হঠাৎ একদিন সে নক করে বললো, আপনি কি তেজগাঁও কলেজে পড়েন? আমি উত্তর করলাম, হ্যাঁ। সেই থেকে শুরু। ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে চলে এলো সম্পর্কটা। ধীরে ধীরে একসময় ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’তে। আমি আমার সব কথাই তার সাথে শেয়ার করতাম। সেও করতো। দু’জনের মধ্যে থাকা সম্পর্কের বাধনটা অতি মজবুত ছিল।
তখনো তার সাথে আমার দেখা হয়নি। পায়ে অাঘাত লেগে ইনফেকশন তৈরি হওয়ার কারণে তার পায়ের অপারেশন চলে তখন। সেজন্য তার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে কলেজে আসতে পারতো না। এদিকে আমি অধীর আগ্রহে থাকতাম, কবে তার পা ঠিক হবে। একদিন মেসেন্জারে কথা বলার সময় তাকে বললাম, আগামীতে আমাদের মাঝে থাকা এই সম্পর্কটা আর থাকবে না।সে সহজভাবে উত্তর করলো, কেন?আমি বললাম, কারণটা বলতে পারবো না। তবে সম্পর্ক থাকবে না, এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। পারলে এই কথাটা স্ক্রিনসট দিয়ে রাখ। সে বললো, কখনোই এমনটা হবে না।
ধীরে ধীরে তার প্রতি দূর্বল হতে থাকলাম। একদিন মেসেন্জারে তাকে “ভালবাসি”ও বললাম। সে উত্তর করলো, আমিও বাসি। তবে বন্ধু হিসেবে। প্রতিরাতেই তাকে বিরক্ত করতাম। কথায় কথায় “ভালবাসি” বলতাম। সে বিরক্ত হতো ঠিকই। তবে প্রকাশ করতো না খুব একটা। একদিন সে বলেই বসলো, দেখ এসব প্রেম ভালোবাসা আমার পছন্দ না। এরপরেও তাকে বিরক্ত করতাম। মাস কয়েক আগে সে জানালো তার পা মোটামোটি ঠিক হয়ে গিয়েছে। আগামী সপ্তাহে সে কলেজে আসবে। এদিকে আমি ধৈর্যহারা হয়ে যাচ্ছি। আগামী সপ্তাহ আসতে আরো বেশ কিছুদিন বাকি।
দেখতে দেখতে শুক্রবার চলে এলো। আমি তাকে নক করলাম। বললাম, কাল দেখা হচ্ছে তাহলে। সে বললো, শনিবার আমার সেমিস্টার অফ। রবিবারে দেখা হবে।রবিবার চলে গেল। তবু সে এলো না। ধীরে ধীরে সপ্তাহটাই পেরিয়ে গেল। পরের সপ্তাহে সে কলেজে এলো। তাকে কল করলে সে বললো, ক্লাসে আছি। আমি বললাম, ক্লাস শেষ করে ক্যাফে আয়।দেখা হলো। আংশিক কথা হলো। ধীরে ধীরে সম্পর্কের দুরুত্ব বাড়লো। এর মাঝে কলেজের এক বড় ভাই একটা পাবলিক গ্রুপ খুললো। সেখানে মেয়েটি আমাকে এড করলো। কালানুক্রমে সেই গ্রুপের এডমিনও হয়ে গেলাম আমি। তাকেও এডমিনে এড করলাম।
সম্পর্কের দুরুত্ব বাড়লেও “হাই হ্যালো, কেমন আছিস” এটুকু কথা হতো। কলেজের একটা ছেলে আমাদের ঐ পাবলিক গ্রুপে কী যেন একটা পোস্ট করে। পোস্টটি অসঙ্গত হওয়ায় এডমিন কর্তৃক পোস্টটি ডিলিট করা হয়। যার কারণে ছেলেটি বেছে বেছে তাকে নক করে। সেই সময় আমাদের গ্রুপে তিনজন মেয়ে এডমিন ছিল।
ছেলেটি তাকে নক করে হুমকি ধামকি দিলে সে আমাকে ব্যাপারটা জানালো। আমি তাকে বললাম, কোন ছেলে তোকে হুমকি দিচ্ছে?
সে কিছুতেই নাম বলে না। পরে আমি এক্টিভিটি লগ চেক করে তিনজনের একটা লিস্ট দিলাম। বললাম, এই তিনজনের মধ্যে কে?সে তবুও বলে না। সে শুধু বলে, তুই ঝামেলা করিস না প্লিজ।একটু জোর দিতেই সে ছেলেটির নাম বললো। আমি তৎক্ষণাৎ ছেলেটিকে মেসেজ দিলাম, কিরে? গ্রুপ নাকি খেয়ে দিবি? এতো বড় সাহস দিল কে তোকে? আর গ্রুপের মেয়ে এডমিনকে হুমকি দেওয়ার সাহসই বা দিছে কে তোকে? মেয়েটি আমাকে বারবার বলতে লাগলো, দেখ সে রাজনীতি করে। তাছাড়া সে সিনিয়র। তুই সরি বল তাকে। তার কথায় আমি ছেলেটিকে সরিও বললাম। তারপর কনভার্সেশন এভরিওয়ান ডিলিট দিলাম। যাতে সে দেখতে না পারে। তবুও ছেলেটি কিভাবে যেন প্রথম মেসেজটি দেখে ফেলে।
ছেলেটি আমার বাপ মা তুলে আমাকে গালি দিতে থাকলো। আমি কিছুই বললাম না। সে আমাকে হুমকি দিল। আমাকে নাকি ক্লাস থেকে তুলে নিয়ে যাবে।আমি এরকম হুমকি শুনে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। পরে গ্রুপের অন্য একজন এডমিনকে বিষয়টা জানালাম। তিনি আমাকে বললেন, তোকে কে ক্লাস থেকে তুলে নিয়ে যায় সেটা আমি দেখবো। তুই আমার নাম্বার রাখ। একটু সাহস পেলাম উনার কথায়। উনিও সিনিয়র। আর এক বছর গেলেই তেজগাঁও কলেজে উনার পড়ালেখা শেষ হবে। আমি উনাকে বললাম, ভাইয়া এসব ব্যাপারে যেন সে (মেয়েটি) কোনো কিছু না জানে। ঐ ছেলে আমারবেয়াদবির জন্য আমাকে দু’চারটা চড় থাপ্পড় মারুক। তবু সে যেন কিছু না জানে। উনি বললেন, চড় থাপ্পড় মারবে মানে? আমি আছি কী করতে?
এদিকে আমি সাহস পেয়ে গেলাম। আগের মতো আবার কলেজে যেতে থাকলাম। কিন্তু এর মাঝে আমাদের ক্লাসের কিছু ছেলে আমাকে নক করে বললো, কিরে তোকে অমুক খোঁজে কেন? কাল কলেজে আয়, যা হয়েছে মিটমাট করে নে। আমার মধ্যে আবারো ভয়ের উদয় হলো। আমার বন্ধু সৌরভ বললো, বেটা চিন্তা নাও কেন তুমি? আমি আছি কি বালকরতে? কোন ছেলে তোকে ক্লাস থেকে তুলে নিয়ে যায়, সেটা দেখবো আমি।আমি বললাম, তোর তো হাত ভেঙে গেছে। তুই আর কিভাবে দেখবি? সে বললো, কোন ছেলে তোকে হুমকি দেয় তার ছবি দেখা। আমি তাকে ছবি দেখালাম। সে হেসে বললো, এই ছেলে? আমি বললাম, হ্যাঁ। সে বললো, আরে হাত ভেঙে গেছে তো কী হয়েছে? এইরকম দুই তিনটা ছেলে আমার এই এক হাতের কাছে কিছুই না।
আমি বিশ্বাস করলাম। কেননা, তার বডি ফিগনেস দারুণ। এদিকে জীম করা বাদ দিয়েছি অনেকদিন হলো। ঘটনা বেগতিক দেখে টুকটাক আবারো শুরু করলাম। ছেলেটি বরাবরের মতো আমাকে হুমকিসহ বাপ মা তুলে গালাগালি করেই চলেছে। আমি তাকে তখন অব্দিও আপনি করে বলতেছি। হঠাৎ একদিন প্রিন্সিপ্যালের রুমের সামনে ছেলেটিকে দেখলাম। তাকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছি। কিন্তু সে আমাকে চিনতে পারেনি। কেননা ফেসবুকে আমার কোনো ছবি দেওয়া নেই। ছোটখাটো মাপের গান্ডুগুণ্ডু ছেলে। মনে মনে বললাম, তুই আমাকে হুমকি দিস? তুই আমাকে গালি দিস? এবার তুই দিয়ে দেখিস। আর হিম্মৎ থাকলে দলবল না নিয়ে একা লাগতে আসিস।
এদিকে মেয়েটির সাথে সম্পর্কে দুরুত্বটা ক্রমান্বয়ে অনেকখানি বেড়ে গেল। আমি কল করলে সে রিসিভ করে না। মাঝে মাঝে কেটেও দেয়। কলেজে দেখা হলেও কথা বলে না। আমি যদি তাকে বলি, তুই অতগুলা ছেলেদের সাথে ঘুরিস, আড্ডা দিস। আমার সাথে ঘুরলে, আড্ডা দিলে দোষ কোথায়? তারা তোর বন্ধু, আমিও তোর বন্ধু। সে কোনো উত্তর করে না। শুধু বলে তারা নাকি তার ক্লাসমেট। এইতো মাসখানেক হবে। তাকে নক করে বললাম, ঐ ছেলে তোর ফ্রেণ্ডলিস্টে কী করে? সে বললো, কোন ছেলে? আমি বললাম, ঐযে ঐ ছেলে। তোর জন্য যার সাথে ঝামেলা করেছিলাম। সে বললো, আমার জন্য মানে? আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে। তোর জন্য না। তো যাইহোক, ঐ ছেলে তোর লিস্টে কী করে? সে বললো, কেন? কিছুই করে না।
আমি বললাম, কিছুই করে না মানে? সে তোর পোস্টে লাইক কমেন্ট করবে কেন? তুই এখনই তাকে ব্লক করবি।
সে বলে, ব্লক করবো না। আমি তাকে ঐ ছেলের সাথে হওয়া আমার কনভার্সেশনের স্ক্রিনসট দিয়ে বললাম, দেখ সে আমার বাপ মা তুলে আমাকে গালি দিয়েছে। তবুও তুই ব্লক করবি না? সে বলে, না করবো না। এক পর্যায়ে আমিই তাকে ব্লক করে দেই। তাকে ব্লক দেওয়ার সাথে সাথে সে আমার প্রতিটা পেজ থেকে লিভ নেয়। অর্থ্যাৎ তাকে আমি আমার প্রতিটা পেজের এডমিন করেছিলাম। সে সেখান থেকে লিভ করে। তার অমন কার্য দেখে আমি আমাদের কলেজের ঐ গ্রুপ থেকে তাকে রিমুভ করে ব্লক করে দেই।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে মনে হলো, তার সাথে একটু বেশিই করে ফেলেছি বোধ হয়। তৎক্ষণাৎ তাকে কল করলাম। কিন্তু একি! সে আমার নাম্বার ব্লাকলিস্ট করে রেখেছে। কলেজে গিয়ে তার ক্লাসরুমের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে ব্লক থেকে মুক্ত করে টেক্সট করলাম, ঐ ছেলের জন্য তুই আমার নাম্বার ব্লক করলি? খানিকপর দেখলাম সে আমাকে ফেসবুক থেকেও ব্লক করে দিলো। এর মাঝে বিভিন্নভাবে আকুতি মিনতি করে ব্লক ছাড়াতে সক্ষম হলাম। সম্পর্কে সেই কবেই ভাটা পড়েছে। ব্লক ছাড়ালেও তেমনটা কথা হতো না। একদিন রাতে তাকে নক করতে গিয়ে দেখি সে আবারো ব্লক করেছে। তার নাম্বারে কল করতে গিয়ে দেখি নাম্বারও ব্লাকলিস্ট করে রেখেছে। কিন্তু কেন করলো, তার কারণ আমার অজানা।
পরদিন কলেজে গিয়ে তার পিছে ঘুরলাম কিছুক্ষণ। সে আমার সাথে কথা বলতেই চায় না। যেন আমি তার কাছে ঘৃণ্য কোনো প্রাণী। তাকে ব্লক করার কারণ জানার জন্য অধিক জোড়াজুড়ি করাতে সে আমাকে বললো, শ্রাবণ তুই আমাকে ভুলে যাস। তারপর সে লিফটে করে উপরে চলে গেল। আর আমি চলে এলাম বাসায়। জীবনে “বাপ মা আর নানি” ছাড়া কারো জন্য কান্না করিনি। কিন্তু সেদিন তার জন্য কান্না করেছিলাম। অবশ্য এর আগেও কেঁদেছি তার জন্য।
প্রায় দিনই তাকে কল করতাম। কিন্তু বারবার ব্যস্ত দেখাতো। তার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। কলেজে যাই না আমি। দেখাও হয় না। বড্ড ইচ্ছে করতো তার সাথে একটু কথা বলতে। কিন্তু পারতাম না। এমন কোনো রাত নেই যে, তার ছবি দেখিনি আমি। পরে নতুন একটা ফেসবুক একাউন্ট খুলে তার আইডিতে ঘুরতাম। দেখতাম, সে ভালোই আছে। তার খোঁজ নেওয়ার মতো অনেকে আছে। আর আমি বলদ শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছি। হাজারভাবে মনকে বুঝালেও মন বুঝতো না।
বিশ ডিসেম্বর, আমার জন্মদিন ছিল। তার থেকে শুধু উইশটা প্রত্যাশা করেছিলাম। সেটাও পেলাম না। সেদিন ২৪ ডিসেম্বর রাত বারোটা বেজে বায়ান্ন মিনিটে সে আমাকে কল করলো। আমি তখন ভাইয়ার পাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলাম। আর ভাইয়া আমার ফোন নিয়ে ইসলামিক আলোচনা শুনছিলেন। উনাকে রাত বারোটা পর্যন্ত আরবি শিখিয়ে আমি ঘুমিয়ে যাই। তাছাড়া উনার আদেশ, আমি যেন রাত বারোটার পর ফেসবুক না চালাই। যদি চালাই, তবে তিনি আমার ফোনটা নিয়ে টাইলসের উপর আছাড় মারবেন।
ভাইয়া আমাকে ডেকে তুলে বললেন, দেখ কে যেন কল করেছে তোকে। আমি ঘুম ঘুম চোখে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি সে কল করেছে। রিসিভ করতে যাবো, ঠিক তখনই মনে হলো, “আরে এ তো মেসেন্জারে কল করেছে। তার মানে ব্লক ছাড়িয়েছে!” এদিকে ভাইয়া আমাকে দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি ভাইয়াকে বললাম, রিসিভ করবো? তিনি বললেন, কর। আমি রিসিভ করে সালাম দিয়ে হ্যালো হ্যালো বললাম। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে কল রেখে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। খানিক পর ভাইয়া বললেন, এই নে চ্যাটিং কর। সে তোর সালামের উত্তর দিয়েছে। আমার চোখে তখন প্রচুর ঘুম।
গল্প এতটুকুই। তবে ঐযে তাকে একদিন বলেছিলাম, আমাদের মাঝে থাকা এই সম্পর্কটা একদিন থাকবে না। প্রত্যুত্তরে সে বলেছিল, এমনটা কখনোই হবে না। কিন্তু আমি জানতাম, এমনটা হবে। আর হলোও তাই। দেখা যায় বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা সম্পর্কও নষ্ট হয়ে যায়। আর এটা তো আট ন’মাসের সম্পর্ক। সো, এমনটা হওয়া স্বাভাবিক।