্য আপনাকে করতে পারব বলে তো আমার মনে হয় না, মিঃ বসাক।

আপনি বিনয়েন্দ্রবাবুর সহপাঠী যখন, তখন পুরন্দরবাবুর সঙ্গেও বোধহয় আপনার সেই সময়েই আলাপ মিঃ ঝা?

প্রশান্ত বসাকের আকস্মিক প্রশ্নে চকিতে সুন্দরলাল তাঁর পার্শ্বে উপবিষ্ট পুরন্দর চৌধুরীর দিকে একবার তাকালেন। তারপর মৃদু স্মিতকণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ, ওঁর সঙ্গেও আমার আলাপ আছে।

মিঃ বসাক সুন্দরলালের সঙ্গে এমনি ঘরোয়া সহজভরে কথাবার্তা বলতে বলতেই তীক্ষ্ণ সতর্ক দৃষ্টিতে সুন্দরলালকে দেখছিলেন।

বয়েস যাই হোক না কেন, সুন্দরলালকে কিন্তু পুরন্দর চৌধুরী ও বিনয়েন্দ্র রায়ের সহপাঠী হিসাবে যথেষ্ঠ কম বয়েসী বলেই মনে হচ্ছিল।

শুধু তাই নয়, মুখে যেন কেমন একটা রমনী-সুলভ কমনীয়তা,দাড়ি নিখুঁতভাবে কামানন, সরু গোঁফ।

দেহের গঠনটাও ভারী সুশ্রী–লম্বা, খুব রোগাও নয়, আবার মোটও নয়।

কাঁটা চামচের সাহায্যে আহার করছিলেন সুন্দরলাল, হাতের আঙুলগুলো লম্বা লম্বা সরু সরু।

ডান হাতের অনামিকায় ও মধ্যাঙ্গুষ্ঠে দুটি পাথর বসানো স্বর্ণ-অঙ্গুরীয়। একটি পাথর, প্রবাল। অন্যটি বোধ হয় হীরা।

ঘরের আলোয় আংটির হীরাটি ঝিলমিল করছিল।

টেবিলে বসে খেতে খেতেই নানাবিধ আলোচনা চলতে লাগল অতঃপর।

.

আহারাদির পর পুনরায় আগামী কাল আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সুন্দরলাল বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

রজত অসুস্থ ছিল, সেও শুতে গেল।

সুজাতার ঘুম আসছিল না বলে তিন তলার ছাতে বেড়াতে গেল।

কেবল একটা টর্চ ও লোডেড পিস্তল পকেটে নিয়ে প্রশান্ত বসাক বাড়ির পশ্চাতের বাগানে গিয়ে প্রবেশ করলেন।

চাঁদ উঠতে আজ অনেক দেরি। অন্ধকার আকাশে এক ঝাঁক তারা জ্বলজ্বল করছে।

দীর্ঘ দিনের অযত্নে বাগানের চারিদিকে প্রচুর আগাছা নির্বিবাদে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকার রাত্রি যেন চারিদিককার আগাছা ও জঙ্গলের মধ্যে লুকোচুরি খেলছে। প্রাচীরের সীমানা ঘেঁষে বড় বড় দুটি কনকচাঁপার গাছ। ডালে ডালে তার অজস্র বিকশিত পুষ্প-গন্ধ বাতাসে যেন ম-ম করছে।

পায়ে-চলা একটা অপ্রশস্ত পথ বাগানের মধ্যে দিয়ে বরাবর চলে গিয়েছে প্রাচীর সীমানার গেট পর্যন্ত, সেই পথটা ধরেই এগিয়ে চললেন প্রশান্ত বসাক।

.

২৯.

সুজাতা একাকী তিনতলার ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আজ যেন কোথায়ও হাওয়া এতটুকুও নেই। অসহ্য একটা গুমোট ভাব।

কালই সকালে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে মনস্থ করেছিল সুজাতা। এবং যাবার জন্য। গতকাল দ্বিপ্রহর পর্যন্ত তার মনের মধ্যে একটা আগ্রহও যেন তাকে তাড়না করছিল। কিন্তু এখন সে তাড়না যেন আর তত তীব্র নেই।

ছোট্রকার আকস্মিক মৃত্যুসংবাদে যে বিহ্বলতা এসেছিল সেটাও যেনকেমন থিতিয়ে এসেছে। নিজেকে কেমন যেন দুর্বল মনে হয়।

