০৬. দিন চারেক বাদে কিরীটী
দিন চারেক বাদে কিরীটী কলকাতায় ফিরে এল।
আগেই দিল্লী থেকে ট্রাঙ্ককল করে দিয়েছিল কিরীটী, গাড়ি এয়ারপোর্টে পাঠাবার জন্য।
বাড়ি পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে ঘরে ঢুকতেই দেখে সুব্রত বসে আছে।
সুব্রত জানত কেন কিরীটী দিল্লী গেছে। সে বললে, কি হল, দিল্লীর ব্যাপারের কোন হদিস করতে পারলি?
ব্যাপারটা জটিল। সময় শেষ, তবে মনে হচ্ছে—
কি?
কিরীটী সোফার ওপরে বসে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করতে করতে বললে, আমাদের বিকাশ সেনকেও কথা দিয়েছি, নচেৎ কটা দিন ওখানে আরও থেকে প্রাথমিক ব্যাপারটা শেষ করে আসতাম।
কৃষ্ণা এসে ঘরে ঢুকল, তার হাতে ছোট একটা ট্রের উপর ধূমায়িত দু কাপ কফি নিয়ে।
শরীর ভাল আছে তো? কৃষ্ণা সহাস্যে শুধায় কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে।
কফির কাপটা হাতে নিতে নিতে কিরীটী বললে, ভাল। নে সুব্রত।
সুব্রতও একটা কাপ তুলে নিল। কৃষ্ণা পাশেই বসল কিরীটীর।
শীতের ছোট বেলা বাইরে তখন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। পড়ন্ত আলোর সঙ্গে একটা আবছায়া ঘনাচ্ছে যেন।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী বললে, এখানে বেশ শীত পড়েছে দেখছি।
সুব্রত বললে, হ্যাঁ, পরশু থেকে। দিল্লীতে শীত কেমন পেলি?
রাজধানীর ব্যাপার তো, কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, হাড়-কাপানো! তার পর তোর হীরেন সরকারের সঙ্গে দেখা করেছিলি সুব্রত?
গিয়েছিলাম।
গিয়েছিলি? কবে আসছে?
তার পক্ষ আসা সম্ভব নয়।
কেন? আসতে চায় না বুঝি?
না, বেচারী মাস আষ্টেক ধরে একেবারে শয্যাশায়ী।
শয্যাশায়ী! কি হয়েছে কি?
লোয়ার মটোর প্যারালিসিসে পা দুটো পঙ্গু, শয্যা থেকে উঠতেই পারে না। রোগা। হয়ে গেছে।
তাই নাকি!
তাই দেখলাম। বললে, তুই ডেকেছিস, আলাপ করতে চাস-এ যে তার কি সৌভাগ্য! কিন্তু আসতে পারবে না–
কিরীটী বললে, তাতে আর কি হয়েছে, আমরাই না হয় যাব আজ।
আজই যাবি?
হ্যাঁ। ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করা একটিবার বিশেষ দরকার। তা ভদ্রলোকের অবস্থা কেমন দেখলি? দোকান উঠে যাবার পর–
দোকানটা ওদের তিনজনের ছিল—মানে জ্যাঠতুত, খুড়তুত তিন ভায়ের। ওদের বাবা কাকা জ্যাঠারা অনেক দিন আগেই মারা গেছেন।
তারপর?
ওরা তিন ভাই-ই দোকানটা দেখাশোনা করছিল-চলছিলও বেশ। হঠাৎ একদিন আবিষ্কৃত হল, ভেতরে ভেতরে শনির দৃষ্টি পড়েছে দোকানটার ওপরে।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। যেদিন ব্যাপারটা আবিষ্কৃত হল, অর্থাৎ ওরা জানতে পারল, দেখলে ওদের কারিগরেরাই ওদের পথে বসিয়েছে।
কারিগরেরা পথে বসিয়েছে কি রকম?
আসলে ওদের তিনজনের একজনও কাজকর্ম কিছু জানত না। ধনী গৃহের ছেলে,–সোনার চামচ মুখে দিয়ে সব জন্মেছিল। কখনও দোকানের কাজকর্ম যেমন কিছু শেখবার চেষ্টা করেনি, তেমন কাজকর্মও বুঝত না। ওদের ছোট কাকাই সব দেখাশোনা করছিল, তার আর দু ভাইয়ের মৃত্যুর পর। ওরা মধ্যে মধ্যে সেজেগুজে দোকানে আসত। আর মোটা মাসোহারা নিত। তিন ভাই দামী দামী গাড়িতে চড়ত, বাবুয়ানী করত। একজনের ছিল রেস খেলার বাতিক, একজনের দেশভ্রমণের বাতিক, আর হীরেনের। ছিল থিয়েটারের বাতিক–
থিয়েটার।
হ্যাঁ। ভাল চেহারা না থাকলেও অভিনয় সে ভালই করত। নামও করেছিল। একটা নামকরা পাবলিক রঙ্গমঞ্চে অ্যামেচার অভিনেতা হিসাবে অভিনয় করত। হীরেনের বাবা আগেই মারা গিয়েছিল। ছোট ভাই কর্তাদের মধ্যে। মেজ কর্তার সন্তানাদি ছিল না। বড়কর্তার দুই ছেলে—হরেন্দ্র আর নীরেন্দ্র।
কিরীটী নিঃশব্দে শুনতে থাকে।
বাইরে আসন্ন সন্ধ্যার ধূসরতা নামে। সেই সঙ্গে শহর কলকাতার চাপ-চাপ ধোঁয়া।
সুব্রত বলতে লাগল, ছোটকর্তার মৃত্যুর পর তিন ভাই দোকানে বসতে শুরু করল। তবে ওই নামেই—সব ভরসা কর্মচারীদের ওপরেই। কেউ কোন কাজ জানো না। ওরা যা করে, যা বোঝায়—তাই ওরা বোঝে।
মাস আষ্টেক বাদে এক খরিদ্দার এল-ভদ্রলোক তো মহা খাপ্পা–
কেন?
যে গহনা তিনি করে নিয়ে গিয়েছেন, তার বোল আনার মধ্যে বারো আনাই নাকি খাদ। পরীক্ষা করে দেখা গেল কথাটা মিথ্যা নয়, সত্যিই তাই। ওরা আর কি করে, খেসারত দিল মোটা টাকার।
Interesting!
কেবল ওই খরিদ্দারটিই নয়—বিরাট ঢালাও কারবার, মাস দুয়েকের মধ্যে আরও বিশজন খরিদ্দার ওই একই কমপ্লেন নিয়ে এল। সোনায়ই যে কেবল খাদ তাই নয়, জড়োয়া গয়নার মধ্যে যে সব জুয়েলস দিয়েছে তাও মেকী।
তিন ভাই মাথায় হাত দিয়ে বসল, এ কি ব্যাপার! কিন্তু তখন যা হবার হয়ে গেছে, তলে তলে দোকান ফাঁক। সোনা যত স্টকে ছিল এবং যত রেয়ার জুয়েলস্ ছিল, সব উধাও। ঝাঝরা হয়ে গেছে দোকানটা। সবচাইতে পুরনো চারজন কর্মচারী ছিল—তাদেরও তারা ডাকল, এবং কর্মচারী চারজন কারা জানিস?
জানি শশধর, শ্ৰীমন্ত আর হারাধন নিশ্চয়ই। কিরীটী বললে।
তুই জানলি কি করে?
জানি। কিন্তু চতুর্থ ব্যক্তির নামটি কি শিবানন্দ বসু?
তুই জানলি কি করে?
জানি। তারপর একটু থেমে বললে, তাহলে দেখছি, আমার অনুমান ভুল নয়। কিরীটীর চোখের মণি দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
কৃষ্ণা বললে, কেমন করে ওদের নাম তুমি জানলে গো? শশধর শ্রীমন্ত আর হারাধন না হয়—
বিজ্ঞাপনের কবিতাটা তোমরা ভুলে গেলে কৃষ্ণা! তাছাড়া শিবানন্দ যে এসে ছিল নিজেই।
তবে? কৃষ্ণা শুধায়।
কি তবে?
তাকেও মরতে হবে নাকি?
অঙ্ক অনুযায়ী তাই তো হওয়া উচিত। কবিতার মিলের জন্যই। যাক, ধোঁয়াটে ব্যাপারটা পরিষ্কার এখন বোঝা যাচ্ছে। খুব জটিল নয়।
হত্যাকারীকে ধরতে পেরেছ? কৃষ্ণা শুধায়।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, একেবারে যে পারছি না তা নয়। তবে উদ্দেশ্যটা-হত্যার উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। আর মোটিভ যখন জানা গেছে, বাকি রহস্যটুকুও উদ্ঘাটিত করতে আর বেশি বেগ পেতে হবে না। তুই বস্ সুব্রত, স্নান করে জামাকাপড়টা বদলে আসি।
কৃষ্ণা আর সুব্রত বসে বসে গল্প করে।
কিরীটী ভেতরে চলে যায়।
আধ ঘণ্টা পরে কিরীটী ফিরে এল। পরনে তার গরম পায়জামা ও পাঞ্জাবি, গায়ে একটা সাদা শাল।
সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বলে, উত্তিষ্ঠ বৎস!
এখন কোথায় আবার বেরুবি?
কোথায় মানে? তোর সেই পরিচিত পঙ্গু ভদ্রলোক হীরেন সরকারের ওখানে!
এখুনি?
আজ এবং ইমিডিয়াটলি। চল্ ওঠ। বেশি রাত হয়নি, মাত্র আটটা-শীতের রাত এমন কিছু নয়।
সুব্রত জানে কিরীটীকে থামানো যাবে না। ও যখন যাবে বলেছে, তখন যাবেই। কাজেই সে উঠে দাঁড়াল।
এই রাত্রে না গিয়ে কাল সকালে গেলেই হত।
না, চ। হীরেনের সঙ্গে দেখা করতেই হবে।
কখন ফিরবে? কৃষ্ণা শুধায়।
বৌবাজার থেকে ফিরতে আর কতক্ষণ লাগবে! কিরীটী বলে।
সুব্রত বলে, সে তো বৌবাজারে থাকে না। সে এজমালি পৈতৃক বাড়ি তো কবেই দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গেছে সরকারদের!
তবে? ভদ্রলোক এখন থাকেন কোথায়?
ল্যান্সডাউন মার্কেটের কাছে হীরেন অন্য একটা বাড়িতে থাকে।
তাই নাকি? তবে তো সে কাছেই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তো তাহলে ফিরতে পারব। নে, চল্।
ওরা দুজনে বের হয়ে গেল।
আগের পর্ব :
০১. বছর দশ-বারো আগেকার কথা
০২. চা-জলখাবার নিয়ে আসি
০৩. ঘণ্টাখানেক বাদে কিরীটীও বের হচ্ছে
০৪. সুব্রত বললে, তাহলে তুই বলতে চাস
০৫. বিকাশ সেন আবার শুরু করে
পরের পর্ব :
০৭. ল্যান্সডাউন মার্কেটের কাছাকাছি
০৮. সুব্রত হাসতে হাসতে বলে
০৯. এবার কি কর্তব্য বলুন
১০. সরু রাস্তাটা থেকে সকলে