প্রেমিকার সঙ্গে বিবাহহীন শারীরিক সম্পর্ক আজকাল ডালভাত।কিন্তু আমার গল্পটা একটু ভিন্ন। আমার ভালোবাসার মেয়েটিকে আমি প্রায়ই চুরি করে সিঙ্গারা,জিলাপি,পুরি—এসব খাওয়াতাম।নিজের টাকায় না,বাপের হোটেল থেকে। আসলে আমাদের একটা তেলেভাজা কাম দুপুরে ভাত বেচার দোকান ছিল,পুরান ঢাকার কালিপিচাসের গলিতে।বড়রাস্তা থেকে ডাইনে সোজা মৃত অজগরের মত ঢুকে গেছে পরিচ্ছন্ন গলিটা।সেই গলির শেষ প্রান্তেই মেয়েটির পরিবার একদিন এসে উঠল হলদেটে বাড়ীটায়।ওর বয়স তখন পনেরোর শেষাশেষি।ক্লাস টেনে পড়তো।বয়সের তুলনায় গায়ে গতরে বেশ স্বাস্থ্যবতী আর ভারি মিস্টি ছিল মুখটা।সাদা-ধূসর স্কুল ড্রেসটা পড়ে কোঁকড়া চুলের রাশি খেলিয়ে আমাদের হানিফ বাবুর্চির দোকানের সামনে দিয়ে যখন যেত,তখন আমি হাঁ করে চেয়ে থাকতাম।খদ্দেররা আমার মুখের সামনে টাকার বাতাস করলেও সহজে সম্বিৎ ফিরতো না।
প্রায় ষোড়শীর সঙ্গে আমার পরিচয়ের দিনটা আজো মনে মুক্তোর মত জ্বলজ্বল করছে।টিপে টাপে বৃষ্টি পড়ছিল।দোকানে রহিম চাচা সব ভেজে-ভুজে বসে বসে মাছি মারছে।কাস্টমারের দেখা নেই।আমি টুলের উপর ক্যাসিয়ারে বসে পুরোনো পেপার কাটিং পড়ছিলাম।এমন সময় সে এলো।ড্রেসটা ভিজে গায়ে লেপ্টে আছে।আমি বসে থাকায় সদ্য প্রস্ফুটিত স্তন্যের আভাস প্রথমেই নজরে পড়ল,গা শিরশির করে উঠেছিলো আমার।কিছুটা লজ্জাও ছিল।সে কিন্তু সরল গলায় বলল,”একটা পলিথিন হবে ভাইয়া?”
বোকার মত বললাম,”প-পলিথিন?না,মানে আছে তো,কিন্তু কেন-“ মেয়েটি আন্তরিক গলায় বলল,”দেখছেন না কী রকম ভিজে একসা।সর্দি ফর্দি আজ হবে নির্ঘাত।অন্তত পলিথিনটা মাথায় দিয়ে গেলে বাসায় মা লম্বা লেকচারটা ঝাড়বে না।” “ও,আচ্ছা -“বলে আমি খুঁজে পেতে একটা বড় পলিথিন বের করে দিয়ে বলেছিলাম,”আর কিছু লাগবে?” সে অপূর্ব এক মুচকে হেসে বলেছিল,”লাগবে।কিন্তু পলিথিনের মত কি সব ফ্রিতে দেবেন?টাকা নেই আজ।” মন বলছিল মেয়েটার খিদে পেয়েছে।মিষ্টি মুখটায় কিছুটা নিষ্প্রভ আলো দেখা দিয়েছিল বোধহয়।তাতেই এই আমি কিপ্টে বালক উদার হয়ে বললাম,”কিছু লাগলে নেন।টাকা পরে দিলেও হবে।”
সে খাবারগুলোতে এক নজর বুলিয়ে বলল,”দুইটা সিঙ্গারা আর দুটা জিলাপি।দাম কত পড়বে?” সামান্য খাবার ক’টা সাদা ঠোঙায় পুরে বলেছিলাম,”বিশ টাকা হল।সময় করে দিলেই হবে।” সে যাবার সময় বলে গেল,”২৭ নাম্বার বিল্ডিংটার দোতলায় উঠেছি আমরা।টাকা হারানোর ভয় নেই।” বৃষ্টির গন্ধমাখা হাসনেহানা ফুলের ঘ্রাণটা তখনও ছিল,তবু আমার মাথাটা গরম হয়ে উঠেছিল রহিম চাচার দিকে তাকিয়ে।বুড়ো হাবড়াটা এতোক্ষণ মেয়েটার নারীত্ব প্রকট শরীর লেহন করছিল যেন,এখনো ব্যাটা ওর গমন পথের দিকে চেয়ে আছে,জুলজুল চোখে।আমাদের দোকানে সাধারনত মেয়ে কাস্টমার আসে না;এলে রহিম চাচার চোখের চাপায় পড়তে হয়।আদর্শ চরিত্রহীন!
দু’দিন মেয়েটার আর দেখা নেই।তারপর দিন সকালে যখন আমি ছিলাম না,কলেজে ছিলাম,সে আমাকে খুঁজছিল।ক্যাসে ছিল ছোটভাই শাহীন।ওকেই নাকি টাকা দিয়ে বলেছিল,”বলবেন শঙ্খমালা দিয়ে গেছে।” রাতে দোকানের ঝাপ ফেলে ভিতর ঘরে যখন শুতে গেলাম,দেখি শাহীন বিছানায় শুয়ে আছে।সজাগ।বাতি নেভাতেই বলে উঠল,”মেয়েটা কে রে?তোর পরিচিত?” আমার নীরবস্বর,”চিনি না।” শাহীন সন্দিহান হয়ে বলল,”না,মানে একটা হিন্দু মেয়েকে জানা নেই,শোনা নেই বাকী দিয়েছিস।তাই-“ আমি ঝাঁঝিয়ে উঠলাম,”মেয়েটা যে হিন্দু তুই জানলি কেমনে?” শাহীন হাসে,”কেন রে শ্লা ভাই,এতো পরিচয় তোর সাথে,নাম বলে নাই!শঙ্খ-মা-লা।”
আমার কানের কাছে মুখ এনে বলে,”যা-ই বলিস,মাইয়াটা কিন্তু জোস।” আপনারা নিশ্চয় অবাক হচ্ছেন,বড়ভাইয়ের সঙ্গে ছোটভাইয়ের এ কেমন ব্যবহার!আসলে,আমি একটা গুড ফর নাথিং।কিংবা খোদার হতভাগ্য সৃষ্টি।লম্বা-সম্বা বোকাটে চেহারা আমার।পড়ালেখায় অষ্টরম্ভা।একটা অখ্যাত কলেজে বাংলায় বি.এ. শেষ করার ধান্দা করতে হয় বাপের হোটেল সামলে।বাপ আমার মুনসি খালেক উদ্দিন রাজনীতির জোয়ারে ভেসে চার’মাসের জেলে আরামে আছেন সব দায়িত্ব আমাকে ছেড়ে দিয়ে।ছোটভাইটা বাপের খুব আদরের,মেধায় ভরপুর কিন্তু আই.এ শেষ না করেই রাজনীতিতে হাত পাকাচ্ছে।সেই সঙ্গে বোকা-সোকা বড়ভাইয়ের উপর দাপট ঝাড়া তো আছেই।
শঙ্খমালা বোধহয় আমার এতোটা কাছে আসতো না,যদি ওর বাবা শ্রী শশীকান্ত দাস হুট করে,বলা যায় হৃদয় রোগে বিনা চিকিৎসায় মারা না যেতেন।বাড়িওয়ালা মা-মেয়ে আর সাত বছরের ভাইটাকে নির্দ্বিধায় বের করে দেবার আগেই শঙ্খমালার ছোটকাকা বউকে নিয়ে উঠল ২৭ নাম্বারের দোতালায়,পূর্বোক্ত ভাড়া পরিশোধ করে।যাক্,আমার প্রেম কিছুদিনের জন্য বেঁচে ছিল।
শঙ্খমালাকে তখনও স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেয়নি,আমিও ভালোবাসি কথাটা স্পষ্ট করে বলি নি,হৃদয়ের কথা যা প্রকাশ পাচ্ছিল সব হাবে ভাবে।দু’একটা ক্যাজুয়াল কথায়। মলিন হয়ে যাওয়া স্কুল ড্রেসটা পরে শঙ্খমালাকে গলির মুখে ঢুকতে দেখলেই বাবুর্চি রহিম মিয়াকে বলতাম,”পাকঘরে গিয়ে দেখো তো মতিনের বাচ্চাটা কী করতেসে।মোগলাইয়ের লেই আজ তুমি মেখে রাখো।” রহিম চাচা মুখ অন্ধকার করে বলতো,”মতিন্যার তো ময়দা গুলতেই রাখা হইছে।হাবিজাবি পাকানো,মসলা দেওনের কাজ তো আমি করি।আমি পেছন সামলাইলে সামনে আপনের চাপ পড়বো।” আমিও রাগি গলায় বলতাম,”চাপ পড়বো না।যা বলছি করো,মতিন রে পাঠায় দ্যাও।”
শঙ্খমালা আসতো আমার দোকানে,বুকের কাছে বইপত্র জড়ো করা।পুরোনো ব্যাগটা এতোটাই ছিড়ে গিয়েছিল যে তা আর ব্যবহারের যোগ্য ছিল না।দ্রুত দু’তিনটা সিঙ্গারা,খানিক ছোলা,ডালপুরি ঠোঙায় ভরে দিতাম।মেয়েটা বেশ ক’দিন ধরে দুপুরে কিছু খেতো না,জিগ্যেস করলে বলতো,বাবা মরে যাওয়াতে কী যেন ব্রত পালন করছে।
মতিন তিন চারজন খদ্দের সামলায়,আমি কাউন্টার থেকে বেরিয়ে আমার ক্ষুদ্র নিবেদন ওর হাতে তুলে দিই।ও নরম করে বলে,”রোজ রোজ দিচ্ছেন।আমি তো হিসাব করে রাখি।ম্যালা টাকা জমে যাচ্ছে।”
আমি ওর চোখে চেয়ে বলি,”আমার তো পুরো জীবনটা খরচের খাতায়,যা জমছে তার মূল্য কি কাগজের নোট দিয়ে হয় ম্যাডাম?”(কাব্যি করে কথা বলছি একজন দোকানদার হয়ে,আমাকে হয়তো মানায় না,কিন্তু কি করবো বলেন?সুন্দর সুন্দর কথাকাব্য তো আর জাত পাত দেখে আসে না।) তারপর মুখে হাসি ফুটাতাম,”রুকন কেমন আছে?কালরাত্রে কী রকম দুষ্টামি করলো তোমার সাথে?” “কাল রাতে মোটেও জ্বালায়নি আমাকে।মা খুব মেরেছিল,আমার বুকে মুখ গুঁজে ছেলেটার কি কান্না।” “কেন মারল শুধু শুধু!” “কাকিমার পানের বাক্স থেকে পান চুরি করে এনে মায়ের বাক্সে রাখে।মা তখন আনমনা হয়ে রান্না করছিল,খেয়াল করে নি।পরে তো কাকিমা মাকে দু’কথা শুনিয়ে দিল এই নিয়ে।” কথা বলতে বলতে প্রায় নির্জন গলির শেষ পর্যন্ত চলে আসি ওর সঙ্গে। দু’টা বাড়ি আগেই আমার হাত ছুঁয়ে ট্রেডমার্ক করা কিশোরী সুলভ সেই হাসিটি দিয়ে সে বলে,”আপনার এতো ঋণ আমি কীভাবে শোধ করবো বলেন তো?”
প্রেমে পড়লে বোকা মানুষরা চালাক হয়,যার প্রমান দিতে আমি বলেছিলাম,”তুমি করে বললেই ঋণ শোধ হয়ে যাবে খুকি—“ শঙ্খমালা অবাক হয়।কিন্তু আমি জানি,সে আসলে এটাই চাইছিল।রাস্তায় পড়ন্ত রোদ্দুরে উড়ে যাওয়া কাকের কা-কা ধ্বনির সঙ্গে সুর মিলিয়ে শঙ্খ আমার হাতে মৃদু একটা চাপ দিয়ে বলেছিল,”তুমি,তুমি,তুমি!তুমি এতো ভালো কেন?” এর মধ্যে দোকানে খিলি পান বিক্রিও শুরু করে দিলাম।উদ্দেশ্য,শঙ্খমালাকে দু’তিন খিলি প্রতিদিন ধরিয়ে দেবো।ওর মায়ের পানের নেশা প্রচন্ড,কিন্তু এখন রোজ রোজ পানের দেখা পেয়ে আমার ওপর শঙ্খমালার মা বেশ প্রফুল্ল হয়ে উঠেছিল,শঙ্খমালা নাকি মায়ের কাছে আমার কথা বলেছিল।বলেছিল, “জানো না,মানুষটা ভীষন ভালো।আমাকে ছোটবোনের চোখে দেখে,বাবার কাছে নাকি এক সময় পড়তো।আমার তো দাদা নাই।আমি ওকেই সাগরদা বলি।” আসলে মিথ্যে কফিয়ত না দিলেও চলতো।বাপ মরা,অন্যের কৃপায় থাকা অবস্হায় যদি কারো কাছে একটু দয়া পায়,তবে খারাপ কী! এই মেয়েকে তো চাইলে আসমানে বিয়ে দেয়া যাবে না।
তখন মোবাইল ফোন এতোটা সহজলভ্য ছিল না।ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগের মাধ্যম—হয় মুখোমুখি কথা বলা,নয়তো আমার চেয়েও বোকাটে মতিনের ধারস্থ হওয়া।মতিনকে বলেছিলাম দিনে দু’বার ২৭ নাম্বারের পলেস্তারা খসা বাড়িটার সামনে গিয়ে দাড়াবি ফাঁক পেলে।শঙ্খমালা বারান্দায় মোড়া পেতে পড়তো।এক্সারসাইজ খাতার পেজ ছিড়ে ছোট্ট চিরকুট পাঠাতো আমাকে।সবই ভাববাচ্যে,সেখানে প্রেম ভালোবাসার কথা লেখা থাকতো না।যেমন-
“দুপুরে খাওয়া হয়েছে জনাবের?” “বান্ধবীদের প্রাকটিক্যাল খাতা এঁকে দিচ্ছি,টাকা পাচ্ছি কিছু।” “রোদের দিকে মুখ করে কাউন্টারে দাড়িয়ে থাকা কেন?একটু ভেতরে চেয়ারে বসলেই তো হয়।দোকানে কোনো হীরা জহরত নেই যে ঋত্বিক রোশন চুরি করতে আসবে।” “আজকে পান চিবিয়ে ঠোঁট লাল করবো,২৫ নাম্বারের সামনে যেন থাকা হয়।ভয় দেখানো হবে।” হঠাৎ কিছুদিন শঙ্খমালার দেখা নেই,স্কুলে যায় না,বারান্দায়ও বসে না,মতিন গিয়ে ফিরে আসে। আমার অস্থিরতা যখন তুঙ্গে তখন একদিন সোজা দোকানে এসে হাজির শঙ্খমালা।হাতে বেশ কিছু টাকা।
শঙ্খমালাকে টুকটাক খাবার দাবার মাসখানেক ধরে মতিনকে দিয়েই পাঠাতাম।ছোটভাই,রহিম চাচা জানতো যে ২৭ নাম্বারে এসব মাসকাবারি বাকিতে দেয়া হচ্ছে।কিন্তু আমার বিন্দু আগ্রহও নেই হাজারের কয়েকটা নোটে।
সেদিন শঙ্খকে দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম।হালকা গোলাপী,বাটিকের কাজ করা একটা শাড়ি পরনে।এর আগে যতবারেই দেখেছি,সেলোয়ার কামিজ নয়তো স্কুল ড্রেসে।চোখ খানিকটা লাল,ফোলাফুলো।বিষন্ন সুন্দরী।
টাকাগুলি আমার হাতে দিয়ে বলল,”দেড় হাজারের মত আছে।” আমি চোখ পাকিয়ে বলি,”এতোদিন কোনো খোঁজ-খবর নেই,আজ হুট করে টাকা কিসের?” রহিম চাচা এদিকে তাকিয়ে আছে দেখে শঙ্খমালাকে কথা বলতে না দিয়ে,হাত ধরে টেনে বাইরে বের করে আনলাম।তখন মধ্য গোধূলির ধসা আলোয় চারদিক ছেয়ে ছিল।
কয়েকজন খদ্দের অবাক হয়ে আমাদের দেখছিল,বড়রাস্তায় এসে হাঁপ ছাড়লাম।বললাম,”ব্যাপারটা খুলে বলো।”
শঙ্খমালা ধরা গলায় বলল,”দেখো ন্যাকামি করো না,টাকাটা নিয়ে নাও প্লিজ।তোমার বাবার দোকানের খাবার বিনে পয়সায় খাচ্ছি দাচ্ছি,আমার ছোটভাই মাকে খাওয়াচ্ছি-এটা দৃষ্টিকটু।কাকিমা এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে,মা-ও বোকার মত তোমার কথা বলে দিয়েছে।” আমি বললাম,”টাকা কে দিলো?” “কেউ দেয় নি।আমার।” ইতোমধ্যে অলিখিত একটা অধিকারবোধ শঙ্খমালার উপর আমি করতে শুরু করেছি।সে থেকেই বলি,”কী করে তোমার হল?”
“তোমাকে বলেছিলাম মিস্টার।এই বন্ধে বান্ধবীদের কৃষিশিক্ষার বেশকিছু প্রাকটিক্যাল খাতা এঁকে দিয়েছিলাম,তার পেমেন্ট খরচ করি নি।জমিয়েছি।” আমি নিভে যেতে যেতে বলতে থাকি,”এই টাকা আমি নিতে পারবো না শঙ্খ।কিছুতেই ন্…না—“ শঙ্খমালা হঠাৎ আমার বুকে মাথা রেখে কেঁদে উঠল।রাস্তা দিয়ে বাস গাড়ি ছুটছে,মানুষজন হাঁটছে নানান চিন্তায়,তা মেয়েটা সেসবের তোয়াক্কা করল না! বুঝতে পারলাম,ভেতরে কিছু একটা ক্ষরণ হচ্ছে ওর।কিছু অপ্রীতিকর অনুভূতি। আমার হুট করে মনেহল,শঙ্খকে নিয়ে তো কখনো বাইরে যাইনি ঘুরতে।আজকে নাহয় যাই।মেয়েটার মন খারাপ যখন।আলতো করে ওর মাথায় চাটি মেরে বললাম,”আরে,কি এমন হয়েছে খুকি?খুব কষ্ট?চল্ আজ কষ্ট খাই দু জনা।”
একটা রিক্সা ডেকে শঙ্খমালার হাত ধরে উঠে পড়লাম।গন্তব্য বাঘবাহাদুর পার্ক। রিকশা চলছে।শঙ্খ এখনো ধাতস্থ হয়ে ওঠেনি।সে একটু হকচকিয়ে গেছে।ভাবে নি,আমার মত একটা ব্যক্তিত্বহীন ছেলে এরকম সাহসিক কাজ করবে।আচমকা। নীরবতা কয়েকটা ক্ষণ।আমি ওর লাল ব্রেসলেট পরা কোমল পেলব হাতটা তুলে নিই নিজের ডানমুঠোয়।নির্ভরতার স্পর্শে বোঝানোর চেষ্টা করি—শঙ্খচিল,ভয় নেই তোমার।আমি তো আছি। বাঘবাহাদুর পার্কে আজ জনপ্রানী নেই তেমন,জোড়া কয়েক কপোত-কপোতী ছাড়া।ছোট্ট ঝিলটার পাশে শিমুল গাছের তলায় একটা খড়ের চাল দেওয়া আরামাসন আছে।সেখানে সিমেন্টের পাটাতনে পাশাপাশি বসলাম আমরা।দিন যাই যাই করছে।বৃষ্টি চাখা স্বচ্ছ প্রকৃত।আমি আনরোমান্টিকের মতন বললাম,”এবার বলো তোমার মন খারাপের কারন।”
শঙ্খমালা ইষৎ হেসে বলল,”শুনে কী করবে?তুমি আমার কে শুনি?” বললাম,”আমি কেউ না তোমার।ধরো আমি মানুষই না।এবার বলো।” তারপর কান্না মেশানো স্বরে সে যা বলল,তাতে আমার ভীড়মি খাওয়ার জোগাড়।ওর কাকিমা নাকি ওকে বেশ্যা বলেছে,বিধর্মী নাগর লাটকানো মেয়ে,আরো খারাপ খারাপ কথা।কারন?আমার সঙ্গে হাঁটতে দেখেছে,মতিনকে দেখেছে দাড়িয়ে থাকতে।মা-ছেলে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ফ্রিতে দেয়া খাবার খাচ্ছে।আর মেয়ে দেহদান করে বেড়াচ্ছে—এসব কথা।ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি।
স্কুলের গার্লস সেকশনের ক্লার্ক দোজবরে হরিনারায়ন বাবুর বিয়ের প্রস্তাবে ছোটকা রাজী হয়ে গেছে।শঙ্খমালা কিছুতেই পঁয়তাল্লিশ পার হওয়া হরিবাবুকে বিয়ে করবে না।বাবা মারা যাবার কথা জেনে,শঙ্খমালাকে অসহায় বুঝে বেশ কয়েকবার লোকটা ওকে একা পেয়ে খারাপ ইঙ্গিত দিয়েছে।একদিন বকেয়া বেতনের জন্য ছুটির পরে অফিস রুমে ডেকে নিয়ে বুকে হাত দিয়েছে,জড়িয়ে ধরে জোর করে টেবিলে শোয়ানোর চেষ্টা করেছে,সে ধাক্কা মেরে—এই পর্যায়ে শঙ্খমালা আমার কাঁধে মাথা রেখে হুঁ হুঁ করে কাঁদতে থাকে। আমার মনের একটা সমুদ্র যেন কেউ শুষে নিয়েছে।পড়ে আছে শূন্য বালিয়াড়ি।একটা বিরাট রাগ উথলানোর কথা ছিল।কিন্তু অপদার্থ মানুষের কেন যেন রাগ আসে না। ঝিলের দিকে তাকিয়ে থাকি।শান্ত জলের উপর দিয়ে একটা ফিঙে উড়ে গেল। কোনো রাজনীতি করি না,কেউ পোঁছে না,ছোটোভাইয়ের ক্ষমতাটুকু নেই আমার।শাহীন হলে নিশ্চিত হরিনারায়নকে গিয়ে বেদম কঁপচে আসতো। শঙ্খ অভিমানি স্বরে বলে উঠে,”তুমিও মনেমনে আমাকে ঘেন্না করো।”
“কেন ঘেন্না করবো খুকু?”
“আমি হিন্দু বলে।একটা কেরানি আমাকে মলেস্ট করেছে বলে।” আমি আর্তনাদ করি,”না-না!তা কখনোই না! আমি তোমাকে ভালোবাসি”
“সত্যি তো?আগে বলো নি ভালোবাসি।”
“আমি ভেবেছিলাম তুমি প্রথমদিনই বুঝতে পেরেছো।”
আমার কন্ঠ বসে যায়।শঙ্খমালা আমার গলা জড়িয়ে ধরে গাঢ় একটা চুমু খায়।সেই প্রথম আমার।একটা ষোল বছরের মেয়ে যে এতোটা পরিনত,তা সংস্পর্শে না আসলে বোঝা যায় না।অন্য রকম মিস্টি একটা অনুভূতি আমার শূন্য সমুদ্র পূর্ন করে দেয়।চারদিকের ঝিঁঝি’র ডাক,রডোড্রেনডনের সুবাস—সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল।
তৃপ্ত চুম্বন শেষে শঙ্খমালা আমার ঠোঁটে চিমটি কেটে বলেছিল,”তুমি যে আমায় ঘেন্না করো না,প্রমানটা পেলাম।”
এরপরে কিছুটা হাঁটাহাঁটি করে বেরিয়ে পড়েছিলাম।আটটার মধ্যে প্রধান ফটক বন্ধ করে দেয় পার্কটার। পথে একবার শঙ্খ অদ্ভূত করে বলে উঠেছিল,”তুমি খুব ভালো।তুমি বড্ড ভালো সাগর।” আমি হয়তো সেই নির্জন চরাচরে শঙ্খমালা নাম্নী যৌবনে প্রবেশ করা এক ষোড়শীকে আদিম উন্মত্ততায় ভোগ করতে পারতাম।কিন্তু সেটি করিনি দেখেই কি মেয়েটার মন বলেছে আমি ভালো ছেলে? না,আমার তখন খালি পঁয়তাল্লিশ পেরনো হরিনারায়নের কথা মনে পড়ছিল—ছি পুরুষ!
রহিম চাচা আমার সন্ধ্যাটুকুয় ‘নেই’ হয়ে যাবার কথা শাহীনকে বলে দেয়।শাহীন রাত্রে আমাকেই ছোটো ভাই বানিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় গেছি,হিন্দু মেয়ের সাথে এতো মাখোমাখো কিসের,দোকানের বাকির টাকা জমার হিসেবে নেই কেন,ইত্যাদি।শেষে বলে ওঠে,”মেয়েটা দেখতে নায়িকা পূর্নিমার মত।নারে?ডবকা ডাবকা,সেক্সি।তোর মত ছেলের সাথে ঘুরাঘুরি করে,ছ্যা,মেয়েটার নজর এতো—“ আমি বুঝতে পারলাম,বেশ কিছুদিন ধরেই শাহীন আমাকে হিংসে করছে।ছোটোবেলায় মায়ের আদর নিয়ে হিংসে করতো।বড়ছেলে হিসেবে আম্মা আমাকে মাছের মাথাটা খেতে দিলে,শাহীন সেদিন মুখ ফুলিয়ে ভাত ছুঁত না।বড়বেলায় দাদার প্রেমিকা নিয়েও তার হিংসা!সব কিছুতে কি ভাগ বসাতে চায় সে? হঠাৎ সুর পাল্টে শাহীন বলল,”ভাইয়া,তুই কি মেয়েটাকে ভালোবাসিস?” আমি ভয় খাওয়া গলায় বলি,”না,না।ওরে ভালো-ভালোবাসতে যাবো কেন?একটা হিন্দু মেয়ে।এমনে একটু মায়া লাগে।”
শাহীন বলল,”রাইট।তোর আবার প্রেম ভালোবাসার কী দরকার!” আমি কেন সেদিন শাহীনকে মিথ্যে বলেছিলাম?আমি কি আমার দু বছরের ছোটো ভাইকে ভয় পাই?না।আমার বেশি আতংক আমার বাপ।উনি জেল থেকে কিছুদিনের মধ্যেই বের হয়ে আসবেন।বলেছিলেন,জেল ফেরত এসেই উইল করে দোকানটা আমাকে দেবেন,আর দেশের বাড়ির ক্ষেতি জমি সব আদরের ছোট ছেলেকে।রাজনীতি করতে করতে কোনদিন আবার মরে যান।এখন এসব বিষয় যদি শাহীন তাঁর কানে উঠায়,তিনি নিশ্চয় বলবেন না,বাপধন তুমি উত্তম কর্ম করিয়াছ।তোমার মনের মানুষকে ভালোবাসার কথা স্বীকার করিয়াছ।আইসো চুমি দিই। শাহীনকে কোনো রকমে বললাম,”মেয়েটার ব্যাপারে আব্বাকে কিছু বলিস না।” শাহীন আশ্বাস দেয়,”পাগল নাকি আমি!ওই শঙ্খবালা না কি যেনো,ও যে তোর শুধু বন্ধু-সেটা আমি আগেই বুঝেছিলাম।” তারপর হঠাৎ সে আহ্লাদি হয়ে বলল,”দাদাভাই,মেয়েটার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দে না।তোর বন্ধু হলে আমার বন্ধু হতে দোষ কি!”
আমি আশংকা চেপে বললাম,”আচ্ছা।” পরদিনই স্কুল খুলেছিল শঙ্খমালার।বিকেলে দোকানে আসলে শাহীনের সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দিই।শাহীন বেশ সুন্দর করে কথা বলছিল।শঙ্খমালা খুশি আমার ভাইয়ের ব্যবহার দেখে।তিনজনে বসে চা-টা খেলাম। শাহীন হাসি ঠাট্টা করতেও ছাড়ল না আমাদের ছোটোবেলার কথা বলে।শঙ্খ হাসছিল নির্মল।আমার মুখের দিকে বারবার তাকাচ্ছিল,যা শাহীনের নজর এড়ায় নি।আমি হাজার বোকা হলেও বুঝতে পারলাম,শাহীন বুঝতে পারছে যে শঙ্খমালা আমাকে ভালোবাসে। সেদিন তিন প্যাকেট বিরিয়ানী আনায় শাহীন।শঙ্খকে বলে,”তোমার সাথে আলাপের দিনটায় একটা কাহিনি হয়ে যাক।” শঙ্খ বিরিয়ানী কিছুতেই খেতে চাইছিল না।জোরাজুরি করায় বলল,বাসায় নিয়ে যাবে।
আমি বুঝতে পারি,মা-ভাইকে রেখে সুখাদ্য ওর গলা দিয়ে নামবে না।শাহীন বোধহয় বুঝতে পারে।হাসি মুখে বলে,”আচ্ছা সমস্যা নাই।” আরো নানান কথার মাধ্যমে শাহীন শঙ্খমালার কাছে একটা ছদ্ম ভালোমানুষী প্রতিষ্ঠা করে ফেলল। এক দুপুরে আমাকে টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার সাজিয়ে দিয়ে বলে শাহীন,”আজ তুই যা আব্বার কাছে।আমার শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছে রে।” জেলে যাওয়া আসা,তিন ঘন্টার ধাক্কা।আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও যাই।রহিম চাচাকে সে পাঠায় সপ্তাহের বাজার করতে।আর নিরীহ মতিন ছোকড়াটা বহাল তবিয়তে দোকানে থাকে।
আমি সেদিন যেনো ভুলে গিয়েছিলাম শঙ্খমালা বিকেলে আসবে,আজ ওর স্কুলে শেষ ক্লাস,আমাকে কিছু বলার ছিল তার। আমার ছোটো ভাইটার অভিসন্ধি আমি সেদিন কি একটুও আঁচ করতে পারি নি? মতিনের মুখ থেকেই পরে শুনি সব।শঙ্খ ঢুকতেই শাহীন মতিনকে দোকানের ঝাপ ফেলে বাইরে দাড়াতে বলে।কি গোপন কথা বলবে নাকি শঙ্খকে।কাজ সব ওর ছক মত হয়ে গেলে,শাহীন শঙ্খকে কু-প্রস্তাব দেয়।রাজি না হলে,জোর করে ভেতর ঘরে নিতে চায়।শঙ্খ যথারীতি চড় এবং চিৎকার দুটোই করে।তাইতে পাশের বিল্ডিং থেকে দারোয়ানটা ছুটে আসে,মতিন ঝাপ উঠায়।কিন্তু শাহীনকে তারা কিছু বলে না।ভয়ে।
আমি ফিরে আসার পর আমার দুঃসাহসী এবং নির্লজ্জ ছোট ভাইটা চেঁচায়,”বাজারের মেয়ের কি দেমাগ!ওরে দেখায়া দেবো আমি।শালী(লেখার অযোগ্য আরো গালি)” তারপর আমার ক্ষমতাহীনতাকে সম্মান জানিয়েই যেনো সামনেই বলতে থাকে,”আফজাল আর আশিক রে ধরতে হবে।ওই কুত্তীরে গনধর্ষণ না দিলে মোর শান্তি হবে না।” আমার তখন মনে হয়েছিল,১৯ পেরনো এই ছেলেটা কিছুতেই আমার ভাই হতে পারে না।এ যে হরিবাবুর চেয়েও ভয়ানক! আমাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে শাহীন কঠিন মেজাজে একবার বলে,”ওই কুত্তীটাকে খেয়ে ছেড়ে দিতে পারলি না?জিনিসটাও নাই তোর?” আমি কিছু বলতে পারি না।
রাত্রে শোয়ার সময় বাতি নেভায় না সে।নিজের ছোট্ট মহার্ঘ মোবাইলটা বের করে দলের পোলাপানকে কল করে।বিভিন্ন প্ল্যান করে।আগামীকাল রাতেই মুখে কালো কাপড়ে ঢেকে বাসায় ঢুকে যাবে তারা পাঁচজন।দু জনের হাতে থাকবে চাইনিজ পিস্তল,তাতেই নাকি সব ভয়ে মূত্র বিসর্জন করবে। চাচা মা বাচ্চা,আরো যারা আছে তাদের এক ঘরে বন্দি করে আফজাল আর সিরাজকে দেবে পাহারা দিতে।অন্য ঘরে বাকি তিনজন পালা করে চরম লেভেলের ধর্ষণ আর রগড়,দুটোই নাকি দেবে। মটকা মেরে ঘুমের ভান করে থাকলেও বিষয়টা ভেবে জ্বলুনি উঠে বুকে।চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসতে চাইছে।কিছুতেই আটকাতে পারছি না।জীবনের মহাসত্যটা উপলব্ধি করলাম,অপদার্থ পুরুষের প্রেম করা উচিত না।কোনো ভাবেই উচিত নয়।
শাহীন ট্রাংক খুলে একটা দেশি মদের আধ খাওয়া বোতল বের করে শব্দ করে খায়।শেষ বিন্দুটা গলায় ঢেলে সটান শুয়ে পড়ে।আমার মুখের দিকে একবার তাকাতেই আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। আমার চোখের পানি কি সে দেখেছে?আচ্ছা,আমি যদি শাহীনের পা জড়িয়ে ধরে শঙ্খমালার হয়ে মাফ চাই,তাহলে হয় না!আমি জানি লাভ হবে না।আমি যদি বলি শঙ্খ আমার ভালোবাসা।তোর ভাবীকে মাফ করে দে।সে আরো রেগে যাবে,ক্ষেপে যাবে ভয়ানক।হিংসার আগুনে ঘি ঢালা হবে তখন। আধা ঘন্টা আমি চিন্তা ভাবনা করি।কাল শঙ্খমালার জন্মদিন,মনে পড়ে আমার।জন্মদিনের পুরষ্কার কী হতে পারে আমার পক্ষ থেকে?
ঘুমন্ত শাহীনকে দেখি।হলদে আলোয় মুখটা এখন বড়ো নিষ্পাপ লাগছে,যেটা কালকে হয়ে উঠবে শয়তানের মুখ।আমি শঙ্খমালাকে কথা দিয়েছিলাম,পাশে থাকবো।থাকতে পেরেছি কি?আর বেশি কিছু ভাবি না,আমার অপদার্থ প্রেমিক জীবনের অবসান ঘটাতে দুটা বালিস একসাথ করে মাতাল শাহীনের চোখ মুখে চেপে ধরি।সমস্ত শক্তি দিয়ে।নিজের চোখ বুজে ফেলি যাতে শেষ মুহূর্তে ভ্রাতৃবৎসল্য না জেগে উঠে।বেচারা মাতাল হওয়ায় মুখের গোঁ গোঁ শব্দটুকু পর্যন্ত বেরোয় না। মরে যায়।মুখের শেষ আলোটুকু অন্তর্হিত হয়।
.
তারপর?তারপর শঙ্খমালার একটা কথা অন্তত রাখতে পেরেছি,মনকে এই সান্ত্বনা দিয়ে ভাইয়ের আত্নার প্রশান্তি কামনা করতে করতে পূর্নচন্দ্রের রাতে বেরিয়ে পড়েছিলাম।পুরান ঢাকার অলি গলি বড়রাস্তা পেরিয়ে চলে এসেছিলাম কাছের এক স্টেশনে। একটি ধ্যাবড়ে যাওয়া বুড়ো ভিখারীর পাশে সটান শুয়ে পড়ি।একরাশ বোধশূন্যতা। ঝিমুনির মত এসেছিল,শেষ রাত্রের ট্রেনের হুইসেল কান এড়ায় না।উঠে পড়ি।তিন লম্ফে সোজা ছাদে।ট্রেন যখন চলতে শুরু করে,বাতাসের লু হাওয়া জাপটা মারতে মারতে আমার মনের মধ্যে ভুরভুরি কাটতে থাকে-ভালো থেকো ভালোবাসা।ভালো থাকিস ওপারে।ভাই আমার।