বিশেষ একখানি মুখ মনের মধ্যে যেন কেবলই ভেসে ভেসে ওঠে। মনে হয় সত্যিই তো, তাড়াতাড়ি লক্ষ্ণৌ ফিরে গিয়ে কি হবে! সেই তো দৈনন্দিনের রুটিন-বাঁধা একঘেয়ে শিক্ষয়িত্রীর জীবন।

একই বহুবার পঠিত বইয়ের পাতাগুলি একের পর এক উল্টে যাওয়া, একই কথা, একই লেখা, কোন বৈচিত্র্য নেই। কোন নূতনত্ব বা কোন আবিষ্কারের আনন্দ বা উত্তেজনা নেই।

সেই স্কুল, সেই বাসা।

বহু পরিচিত লক্ষ্ণৌ শহরের সেই রাস্তাঘাটগুলো।

সীমাবদ্ধ একটা গণ্ডির মধ্যে কেবলই চোখ-বাঁধা বলদের মত পাক খাওয়া।

এই জীবন তো সুজাতা কোনদিন চায়নি। কল্পনাও তো কখনো করেনি। সারাটা জীবন ধরে এমনি করেই সে রুক্ষ এক মরুভূমির মধ্যে ঘুরে ঘুরেই বেড়াবে!

সেও তো কতদিন স্বপ্ন দেখেছে, জীবনের পাত্রখানি তার একদিন সুধারসে কানায় কানায় ভরে উঠবে। জীবন-মাধুর্য পরিপূর্ণতায় উপচে পড়বে।

জীবনের ত্রিশটা বছর কোথা দিয়ে কেমন করে যে কেটে গেল!

কোথা থেকে এত মিষ্টি চাঁপা ফুলের গন্ধ আসছে! মনে পড়ল আজই সকালে জানলার ভিতর দিয়ে সে দেখেছে বাগানের প্রাচীর সীমানার ধার ঘেঁষে বড় বড় দুটি কনক চাঁপার গাছ অজস্র স্বর্ণ-ফুলে যেন ছেয়ে আছে। এ তারই গন্ধ।

এয়োদশীর ক্ষীণ চাঁদ দেখা দিল আকাশ-দিগন্তে। আবছা মৃদু কোমল আলোর একটি আভাস যেন চারিদিকে ছড়িয়ে গেল।

কত রাত হয়েছে, কে জানে!

সুজাতা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

শেষ সিঁড়িতে পা দিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই আপনার অজ্ঞাতেই যেন থমকে দাঁড়িয়ে যায় সুজাতা।

ও কি! ওটা কি!

চাঁদের আবছা আলোয় বারান্দায় দীর্ঘ শ্বেত বস্ত্রাবৃত ওটা কি!

ভয়ে আতঙ্কে স্থান কাল ভুলে আর্ত একটা চিৎকার করে উঠল সুজাতা এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সিঁড়ির শেষ ধাপের উপরে মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেল।

.

প্রশান্ত বসাকও তখন সবে মাত্র বাগান থেকে ফিরে দোতলায় ওঠবার প্রথম ধাপে পা দিয়েছেন। সুজাতার কণ্ঠনিঃসৃত আর্ত সেই তীক্ষ্ণ চিৎকারের শব্দটা তাঁর কানে যেতেই তিনি চমকে ওঠেন এবং সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পান যেন একটা দুত পদধ্বনি উপরের বারান্দায় মিলিয়ে গেল। এক মুহূর্তও আর দেরি করলেন না প্রশান্ত বসাক।

প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে দু-তিনটা সিঁড়ি এক একবারে অতিক্রম করে ছুটলেন উপরের দিকে।

বারান্দায় এসে যখন পৌঁছলেন, দেখলেন পুরন্দর চৌধুরীও ইতিমধ্যে তাঁর ঘর থেকে বের হয়ে এসেছেন।

কি! কি ব্যাপার! কে যেন চিৎকার করল! পুরন্দর চৌধুরী সামনেই প্রশান্ত বসাককে দেখে প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ, আমিও শুনেছি সে চিৎকার। বলতে বলতেই হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল তিনতলার ছাতে ওঠবার সিঁড়িটার মুখেই কী যেন একটা পড়ে আছে।

ছুটেই একপ্রকার সিঁড়ির কাছে পৌঁছে প্রশান্ত যেন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। সেই ক্ষীণ চন্দ্রালোকেও সুজাতাকে চিনতে তাঁর কষ্ট হয় না।

পুরন্দর চৌধুরীও প্রশান্ত বসাকের পিছনে এসে গিয়েছিলেন এবং তিনিও সুজাতাকে চিনতে পেরেছিলেন। বিস্মিতকণ্ঠে তিনি বললেন, এ কি, সুজাতাদেবী এখানে পড়ে!

