“রাসেলের দোকানে তুমি কেনো বসছো? পরপুরুষের চেহারা দেখতে ভালা লাগে তাইনা? জামাইয়ের তো চল্লিশাও এহনো হয়নাই। এহনি ঢলাঢলি শুরু কইরা দিলা?” কথাগুলো বলেই এক দলা থুথু উঠোনে ফেললো সাহাবুদ্দিন। সুলতানা মাথার ঘোমটা টা বড় করে দিয়ে বলে উঠে, “আব্বা, রাসেল মারা যাওয়ার সময় আমার দুইসন্তান সহ আমাকে নিয়ে মারা যায়নি। আমার সংসারের হাল আমাকেই ধরতে হবে। আর দোকানে বসে ব্যবসা করা মানেই কিন্তু পরপুরুষের সাথে ঢলাঢলি করা না। রাসেল জীবিত থাকাকালীন আমি কখনো ওর অনুমতি ব্যতিত দরজার চৌকাঠও মাড়ায়নি। আমি এখন দোকানে না বসলে দোকানটা বন্ধ হয়ে যেতো। আমার সংসারের খরচ তখন কিভাবে চলতো? মেয়ে দুটোকে তো আমার মানুষ করতে হবে।
দয়া করে আমাকে আর মিথ্যা দোষারোপ করবেন না। ” সাহাবুদ্দিন সুলতানার মুখের সামনে যেয়ে আবারো বলতে শুরু করে, “দুইদিনের ছেমড়ি, আমারে শিখায় সত্য মিথ্যা? সমাজে আমার মানসম্মান থাকলো না। বাজারে গেলেই সবাই টিটকারি দিয়া কয়,কিগো তোমার পোলার বউ বলে বাজারের ব্যবসায়ের খাতায় নাম লেখাইছে? তা পোলার সংসারের ভরণপোষণ দিতে পারলে না? আহারে রাসেলের আত্মাটা বুঝি শান্তি পাইলো না। ” ময়না বেগম বারান্দা থেকে চিৎকার করে সাহাবুদ্দিনকে বলে, “কি শুরু করছো? পোলা বউয়ের লগে কেউ এমন কইরা ঝগড়া করে?” সাহাবুদ্দিন তীব্র এক ধমক দিয়ে ময়না বেগমকে থামিয়ে দেয়।
সাহাবুদ্দিনের মুখের তীব্র পানের গন্ধ উপেক্ষা করে বলে উঠে সুলতানা, “মানুষ আমারে ভাত কাপড় দিবে না আব্বা। তাদের কথায় আমার কিছুই যায় আসবেনা। আপনার বড় ছেলে যখন গাড়ি দূর্ঘটনাতে মারা গিয়েছিলা তখন কিন্তু তার মৃত্যুর পর কেউ বড় ভাবির খোজঁ নেয়নি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ভাবিকে তার ভাইয়ের সংসারে উঠতে হয় ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে। ভাইয়ের বউয়ের প্রতিদিনের খোঁটাতেই কিন্তু ভাবির এখন দিন কাটে। কই একদিন খবর নিয়েছেন তাদের? ভাবি না হয় পরের মেয়ে কিন্তু আপনার বড় ছেলের দুই সন্তানকে তো এক বেলা দেখতে যেতে পারতেন? পড়ালেখার জন্য কিছু টাকা দিতে পারতেন।
কিন্তু বড় ছেলে বেচেঁ থাকতে কিন্তু ঠিকই মাস শেষে ভাইয়ের মাইনে থেকে হাত পেতে টাকা নিয়েছেন। বড় ভাই যদি বলতো,বাবা এইমাসে ছেলেটার স্কুলের ফি দিতে যেয়ে হাতে একদম টাকা নেই। তখন কিন্তু দাতঁ মুখ খিচিঁয়ে বলেছেন, মা-বাবার খরচ চালানো তার কর্তব্য। আচ্ছা বাবা, তার মৃত্যুর পর তার সংসার দেখাটা কি আপনার আমার দায়িত্বে ছিলো না? স্বামী আর বাবা মারা যাওয়ার পর কেনোই বা ভাবিকে তার দুইসন্তান কে নিয়ে তার স্বামীর সংসার ছাড়তে হলো? স্বামী ছাড়া কি স্বামীর সংসারে ঠাইঁ হয় না? তার বাড়ি থেকে কিন্তু ভাবিকে আবার বিয়ে দিতে চেয়েছে। ভাবি এক কথায় বলেছে,সুখ কপালে থাকলে স্বামী কে হারাতে হতো না। দ্বিতীয় বার যে সেই স্বামীও যে মারা যাবে না তার কি গ্যারান্টি?
সাহাবুদ্দিনের মুখ থেকে আর টুঁ শব্দটি বের হয়না। বুড়ো নখের দিকে তাকিয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ। দুইছেলেকে হারানোর শোক তাকে কাবু করতে পারেনি। তবুও কেনো জানি আজ ছেলেদুটোর কথা ভাবতেই চোখের পানি বাধঁ ভেঙ্গে যায়। সঙ্গ দেওয়ার যে আজ আর কেউ থাকলো না। এই বয়সে কাজ করার ক্ষমতাও সে হারিয়েছে। সুলতানা নিজের ঘরে চলে যায়। দুইমেয়ে সাফা আর সাবাকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাদঁতে থাকে আর চিৎকার করে বলে, “রাসেল,আমাদের তো একসাথে দুইমেয়েকে মানুষ করার কথা ছিলো। তাহলে কেনো এই জীবন সমুদ্রে আমাকে একা ফেলে চলে গেলে? আদৌ কি আমি সমুদ্রের তীরে পৌঁছাবো? নাকি অথৈ সাগরে ডুবে যাবো? এই প্রশ্নের উত্তর আমায় কে দিবে রাসেল? কে দিবে? আমাকে এই ধূসর সময়ের দোটানায় কেনো বাধঁলে? ” সাফা আর সাবা মায়ের চোখের পানি দেখে নিজেরাও কাদঁতে থাকে।
সুলতানা দোকানে যাওয়ার জন্য যখন বাসা থেকে বের হয় তখন খেয়াল করে তার শ্বশুর ও তার পেছনে পেছনে আসছে। সুলতানা কিছু না বলে নিঃশব্দে হেটেঁ চলে। দোকানের চাবিটা দিয়ে যখন তালা খুলতে যাবে তখন সাহাবুদ্দিন বলে, “বউ,আমার কাছে দেও চাবিটা। আমি তালা টা খুলি। ” সুলতানা চাবিটা হাতে দিয়ে দেয় তার। সাহাবুদ্দিন সুলতানার দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করে বলে, “বউ,আমিতো ওইসব লেখাপড়া জানিনা তুমি ফেক্সিলোড,বিকাশে টাকা, ইলেক্ট্রিক জিনিস পত্র বিক্রি কইরো। আমি নাহয় দোকানে বইসা থাকমুনে তোমার লগে। বুঝোয় তো যুগ ভালা না,তুমি ভালা হইলেই কি হইবো? বেডা মানুষ গো নজর ভালা না। ”
সুলতানা মুচকি হাসি দিয়ে বলে, “আচ্ছা, আব্বা। আপনি আমার সাথে বসে আমাকে পাহাড়া দিয়েন না হয়। ” সাহাবুদ্দিন মাথা নিচু করে মাথা নাড়াঁয়। আবার পরক্ষণে বলে উঠে, “বড় বউ আর তার পোলা মাইয়ারে বাড়িতে নিয়া আমু। আমরা ডাইলভাত খাইলে হেইও খাইবো না হয়। ” সুলতানাও সম্মতি জানায় এতে। “আব্বা, আপনার দুই ছেলে না থাকলে কি হবে আপনার দুই ছেলের বউ তো আছে। সংসার একভাবে না একভাবে ঠিকই চলবো। ” সাহাবুদ্দিন সুলতানার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়,চোখের পানি লুকানোর মিথ্যা প্রয়াস করে।
সুলতানা ভাবে আচ্ছা প্রতিটা মানুষ এইভাবে তার শ্বশুরের মতো হুট করেই যদি পরিবর্তন হয়ে যেতো। খুব সহজেই ভালো-মন্দ,উচিত-অনুচিত টা বুঝতে পারতো। তাহলে হয়তবা অনেক মেয়েকে স্বামীর মৃত্যুতে নিজের শ্বশুর বাড়ি ছাড়তে হতো না। সকল মানুষ এক হয়না।ভিন্নতা মানুষের মধ্যে থাকবেই এটাই স্বাভাবিক প্রকৃতির নিয়ম।