সন্ধ্যা হয়ে এসেছে৷ হাত ঘড়িতে ছয়টা বাজতে দেখে চৈতীর বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠলো৷ রিকশায় পাশে বসা রাতুলকে বলল, ‘অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ এখন আমাকে বাসায় যেতে হবে৷’ চৈতীর হাতের উপর হাত রাখলো রাতুল৷ নীরব স্বরে অনুনয় করে বলল, ‘আর কিছুটা সময় থাকা যায় না?’ রাতুলের হাতটা শক্ত করে ধরলো৷ তারপর হাতটি ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘উহু! একদমই সম্ভব না৷ মুহিতের বাসায় আসার সময় হয়ে এসেছে৷’
রাতুল চৈতীর মুখে তাকালো৷ বিকেলের আলোয় ওর মুখটা উজ্জ্বল দেখিয়েছিল৷ কিন্তু সন্ধ্যার অন্ধকারে মুখখানা ম্লান হয়ে আছে৷ দিকহারা চেহারায় যে হতাশা ভর করে৷ সেই হতাশা চৈতীর মুখে দেখতে পেল রাতুল৷ বিকেলের আলোতেও চৈতী হেসেছে৷ বান্ধবীদের বিষয়ে গল্প করেছে৷ সিনেমার রোমাঞ্চকর কাহিনী খুব রোমাঞ্চিত হয়ে বলেছে৷ কিন্তু যেই এখন মুহিতের কাছে যাওয়ার সময় হলো— ওমনই হাসি , উত্তেজনা, গল্প সব অন্ধকারে একসাথে মিশে গেল৷ খানিকটা রাগের স্বরে রাতুল বলল, ‘এভাবে কত দিন চলবে? কত দিন আর ইচ্ছের বাইরে থেকে মুহিতের সাথে সংসার টিকিয়ে রাখবে? আমাদের ভালোবাসার সম্পর্কের চার বছর চলছে৷ যখন আমি কর্মহীন ছিলাম তখন পরিবারের চাপে বিয়ে করেছ৷ যে বিয়ের সম্পর্কটা শুধু মাত্র কাবিন নামায় সীমাবদ্ধ৷
তখন তোমার কিছুই করার ছিল না৷ কিন্তু আজ আমি ভালো পয়সা আয় করছি৷ তোমার এখন অনেক কিছুই করার আছে৷’ এক টানে এ কথা গুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রাতুল৷ তারপর বোঝানোর ভঙিমায় নরম স্বরে বলল, ‘চৈতী, তুমি শুধু কাবিন নামার সম্পর্কটা তালাক নামায় রুপান্তর করো৷ এরপর তোমার সুখের দায়িত্ব, তোমাকে ভালোবাসার দায়িত্ব— সব আমার়৷ কথা দিচ্ছি৷ ’ কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে উত্তরে চৈতী কেবল বলল, ‘শরীরটা ভালো লাগছে না৷ মাথা ঘুরছে৷ রিক্সাটা বাসার দিকে নিয়ে যেতে বলো৷’ কিছুকালের জন্য ওদের মাঝে এক নীরবতা নেমে এলো৷ কেউ কোন কথা বলছে না৷ রাতুল মাঝে মাঝে ঘাড় বাকিয়ে চৈতীকে দেখছে৷ চৈতী সোজা তাকিয়ে আছে বাড়ির গন্তব্যে৷
বাড়ির সামনে এসে রিক্সা থামলো৷ চৈতী রিক্সা থেকে নেমে তিন তালার অন্ধকার বারান্দায় চোখ রেখে এক ছায়া মূর্তি দেখতে পেল৷ মুহিত অফিস থেকে ফিরেছে৷ বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে৷ চৈতী খানিকটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেল এই ভেবে যে— স্বামী দেখছে বউ তার প্রেমিকের সাথে রিক্সা থেকে নেমেছে৷ কিছুটা ভয়ও হলো ওর৷ যদিও ভয়ের কোন কারন নেই৷ মুহিত গায়ে হাত তোলে না, আজে বাজে বকেও না৷ তবুও ওর ভয় করছে৷ রাতুলকে ‘যাই’ বলে চৈতী বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লো৷ রাতুল বারান্দায় ছায়া মূর্তির দিকে চোখ ফেলে রিক্সাওয়ালাকে নির্দেশ দিল সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য৷
ঘরে প্রবেশ করে দেখলো সব বাতি বন্ধ৷ অন্ধকারের মাঝেই পা টিপে টিপে শোয়ার ঘরে ঢুকলো চৈতী৷ বাতি জ্বালিয়ে দেখলো ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে মুহিত৷ চোখ দুটো হায়নার চোখের মত লাল হয়ে আছে৷ যেন এখনই চৈতীকে ছিড়ে খেয়ে ফেলবে৷ খাটের পাশে ছোট টেবিলে তাকালো চৈতী৷ দেখলো গতকালের কেনা হুইস্কির বোতল অর্ধেকটা খালি হয়ে গেছে৷ এর মানে মুহিত অনেকখন হলো অফিস থেকে ফিরেছে৷ এসেই ড্রিংস শুরু করেছে৷ মুহিতের দিকে না তাকিয়ে ওড়নায় গাথা সেফটিপিন খোলার মাঝে চৈতী বলল, ‘কখন এসেছ?’ মুহিত গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে বলল, ‘বিকেলে এসেছি৷ আজ অফিসে তেমন কাজ ছিল না৷’
—‘দুুপুরে মিতুদের বাসায় দাওয়াত ছিল৷ সেখান থেকে ফেরার পথে রাতুলের সাথে দেখা৷’
—‘আমি কি শুনতে চেয়েছি কোথায় গিয়েছিলে? আমাদের সম্পর্ক কি জবাবদিহির! আমরা তো স্বাধীন৷ যা খুশি তাই করতে পারি৷’
চৈতী মুহিতের কথায় অবাক হলো না৷ বরং তার কাছে মিথ্যা কৈফিয়ত দিয়াতে অবাক হলো৷ রাতুলের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো তা সরাসরি বললেও কিছু যায় আসতো না৷ কিন্তু কেন মিথ্যা কথাটি বলতে গেল! কোন অদৃশ্য ভয়ের কারনে নাকি লজ্জা থেকে আসা অনুশোচনা বোধ৷ চৈতীর মনে এমন কথা ঘুরতেই মুহিত বলল, ‘ তোমার শরীর এখন কেমন? ’
—‘হুম, ভালো৷’
চৈতীর কাছে গিয়ে কপালে হাত রাখলো মুহিত৷ বলল, ‘ভালো কোথায়! জ্বরতো দেখছি অনেক৷ মুখটাও তো শুকনো লাগছে৷ দুপুরে খাওয়া দাওয়া করোনি?’
—‘হ্যা, খেয়েছি৷ মিতু আমার পছন্দের খিচুরী আর ডিম ভাজি করেছিল৷’
—‘আচ্ছা৷’
—‘তোমার হাতের গ্লাস সহ কয় প্যাগ হলো?’ মুহিতকে প্রশ্নটি করে বুক সেল্ফের দিকে এগিয়ে গেল চৈতী ৷
—‘এইট রানিং৷’
মুহিত নীরবে গ্লাসে চুমুক দিয়ে চৈতীকে দেখছে৷ বুক সেল্ফ থেকে শরদিন্দুর এক বই হাতে নিল ও৷ সেই হাতের দিকে তাকিয়ে মুহিত বলল, ‘তোমার হাতের কনুইয়ের উপরে ঐটা কিসের দাগ? দেখে মনে হচ্ছে রক্ত জমে আছে৷’
হাত ঘুরিয়ে সেই জায়গাটা দেখলো চৈতী৷ এমন গোল হয়ে রক্ত জমে আছে সেটি আগে খেয়াল করেনি ও৷ ভালো করে দেখে বলল, ‘হয়তো রিক্সার সাথে লেগে এমন হয়েছে৷’
—‘ক্ষত জায়গাটায় খানিকটা বরফ ঘষলে ঠিক হওয়ার কথা৷ আমি ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে আসছি৷ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরে গেল মুহিত৷’
মুহিতের এমন যত্ন নেশার ঘোরের জন্য না৷ আড়াই বছরের বৈবাহিক সম্পর্কের মাঝে তাকে এমন যত্নশীল দেখছে চৈতী৷ কিছু সময়ে ওর মনে হয়, মুহিত খুব ভালোবাসে ওকে৷ এমন ভাবনার মাঝেই ফোনে রাতুল মেসেজ দিয়েছে ,’সব ঠিক আছে? ’ মেসেজটি দেখে রাতুলের নাম্বারে ফোন দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো ও৷ রাতুল ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই চৈতী বলল, ‘হ্যা, সব ঠিক আছে৷’ এ কথার পর দুজনে কিছুখন নীরবতা পালন করলো৷ নীরবতা ভেঙে রাতুল বলল, ‘তুমি আজকেই ডিভোর্সের বিষয়টা আলোচনা করবে৷ এমন চাপা সম্পর্ক আর কত সময়? কত দিন?’