প্রশান্ত বসাক ততক্ষণে সুজাতার জ্ঞানহীন দেহটা পরম স্নেহে দু হাতে তুলে নিয়েছেন। সুজাতার ঘরের দিকে এগুতে এগুতে বললেন, ছাতের সিঁড়ির দরজাটায় শিকল তুলে দিন তো মিঃ চৌধুরী।

সুজাতার ঘরে প্রবেশ করে তার শয্যার.ওপরেই ধীরে ধীরে শুইয়ে দিলেন সুজাতাকে।

চোখে মুখে জলের ছিটে দিতেই সুজাতার লুপ্ত জ্ঞান ফিরে এল।

চোখ মেলে তাকল সে।

সুজাতাদেবী!

কে?

আমি প্রশান্ত, সুজাতাদেবী।

আমি—

একটু চুপ করে থাকুন।

কিন্তু সুজাতা চুপ করে থাকে না। বলে, এ বাড়িতে নিশ্চয়ই ভূত আছে প্রশান্তবাবু।

ভূত!

হ্যাঁ। স্পষ্ট বারান্দায় আমি হেঁটে বেড়াতে দেখেছি।

ইতিমধ্যে পুরন্দর চৌধুরী রজতকে ডেকে তুলেছিলেন। রজতও এসে কক্ষে প্রবেশ করে বলে, ব্যাপার কি, কি হয়েছে সুজাতা?

প্রশান্ত বসাক আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কী ঠিক দেখেছেন বলুন তো সুজাতা দেবী?

সাদা চাদরে সর্বাঙ্গ ঢাকা একটা মৃর্তি বারান্দায় হেঁটে বেড়াচ্ছিল। আমাকে দেখেই ছুটে সেই মূর্তিটা যেন ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল।

প্রশান্ত বসাককে মনে হল যেন অত্যন্ত চিন্তিত।

রজত আবার কথা বলে, তাহলে রেবতী যে ছায়ামূর্তির কথা এ বাড়িতে মধ্যে মধ্যে রাত্রে দেখা দেয় বলেছিল তা দেখছি মিথ্যা নয়।

ছায়ামূর্তি? সে আবার কি? পুরন্দর চৌধুরী প্রশ্ন করলেন রজতকে।

হ্যাঁ, আপনি শোনেননি?

কই, না তো।

যাকগে সে কথা। রজতবাবু, এ ঘরে আপনি ততক্ষণ একটু বসুন, আমি আসছি।

কথাটা বলে হঠাৎ যেন প্রশান্ত বসাক ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

.

৩০.

প্রশান্ত বসাক সুজাতার ঘর থেকে বের হয়ে সোজা ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করে সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বালালেন।

কিরীটীর কথাটাই তাঁর ঐ মুহূর্তে নতুন করে মনে পড়েছিল, সে বলেছিল ল্যাবরেটারী ঘরটা আর একবার ভাল করে দেখতে।

শূন্য ঘর। কোথাও কিছু নেই।

তবু সমস্ত ল্যাবরেটারী ঘর ও তৎসংলগ্ন বিনয়েন্দ্রর শূন্য শয়ন ঘরটা তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন।

কিন্তু কোথায়ও কিছু নেই। আবার ল্যাবরেটরী ঘরে ফিরে এলেন।

হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল ল্যাবরেটরীর মধ্যস্থিত বাথরুমের দরজাটা হাঁ হাঁ করছে খোলা।

এগিয়ে গেলেন প্রশান্ত বসাক বাথরুমের দিকে।

কিন্তু বাথরুমের দরজাপথে প্রবেশ করতে গিয়েই যেন দরজার সামনে থমকে দাঁড়ালেন। দরজার সামনে কতকগুলো অস্পষ্ট জলসিক্ত পায়ের ছাপ। ছাপগুলো বাথরুম থেকে এসে যেন ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে। খালি পায়ের ছাপ। বাথরুমের খোলা দরজাপথে প্রশান্ত বসাক ভিতরে উঁকি দিলেন, বাথরুমের মেঝেতে জল জমে আছে, বুঝলেন ঐ জল লেগেই পায়ের ছাপ ফেলেছে এ ঘরে।

