০১. মানুষের জীবনে এমন এক একটা ঘটনা
মানুষের জীবনে এমন এক একটা ঘটনা দৈবাত ঘটে যায় যা একটা দুঃস্বপ্নের মতই যেন বাকি জীবনে কখনই সে ভুলতে পারে না। ডাঃ সমর সেনও তার জীবনের এক মধ্যরাত্রির অনুরূপ একটি ঘটনা আজ পর্যন্ত ভুলতে তো পারেইনি, এমন কি আজও যেন মধ্যে মধ্যে তার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটিয়ে তার মনের মধ্যে অদ্ভুত এক আলোড়নের সৃষ্টি করে। মধ্যে মধ্যে আজও নিদ্রার ঘোরে যেন ডাঃ সমর সেনকে সেই দুঃস্বপ্নটা আতঙ্কিত করে তোলে।
মনে হয় অন্ধকারের মধ্যে যেন কে তার দিকে চেয়ে আছে।
পলকহীন, স্থির নিষ্কম্প, বিভীষিকাময় দুই চক্ষুর কঠিন মৌন দৃষ্টি যেন তারই দিকে তাকিয়ে আছে। এ দৃষ্টি যেন এ জগতের নয়, কোন প্রেতলোকের বায়বীয় দেহের।
হাড় জাগানো বলিরেখাঙ্কিত মুখ : ফ্যাকাশে রক্তহীন লোল চর্ম। বিস্ত কাঁচাপাকা চুলগুলি বলিরেখাঙ্কিত কপালের উপরে নেমে এসেছে।
আর ঐ সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে সেই লোকটির বক্ষে সমূলে বিদ্ধ হয়ে আছে একখানি কালো বাঁটওয়ালা ছোরা।
ডাঃ সমর সেনের ঘুমটা আজও আবার ভেঙে গেল।
নিস্তব্ধ মধ্যরাত্রি। ঘরের মধ্যে ও বাইরে অন্ধকার থমথম করছে। নিচ্ছিদ্র জমাট কালো কালির মত নিবিড় অন্ধকার।
তারপরই ডাঃ সমর সেন স্পষ্ট শুনতে পায় বদ্ধ দরজার গায়ে মৃদু করাঘাত করতে করতে কে যেন মৃদু কণ্ঠে ডাকছে, ডাক্তার সাব, ডাক্তার সাব–
কে?
সে রাত্রেও ঠিক অমনি শয়নঘরের বন্ধ দরজার গায়ে মৃদু অথচ স্পষ্ট করাঘাতের শব্দে আচমকা ডাক্তারের ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল।
একটা জটিল অপারেশনের ব্যাপারে সমস্তটা দ্বিপ্রহর ও সন্ধ্যা রাত্রি পর্যন্ত ব্যস্ত থেকে পরিশ্রান্ত ডাক্তার তাড়াতাড়িই গিয়ে শয্যা গ্রহণ করেছিল এবং ঘুমিয়ে পড়েছিল।
হঠাৎ দরজায় করাঘাতের শব্দ ও সেই সঙ্গে কে যেন ডাকছে, সাব, ডাক্তার সাব—
একটা বিশ্রী অস্বস্তির সঙ্গে ডাঃ সেন শয্যার উপর উঠে বসে, কে?
সাব আমি শিবু। একটা জরুরী কল এসেছে।
কল! এত রাত্রে জরুরী কল!
একান্ত বিরক্তচিত্তেই ডাঃ সেন শয্যা থেকে মেঝের উপরে নেমে দাঁড়ায়। মাঘের শেষ, তবে বিহার অঞ্চল বলেই শীতের প্রকোপ যেন একটু বেশীই দাঁত বসায়। খাটের বাজু থেকে গরম ড্রেসিং গাউনটা টেনে নিয়ে গায়ে চাপাতে চাপাতে বিরক্তির সঙ্গেই ঘরের দ্বার অর্গলমুক্ত করে বাইরে এসে দাঁড়াল, কে? কোতা থেকে কল এসেছে?