—‘হ্যা, আমি বুঝেছি৷ আমি রাতেই ওকে ডিভোর্সের কথাটি বলব৷‘ এ কথায় রাতুল যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল৷ তারপর আনন্দ মাখা কন্ঠে বলল, ‘বলো ভালোবাসি৷’ চৈতী বলতে পারলো না৷ কিসের এক শক্তি যেন ওর মুখ বন্ধ করে দিল৷ ‘বলো ভালোবাসি’— কথাটি খুব অস্বস্তিতে ফেলে দিল ওকে৷
রাতুল আবার বলল, ‘ কি হলো, বলো!’ চৈতী কোন মতেই বলতে পারছে না৷ আসলে ওর মন এই কথাটি বলায় উৎসাহ জাগাচ্ছে না৷ চৈতী বারান্দার দরজা দিয়ে ঘরের ভেতর উকি দিয়ে দেখলো, মুহিত বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ ছোট টেবিলে রাখা বরফ৷ রাতুলকে বলল, ‘এখন শরীরটা ভালো লাগছে না৷ পরে কথা হবে—’ বলেই লাইন কেটে দিল৷ ঘরে ঢুকে চৈতী পড়নের জামা খুলে বাসার জামাটি পড়তেই দেখলো ওর বুকেও রক্ত জমে গোল হয়ে আছে৷ মনে হলো এলার্জির সমস্যা৷ দুটো এভিল টেবলেট খেয়ে আবার বই পড়তে শুরু করলো৷ খানিকটা পড়ে ঘাড় বাকিয়ে ঘুমন্ত মুহিতের দিকে তাকালো৷ চৈতীকে মানুষটা দিন দিন কেমন যেন এক মায়ার জালে আটকে দিচ্ছে৷
গত সপ্তাহ খানেক ধরে চৈতীর শরীরের অবস্থা ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছে৷ ক্ষণে ক্ষণে ফ্লু হচ্ছে৷ প্রতিদিনই জ্বর রয়েছে৷ শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্ত জমে জমে গেছে৷ ওজনও অনেক কমেছে৷ ওর এমন অবস্থা দেখে মুহিত অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যায় নিয়ে গেছে পিজি হাসপাতালে৷ ডাক্তার চৈতীকে দেখে, রক্ত পরীক্ষা করিয়ে বলল, ‘ব্লাড ক্যান্সার৷’ ক্যান্সার কথাটি মুহিতকে একা ডেকে বলেছে৷ কিছু শব্দের মাঝে যেন দেখতে পাওয়া যায় সুদূর ভবিষ্যৎ৷ টের পাওয়া যায় বর্তমান জীবনে আসা বিশাল এক ভূমিকম্প৷ ভেঙে পরে জীবনের ভেতর গড়া স্বপ্ন বাড়ির খুঁটি৷ সেই কিছু শব্দের মাঝে একটি হচ্ছে – ‘ক্যান্সার’৷ মুহিত যেন দেখতে পেল চৈতীর ভবিষ্যৎ৷ কিন্তু কোন মতেই তা গ্রহন করতে পারলো না৷ চৈতী চাইলে এখনই নিজের জীবন থেকে রাতুলের জীবনে পাঠিয়ে দেবে৷ কিন্তু তাকে পৃথিবী ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার সুযোগ দেবে না৷ ডাক্তার মুহিতকে চুপ থাকতে দেখে বলল, ‘মুহিত সাহেব৷’ হকচকিয়ে উঠলো মুহিত৷ ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ হ্যা বলুন৷’
—‘কি ভাবছেন?’
—‘ভাবছি এর ভবিষ্যৎ৷ আচ্ছা ডাক্তার, ক্যান্সারটি কোন স্টেজে আছে?’