প্রশান্ত বসাক এবারে বাথরুমের মধ্যে প্রবেশ করলেন।

বাথরুমে একটি মাত্রই কাঁচের জানালা। ঠিক ল্যাবরেটরী ঘরেরই জানলার অনুরূপ।

লোহার-ফ্রেমে ঘষা কাচ বসানো একটি মাত্রই পাল্লা। এবং সেই পাল্লাটি ঠিক মধ্যস্থলে একটি ফালক্রেমের সাহায্যে দড়ি দিয়ে ওঠা নামা করা যায়।

প্রশান্ত বসাক বাথরুমের মধ্যে ঢুকে দেখলেন, জানলার পাল্লাটি ওঠানো।

হস্তধৃত টর্চের আলোর সাহায্যে বাথরুমের আলোর সুইচটা খুঁজে নিয়ে আলোটা জ্বালালেন মিঃ বসাক।

বাথরুমটা আলোয় ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখতে গিয়ে প্রশান্তর মনে হল ঘরের সংলগ্ন ঐ বাথরুমটি যেন বরাবর ছিল না। পরে তৈরি করে নেওয়া হয়েছে। অথবা এমনও হতে পারে ঐ বড় হলঘরটির সংলগ্ন এই ছোট ঘরটি পূর্বে অন্য কোন ব্যাপারে ব্যবহার করা হত, বিনয়েন্দ্র পরে সেটিকে নিজের সুবিধার জন্য বাথরুমে পরিণত করে নিয়েছিলেন।

প্রশান্তর বুঝতে কষ্ট হয় না, বাথরুমের ঐ জানলাপথেই কেউ এ ঘরে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু কি ভাবে এল জানলাপথে!

কাঁচের জানলার পাল্লাটার তলা দিয়ে উঁকি দিলেন। নীলকুঠির পশ্চাতের বাগানের খানিকটা অংশ চোখে পড়ল।

আরও একটু ঝুঁকে পড়ে ভাল করে পরীক্ষা করতে গিয়ে চোখে পড়ল জানলার ঠিক নীচেই চওড়া কার্নিশ।

সেই কার্নিশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায় বটে, তবে সেটা বেশ বিপদসঙ্কুল এবং শুধু তাই নয় সাহসেরও প্রয়োজন।

আবার ঘরের মেঝেতে জলসিক্ত সেই অস্পষ্ট পদচিহ্নগুলো পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন—যদি কোন বিশেষত্ব থাকে পদচিহ্নগুলোর মধ্যে। কিন্তু তেমন কোন উল্লেখযোেগ্য বিশেষত্বই চোখে পড়ল না প্রশান্ত বসাকের।

বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে একসময় ফিরে এলেন ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যে প্রশান্ত বসাক।

পূর্বোক্ত ঘরে প্রশান্ত বসাক যখন ফিরে এলেন, রজত সুজাতার পাশে বসে আছে আর জানলার কাছে দাঁড়িয়ে লম্বা সেই বিচিত্র পাইপটায় নিঃশব্দে ধূমপান করছেন পুরন্দর চৌধুরী। সুজাতার জ্ঞান ফিরে এসেছে।

একটা কটু তীব্র তামাকের গন্ধ ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।

প্রশান্তর পদশব্দে ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই যুগপৎ চোখ তুলে দরজার দিকে তাকাল। পুরন্দর চৌধুরীই প্রথমে কথা বললেন, Anything wrong ইন্সপেক্টার?

না কিছুই দেখতে পেলাম না।

আমার মনে হয় হঠাৎ উনি কোনরকম ছায়া-টায়া দেখে হয়তো–

পুরন্দর চৌধুরীর কথাটা শেষ হল না। জবাব দিল সুজাতাই, কোন রকম ছায়া যে সেটা নয় সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত মিঃ চৌধুরী। হঠাৎ দেখে আচমকা আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম বটে সত্যি, তবে সে দেখার মধ্যে কোন রকম আমার ভুল হয়নি।

কিন্তু তাই যদি হবে, তবে এত তাড়াতাড়ি সেটা উধাও হয়ই বা কি করে দোতলা থেকে? কথাটা বললে রজত।

কিন্তু সেটাই তো আমার না দেখার বা কিছু একটা ভুল দেখবার একমাত্র যুক্তি নয় রজতদা। জবাবে বলে সুজাতা।

