১০. সরু রাস্তাটা থেকে সকলে
সরু রাস্তাটা থেকে সকলে এসে একটা অপ্রশস্ত গলির মধ্যে প্রবেশ করল।
আগে আগে কিরীটী, পশ্চাতে ওরা তিনজন। নিঃশব্দে ওরা তিনজন কিরীটীকে অনুসরণ করে।
একটা তিনতলা বাড়ির সামনে এসে ওরা দাঁড়াল।
বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। কলিংবেলটা টিপতেই একজন প্রৌঢ় ভৃত্য এসে দরজা খুলে দিল।
কিন্তু লোকটা চারজনের মধ্যে পুলিসের পোশাক পরা দুজনকে দেখে হঠাৎ যেন কেমন বোবা হয়ে যায়।
তোমার মা বাড়িতে আছেন?
মা!
হ্যাঁ। আছেন? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
আছেন। লোকটি বলে।
কোথায়?
দোতলায়। খবর দেব?
না। আসুন রথীনবাবু, এস বিকাশ। বলে কিরীটীই প্রথমে দোতলার সিঁড়ির দিকে। এগিয়ে যায়।
ভৃত্যটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। পুলিসের লোক বলে বাধা দিতে সাহস পায় না বোধ হয়।
দোতলায় উঠতেই সামনের ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে যে ভদ্রমহিলা ওদের সামনে এসে দাঁড়াল, বিকাশ ও রথীন তাকে চিনতে না পারলেও সুব্রত তাকে চিনতে পারে।
নমস্কার সঞ্চারিণী দেবী। চিনতে পারছেন! কিরীটীই কথা বললে।
সঞ্চারিণী বিশ্বাসের মুখের ভাবটা হঠাৎ কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, না তো।
চিনতে পারছেন না। কয়েকদিন আগেই তো আপনার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল।
কোথায় বলুন তো?
বলছি। আপনার তিনিটি নিশ্চয় এখানেই আছেন?
তিনি!
হ্যাঁ, হীরেন সরকার?
তিনি এখানে থাকতে যাবেন কেন?
যে কারণে আপনি সেদিন তার ওখানে ছিলেন, সেই কারণেই হয়ত তিনিও আপনার এখানে! সরে দাঁড়ান, আমরা ঘরে যেতে চাই
ঘরে যাবেন!
কেন, আপত্তি আছে? কিরীটী শুধোয়।
তা আছে বৈকি! বিনা ওয়ারেন্টে আমার ঘরে আপনাদের ঢুকতে দেব কেন?
মিথ্যে চেষ্টা করছেন সঞ্চারিণী দেবী। তাকে পালাবার সুযোগ আপনি করে দিতে পারবেন না। কারণ আমি জানি, ওই সিঁড়ি ছাড়া দোতলা থেকে নামবার আর কোন রাস্তা নেই। এ বাড়িটার detils আপনাদের থিয়েটারেরই এক অভিনেত্রীর কাছ থেকে পূর্বাহেই আমার সংগ্রহ করা আছে।
সঞ্চারণী বিশ্বাস যে বোবা।
সরে দাঁড়ান। সঞ্চারিণী সরে দাঁড়াল। সকলে ঘরে প্রবেশ করল।
শয্যার ওপরে কে যেন পেছন ফিরে আগাগোড়া একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।
কিরীটী মুহূর্তকাল দাঁড়াল, তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে এক হেঁচকা টান দিয়ে কম্বলটা ফেলে দিতেই যে লোকটি উঠে বসল সে হীরেন সরকার।
হীরেন সরকার বলে ওঠে, কে আপনারা? এসবের মানে কি?
হীরেনবাবু, নমস্কার। এঁরা দুজন থানা-অফিসার, আর আমাকে আপনার না চেনার কথা নয়–
না, আপনাকে আমি চিনি না—never seen you before in my life!
সুব্রতও অবাক হয়ে হীরেন সরকারের মুখের দিকে তাকিয়েছিল।
কিরীটী আবার ব্যঙ্গভরে বলে ওঠে, চিনতে পারছেন না? আশ্চর্য! আমার বাড়িতে গিয়ে আমার মুখোমুখি বসে শিবানন্দ বোস সেজে অত কথা বলে এলেন, আর এর মধ্যেই সব ভুলে গেলেন? না না, তাও কি হয়!