একেবারে গাড়ি নিয়ে এসেছে সাহেব। আমি বাইরের ঘরে বসতে দিয়েছি। বিনীতভাবে ভৃত্য শিবদাস বলে।
শিবদাস ডাক্তারের কমবাইণ্ড হ্যাণ্ড।
ডাঃ সেন বাইরের দিকে পা বাড়ায়।
একতলা বাংলো প্যাটার্নের ছোটখাটো বাড়িটা। সামনে ও পেছনের দিকে নাতিপ্ৰশস্ত বারান্দা, বারান্দা অতিক্রম করে ডাক্তার ঘরের সামনে এসে ভারী পদাটা তুলে ভিতরে ঢুকল।
ঘরের অত্যুজ্জ্বল আলোয় ডাঃ সেন আগন্তুকের প্রতি দৃষ্টিপাত করে।
গলাবন্ধ কালো রঙের একটা কোট গায়ে, মাথায় উলের মাঙ্কি ক্যাপ এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ঘরের মধ্যে একটা সোফার উপর পা তুলে দিয়ে শীতে জবুথবু ভাবে বসে।
ডাঃ সেনের পদশব্দে লোকটি উঠে দাঁড়ায় : নমস্কার। আপনিই বোধ হয় ডাঃ সেন?
হ্যাঁ।
বলছিলাম কি, এখুনি আজ্ঞে, আপনাকে একটিবার শ্রীনিলয়ে যেতে হবে।
শ্রীনিলয়! কার বাড়ি? ভ্রূকুঞ্চিত করে ডাক্তার প্রশ্ন করে।
বলছিলাম কি, সাত-সাতটা কোল মাইনসের প্রোপাইটার রায় বাহাদুর দুর্যোধন চৌধুরীর নাম শোনেননি আজ্ঞে?
না। শোনবার সৌভাগ্য হয়নি। একটু ব্যঙ্গভরেই যেন জবাবটা দেয় ডাঃ সেন। তা কেষ্টা কি, কারই বা অসুখ?
বলছিলাম কি, অধীন সামান্য তশীলদার। সংবাদ তো জানি না আজ্ঞে, তবে রায়বাহাদুরেরই অসুখ—তিনিই আজ্ঞে রোগী।
হুঁ। এখান থেকে আপনার শ্রীনিলয় কতদূর?
তা মাইল দশেক পথ হবে।
ফিস্ কিন্তু আড়াইশো টাকা নেব।
তাই পাবেন। বলছিলাম কি, একটু তাড়াতাড়ি করলে—
বসুন। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমি আসছি।
ডাক্তার ঘর হতে বের হয়ে গেল।
লোকটিকে বাইরের ঘরে বসতে বলে শয়নঘরে ঢুকে বেশ বদলাতে বদলাতে ডাক্তার কলটির কথাই ভাবছিল।
সত্যি কথা বলতে কি ডাক্তার একটু যেন বিস্মিতই হয়। এ তল্লাটে আড়াইশো টাকা ফিস এক কথায় দিতে রাজী হয়! তাছাড়া ডাঃ সেন বৎসরখানেক হয় এখানে এসে প্র্যাকটিস শুরু করেছে, কিন্তু কই রায়বাহাদুর দুযোধন চৌধুরী বা শ্রীনিলয়ের নাম ইতিপূর্বে কখনও শুনেছে বলে তো মনে পড়ে না। তাই যেন কিছুটা কৌতূহল জাগে মনের মধ্যে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে ডাক্তার পুনরায় বসবার ঘরে ফিরে এসে বলে, চলুন। আগে সেই বৃদ্ধ ও পশ্চাতে ডাঃ সেন তাকে অনুসরণ করে ওরা বাইরে এসে দাঁড়ায়। আকাশে স্বল্প জ্যোৎস্না পাতলা একটা কুয়াশার আবরণের তলায় যেন মৃতি হয়ে পড়ে আছে। কুয়াশাচ্ছন্ন সেই মৃদু জ্যোৎস্নালোকে ডাক্তার দেখতে পায় গেটের অনতিদূরে কালো রঙের একখানা সুবৃহৎ প্যাকার্ড-গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তূপীকৃত একটা ছায়ার মতই।
বৃদ্ধই এগিয়ে গিয়ে গাড়ির সামনে উপবিষ্ট ড্রাইভারকে সম্বোধন করে বলে, রামনরেশ, দরজাটা খুলে দাও।
ডাক শুনেই ড্রাইভার নিঃশব্দে গাড়ি থেকে নেমে এসে দরজা খুলে দিল।
উঠুন ডাক্তারবাবু।
আগে ডাক্তার ও পশ্চাতে বৃদ্ধ গাড়ির মধ্যে উঠে বসে অতঃপর।
গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে রামনরেশও গাড়িতে উঠে বসে স্টার্ট দিল।
গাড়ি নিঃশব্দ গতিতে অগ্রসর হয়ে দক্ষিণ দিকে বাঁক নিয়ে মেটাল রোডের উপর পড়তেই স্পীড় নেয় প্রায় ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইলের কাছাকাছি।
নিস্তব্ধ মৃদু কুয়াশা ঘেরা, স্বল্প চন্দ্রালোকিত মধ্যরাত্রি।
মেটালে বাঁধানো মসৃণ উঁচু-নীচু পাহাড়ী পথ।
সুতীব্র হেড লাইটের আলো ফেলে গাড়ি ছুটছে হুঁ হুঁ করে গন্তব্যপথে।
ডাক্তার পকেট থেকে চামড়ার সিগার কেসটা বের করে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করল।
জ্বলন্ত সিগারে গোটা দুই টান দিয়ে পাশে উপবিষ্ট বৃদ্ধের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে। মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করল, আপনার নামটা জানতে পারি কি?
বিলক্ষণ। শ্রীকুণ্ডলেশ্বর শম। ব্রাহ্মণ, বারেন্দ্র শ্রেণী–কাশ্যপ গোত্র–
ভদ্রলোকের নামের সঙ্গে সঙ্গে গোত্রের পরিচয়টা পর্যন্ত পেয়ে ডাক্তার যে একটু বিস্মিত হয়নি তা নয়। তাই কিছুক্ষণ অতঃপর চুপ করেই থাকে। তারপর আবার প্রশ্ন করে, হুঁ, আচ্ছা কুণ্ডলেশ্বরবাবু, রায়বাহাদুরের অসুখটা কি কিছুই জানেন না আপনি?
বলছিলাম কি আজ্ঞে, জানিও বটে আবার জানি নাও বটে।
কুণ্ডলেশ্বরের কথায় ডাক্তার এবার যেন একটু বেশ কৌতূহলী হয়ে ওঠে এবং অন্তরের কৌতূহলটা চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করে, কি রকম? জানেন অথচ আবার জানেনও না!
আজ্ঞে তাই।
হুঁ, তা কতদিন রায়বাহাদুরের ওখানে কাজ করছেন?
তা বিশ বৎসর। হ্যাঁ, তা বলছিলাম কি, তাই হবে বইকি।
ওঃ, তবে তো অনেক দিন আছেন। অনেক দিনকার পুরনো লোক আপনি।
তা তো বটেই। তবে বলছিলাম কি আজ্ঞে, নিজে যখন যাচ্ছেন সবই তো আজ্ঞে স্বচক্ষে দেখবেন আর জানতেও পারবেন আজ্ঞে।
ডাঃ সেন বুঝতে পারে যে কোন কারণেই হোক কুণ্ডলেশ্বর রায়বাহাদুরের রোগের সংবাদটি তাকে দিতে ইচ্ছুক নয় আপাততঃ।
এরপর আর পীড়াপীড়ি করাটা শোভন দেখায় না, অতএব নিঃশব্দে সে ধূমপানই করতে থাকে।
.
ইউরোপ থেকে বহু কষ্টে নিজের চেষ্টায় এফ.আর.সি.এস হয়ে এসে কলকাতা শহরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য সচেষ্ট হয় ডাঃ সমর সেন নবীন উদ্যমে ও আশায়, কিন্তু দু বছর ধৈর্য ধরে থেকেও যখন প্র্যাকটিসের ব্যাপারে বিশেষ কোন সুবিধাই করতে পারল না ডাঃ সমর সেন—এবং প্রায় উপবাসের সামিল—অর্থাৎ যে বস্তুটি হলে স্থূলভাবে এ জগতে বেঁচে থাকা চলে সেই অর্থের অনটনটা ক্রমশঃ এমন জটিল হয়ে উঠতে লাগল যে উপবাসও বটে, সেই সঙ্গে অস্তিত্বটুকুও যাবার যোগাড় তখন বিলাতী খেতাবটা পকেটস্থ করে এক প্রকার বাধ্য। হয়েই মহানগরীর মায়া ত্যাগ করেছিল সে। তারপর কিছুদিন ধরে অনেক ভেবে সে কোন এক ধনী বন্ধুর কাছ থেকে হাজার দুই টাকা ধার করে বিহারের এই খনিপ্রধান অঞ্চলে এসে ডেরা বেঁধে প্রাটি শুরু করল।
এবারে বোধ হয় ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন ছিলেন। বৎসরখানেকের মধ্যেই সুচিকিৎসক হিসাবে সমর সেনের নামটা আশপাশে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
এবং ইতিমধ্যে চার-পাঁচ মাইলের মধ্যে যত ধনী কোল মাইনসের প্রোপাইটার সকলের সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচয় ঘটেছিল কিন্তু আজ পর্যন্ত রায়বাহাদুর দুযযাধন চৌধুরীর নাম তো সে শোনননি।
বিচিত্র কৌতূহলকে কেন্দ্র করে সময়ের মনের মধ্যে নানাবিধ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কুণ্ডলেশ্বর শমা নিস্তব্ধ নিঝুম হয়ে তার পাশেই বসে আছে।
অন্ধকারে আর একবার চোখ ঘুরিয়ে তাকাল সমর কুণ্ডলেশ্বরের দিকে, কিন্তু দেখা গেল লোকটার মুখ। ভদ্রলোকের নামটিও অদ্ভুত। নিঃশব্দ গতিতে দামী গাড়ি মসৃণ রাস্তার উপর দিয়ে যেন হাওয়ার বেগে ছুটে চলেছে। আঁকাবাবাঁকা উচুনীচু পথ। একটানা গাড়ির ইঞ্জিনের একটা চাপা গোঁ গোঁ শব্দ ও হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দের সংমিশ্রণ। মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে তোলায় চোখের পাতায় ঘুম যেন তখনও জড়িয়ে আছে।
এবং গাড়ির দোলায় কখন একসময় বুঝি ঘুমিয়েও পড়েছিল সমর—হঠাৎ একটা মৃদু ঝাঁকুনি ও একটা দীর্ঘ বিশ্রী চিৎকারে তন্দ্রা ছুটে গেল।
উঁ! উঁ!
কুয়াশাচ্ছন্ন সামান্য যেটুকু চন্দ্রকিরণ প্রকৃতি জুড়ে এতক্ষণ স্বপ্নের মতই বিরাজ করছিল, ইতিমধ্যে সেটুকুও যেন কখন নিভে গিয়েছে।
থমথমে অন্ধকারে বিশ্রী চিৎকারের শব্দটা যেন ভৌতিক এক বিভীষিকার মত রাত্রির অন্ধকারকে চিরে দিয়ে গেল।
সমর চমকে চোখ মেলে তাকায়। ড্রাইভার রামনরেশ ততক্ষণে গাড়ি থামিয়ে নেমে দাঁড়িয়ে হাতল ঘুরিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছে।
বলছিলাম কি আজ্ঞে, শ্রীনিলয়ে এসে গেছি ডাক্তারবাবু–নামুন আজ্ঞে।
কুণ্ডলেশ্বরের কথায় সমর গাড়ি থেকে নামে। পোটিকোর নীচে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। সামনেই টানা দীর্ঘ বারান্দা লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা।
স্বল্প-শক্তির একটা প্রজ্বলিত বৈদ্যুতিক বাতি পোটিকোর সিলিং থেকে ঝুলছে, তারই মৃদু আলোয় বারান্দার কিয়দংশ ও সম্মুখের পোর্টিকো আলো-আঁধারিতে যেন অদ্ভুত একটা রহস্যে নিবিড় হয়ে উঠেছে।
সমর গাড়ির ভেতর থেকে তার ডাক্তারী ব্যাগটা নামাতে যেতেই কুণ্ডলেশ্বর বাধা দিল, থাক। বলছিলাম কি আজ্ঞে, কৈরালাপ্রসাদই নামিয়ে আনবেখন। চলুন।
কুণ্ডলেশ্বরের ইঙ্গিতে সমর সিঁড়ি অতিক্রম করে বারান্দা-পথে অগ্রসর হয়। আগে কুণ্ডলেশ্বর, পেছনে সমর। দীর্ঘ বারান্দা অতিক্রম করে কুণ্ডলেশ্বরকে অনুসরণ করে একসময় উভয়ে প্রকাণ্ড একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।
দরজার গায়ে কলিং বেল টিপতেই অল্পক্ষণ পরে নিঃশব্দে বৃহৎ দ্বার উন্মুক্ত হল।
চলুন—
প্রকাণ্ড একটা হলঘর। একটি মাত্র স্বল্প-শক্তির নীলাভ বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় ঘরটা স্বল্পালোকিত। বারেকের জন্য চোখ তুলে সমর ঘরের চতুর্দিকে একবার দৃষ্টিপাত করল।
ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যে সমগ্র ঘরখানি যেন একেবারে ঠাসা, তবে রুচি বা শৃঙ্খলার কোন চিহ্নই পরিলক্ষিত হয় না। মেঝেতে পুরু গালিচা বিস্তৃত: বড় বড় কারুকার্যমণ্ডিত মেহগনি কাঠের আলমারি গোটাচারেক। একপাশে খানপাঁচেক সোফা। একপাশে প্রকাণ্ড একটি শ্বেতপাথরের টেবিল টেবিলের দুদিকে খান আষ্টেক চেয়ার।
এক কোণে একটি ট্যান করা বৃহৎ ব্যাঘ্রমূর্তি জিঘাংসায় ধারাল দন্ত বিকশিত করে আছে। কাঁচের চোখ দুটো ধকধক করে জ্বলছে নীলাভ দ্যুতিতে।
দেওয়ালের সর্বত্র বড় বড় সব বিদেশী নরনারীর তৈলচিত্র।
বেশীর ভাগই ইংরাজ অধীশ্বর ও অধীশ্বরীদের। এক কোণে সুবৃহৎ পাথরের স্ট্যাণ্ডে একটি সুদৃশ্য দামী জামান ক্লক দণ্ডায়মান। ঐ সময় হঠাৎ ঢং ঢং করে রাত দুটো ঘোষণা করল ক্লকটা। ক্লকের সঙ্কেতধ্বনি যেমন গম্ভীর তেমনি মিষ্টি।
ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনিটা প্রায় মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই অদ্ভুত বামন আকৃতির এক নেপালী ভৃত্য ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করতেই কুণ্ডলেশ্বর তাকে সম্বোধন করে বলে, সিক্রিটারীবাবুকে সংবাদ দে কৈরালা, ডাক্তারবাবু এসেছেন।
ডাক্তার সাকা উপরমে লে যানে কো হুকুম হায়, কৈরালা বলে।
ও, বলছিলাম কি, তাহলে আজ্ঞে যান ওর সঙ্গেই। আমি আপনার ব্যাগটি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
সহসা এমন সময় আবার সেই পূর্বের বিশ্রী চিৎকারটা রাত্রির অন্ধকারে শোনা গেল।
ও কিসের চিৎকার কুণ্ডলেশ্বরবাবু? সমর প্রশ্ন না করে আর পারে না।
আজ্ঞে, নাইটকীপার হুম্ সিং পাহারা দিচ্ছে। আজ্ঞে তাহলে বলছিলাম কি আপনি যান—
নাইটকীপার?
হ্যাঁ, নাইটকীপার হুম্ সিং সারারাত জেগে অমনি করে শ্রীনিলয় পাহারা দেয়।
চলিয়ে ডাক্তার সাব—
কৈরালাপ্রসাদের ডাকে সমরের সম্বিৎ যেন আবার ফিরে আসে। আত্মগত চিন্তায় সে কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল।
চল—
কৈরালাপ্রসাদকে অনুসরণ করে সমর।
হলঘরটি অতিক্রম করে উভয়ে আর একটি স্বল্পালোকিত দীর্ঘ লম্বা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। এত বড় বারান্দায় কেবলমাত্র একটি সিলিং থেকে ঝুলন্ত স্বল্প-শক্তির বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে, সে আলোয় অন্ধকার তো দূরীভূত হয়ইনি বরং অন্ধকার আরও যেন ঘন ও রহস্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সমরের কেমন বিস্ময় বোধ হচ্ছিল। এত বড় জাঁকজমকপূর্ণ ধনীর প্রাসাদতুল্য বাড়ি অথচ আলোর ব্যবস্থা এত কম কেন!
আর আলোর ব্যবস্থায় অহেতুক এই কার্পণ্যই বা কেন! এর কারণই বা কি?
শুধু আলোর ব্যবস্থাই যে কম তাই নয়, সমস্ত বাড়িটা জুড়ে অদ্ভুত একটা স্তব্ধতাও যেন থম থম করছে।
মনে হয় যেন এ কারও কোন বাড়ি বা বাসস্থান নয়, কোলাহলমুখরিত নগরীর দূরপ্রান্তে পরিত্যক্ত ভয়াবহ এক নিঃশব্দ বিরাট কোন এক কবরখানা।
রাত্রির অন্ধকারে সেখানে কালো বাদুড়ের ডানার মত ছড়িয়ে পড়ে নিঃসীম কালো শুন্যতা। অশরীরী প্রেতের নিঃশব্দ পদবিক্ষেপে ও দীর্ঘশ্বাসে সেখানকার বায়ুতরঙ্গ হিমানীর মত ঠাণ্ডা, সবাঙ্গে শিহরণ জাগায়, প্রতি রোমকূপে রোমকূপে ভীতির অনুভূতি তোলে।
বলাই বাহুল্য সিঁড়িপথেও তেমন আলোর ব্যবস্থা নেই। মৃদু আলোছায়াচ্ছন্ন প্রশস্ত সিঁড়িপথ অতিক্রম করে বামন আকৃতির কৈরালাপ্রসাদকে অনুসরণ করে দ্বিতলে অনুরূপ একটি দীর্ঘ বারান্দার প্রান্তে এসে সমর দাঁড়ায় এবং সেখানে পৌঁছেই বামন কৈরালাপ্রসাদ ঘুরে দাঁড়ায় এবং চাপা কণ্ঠে বলে, চলে যান, সামনেই ঘর।
কথা কটি বলে এবং দ্বিতীয় কোন বাক্যোচ্চারণে সমরকে অবকাশ মাত্রও না দিয়ে নিমেষে অত্যন্ত দ্রুতপদে কৈরালাপ্রসাদ সিঁড়িপথ দিয়ে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঘটনার অত্যন্ত দ্রুত আকস্মিকতায় সমর যেন কতকটা হতবুদ্ধি ও বিহ্বল হয়ে আলোছায়াচ্ছন্ন বারান্দার প্রান্তে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।
সম্মুখে পর পর অনেকগুলি ঘরের দরজা। কৈরালাপ্রসাদ বলে গেল সামনের ঘরে যেতে কিন্তু কোন্ ঘরে সে যাবে!
হতবুদ্ধি সমর যন্ত্রচালিতের মতই কতকটা অগ্রসর হয়ে প্রথম বন্ধ দরজাটার গায়ে হাত দিয়ে ঈষৎ ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে মধুর বীণাযন্ত্রসহযোগে অপূর্ব সুমিষ্ট নারীকণ্ঠসঙ্গীতের একটা ঝাপটা কানে এসে প্রবেশ করে : খুল খুল যায় বাজুবন্দ।
সঙ্গীত ও সেই সুরের আকর্ষণে বোধ হয় মন্ত্রমুগ্ধের মত অত্যুজ্জ্বল আলোকোদ্ভাসিত সেই কক্ষের উন্মুক্ত দ্বারপথেই ভিতরে গিয়ে দাঁড়ায় সমর।
উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোর প্রভায় সমগ্র কক্ষখানি যেন ঝলমল করছিল।
বাড়ির সর্বত্র অন্ধকার অথচ ঐ কক্ষটি যেন আলোয় ঝলমল। তাছাড়া রোগী দেখতে এই মধ্যরাত্রে যে বাড়িতে সে এসেছে সেই বাড়িরই কোন ঘরে ঐ রকম সঙ্গীতের আনন্দ বসবে ব্যাপারটা সহসা যেন কেমন সমর সেনের বোধগম্য হয় না। তাই কতকটা বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে সে দাঁড়িয়ে যায়।
সমস্ত মেঝে জুড়ে দামী গালিচা বিস্তৃত এবং মাঝখানে ফরাস বিছানো। সেই ফরাসের উপর অপূর্ব সুন্দরী এক যুবতী কোলের কাছে বীণা নিয়ে বীণে সুরঝঙ্কারের সঙ্গে নিজের মধুস্রাবী কণ্ঠস্বরকে গঙ্গা-যমুনার ধারার মতই মিলিয়ে দিয়েছে।
অদূরে উপবিষ্ট পঞ্চাশের ঊর্ধ্বেই হবে, এক অতীব সুশ্রী ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত শ্যামকান্তি প্রৌঢ় ব্যক্তি।
প্রৌঢ়ের কাঁধের উপর দামী একখানা কাশ্মীরী শাল কাঁধ থেকে মাটিতে নেমেছে। প্রৌঢ়ের হাতে একটি কাঁচের রঙীন সুরা-ভর্তি পাত্র, পেগ গ্লাস।
যন্ত্র ও কণ্ঠের মিলিত সুরধারা যেন সুধাক্ষরণ করছিল কক্ষমধ্যে।
গায়িকার সুরেলা কণ্ঠ তখনও মিনতি করছে বারংবার : খুল খু যায় বাজুবন্দু। সুরের ধারায় সম্মোহিত সমর যেন সব কিছু ভুলে যায়।
সে যেন ভুলে যায় কেন সে এখানে এসেছে। সে যে একজন ডাক্তার এবং বিশেষ একটি রোগীর সঙ্কটময় পরিস্থিতির দরুন তাকে এই মধ্যরাত্রে ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে আনা হয়েছে, কিছুই যেন মনে পড়ে না।
কতক্ষণ ঐ ভাবে মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে ছিল সমর তার নিজেরও মনে নেই হঠাৎ চমকে ওঠে পিঠের ওপর যেন কার অলক্ষিত মৃদু করস্পর্শে।
চমকে তাকায় সমর সেন, তার ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে থোগা ডিগডিগে এক ব্যক্তি,দৈর্ঘ্য প্রায় ছ ফুটেরও ইঞ্চিখানেক বোধ হয় বেশী হবে। যেমন দৈর্ঘ্যে সেই অনুপাতে প্রস্থে একেবারে শূন্যের কোঠায় বললেও চলে।
মাথার চুল ছোট ছোট করে কদমছাঁট করা। শকুনের মত দীর্ঘ বাঁকানো নাসিকা ও ক্ষুদ্র গোলাকার চোখ। চোখের দৃষ্টি স্থির ঘষা কাঁচের ন্যায় ফ্যাকাসে প্রাণহীন। সহসা দেখলে প্রেতের চাউনি বলেই মনে হয়।
মুখের দু পাশের হনু দুটি বিশ্রীভাবে সজাগ হয়ে আছে। দাড়ি নিখুঁতভাবে কামানো।
ডান হাতের হাড় বের করা শিরাবহুল তর্জনীটি ওষ্ঠের ওপর স্থাপন করে ইশারায় লোকটি সমরকে কথা বলতে নিষেধ জানাল এবং স্থির ঘষা কাঁচের মত ফ্যাকাসে দৃষ্টি দিয়ে যেন বলে—আমার সঙ্গে আসুন।
কতকটা যন্ত্রচালিতের মতই সমর দ্বিতীয় আর বাক্যব্যয় না করে লোকটিকে অনুসরণ করে বাইরের স্বল্পালোকিত বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
স্প্রিং অ্যাকশনে ঘরের দরজাটা পুনরায় ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
পরের পর্ব :
০২. মামাকে দেখতে এসেছেন
০৩. ঘরের মধ্যে ঐ সময়
০৪. গানের মতই মিষ্টি কণ্ঠস্বর
০৫. বৃহন্নলা চৌধুরী কেমন যেন
০৬. আরও প্রায় আধ ঘণ্টা পরে
০৭. ব্যস্ত হবেন না মিঃ ঘোঘ
০৮. সেতারে ভৈরো আলাপ
০৯. ডাঃ সানিয়ালের ঘরে
১০. কিছুক্ষণ অতঃপর উভয়েই স্তব্ধ
১১. কিরীটীর প্রশ্নে কিছুক্ষণের জন্য সুলতা
১২. কিরীটী পকেট থেকে তার নোট বুকটা
১৩. ডাঃ সানিয়ালের ঘরে বসেই
১৪. বৃহন্নলা চৌধুরী ও কিরীটীর মধ্যে কথাবার্তা
১৫. অবিনাশ চৌধুরীর ঘরের দরজা
১৬. কিরীটী যেমন দাঁড়িয়েছিল
১৭. অবিনাশ পায়চারি করছেন
১৮. মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য
১৯. কিরীটী রুচিরাকে বিদায় দিয়ে
২০-২১. কথাটা আর চাপা রাখা গেল না