না। উনি ভুল দেখেননি রজতবাবু। কথাটা বললেন এবারে প্রশান্ত। এবং তাঁর কথায় ও তাঁর গলার স্বরে পুরন্দর চৌধুরী ও রজত দুজনেই যেন যুগপৎ চমকে প্রশান্তর মুখের দিকে তাকাল।

সত্যি বলছেন আপনি মিঃ বসাক? কথাটা বলে রজত।

হ্যাঁ রজতবাবু, আমি সত্যিই বলছি। কিন্তু রাত প্রায় পৌনে দুটো বাজে, বাকি রাতটুকু আপনারা সকলেই ঘুমবার চেষ্টা করুন, আমিও এবারে শুতে যাব, ঘুমে আমার দু চোখ ভেঙে আসছে।

সমস্ত আলোচনাটার উপরে যেন অকস্মাৎ একটা দাঁড়ি টেনে প্রশান্ত বসাক বোধ হয় ঘর ত্যাগ করে নিজের ঘরে শুতে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। এবং কক্ষ ত্যাগের পূর্বে সুজাতাকে লক্ষ্য করে বললেন, ঘরের দরজায় খিল তুলে দিয়ে শোবেন মিস রয়।

কথাটা শেষ করেই আর মুহূর্তমাত্রও দাঁড়ালেন না ইন্সপেক্টার, নিঃশব্দে কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

অতঃপর রজত ও পুরন্দর চৌধুরীও যে যার ঘরে শুতে যাবার জন্য পা বাড়াল।

.

প্রশান্ত নিজের নির্দিষ্ট ঘরে প্রবেশ করে দরজাটা কেবল ভেজিয়ে দিলেন।

ঘুমের কথা বলে আলোচনার সমাপ্তি করে বিদায় নিয়ে এলেও ঘুম কিন্তু প্রশান্ত বসারে দুচোখের কোথাও তখন ছিল না।

তিনি কেবল নিজের মনে মনে সমস্ত ব্যাপারটা আগাগোড়া আর একবার ভাল করে ভেবে দেখতে চান।

বাথরুমের মেঝেতে, জলসিক্ত পদচিহ্নগুলো সত্যিই তাঁকে বিশেষভাবেই যেন বিচলিত করে তুলেছিল। আর কিছুনা হোক পদচিহ্নগুলো সুস্পষ্টভাবে একটা জিনিস প্রমাণিত করছে, ওই রাত্রে কিছুক্ষণ আগে কোন তৃতীয় ব্যক্তিবিশেষের আবির্ভাব ওই নীলকুঠীতে ঘটেছিল নিঃসন্দেহে। কোন ছায়ার মায়া নয়। এবং লছমনের মুখে শোনা সেই ভৌতিক আবির্ভাবের সঙ্গে যে আজকের রাত্রে সুজাতাদেবীর দৈখা ছায়ামূর্তির বিশেষ এক যোগাযোগ আছে সে বিষয়েও তাঁর যেন কোনই আর সন্দেহ বা দ্বিমত থাকছে না।

আর এও বোঝা যাচ্ছে ভৌতিক ব্যাপারটা এ বাড়িতে পূর্বে যারা দেখেছে তাদের সে দেখাটাও যেমন মিথ্যা নয়, তেমনি ব্যাপারটাও সত্যি সত্যিই কিছু আসলে ভৌতিক নয়।

লছমনের মুখ থেকেই তার জবানবন্দিতে শোনা গেছে রামচরণ বিনয়েন্দ্র এবং লছমন নিজেও পূর্বে এ বাড়িতে রাত্রে ওই ছায়ামূর্তি নাকি দেখেছে। অর্থাৎ ব্যাপারটা চলে আসছে বেশ কিছুদিন ধরে। এবং ছায়ামূর্তির ভৌতিক মুখোসের অন্তরালে যখন সত্যিকারের একটা জলজ্যান্ত মানুষ আছে তখন ওর পশ্চাতে কোন রহস্য যে আছে সেও সুনিশ্চিত।

আগের পর্ব :

০১-০৫. রজত আর সুজাতা
০৬-১০. রামচরণ মাত্র আঠারো বছর বয়সে
১১-১৫. সমস্ত ঘটনাটা সংক্ষেপে বর্ণনা
১৬-২০. পুরন্দর চৌধুরী আবার বলতে লাগলেন
২১-২৫. গত রাত্রে নীচের তলায়

পরের পর্ব :
৩১-৩৫. নীলকুঠির আশেপাশে
৩৬-৪২. থানা-ইনচার্জ রামানন্দ সেন

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত