০২. সুশান্ত হাঁটতে হাঁটতে এসে লেকে ঢুকল
সুশান্ত হাঁটতে হাঁটতে এসে লেকে ঢুকল। এখন আর লেকে অত মানুষজনের ভিড় নেই, জলের ধার ঘেঁয়ে গাছতলার নীচে অন্ধকার একটা বেঞ্চে বসল সুশান্ত।
বুকের ভেতরটা আজ এত বছর পরে যেন কি এক জ্বালায় জ্বলে যাচ্ছে। নিরুপায়। আক্রোশে যেন নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতে চায়।
এত বড় লজ্জাটা সে বহন করছে এই সাত বছর ধরে, হ্যাঁ, সাত বছরই হবে— বালিগঞ্জের হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে আসার আগে যখন তারা হেদুয়ার কাছে একটা গলিতে ছোট দোতলা একটা বাড়ির একতলায় থাকত, তখন থেকেই তো মালঞ্চর অফিসের ম্যানেজার সুরজিৎ ঘোষাল সেখানে যাতায়াত শুরু করেছিল।
মালঞ্চ সুরজিৎ ঘোষালের অফিসে তার পার্সোন্যাল স্টেনো টাইপিস্ট ছিল। সেখান থেকেই দুজনের আলাপ।
বালিগঞ্জের বাড়িতে উঠে আসবার মাস দুই আগেই মালঞ্চ চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল। না, বাধা দেয়নি সুশান্ত। সুরজিৎ ঘোষাল এলেই সে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেত। আর বাধা দিয়েই বা সে কি করত, মালঞ্চ কি শুনত তার কথা।
স্বামী স্ত্রী, সুশান্ত আর মালঞ্চ দুজনেই দুটো অফিসে চাকরি করত, হঠাৎ কেন যেন চাকরিটা ছেড়ে দিল সুশান্ত। মালঞ্চ প্রথমটায় বুঝতে পারেনি যে তার স্বামী চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।
আর বুঝবেই বা কি করে, সুশান্তর সঙ্গে তখন তার সম্পর্কই বা কতটুকু। সুরজিৎ ঘোষালের অনুগ্রহে তখন তার নিত্য নতুন দামী দামী শাড়ি আসছে, দু-একটা অলংকারও সেই সঙ্গে গায়ে শোভা পেতে শুরু করেছে।
সুশান্ত নীরেট বোকা, তাই প্রথমটায় ধরতে পারেনি, ধরতে পেরেছিল অনেক দেরিতে, যখন সুরজিৎ ঘোষাল তাদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছিল, তার আগে মধ্যে মধ্যে অফিস থেকে তার ফিরতে দেরি হলে মালঞ্চ সুশান্তকে বলেছে, অফিসে কাজের চাপ।
নীরেট বোকা সুশান্ত সরল মনেই কথাটা বিশ্বাস করেছে। চোখ থেকে পর্দাটা সরে যাওয়া পর্যন্ত তাদের অন্তরঙ্গতা বুঝতে পারেনি, কিন্তু যখন বুঝল তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
প্রচণ্ড ঝগড়া হয়ে গেল একদিন।
—মালা, আমি অন্ধ নই, বলেছিল সুশান্ত।
—অন্ধ হবার তো কোন প্রয়োজন নেই, আর দুজোড়া চোখ থাকতে অন্ধ হতে যাবেই বা কেন-বলেছিল মালা।
—তুমি তাহলে সুরজিৎ ঘোষালের রক্ষিতা হয়েই থাকতে চাও?
মালঞ্চ বোধহয় বুঝতে পারেনি কথাটা অমন স্পষ্টাস্পষ্টি ভাবে সুশান্ত উচ্চারণ করতে পারে। মুহূর্তের জন্য সে স্তব্ধ হয়ে থাকে, তারপর বলে, সুরজিৎকে আমি ভক্তি করি।
–তাই নাকি! তাহলে তোমার আজ প্রয়োজন ডিভোর্সের—কিন্তু শুনে রাখ মালঞ্চ-তা আমি হতে দেবো না।
–বাধা দিতে পারবে?
–দেবো, আর আমি দেখব আমার এ বাড়িতে যেন সে আর না আসে–।
—তোমার বাড়ি! কিন্তু গত সাত মাস ধরে এ বাড়ির ভাড়া কে দিয়েছে জানো—ঐ সুরজিৎ ঘোষালই।
–মালা!
-হ্যাঁ, আমারও স্পষ্ট কথা শোন, তোমার অসুবিধা হলে তুমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারো।
কথাটা শুনে সুশান্ত যেন কিছুক্ষণ পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর বলে, কি বললে?
-বললাম তো তোমার এখানে না পোষালে তুমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারো।
–আর যদি না যাই?
—তাহলে বুঝব লজ্জা ঘেন্না বলে কিছুই তোমার নেই—
—তোমাকে আমি খুন করব—বেশ্যা—চরিত্রহীন—
অতঃপর মালঞ্চ শান্ত গলায় বলেছিল, Dont shout! আজ পর্যন্ত কি দিয়েছ তুমি আমায়—আমাদের বিয়ে হয়েছে আজ চার বছর, কটা শাড়ি গয়না দিয়েছ বলতে পারো? একটা অন্ধকার গলির মধ্যে এই একতলার স্যাতসেতে ঘরে মানুষ কোন দিন সুস্থ থাকতে পারে? এরই নাম জীবনধারণ! ভুলে যেও না, আমি চাকরি না করলে তোমার ঐ দুশো টাকায় আজকের দিনে দুবেলা পেট ভরে খাওয়াই জুটত না। শোন, গোলমাল চেঁচামেচি করো না, তোমার প্রাপ্য থেকেও তোমাকে আমি বঞ্চিত করছি না, তবে এত বড় সুযোগটা যখন হাতে এসেছে ছেড়ে দেব কেন?
কি হল সুশান্তর, তারপর আর একটি কথাও সে বলতে পারেনি। অফিস যাওয়া তার বন্ধ হয়ে গেল অতঃপর, কেবল রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগল। কেটে গেল আরো দুমাস—
একদিন মালঞ্চ বললে, সুরজিৎ বালিগঞ্জে আমাকে একটা বাড়ি করে দিয়েছে, সামনের মাসে আমরা সেখানে উঠে যাব।
সুশান্তর চাকরিটি তখন আর নেই, সে কেবল স্ত্রীর মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
মালঞ্চ উঠে এল একদিন বালিগঞ্জের হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে। আর আশ্চর্য, সুশান্তও সেই বাড়িতে এসে উঠল। মালঞ্চর সঙ্গে মদ্যপান করে করে সুশান্ত তখন যেন কেমন ভোঁতা হয়ে গিয়েছে।
দোতলায় ঘর থাকা সত্ত্বেও নীচের তলারই একটা ঘরে থাকবার ব্যবস্থা করে নিল। সে। মালঞ্চ বলেছিল, নীচে কেন, ওপরের তলায় ঘর রয়েছে আরও। সুশান্ত মল্লিক কোন জবাব দেয়নি। মদ্যপানের মাত্রা বেড়ে গেল সুশান্তর, আর সে মদের খরচা মালঞ্চই দিত।
অন্ধকার বেঞ্চের ওপরে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হল সে খুন করবে মালঞ্চকে, কিন্তু কেমন করে খুন করবে? কেন, বিষ দেবে সে। বিষ!
