রাত প্রায় ১০টা বাজে তখন শুয়ে শুয়ে ফেসবুকে নিত্তিয়ার সাথে কথা বলছি। তখন নিহানের ফোন আসলো। তাই ফোনটা রিসিভ করলাম। হতে পারে কোন ঝামেলায় পড়ছে।
— হুমম নিহান বল।
— কিরে রাজ কই তুই?
— এই তো বাসায়।
— তুই কি বাচ্চা। এই মাত্র ১০টা বাজে বাসায় বসে আছিস। চল এলাকার মোড়ে বসে সবাই আড্ডা দেই। তাছাড়া সাথে বাইক আছে। তোরে বাসায় দিয়েই আসবো।
— ওকে তোরা থাক আমি ১০ মিনিটের মাঝেই আসছি। ফোনটা রেখে নিত্তিয়াকে বায় দিয়ে জ্যাকেট টা গায়ে দিয়ে বেড়িয়ে পরলাম। দিন দিন শীতের প্রকোপ যেন বাড়ছেই। বাসা থেকে বের হতে যাবো তখনই মা ডাক দিলো।
— কিরে রাজ এতো রাতে কোথায় যাচ্ছিস?
— এই তো সামনে।
— কোথায় যাচ্ছিস ঠিক মত নামটা বলে যা।
— আরে জানি না। আর এতো প্রশ্ন করবে না। সারা দিন শুধু কানের সামনে ঘ্যান ঘ্যান করো।
— দেখ এখনই তোর বাবা বাসায় চলে আসবে। আর বাসায় এসে তোরে না দেখতে পেলে তোরে তো বকবেই সাথে আমায়ও বকবে।
— যাও তো এত্তো কথা বলো না।
— দেখ যাস না।
মায়ের কথায় কান না দিয়ে বেড়িয়ে পরলাম। সারাটা দিন শুধু বকবক করে। এখন অনার্সে পরি, এখনো আমার ইচ্ছা মত চলা ফেরার সময় হয় নি। ছোট থেকেই ওদের কথা মত চলে আসছি। আর চলতে পারবো না, এবার একটু নিজের মত জীবন কাটাবো।
এলাকার মোড়ে চলে আসলাম। নিহান আর সবার সাথে বাইকে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। ব্যস্ত শহরটাও এখন অনেকটা শান্ত হয়ে আছে। আমি নিহানের থেকে সিগারেট টা নিয়ে টান দিলাম। শরীরটা গরম করার জন্য। ইশশ কত্তোটা যে শান্তি লাগছে। তখনই মোড়ের মাঝে একটা অটু এসে থামলো। আর এর থেকে একটা মেয়ে বার হলো। নিহান জোরেই মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে একটা কথা বললো আর আমরা সবাই হাসতে লাগলাম। তখনই অটু থেকে আমার বাবা বেড়িয়ে আসলো। ওনি আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর আমি সিগারেট টা লুকানোর মিথ্যা চেষ্টা করছি।ওনি আমায় কিছু না বলেই চলে গেল। আমি আর লেট না করে সবার থেকে বিদায় নিতে যাবো তখনই নিহান বলল…
— কিরে মাত্র তো আসলি আধা ঘন্টাও হবে না আর এখনি চলে যাচ্ছিস।
— আসলে বাবা আমায় সিগারেট খাওয়া অবস্থায় দেখে নিছে।
— তুই কি তোর বাপের টাকায় সিগারেট খাইছিস?আমরা তোকে খাওয়াইছি এখানে তোর বাপ তোরে কেন কিছু বলবে?
— তবু আজ যাই রে। কাল আসবো নে।
— হুমম সময় মত চলে আসিস। নয়ত চল তোরে বাইকে করে নামিয়ে দিয়ে যাই।
— না আমি যেতে পারবো।
সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। দরজার সামনে আসতেই বাবার গলার আওয়াজ পাচ্ছি।ওনি মাকে বকতেছে। বাবাকে একটু ভয় পাই তাই রুমে ডুকতে ভয় করছে। তবুও সাহস করে দরজা খুলে ঘরে আসলাম। রুমে আসতেই বাবা আমার সামনে আসলো আর মা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
— দেখো তোমার নবাব পুত্র এসেছে। কিরে তোর রাস্তা পাহারা দেওয়া শেষ হইছে।
— ( আমি চুপ করে রইলাম)
— রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়েদের নিয়ে অসভ্যতামী করে আসছিস না। আর সিগারেট খাওয়াও শিখে গেছিস। আরে তোর বাপও তো এখনো সিগারেট খায় নি। বড় হয়ে গেছে।
— আমি তো নিজের টাকায় সিগারেট খাই নি।
— কী বললি? কথাটা আবার বল তো।
— ( আমি চুপ হয়ে গেলাম)
— এখন কথা বলছিস না কেন? যা খেয়ে গিয়ে আমাদের মুক্তি দে। তোরে তো আর তোর বন্ধুরা খাবার দিবো না। এইসবই খাইতে দিবো।
আমি আর না দাঁড়িয়ে আমার রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম। বাইরে থেকে মা ডাকতে লাগলো কিন্তু আমি কোন উত্তর দেই নি। আর বাবার উপরও অনেক রাগ উঠছে। এইটুকুর জন্যই কেউ বকে। রাতে কখন যে ঘুমিয়ে ছিলাম মনে পরছে না। ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি ৯টার উপর বাজে। বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে রুমের দরজা খুলে বাইরে আসলাম। বাবা টেবিলে বসে পেপার পরছে আর মা রান্না ঘরে। আমাকে দেখে বাবা ডাক দিলো। আসলে বাবা আমার উপর রেগে গেলে তুই করে বলে আর রাগটা কমে গেছে তুমি করে বলে।
— খালি পেটে ঘুমটা ঠিক মত হইছে তো।
— ( চুপ)
— টেবিলে বসো। আমি চুপচাপ ওনার সামনের চেয়ার টায় বসলাম।
— বাবারে আমরা মধ্যবৃত্ত পরিবারের মানুষ। আমাদের এইসব করাটা মানায় না।
ধরো রাতে তোমাদেরকে সবাই পুলিশে ধরলো তখন ওদের বাবা টাকা দিয়ে পুলিশের মুখটা বন্ধ করে দিবে কিন্তু আমি কি করবো? আর মধ্যবৃত্তদের কিছু না থাকলেও সম্মান আছে। আমি চাই না আমার ছেলে হয়ে তুই আমার সম্মানটা নষ্ট করে দে। আর সিগারেট খাওয়াটা বাবা ভাল না রে। এতে জীবনটাকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আর মেয়েদের কে কখনো খারাপ উক্তি করতে নেই কারন তারা মায়ের জাত। মনে রাখো তুমি যদি কোন মেয়েকে সম্মান দিতে পারো তাহলে তোমার ঘরের মেয়েরাও বাইরে সম্মান পাবে। আর আমার কথায় অনেক রাগ হয়ে ছিল তাই না।
— হুমম।
— রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। তাই বলে তুমি রাতে না খেয়ে থাকবে। না হয় তোমার বাবা একটু বকেছে তাই বলে খাবার তো কোন দোষ করে নি।
— সরি।
— ঠিক আছে, তুমি যে রাতে খাও নি এর জন্য তোমার বাবা মা কেউ কিন্তু খায় নি।
কথাটা আমার খুব খারাপ লাগলো। আমি বাবার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাচ্ছি না। যার হাত ধরে হাঁটতে শিখেছি গতকাল তার মুখের উপর আমি কথা বলে ছিলাম। তখন বাবা আবার বলল…..
— এখন সব কথা ভুলে খাওয়া দাওয়া শেষ করে নাও তো।
— হুমম
আর কথা না বলে খাওয়া দাওয়া শেষ করে কলেজে চলে আসলাম। কলেজে আসতেই দেখি নিত্তিয়া নিহানের বাইকে বসে কথা বলছে। একটু পর পর নিহানের গায়ে হাত রাখছে আর নিহানও সেই সুযোগটা নিচ্ছে। আমি প্রথমে ভাবলাম ওদের সামনে যাবো না কিন্তু তবুও বন্ধু হিসেবে সামনে গেলাম। আমাকে দেখে নিত্তিয়া বাইক থেকে নামলো। আর বলল…
— আরে রাজ তোমায় এতো মন মরা লাগছে কেন? কোন সমস্যা?
— না তেমন কিছু না।
— ছেলে হয়ত কাল রাতে নিজের বাবার হাতে উত্তম মধ্যম খেয়েছে। ( রাকিব বলে উঠলো)
কেন জানি খুব রাগ উঠলো? আমি রাকিবকে ঘুষি মেরে দেই। তখন রাকিবও আমায় মারতে শুরু করে। তবে অবাক হওয়ার বিষয় হলো কেউ আমাদের থামাচ্ছে না। এক পর্যায় নিহান এসে আমাদের থামালো। আর নিত্তিয়া একটা আওয়াজও করলো না। এমন মনে হচ্ছে সবাই বিনা পয়সায় বিনোদন নিচ্ছে। আমি আর না দাঁড়িয়ে নিজের ক্লাস রুমে চলে গেলাম। চুপচাপ ক্লাসে বসে রইলাম। চিৎকার দিয়ে কান্না করতে ইচ্ছা করছে কিন্তু তাও করতে পারছি না। এরপর কয়েক দিন কেউ আমার কোনো খুঁজ নেয় নি। নিত্তিয়াকে ফোন দিলেও নিত্তিয়া ফোন রিসিভ করে না আর রাতে ওয়েটিং পাই। আস্তে আস্তে আমি যেন একা হতে থাকি। সবাই যেন দূরে সরে যেতে থাকে। কয়েকদিন পর রাতে রুমে শুয়ে গল্প পড় ছিলাম।তখন নিহানের ফোন আসে। এতদিন খুজঁ নেয় নি বলে হয়ত নিহানের খারাপ লাগছে তাই আমাকে ফোন দিছে।
— হুমম নিহান বল।
— দোস্ত তুই কই?
— বাসায়।
— আরে বোকা বন্ধুদের মাঝে ঝগড়া তো হয়ই। তাই বলে কি মন খারাপ করে কেউ কারো সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়।
— কি হইছে এটা বল?
— রাকিব তোর কাছে মাফ চাইবে তুই এলাকার মোড়ে চলে আয়।
— কিন্তু বাবা?
— আরে বেশি সময় লাগবে না বরং ৩০ মিনিট লাগবে।
— আচ্ছা আসছি।
আমি চুপি চুপি বাসা থেকে বেড়িয়ে যাই। এখনো বাবা বাসায় আসে নি। ওনি আসার আগে আমাকে চলে আসতে হবে। আমি সবার সামনে যেতেই রাকিব আমার সামনে আসলো। সবাই কোকা কলা খাচ্ছে। আমার দিকে রাকিব একটা কোকা কলার বোতল বাড়িয়ে দিলো।
— রাজ দোস্ত বন্ধুদের মাঝে তো ঝগড়া হয়ই। তাই বলে তুই আমাদের এতোটা পর করে দিবি। সরি।
— ঠিক আছে (বোতালটা ওর হাত থেকে নিয়ে)
সবার সাথে কথা বলতে বলতে আমিও খেতে লাগলাম। একটু পরই আমার কেমন যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। যেন এখনই মাটিতে পড়ে ঘুমিয়ে পরবো। হঠাৎ ঘুম ঘুম চোখের সামনে রাকিবকে আবিষ্কার করি। ওর হাতে একটা স্টেম দেখতে পাই। ও আমায় মারতে শুরু করে। আমি আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকি কিন্তু এক পর্যায় অনেকে আমায় মারতে শুরু করে কিন্তু কে কে মেরেছে সেটা বুঝার ক্ষমতায় আমি থাকি না।
যখন আমি চোখ খুলি তখন আমি নিজেকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে দেখি। না পারছি হাত নাড়াতে আর না পারছি পা নাড়াতে। মাথা পায়ের দিকে তাক করিয়ে দেখি আমার দুই পায়ে ও হাতে ব্যান্ডেজ। মনে হয় ভেঙ্গে গেছে। কিছুক্ষন পর মা আর বাবা আমার সামনে আসছে। মনে হয় নার্স খবর দিয়েছে যে আমার জ্ঞান ফিরছে।
আমি কথা বলার শক্তিটুকু পাচ্ছি না শুধু ওদের কথা গুলো শুনছি শুধু বললাম ” বাবা আমায় মাফ করে দাও “। এরপর আর কোন মনে নেই। হয়ত আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলি । প্রায় ২ মাস হাসপাতালে রেখে আমায় বাসায় নিয়ে আসা হয়। এত গুলো দিন যে আমার কিভাবে কেঁটেছে সেটা হয়ত বলার মত নয়। এখন হাতটাকে একটু নাড়াতে পারি। কষ্ট করে মোবাইলটা হাতে নিলাম।অনেক খুঁজে নিত্তিয়ার নাম্বারটা বের করলাম।
— হ্যালো নিত্তিয়া।
— আরে রাজ যে, তুমি এতো তারাতারি ঠিক হয়ে গেলে।
— মানে?
— না মানে আমি তো ভাবলাম রাকিব বুঝি তোমায় এতটাই মারছে যে সোজা কোমায় চলে যাবে। এখন তো বলতে হবে রাকিব ঠিক মত মারতেও পারে না। আর গোবেচারা তোমার কপালটা কত্তো ভাল বলো তো।
— তুমি আগে থেকেই সব জানতে।
— অবশ্যই।
তুমি কি ভেবেছো ফেসবুকে তোমার সাথে মিষ্টি মিষ্টি কয়েকটা কথা বলছি বলে আমি তোমায় ভালবাসি। ইশশ তোমার মত মধ্যবৃত্তদের এই এক ফালতু ধারণা। আরে লাইফটা মজা করার বিষয়। সেখানে সিরিয়াস হওয়ার দরকারটা কি?আর তুমি তো শুধু কলেজের ভাল ব্রিলিয়েন্ট ছাত্র হওয়ার কারনে তোমার সাথে প্রেমের নাটক করেছি। আর আমি একা নই বরং নিহানরাও চাইছে তোমার পিছনে বসে পাশ করে যাওয়ার জন্য। আর তুমি রাকিব কে কেন মারছিলে হে? তোমার জায়গা যেখানে তুমি সেখানেই থাকো। আরে বোকা এটা বুঝো নি যে আমরা তোমায় ব্যবহার করে। তাছাড়া আপাতত তোমার নিজের রেজাল্টও খারাপ হচ্ছে তাই তোমার উপর নির্ভর করে লাভ নাই। বুঝলে মিস্টার রাজ।
— অমানুষের বাচ্চা
— কি বললে?
— না তেমন কিছু না।
ফোনটা রেখে দিলাম আর ঘর বন্দি হয়ে দিন কাটতে লাগলাম। হয়ত আমার এটাই প্রাপ্য ছিল। তবে যাই হোক,জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ পথ তো শিখতে পেরেছি। শুধু আমি নই বরং আমার মত হাজারো এমন ছেলে রয়েছে যাদের একদিন আমার মতই পরিনতি হবে। সেদিন বুঝবে বন্ধুত্ব করার সময় বুঝে শুনে করতে হয়। সব বন্ধু এক রকম হয় না।