ডাক্তার নীরব ভঙিতে চোখের থেকে চশমা খুলে টেবিলের উপর রাখলেন৷ সামনে রাখা পানির বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে মুহিতকে বললেন, ‘শুনুন৷ সব কিছুই জয় করা সম্ভব৷ মনের শক্তি, টাকার শক্তি, ভালোবাসার শক্তি৷ এই তিন শক্তি দ্বারা গোটা দুনিয়া জয় করা সম্ভব৷ ক্যান্সারও জয় করা যায়৷ কিন্তু সব কিছুরই একটা নির্দিষ্ট সময় আছে৷ সেই নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হলে৷ এরপর কোন কিছুই আর করার থাকে না৷ আপনি যেই সময়টায় আপনার স্ত্রীকে এনেছেন, এখন আর কিছুই করার নেই৷ হাতে সাত, আট মাস সময় আছে৷ এর মাঝে চিকিৎসা করাতে থাকুন৷ সৃষ্টি কর্তা যদি কোন ম্যাজিক দেখাতে পারে৷
—‘ওহ! হুম৷’ মুহিতের মনে হল উপরের ছাদ ভেঙে ওর কাঁধে পড়েছে৷
ডাক্তার বললেন, ‘ঔষুধ দিচ্ছি৷ আর কেমোথেরাপি চালিয়ে যাবেন৷’ মুহিত ডাক্তারের সামনে থেকে উঠে এসে দরজা দিয়ে বের হতেই দেখলো দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে চৈতী৷ মুহিতেকে দেখে বলল, ‘ডাক্তার কি বললেন?’ মুহিতের চোখে পানি জমে গেল৷ ওর মনে হচ্ছে বুকের ভেতর আগ্নেয়গিরি বিষ্ফোরিত হয়েছে৷ চোখের পানি অনেক কষ্টে আটকে রেখেছে ও৷ এই মুহূর্তে মুহিতের মনে হল, পৃথিবীতে সব চেয়ে কষ্টের কাজ হচ্ছে চোখের পানি আটকে রাখা৷
ওর খুব কষ্ট হলেও , পানি ধরে রেখে চৈতীকে বলল, ‘বাসায় গিয়ে বলছি ৷’ বাসায় এসে সরাসরি বাথরুমে ঢুকল মুহিত৷ পানির কল ছেড়ে দিল৷ সেই সাথে যেন ছেড়ে দিল চোখের পানিকে বাধা দেয়া বাধ৷ এ পানির পরিমান যেন পৃথিবীর দুই ভাগ পানির চেয়েও বেশি৷ এরই মাঝে মুহিত ঠোঁটে সিগারেট ধরালো৷ ওর এখন এক প্যাগ হুস্কি খুব দরকার৷ কিন্তু চোখে এই বন্যা নিয়ে চৈতীর সামনে কোন ভাবেই যাওয়া সম্ভব না৷ ঘরে পড়ার টেবিল চেয়ারের উপর বসে আছে চৈতী৷ রাতুলকে ফোন দিয়েছে৷ রাতুল ওকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘ডাক্তার কি বলেছে?’
—‘আমাকে বলেনি৷ মুহিতকে ডেকে কি সব যেন বলেছে৷’
—‘তুমি শোননি কি বলেছে?’ চৈতী দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনলেও তা রাতুলকে বলার প্রয়োজন মনে করছে না৷ তাই বলল, ‘মুহিত বলেনি৷’
—‘হয়তো ছোট খাটো কোন ইস্যু৷ চিন্তা করো না৷ ওকে ডিভোর্সের কথা বলেছিলে?’
—‘ছোট ইস্যু না রাতুল৷ আমার ক্যান্সার হয়েছে৷ ব্লাড ক্যান্সার৷’ রাতুলের মনে হল কেউ ওর কানের সামনে পর পর কয়েকটি বোমা ফাটিয়েছে৷ যার কারনে কান স্তব্ধ হয়ে গেছে৷ কিছুই শুনতে পায়নি৷ আবার জিজ্ঞাসা করলো, ‘কি বললে?’
—‘ঠিক শুনেছো৷’
কিছুখন নীরব থেকে কাঁপা কাঁপা স্বরে রাতুল বলল,‘এটি তেমন কিছু না৷ আমার এক দূর সম্পর্কের খালার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছিল৷ কেমোথেরাপি, এই-সেই কত কিছু করে ভালো হয়েছে৷ সিঙ্গাপুরে গিয়েও চিকিৎসা করিয়েছিলো৷ খানিকটা টাকা খরচ হয়৷ এই যা৷ তুমি চিন্তা করো না৷’
—‘আমি একদম ফাইনাল স্টেজে রাতুল৷ বড় জোর কয়েক মাস আছি৷’
—‘তুমি এত কিছু শুনলে কি করে! তোমাকে তো মুহিত কিছুই বলেনি৷’
—‘ সব কিছু কি শোনার প্রয়োজন হয়?মুখের ভাষাও অনেক কিছু বলে দেয়৷ তুমি তো জানোই আমি মুখ দেখে মনের ভাষা বুঝতে পারি৷’
কিছু বলার আর ভাষা খুঁজে পেল না রাতুল৷ বাস্তবতার সামনে মানুষের সব ভাষা, সব আবেগ যেন দিশাহারা হয়ে মনের মাঝে ঘুরতে থাকে৷ চৈতীর বুঝতে কষ্ট হলো না যে এই মুহূর্তে রাতুলের বলার কিছুই নেই৷ কি আর বা বলবে৷ সান্তনা দেবে৷ এই জগৎ-এ কিছু ক্ষেত্রে কোন প্রকার বুদ্ধি কাজে আসে না৷ সান্তনা দেয়ার মুখও থাকে না৷ ফোন কেটে দিল চৈতী৷ শুয়ে পড়লো বিছানায়৷ ওর শরীর খুব খারাপ লাগছে৷ তার চেয়েও বেশি খারাপ লাগছে মুহিতের জন্য৷ মুহিত বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখল চৈতী ঘুমিয়ে পড়েছে৷ আসলে ঘুমায়নি৷ কেবল ওর চোখ জোড়া বন্ধ৷
ওর কপালে স্নেহের হাত ছোঁয়াল মুহিত৷ সাথে সাথেই চৈতীর চোখের কোণ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো৷ ক্যান্সারের ছয় মাস পেরিয়েছে৷ এত গুলো মাসে চৈতীর কাছ থেকে মানুষ্য রূপটা হারিয়ে গেছে৷ ওর যেই সুন্দর্যের প্রশংসা করে হিংসা করত লোকে৷ তারাই এখন ওকে দেখে সহানুভূতি দেখিয়ে ভয় পায়৷ মুহিতের দশ বছরের ভাগ্নি নেসা যেই চৈতীর গালে চুমু খেয়ে সারাদিন গলায় ধরে বসে থাকতো৷ সেও এখন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে চৈতীকে দেখে যায়৷
এই মাসগুলোতে মুহিত যেন বিশাল এক বোঝা কাঁধে নিয়ে বয়ে বেরিয়েছে ধু ধু মরুভূমিতে৷ যেখানে সে কেবল এক মুঠো জলের আশা করেছিলো৷ কিন্তু তা পায়নি৷ গাজীপুরে পাঁচ কাঠা জমি বিক্রি করেছে৷ গাড়ি বিক্রি করেছে৷ ব্যাংকের সব জমানো টাকা খুইয়েছে৷ তবুও চৈতীকে নিজের কাছে রাখার আশাটুকু পায়নি৷ রাতুলের সাথে চৈতীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রায় মাস চারেক ধরে৷ পাঁচ বছর ধরে রাতুলের যেই ভালোবাসা দেখেছিলো ও৷ গত চার মাস তার ছিটে ফোটাও দেখেনি৷ এ কারনে ওর মনে আফসোস বা কষ্ট আসেনি৷ কারন চৈতী এই সময়ে পেয়েছে সত্যিকারের ভালোবাসা, দেখতে পেয়েছে কাবিন নামার সম্পর্কের এক অদ্ভুত টান৷
চৈতীর মনে হয়েছে ওর এই খারাপ সময়ে মুহিত ভালো সুযোগ হাতিয়েছে৷ যে মানুষটা কখনো এক সাথে খেত না৷ সে এখন প্রতি বেলায় নিজের হাতে খাওয়ায়ে দেয়৷ শারীরিক সম্পর্ক বাদে যে কখনো হাতটুকুও ধরতো না৷ সে এখন জড়িয়ে ধরে রাতে ঘুমায়৷ আর প্রতিদিন বলে, তোমাকে আজ অদ্ভুত সুন্দর লাগছে৷ খাটের সাথে হেলান দিয়ে বই পড়ছে চৈতী৷ আজ নীল শাড়ি পড়েছে ও৷ চুলে বেণী করেছে৷ মুহিতের রুচির মত নিজেকে সাজিয়েছে৷ বাইরে ঝক ঝকে পরিবেশের কারনে ঘরের সব জানালা খুলে রেখেছে৷ পশ্চিমের আকাশে সূর্য খানিকটা হেলে পড়েছে৷ তখন মুহিত বাড়িতে এলো৷ ঘরে ঢুকেই চৈতীকে দেখে অবাক স্বরে বলল, ‘বাহ! আজ দেখছি আমার ঘরে স্বর্গের এক পরী এসেছে৷’ চৈতী বলল, ‘সুন্দর লাগছে?’ ওর পাশে বসে মুহিত বলল, ‘তোমার এই সুন্দর্যের বর্ননা এই পৃথিবীতে হয় না৷’
—‘দুপুরে কিছু খেয়েছিলে?’
—‘হু, খেয়েছি৷ আজ হটাৎ এত সুন্দর করে সাজলে?’
—‘তোমাকে একটি কথা বলার আছে৷ তাই ভাবলাম তোমার মন মত করে সেজেই কথাটা বলি৷’
—‘আচ্ছা৷ তবে বলো শুনি৷’
চৈতী হাতের থেকে বইটা পাশে রেখে দিল৷ মুহিতের হাত টেনে নিলো কোলের উপর৷ তারপর বলল, ‘আমার এই অবস্থার জন্য কোন দিনও তুমি দায়ী না৷ তোমার কাছে কোন কিছু না বলাটাই আমার ভুল ছিল৷ সেই ভুল কাল হয়ে দাঁড়ালো৷ তবে বিধাতা মানুষকে কিছু সময়ের মাঝে ফেলে দেয় কিছু সত্য বোঝার জন্য, দেখার জন্য৷ ভালোবাসা কি, তাই হয়তো বোঝানোর জন্য বিধাতা আমাকে এমন সময়ে ফেলেছে৷ তুমি আমাকে যেই ভালোবাসা দিয়েছো, আমার গোটা জীবনেও এমন কল্পনা করিনি৷ আর এমন ভালোবাসা পাব যে, সেই আশাটুকু ছিল না৷ তোমাকে একটি কথা আমি কখনো বলিনি৷ তা হলো তোমাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি মুহিত৷ কাবিন নামার সম্পর্কটি সব সম্পর্কের উর্ধে৷
ওর মুখ থেকে এই কথাগুলো শুনে মুহিতের খুব আনন্দ হচ্ছে৷ ক্ষনিকের জন্য এত দিনের সব কষ্ট ভুলে গেল৷ আনন্দের রেশে যখন চৈতীকে বলতে গেল, আমিও তোমাকে অনেক ভালো চৈতী হাত দিয়ে মুহিতের ঠোঁটে বাধা দিল৷ বলল, ‘এভাবে না৷ আমার ইচ্ছে এক গুচ্ছ গোলাপ দিয়ে কথাটি বলবে৷ ’ মুহিত যেন এই মুহূর্তটায় তরুন প্রেমিকের মত হয়ে গেল৷ উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলল, ‘ আমি এখনই গোলাপ নিয়ে আসছি৷’ বলেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল৷ মুহিতের আনন্দ দেখে মুচকি হাসলো ও৷ তারপর শুয়ে পড়লো বিছানায়৷
এক গুচ্ছ গোলাপ নিয়ে ফিরছে মুহিত৷ চারদিকের পরিবেশ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে৷ কিছুখন আগেও যেই পরিবেশটা হাসছিল৷ সেই পরিবেশ এখন মনমরা হয়ে আছে৷ আকাশে কালো মেঘ জমেছে৷ সেদিকটায় মুহিত ওত খেয়াল না করে সিঁড়ি বেয়ে লাফিয়ে সোজা ঘরে ঢুকলো৷ চৈতীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখো এনেছি৷‘ তারপর চৈতীর মাথার কাছে গিয়ে বসলো৷ বলল, ‘ ঘুমালে? দ্যাখো এনেছি এক গুচ্ছ গোলাপ৷’কোন সাড়া শব্দ করছে না চৈতী৷ ওর কপালে হাত রেখে মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘কি হলো৷ উঠো!’ চৈতী উঠলো না৷ চোখের পাতাও খুলল না৷ মুহিতের চোখ থেকে দু’ফোটা পানি পড়লো চৈতীর চোখে ৷ সেই সাথে প্রকৃতি কেঁদে উঠলো নিজের মত করে৷ দিনের শেষে আকাশ ভেঙে শুরু হলো বৃষ্টি ৷