বি. এস.সিতে কেমিস্ট্রিতে অনার্স ছিল তার, অনেক ইনরগ্যানিক মেটালের নাম জানে সে, যার সামান্য ডোজই মৃত্যু আনে। মালঞ্চর আর বাঁচা চলে না, তাকে মরতেই হবে। ভদ্র গৃহস্থ ঘরের বধূ আজ এক বারবধূর রূপ নিয়েছে। হ্যাঁ, ওর মরাই উচিত। মালঞ্চকে মরতেই হবে, মাথার মধ্যে সুশান্তর আগুন জ্বলতে থাকে।
সে রাত্রে জানতেও পারেনি মালঞ্চ, সুশান্ত বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। জানতে পারল পরের দিন বেলা দশটা নাগাদ, যখন রতন এসে খবর দিল, মা, নীচের বাবু সেই যে কাল সন্ধ্যার পর বের হয়ে গেছেন আর ফিরে আসেননি—
সেদিনও এল না, পরের দিন রাত্রেও ফিরে এল না সুশান্ত। মালঞ্চ সত্যিই এবার যেন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে, মানুষটা গেল কোথায়? চাকরিবাকরি করে না, হাতে পয়সা নেই, মাথা গোঁজবারও যে কোন ঠাঁই নেই তা সে ভাল করেই জানে, তবে গেল কোথায় মানুষটা? সত্যি সত্যিই তবে এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেল নাকি!
স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে দীর্ঘদিন আগেই চিড় ধরেছিল যেদিন থেকে মালঞ্চ সুরজিতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে—তথাপি সুশান্ত যেমন লজ্জা ও অপমান সহ্য করেও ঐ গৃহেই পড়েছিল তেমনি মালঞ্চবও রীতিমত একটা দুর্বল ছিল তার স্বামীর প্রতি। শুধু দুর্বলতা কেন, মালঞ্চর মনের মধ্যে বোধহয় কিছুটা মন ৩ : ছিল ঐ মানুষটার জন্য।
মালঞ্চ ভাবে এর আগেও তো সে মানুষটাকে কত রূঢ় কথা বলেছে, কিন্তু কখনও তো বাড়ি ছেড়ে চলে যায়নি সে, বরং পরের দিন সন্ধ্যাতেই আবার এসে তার কাছে হাত পেতেছে। অথচ সে রাত্রে টাকাও নিল না, তার ওপর ঘর থাকে বের হয়ে গেল।
জানালার সামনে দাঁড়িয়ে পথের দিকে চেয়ে থেকে মালঞ্চ শূন্য দৃষ্টি মেলে। হঠাৎ মালাটার দিকে নজর পড়ল মালঞ্চর, যে মালাটা সুশান্ত দুদিন আগে রেখে গিয়েছে। মালা দুটো মালঞ্চ স্পর্শও করেনি, মনেও ছিল না তার মালা দুটোর কথা। মালঞ্চ পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ছোট টেবিলটার দিকে—মালা দুটো এখনও পড়ে আছে, কিন্তু শুকিয়ে গিয়েছে।
ঘরের ব্র্যাকেটের ওপর রক্ষিত টেলিফোন বেজে উঠল ক্রিং ক্রিং করে। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে মালঞ্চ ফোনের রিসিভারটা তুলে নিল। ওপাশ থেকে আওয়াজ ভেসে এলো পুরুষ কণ্ঠে, হ্যালো
-কে?
—মালঞ্চ? আমি দীপ্তেন।
—বল।
—তুমি কোথাও বেরুচ্ছ নাকি?
–না।
—তাহলে আমি আসছি, বুঝলে, এখুনি আসছি—
মালঞ্চ কোন সাড়া দিল না। অন্য প্রান্তে ফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ হল—মালঞ্চ ফোনটা নামিয়ে রাখল।
অলস ভাবেই তাকাল দেওয়াল-ঘড়িটার দিকে। সবে পৌনে সাতটা। বাইরে সন্ধ্যার ঘোর নেমেছে। সুরজিৎ এখন আসবে না, আজ দুদিন ধরেই মালঞ্চ লক্ষ্য করছে সুরজিতের আসতে সেই নটা সোয়া নটা বাজছে।
সব বুঝেই মালঞ্চ দীপ্তেনকে আসতে মানা করল না।