তাতল সৈকতে: ১৬. কিরীটী যেমন দাঁড়িয়েছিল

তাতল সৈকতে: ১৬. কিরীটী যেমন দাঁড়িয়েছিল

১৬. কিরীটী যেমন দাঁড়িয়েছিল

কিরীটী কিন্তু যেমন দাঁড়িয়েছিল তেমনই দাঁড়িয়ে থাকে।

সে নিজে অত্যন্ত সঙ্গীতপিপাসু হলেও, বর্তমানে তার সমগ্র চিন্তারাজ্যকে মন্থন করে যে চিন্তা ঘূণাবর্ত রচনা করেছিল—সঙ্গীতের সুর তার মধ্যে যেন কোনমতেই প্রবেশ করতে পারে না। এতটুকু স্পর্শও যেন করে না।

অবিনাশ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলা একান্ত প্রয়োজন। কতকগুলো প্রশ্নের জবাব তাঁর কাছ থেকে পেতেই হবে। কিন্তু অবিনাশ চৌধুরীর ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে, অত সহজে তাঁর কাছ থেকে কোন প্রশ্নের জবাব পাওয়া বোধহয় যাবে না। এ অবস্থায় ঠিক কি ভাবে অবিনাশ চৌধুরীর কাছে প্রশ্নগুলো উত্থাপন করে তাঁর জবাব পাওয়া যায়।

বাঈজী তখনও গুনগুন গলায় তান তুলে ভৈরো রাগটা আয়ত্তের মধ্যে আনবার চেষ্টা করছে। কিরীটী কতকটা অনন্যোপায় হয়েই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ঘরের চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। এতক্ষণ সে তার স্বভাববিরুদ্ধ ভাবেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেও, অন্য কোন দিকে দৃষ্টিপাত না করেই অবিনাশ চৌধুরীকেই পর্যবেক্ষণ করছিল।

ঘরের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করতে করতে সহসা তার দৃষ্টি দেওয়ালের গায়ে টাঙানো কতকগুলো ফটো ও চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেই কিরীটী ফটো ও চিত্রগুলো দেখতে থাকে।

চিত্রগুলো সব বিখ্যাত অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের।

নাট্যাচার্য গিরিশ ঘোষ, দানীবাবু, অর্ধেন্দু মুস্তফী, শিশির ভাদুড়ী, কৃষ্ণভামিনী, তারাসুন্দরী, বিনোদিনী, কুসুমকুমারী প্রভৃতির। আর সেই সঙ্গে কয়েকটি ফটো—বিখ্যাত সব নাটকের কয়েকটি বিখ্যাত চরিত্রের রূপসজ্জায়। সাজাহানের ঔরংজীব, প্রফুল্লর রমেশ, চন্দ্রগুপ্তের চাণক্য, প্রতাপাদিনের ভবানন্দ ইত্যাদি।

একসময় কিরীটীর অভিনয় দেখবার প্রচণ্ড নেশা ছিল ছাত্রজীবনে। এক গিরিশ ঘোষ ও সেই সময়কার দু-একজন ব্যতীত প্রায় সব নামকরা অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরই সে প্রায় চেনে। কিন্তু বিশেষ ঐ বিভিন্ন রূপে সজ্জিত অভিনেতাটিকে তো কখনও ইতিপূর্বে কোন নাট্যালয়ে দেখেছে বলে কই স্মরণ করতে পারছে না!

হঠাৎ একটি ফটোর সামনে কৌতূহলভরেইসে এগিয়ে গেল। ঔরংজীবের রূপসজ্জায় ফটোটি।

মুখটা বিশেষ করে চোখ দুটি চেনা-চেনা বলে মনে হচ্ছে যেন। কে ঐ অভিনেতা? কে?

সহসা যেন বিদ্যুৎ-চমকের মতই মানসপটে একটা সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে যায়।

তবে কি—

সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ায় কিরীটী। এবং ঘুরে দাঁড়াতেই অবিনাশ চৌধুরীর কৌতূহলী দৃষ্টির সঙ্গে তার দৃষ্টি-বিনিময় হয়।