কি আবোল-তাবোল বকছেন মশাই! আট মাসের ওপর আমি
আপনি পঙ্গু-শয্যাশায়ী, তাই না? আর তাতেই বুঝি খোসমেজাজে একবার ল্যান্সডাউনের বাড়িতে আর একবার এখানকার বাড়িতে যাতায়াত করে থাকেন? শুনুন হীরেনবাবু, আর যার চেখেই ধুলো দিন না কেন, কিরীটী রায়ের চোখে আপনি ধুলো দিতে পারেন নি। প্রথম দিনই মোলাকাতের সময় আমার ওখানে আপনার সত্যকার পরিচয়টা আমার চোখের সামনে দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।
হীরেন সরকার বাবা।
হ্যাঁ, আপনার হাতের মীনা করা একটা আংটি-ওই যে এখনও আপনার ডান হাতের অনামিকায় রয়েছে বাংলায় ওপরে লেখা হীরেন-অন্য আংটিগুলো পরার সময় ওটা যদি খুলে রেখে যেতেন। কিন্তু এখন তো বুঝত পারছেন, পাপ আর গরল চাপা দেওয়া যায় না!
সকলেরই দৃষ্টি গিয়ে পড়ল আংটিটির ওপরে।
সত্যিই আংটিটার ওপরে মীনা করা হীরেন নামটা।
সহসা হীরেনের চোখমুখে একটা হাসির দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ল। সে কালো কালো একঝাক দাঁত বের করে বললে, বেশ মেনে নিলাম, আপনার ওখানে শিবানন্দ ছদ্ম পরিচয়ে আমি গিয়েছিলাম। তা তাতে হয়েছেটা কি।
আর কিছুই হয়নি, কেবল ধরা পড়ে গেছেন।
ধরা পড়ে গেছি!
হ্যাঁ। আপনিই যে শ্ৰীমন্ত, হারাধন, শশধর ও শিবানন্দর হত্যাকারী—
কি পাগলের মত যা-তা বলছেন!
পাগল কিনা সেটা আদালতেই প্রমাণ হবে।
বেশ বেশ, তাই না হয় প্রমাণ করবেন। আপনারা আমার অতিথি-বসুন, চা খান। সঞ্চারিণী, বলে উঁচু গলায় ডাক দিল হীরেন সরকার।
সঞ্চারিণী এসে ঘরে ঢুকল।
এঁদের চায়ের ব্যবস্থা কর, এঁরা আমার অতিথি।
এখানে চা-পান করতে আমরা আসিনি হীরেনবাবু। উঠুন, আমাদের সঙ্গে এখুনি আপনাকে যেতে হবে। কিরীটী শান্ত কঠিন গলায় বললে।
যাব যাব, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? যেখানে খুশি নিয়ে যেতে চান আমাকে যাব—My mission is over-যে চারজন শয়তান একদিন ষড়যন্ত্র করে আমদের পথে বসিয়েছিল, তাদের প্রত্যেককে কীটের মত শ্বাসরোধ করে ধ্বংস করেছি।
বিকাশ সেন অবাক হয়ে চেয়েছিল হীরেন সরকারের মুখের দিকে। অবাক বিস্ময়েই শুনছিল যে ওর প্রতিটি কথা।
লোকটি শয়তান, না বদ্ধ উন্মাদ!
হীরেন সরকার অতঃপর উঠে দাঁড়াল। রোগা, পাকানো চেহারা।
কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ। পঙ্গুত্ব কোথা তার শরীরে নেই।
এখন বুঝতে পারছি, সেদিন আপনার বুদ্ধির দৌড়টা যাচাই করবার জন্য আপনার সামনে শিবানন্দ পরিচয়ে না গেলেই হয়ত ভাল করতাম কিরীটীবাবু!
সবাই চুপ, কারও মুখে কোন কথা নেই।
হীরন সরকার বলতে থাকে, আপনার কীর্তিকলাপ ও অত্যাশ্চর্য শক্তির সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন পরিচিত মিস্টার রায়। চাক্ষুষ ও সাক্ষাৎ আমাদের মধ্যে পরস্পর-পরিচয়ের সৌভাগ্য না ঘটলেও, আপনার কথা শুনে শুনে মনে হত কি জানেন?
কি?
পড়তেন আপনি মুখোমুখি সেরকম একজনের পাল্লায়, বোঝা যেত সত্যিকারের আপনার ক্ষুরধারটা—যাচাই হয়ে যেত হাতে হাতে ব্যাপারটা। আর তাই ওই চার-চার বিশ্বাসঘাতক শয়তানের ধ্বংসযজ্ঞে নেমে পরপর তিনজনকে হত্যা করবার পরও যখন দেখলাম আপনার টনক নড়ল না, আর স্থির থাকতে পারলাম না।
নিজেই গেলেন আমার কাছে?
হ্যাঁ।
এবং সেটাই হয়ে দাঁড়াল আপনার জীবনের সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ভুল।
তা হয়ত হয়েছে। তবু জানি, আপনি ছাড়া বোধ হয় দুনিয়ায় কারও সাধ্য ছিল আমাকে ধরে। ধরা পড়েছি বলে আমার কোনও দুঃখ নেই মিস্টার রায়, আমার প্রতিজ্ঞা আমি পূর্ণ করেছি। I have done my duty!
কিন্তু এ কাজ কেন করতে গেলেন, হীরেনবাবু? কেন যেন কিরীটীর মনের মধ্যে হীরেনের প্রতি একটা মমতা জাগে।
কেন করতে গেলাম!
হ্যাঁ, আইন ছিল দেশে, আইনের আশ্রয় নিলেই তো পারতেন।
কিছু হত না তাতে করে। আইনের সাধ্য ছিল না ওই পাষণ্ডদের কেশ স্পর্শ করে। ওই ধূর্ত শয়তান শৃগালের দলকে ধরা যেত না হাতেনাতে। তাই ওই পথটাই আমি বেছে নিয়েছিলাম।
তারপর একটু কেশে বললে হীরেন সরকার, কিন্তু আপনি সত্যি বলুন তো, আমাকে সন্দেহ করলেন কি করে?
যে মুহূর্তে জানতে পেরেছিলাম, ওরা চারজনই আপনাদের পূর্বতন কর্মচারী ছিল এবং ওদেরই জন্য আপনাদের ব্যবসায় ভরাড়ুবি হয়েছিল তখনি–
কি?
ওদের হত্যার মোটিভটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। তবে—
তবে?
মোটিভটা খুঁজে পেলেও তখনও স্থিরনিশ্চিত হতে পারিনি, আপনাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে কে এ কাজ করেছে! কিন্তু আপনার আমার গৃহে আসা ও তারপর আপনার হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার আট মাস আগে থাকতে পঙ্গু বনে যাবার ইতিহাস, আপনার অভিনয়-ক্ষমতা সব মিলিয়ে আপনার উপরেই আমার সন্দেহটা পড়ে।
কেবল কি তাই?
আরও আছে।
কি?
সংবাদপত্র প্রত্যহে প্রকাশিত ধারাবাহিক বিজ্ঞাপনটাও আমার চোখের দৃষ্টি খুলে দিয়েছিল। আর শেষ ও মোক্ষম প্রমাণ–
কি?
পকেট থেকে কিরীটী সোনার একটা সিগারেট কেস বের করল।
এই সোনার সিগারেট কেসটা! এটা শিবানন্দর দোকানের শো-কেসের তলায় পড়ে থাকতে দেখে সবার অলক্ষ্যে তুলে নিতেই আর মনে সন্দেহের অবকাশ মাত্রও রইল না আমার।—চিনতে পারছেন এটা?
হীরেন সরকার হেসে হাত বাড়ল—নিশ্চয়ই। দিন ওটা।
উঁহু, এটা আদালতের property এখন—
দেবেন না?
না।
আগের পর্ব :
০১. বছর দশ-বারো আগেকার কথা
০২. চা-জলখাবার নিয়ে আসি
০৩. ঘণ্টাখানেক বাদে কিরীটীও বের হচ্ছে
০৪. সুব্রত বললে, তাহলে তুই বলতে চাস
০৫. বিকাশ সেন আবার শুরু করে
০৬. দিন চারেক বাদে কিরীটী
০৭. ল্যান্সডাউন মার্কেটের কাছাকাছি
০৮. সুব্রত হাসতে হাসতে বলে
০৯. এবার কি কর্তব্য বলুন