কি দেখছেন মিঃ রায়! অবিনাশ চৌধুরী প্রশ্ন করেন।

আপনারই রূপসজ্জার ফটো বোধ হয় এগুলো? প্রশ্ন করে কিরীটী।

এতক্ষণ ধরে ঘরের মধ্যে যার উপস্থিতিকে অবিনাশ চৌধুরী ভ্রুক্ষেপমাত্রও করেননি—ফিরে তাকাননি পর্যন্ত তার দিকে, কিরীটীর ঐ শেষের প্রশ্নে সেই অবিনাশ চৌধুরী যেন সচকিতে মুখ তুলে তাকালেন ওর দিকে এবং এতক্ষণের মৌনতা ও বিরক্তি যেন সহসা মুহূর্তে এক নির্মল স্নিগ্ধ কৌতুক হাসিতে রূপান্তরিত হল।

স্নিগ্ধ প্রসন্ন কণ্ঠে চৌধুরী বললেন, হ্যাঁ। এককালে আমার ঐ থিয়েটার করা একটা প্রচণ্ড নেশা ছিল রায় মশায়—বলতে বলতে সহসা উপবিষ্ট অবিনাশ গালিচা ছেড়ে উঠে কিরীটীর। একেবারে পাশটিতে এসে দাঁড়ালেন।

আপনি কখনও পাবলিক স্টেজে অভিনয় করেছেন?

না। সাধারণ রঙ্গমঞ্চে পেশাদারী ভাবে অভিনয় আমার ধাতে ঠিক খাপ খেত না রায় মশাই। স্টেজ ও অভিনয়ের ব্যাপারে আমার যেমন আগ্রহ কৌতূহল ও নিষ্ঠার অভাব ছিল না তেমনি অর্থব্যয়ও কম করিনি। শুধু আমাদের দেশেই নয়, ওদের দেশের অভিনয়, অভিনেতা ও ওখানকার রঙ্গমঞ্চ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করবার জন্য ওদের দেশেও গিয়েছি এবং জীবনে এক সময় অভিনয়কেই পেশা বলে গ্রহণ করব ভেবেছিলাম। কিন্তু আপনি হয়ত জানেন না রায় মশাই, এদেশের অভিনয়শিল্পের সঙ্গে যে সব পুরুষ ও নারী সংশ্লিষ্ট, বলতে গেলে তাদের মধ্যে সকলেরই প্রায় অত বড় একটা শিল্পের প্রতি যে নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধা থাকা দরকার তার বিন্দুমাত্রও আদৌ নেই। সেই জন্যই শেষ পর্যন্ত রঙ্গমঞ্চ ও অভিনয়কে ত্যাগ করে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি।

দোষটা হয়ত এক পক্ষেরই নয় চৌধুরী মশায়। কিরীটী মৃদু হেসে বলে, জনসাধারণের কাছ থেকেই বা অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা কতটুকু সম্মান পেয়ে থাকেন আমাদের দেশে বলুন!

শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে হয়, অর্জন করতে হয় মিঃ রায়। ভিক্ষুকের মত হাত পেতে তা মেলে না।

কিরীটী ও অবিনাশ চৌধুরীর কথাবার্তায় আকৃষ্ট হয়ে ইতিমধ্যে কখন এক সময় বাঈজী গুনগুন করে কণ্ঠে যে তাল তুলেছিল সেটা মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে কখন এক সময় ওদের কথাবার্তায় কান দিয়েছিল। কেবল মধ্যে মধ্যে অন্যমনস্কভাবে ক্রোড়স্থিত বীণার তারে মৃদু মৃদু অঙ্গুলি সঞ্চালন করছিল।

মধ্যে মধ্যে রিনঝিন একটা মিষ্টি তারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।

অবিনাশ চৌধুরী যেন কিরীটীর প্রতি সহসা অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে ওঠেন।

অবিনাশ ও কিরীটী অভিনয়-সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনায় এতটা তন্ময় হয়ে ওঠে যে, বাঈজী যে একপ্রকার বাধ্য হয়েই একসময় ক্রোড়স্থিত বীণাটি গালিচার ওপরে নিঃশব্দে নামিয়ে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল অবিনাশ চৌধুরীরও যেন সেটা নজরেই পড়ে না।

কিরীটী অবিনাশ চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনায় নিবিষ্ট থাকলেও, তার মনের সক্রিয় অংশটা কিন্তু সুযোগের অপেক্ষায় ছিল—কখন কোন ফাঁকে সে তার আসল বক্তব্যের মধ্যে প্রবেশ করবে!

সুযোগ করে দিলেন অবিনাশ চৌধুরী নিজেই। সহসা তিনিই কিরীটীকে প্রশ্ন করলেন, আপনার কি যেন প্রয়োজন ছিল আমার কাছে রায় মশাই, আপনি বলছিলেন—

না না থাক, সে অন্য সময় হবেখন।

উঁহু! স্বর্ণলঙ্কাধিপতি রাবণের খেদোক্তি শোনেননি, আজ নয় কাল এই করে করে স্বর্গের সিঁড়ি শেষ পর্যন্ত তাঁর তৈরী করাই হল না। বলুন, out with it!

বিশেষ তেমন কিছু না। আপনি তো জানেন, মৃত্যুভয়ে ভীত হয়েই রায়বাহাদুর আমাকে এখানে আনিয়েছিলেন! এখন যদি তাঁর হত্যাকারীকে—

কথাটা কিরীটী শেষ না করেই থেমে গেল এবং সঙ্কোচের সঙ্গে অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকায়।

অবিনাশ চৌধুরীও যেন হঠাৎ ঐ কথায় কেমন কিছুক্ষণের জন্যে গুম হয়ে থাকেন। শুধু তাই নয়, কিরীটীর মনে হয় অবিনাশ চৌধুরী কেমন যেন একটু চিন্তিত তাঁর প্রশস্ত উন্নত ললাটে কয়েকটা চিন্তার রেখা জেগে উঠেছে।

এক সময় ধীরে ধীরে অবিনাশ চৌধুরী বলতে শুরু করলেন, কি জানেন রায় মশাই, সবই দুভাগ্য। নচেৎ বয়েস হয়েছে আমার, যাবার কথা তো আমারই। কিন্তু চলে গেল দুর্যোধন। অবিশ্যি আপনারা বলবেন সে তো অসুস্থ ছিলই। তা ছিল—ঐ ভাবে না মরে যদি সে অসুখেই মারা যেত, তবে তো দুঃখটা এত হত না। এত painful হত না ব্যাপারটা। ওরা তো জানে না, এই বিরাট কোলিয়ারীর বিজনেস দুজনে মিলে আমরা গায়ের রক্ত জল করে দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি অক্লান্ত পরিশ্রমে তিল তিল করে কি ভাবে গড়ে তুলেছিলাম! এই মাত্র বছর দুই হল কাজ থেকে অবসর নিয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। দুযযাধন যে আমার কতখানি ছিল, ভাইপো হলেও সে আমার বন্ধু বলতে বন্ধু, সুহৃদ, পরামর্শদাতা, সঙ্গী সাথী—একাধারে সে-ই আমার সব ছিল। দুযযাধনই ছিল এ গোষ্ঠীর মধ্যে মানুষের মত মানুষ। নচেৎ এই চৌধুরী-বাড়িতে আর মানুষ বলতে একটা প্রাণীও আছে নাকি? ওর একমাত্র ছেলে ঐ বৃহন্নলা, ওটা তো মেয়েমানুষের অধম-effiminate, মেরুদণ্ডহীন। একমাত্র ঐ ভাই দুঃশাসন, ওটার কিছু বুদ্ধি ছিল; কিন্তু ওটার মাথায়ও পোকা আছে।

পোকা আছে! কিরীটী প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকায় অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে।

তা নয় তো কি? নইলে ও হতভাগাটার মধ্যেও পার্টস ছিল। এককালে চমৎকার গান-বাজনার শখ ছিল। কিন্তু সব গোল্লায় দিয়ে বসে আছে।

কেন, এখন আর গান-বাজনার শখ নেই বুঝি?

না, এখন কেবল এক নেশা হয়েছেটাকা, টাকা আর টাকা! দিবারাত্র কেবল ফন্দিফিকির আঁটছে কিসে টাকা আসবে!

আচ্ছা শুনছিলাম মৌচীতে বিজনেসে নাকি বেশ টাকা উনি রোজগার করছিলেন, তবে চলে এলেন কেন হঠাৎ?

বেশ টাকা রোজগার করছিল না ঘোড়ার ডিম! সেখানকার ব্যবসা নষ্ট করে এখন এখানে বসে সব লণ্ডভণ্ড করবে এই মতলব। মরুক গে। দুর্যোধন গেল। আমিও আর কটা দিনই বা! থাকলে ওর আর বৃহন্নলারই থাকত। বৃহন্নলাটা একটা হস্তীমূখ। এখন সুবিধেই হল, দুদিনে সব তছনছ করে দেবে।

কিন্তু গতরাত্রে আপনি তো বলছিলেন রায়বাহাদুরের উইল আছে—

উইল! হ্যাঁ, উইল একটা আছে। আর আমি জানি সে উইলে একটা কপর্দকও কারও নষ্ট করার ক্ষমতা নেই এমন ভাবেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু সাত-সাতটা কোলিয়ারীর দেখাশোনা করবে কে? কাঁচা পয়সা কোলিয়ারীতে। ওরা কাকা-ভাইপোই তো দেখবে সব। দিনের আলোয় পুকুরচুরি হলেই বা ঠেকাচ্ছে কে?

আচ্ছা উইলটা কি রেজেস্ট্রি করা আছে?

তা জানি না, সংবাদ রাখি না।

আচ্ছা কাকা সাহেব, রায়বাহাদুর যে নিহত হবেন গত রাত্রে রাত চারটের সময়, এই বদ্ধমূল ধারণাটা তাঁর কেন হয়েছিল বলতে পারেন কিছু? কোন কারণ ছিল কি?

কিরীটীর প্রশ্নে অবিনাশ চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, কোন জবাবই দেন না।

তারপর শান্ত কণ্ঠে বললেন, না। বলতে পারি না।

আর একটা কথা। গতরাত্রে কে আপনাকে রায়বাহাদুরের নিহত হবার সংবাদটা দেয়?

প্রসাদই তো দেয়।

প্রসাদ!

হ্যাঁ।

কাল রাত সাড়ে তিনটে থেকে রায়বাহাদুরের নিহত হবার সংবাদ পাওয়া পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন?

রাত তিনটে নাগাদ বাঈজী চলে যায়। তারপর পাশের ঘরে আমি শুতে যাই। কিন্তু ঘুম আসছিল না বলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম।

প্রসাদ ঠিক কটায় আপনাকে সংবাদ দিতে এসেছিল জানেন? মনে আছে আপনার?

রাত তখন প্রায় সাড়ে চারটে হবে বোধ হয়।

তখন কি আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন?

ঠিক ঘুম নয়, বোধ হয় একটু তন্দ্রামত এসেছিল, এমন সময় প্রসাদ এসে ডাকতেই—

ও-ঘর থেকে ফিরে এসে আপনি বোধ হয় আর শুতে যাননি?

না। মনটা এমন অস্থির লাগতে লাগল দুযযাধনকে ঐভাবে নিহত হতে দেখে যে বাধ্য হয়ে মুন্নাকে এ-ঘরে তখুনি আবার ডেকে পাঠালাম? মুন্নাও অবাক হয়ে গিয়েছিল। ঘণ্টাখানেক আগে মাত্র তাকে রাত্রির মত বিদায় দিয়েছিলাম।

মুন্নাবাঈ তখনও জেগেই ছিলেন?

হ্যাঁ। ও এসে বললে, অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ও নিজেও বিছানায় শুয়ে ছটফট করছিল। আমার চাকর গিয়ে ডাকতেই উঠে এসেছিল।

হঠাৎ এমন সময় দেওয়াল ঘড়িটায় ঢং ঢং করে বেলা এগারটার সময়-সঙ্কেত শোনা গেল।

ঘড়ির সময়-সঙ্কেতে কিরীটীর খেয়াল হল অনেকক্ষণ সে ঐ ঘরে আছে। বলে, আচ্ছা অনেক বেলা হয়ে গেল, আর আপনাকে বিরক্ত করব না কাকা সাহেব।

কাকা সাহেবও যেন কিরীটীর কথায় চমকে ওঠেন। এবং অকস্মাৎ একটা প্রশ্ন করে বসেন, আচ্ছা রায় মশাই, দুযযাধনের মৃতদেহটা কি ওরা এখান থেকে নিয়ে গিয়েছে? প্রশ্নটা করে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণের জন্য অবিনাশ চৌধুরী।

হ্যাঁ, ময়নাতদন্তের জন্য পুলিস মৃতদেহ নিয়ে গিয়েছে।

সৎকার হবে না?

ময়নাতদন্ত হয়ে গেলেই আপনারা সৎকারের ব্যবস্থা করতে পারবেন। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেয়।

তার আয়োজন কিছু ওরা করেছে জানেন?

আমি এখুনি গিয়ে বৃহন্নলা ও দুঃশাসন চৌধুরীর কাছে সংবাদ নিচ্ছি।

দয়া করে ওদের বলে দেবেন, আমাকে যেন ওর মধ্যে আর না টানে। আর একটা কথা বলে দেবেন, অস্থিটা যেন গঙ্গায় ফেলার ব্যবস্থা করা হয়।

বলব।

দুঃখ যেমন দিয়েছে তেমনি নিজেও দুঃখ কম পায়নি। দিক, অস্থিটা গঙ্গাতেই বিসর্জন দিক। তবু যদি মরার পর গিয়ে শান্তি পায়।

কথাগুলো বলে অবিনাশ চৌধুরী যেন হঠাৎ আবার কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যান। এবং নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে আবার পায়চারি শুরু করেন।

তারপর আবার একসময় পায়চারি থামিয়ে অবিনাশ চৌধুরী বলেন, মৃত্যুর পরে ঐসব প্রেতলোকটোক আপনি মানেন রায় মশাই?

হিন্দুর ছেলে যখন তখন চিরন্তন সংস্কারকে একেবারে এড়াব কেমন করে বলুন!

বিশ্বাস করেন তাহলে?

কিরীটী প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসে।

এই যে সব লোকে বলে অতৃপ্ত বাসনা বা কামনা নিয়ে মরলে বায়বীয় সত্তা সেই বাসনা বা কামনার জন্য এই পৃথিবীতে ফিরে ফিরে আসে, বিশ্বাস করেন এসব কথা?

কিরীটী অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে অতঃপর না তাকিয়ে পারে না। বিশেষ করে অবিনাশ চৌধুরীর কণ্ঠস্বর শুনে। অবিনাশ চৌধুরীর মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ যেন ওর মনে হয় একটা অলিখিত ভয় ও শঙ্কা যেন সে মুখের রেখায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেন?

অবিনাশ চৌধুরী অতঃপর ঘুরে দাঁড়িয়ে দেয়ালে প্রলম্বিত একখানি নিজেরই ছবির দিকে। একদৃষ্টে চেয়ে যেন কি দেখতে লাগলেন। আর একটি কথাও কিরীটীর সঙ্গে বললেন না।

কিরীটী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু অবিনাশ চৌধুরী পূর্ববৎ পায়চারি করতে লাগলেন।

কিরীটী ঘর হতে বের হয়ে আসবার জন্য অতঃপর দুয়ারের দিকে পা বাড়ায়।

কিরীটী অবিনাশ চৌধুরীর ঘর থেকে বের হয়ে কি ভেবে আবার রায়বাহাদুর দুর্যোধনের ঘরের দিকে অগ্রসর হয় এবং ঢুকতেই হঠাৎ মেঝেতে রায়বাহাদুরের শূন্য খাটটার নীচে কি একটা বস্তু চিকচিক করছে তার নজরে পড়ে। কৌতূহলে এগিয়ে গিয়ে তুলে নেয় নীচু হয়ে বস্তুটি। একটা লাল সূতোয় বাঁধা সোনার লকেট। লকেটটা খুলতেই ভেতর থেকে প্রকাশ পেল অপরূপ সুন্দরী একটি তরুণীর মুখচ্ছবি। কে? কার ফটো?

আগের পর্ব :

০১. মানুষের জীবনে এমন এক একটা ঘটনা
০২. মামাকে দেখতে এসেছেন
০৩. ঘরের মধ্যে ঐ সময়
০৪. গানের মতই মিষ্টি কণ্ঠস্বর
০৫. বৃহন্নলা চৌধুরী কেমন যেন
০৬. আরও প্রায় আধ ঘণ্টা পরে
০৭. ব্যস্ত হবেন না মিঃ ঘোঘ
০৮. সেতারে ভৈরো আলাপ
০৯. ডাঃ সানিয়ালের ঘরে
১০. কিছুক্ষণ অতঃপর উভয়েই স্তব্ধ
১১. কিরীটীর প্রশ্নে কিছুক্ষণের জন্য সুলতা
১২. কিরীটী পকেট থেকে তার নোট বুকটা
১৩. ডাঃ সানিয়ালের ঘরে বসেই
১৪. বৃহন্নলা চৌধুরী ও কিরীটীর মধ্যে কথাবার্তা
১৫. অবিনাশ চৌধুরীর ঘরের দরজা

পরের পর্ব :
১৭. অবিনাশ পায়চারি করছেন
১৮. মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য
১৯. কিরীটী রুচিরাকে বিদায় দিয়ে
২০-২১. কথাটা আর চাপা রাখা গেল না

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত