বড় একটা ঝড় বয়ে গেল নীলিমার মনের ভেতর। তার সাথে সম্পর্কটা শেষ না করে উপায় ছিল না। কলেজ জীবনের ভুল আবেগের বশবর্তী হয়ে প্রণয়ে জড়ানোটা কত বড় বোকামি তা দেরীতে হলেও নীলিমা বুঝতে পেরেছে। কিছুদিন খারাপ লাগলেও এখন মোটামুটি স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে সে। বিকেল থেকেই বৃষ্টি। বাইরে কিছু কাজ ছিল কিন্তু বৃষ্টির কারণে যাওয়া হল না। নীলিমার ঠাণ্ডায় সমস্যা হয়। অগত্যা ঘরে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। রান্না করলে কেমন হয়? ফ্রিজে গরুর মাংস থাকার কথা। নীলিমার মায়ের নাম কান্তা। সে তার মাকে ডেকে বলল, মা, ফ্রিজে গরুর মাংস আছে?
-হ্যাঁ। কেন?
-আজ ভুনাখিচুড়ি আর গরুর মাংস রান্না করব।
-সত্যি?
-হ্যাঁ।
-কর, আমি তাহলে একটু ঘুমাই।
-আচ্ছা।
বেশ আটঘাট বেঁধে রাঁধতে নেমেছে নীলিমা। ওড়নাটা কোমরে বেঁধে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। বাড়িতে কোন পুরুষ লোক থাকে না। তাই ঘরের মধ্যে একটু স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলাফেরা করা যায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সুউচ্চ বুকের দিকে তাকালো সে। বুকের ভাঁজে চোখ আটকে গেল তার। ভাঁজের উপরে ছোট্ট একটা লাল তিল। জামার গলাটা বড় হওয়ায় তিলটা দেখা যায়। পুরুষরা নাকি মেয়েদের শরীরের তিল খুব পছন্দ করে, আর তা যদি বুকে হয় তাহলে তো কথাই নেই। ইদানীং পাড়ার কিছু ছেলে তাকে রাস্তায় ফলো করে। তাদের দৃষ্টি আটকে থাকে নিতম্ব ও বুকের দিকে। কিন্তু নীলিমা কিছু বলে না। ছেলেগুলো নীলিমার চেয়ে কম বয়সী হবে। কিন্তু ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় এরা বেশ চেংড়া হয়ে গেছে।
গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে রান্না শেষ করল। ঘ্রাণটা অনেক সুন্দর হয়েছে। এখনো স্বাদের খবর জানা যায়নি। নীলিমার মন বলছে খেতেও সুস্বাদু হবে। আর বৃষ্টির দিনে ভুনাখিচুড়ি এবং গরুরমাংসের চেয়ে ভালো খাবার আর কী হতে পারে? খাওয়ার সময় নীলিমার মা বলল, এত সুন্দর খাবার আমি আমার জীবনে আগে একবার খেয়েছিলাম।
-কখন?
-আমি যখন ছোট ছিলাম। তখন আমার মা রান্না করে খাইয়েছিল।
-আমি তোমার মায়ের চেয়ে ভাল রান্না করেছি। বুঝলে মা?
-হুম। তা তো দেখছি। তোর বর যদি ভোজনরসিক হয়, তাহলে তো ভালই।
-আমার বর হবে খুব গম্ভীর টাইপের।
নিজের বরের কথা বলেই লজ্জা পেলো নীলিমা। চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে তার মা চোখ বড়বড় করে আছে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠল। এমনভাবে হাসছে যে হেঁচকি উঠার উপক্রম। হাসি থামিয়ে কান্তা বলল, তোকে সামনের বছর বিয়ে দিব।
-যাও। আমার বিয়ে করার দেরী আছে।
-দেখা যাবে।
-দেইখো।
খাওয়াদাওয়া শেষ করতেই বিদ্যুৎ চলে গেলো। বজ্রপাত হচ্ছে। বজ্রধ্বনিতে নীলিমার বুক কেঁপে উঠছে ভয়ে। ঘরে মোমবাতি জ্বালানো। হালকা আলোয় কেমনযেন রোমান্টিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তার সাথে সম্পর্কের সময় ফোনে অনেক রোমান্টিক কথাবার্তা হত। কল্পনায় দুজন দুজনকে ছুঁয়ে দিত, আদর-চুমু খেতো। নীলিমার কাছে সেই অনুভূতি বাস্তবের চেয়েও বেশি রোমাঞ্চকর মনে হত। ঘুম আসছে না। তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে একটা পুরনো বই খুঁজে পেলো। বইয়ের বেশ কয়েক পাতা নেই। মাঝখান থেকে পড়ছে। কিন্তু কেন জানি নীলিমার মনে হচ্ছে, গল্পটা এখান থেকেই শুরু।
‘নিঃশ্বাসের শব্দের সাথে বাতাসের শোঁশোঁ শব্দ মিলে রোমাঞ্চকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই পরিবেশে রেড ওয়াইনের সাথে সফট মিউজিক শুনতে হবে। ভলিউম থাকবে খুব কম, মিউজিকের দুয়েকটা শব্দ বোঝা যাবে না। তবুও শুনতে হবে। হঠাৎ একটা উষ্ণ হাত এসে আমার পেটে রাখলো। পুরুষের স্পর্শে নারী তার অস্তিত্ব বোঝে, কামনা বোঝে।’
এটুকু পড়ে নীলিমা বুঝল গল্পের কথক কোন মহিলা। হঠাৎ সামনের দরজায় কেমনযেন শব্দ পেলো। নীলিমা প্রথমে ভাবল শব্দটা হয়তো বজ্রপাতের বা মেঘডাকার। কিন্তু দ্বিতীয়বার শব্দ পেলে একটু হকচকিয়ে গেলো সে। ধীরেধীরে পা ফেলে দরজার কাছে এলো। কেউ এসেছে হয়তো? কিন্তু এত রাতে ঝড়জলের মধ্যে তাদের বাসায় কে আসতে পারে? পাশের বাসার কেউ হয়তো। নীলিমা দরজা খুলে কাউকে দেখতে পেলো না। নাকি আলোর অভাবে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। দরজায় ধাক্কা মারলে দরজার কাছে থাকবে। নীলিমা মোবাইল আনার জন্য পিছন ফিরতেই একটা ভেজা লোমশ হাত তার মুখ চেপে ধরল। কোন চিৎকার দিতে পারল না নীলিমা। নীলিমার মুখের মধ্যে একটা রুমাল ঢুকিয়ে দিল সে। নীলিমা জোর খাটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। লোকটার লোমশ হাত নীলিমার বুকে চলে গেলো। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে, বজ্রপাতের শব্দটাও বিকটাকার ধারণ করছে। তার মধ্যেও একটা পশুর গর্জন শুনতে কষ্ট হল না নীলিমার। একটা পরিচিত গন্ধ আসছে নীলিমার নাকে কিন্তু কিসের গন্ধ তা ধরতে পারছে না সে। মুখোশপরা মুখটা মুখোশ পরা অবস্থাতেই চুমু খেল নীলিমার বুকের সেই লাল তিলটায়। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই কান্তা নীলিমার ঘরে এসে দেখলো একটা নিথর দেহ পড়ে আছে। চিৎকার করে ডেকে উঠল, নীলিমা!
নীলিমা জেগে ছিল। সারারাত কেঁদেছে। চোখের পানিতে বালিশ ভিজে একাকার। নিজেকে কোনরকম নিয়ন্ত্রণ করে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কান্তা বলল, কিছু হয়নি মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। কাউকে কোনকিছু জানানো যাবে না। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরল কান্তা। নীলিমা তার বুকে চেপে জোরে কেঁদে উঠল। তার মুখটা কান্তা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বলল, কাঁদিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। নীলিমাকে রেখে কান্তা ঘর গোছালো। কেমনযেন এলোমেলো হয়ে আছে। সব গোছগাছ করে নাস্তা রেডি করে মেয়েকে নিয়ে খেতে বসতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে মা-মেয়ে দুজনেই হকচকিয়ে গেলো। নীলিমাকে বলল, তুই খেতে থাক। আমি দেখছি। কোনো অস্বাভাবিক আচরণ করিস না, মা। দরজা খুলে কান্তা দেখলো কয়েকজন কনস্টেবলসহ একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়ানো। পুলিশ দেখে ঘাবড়ে গেলো কান্তা। তবুও স্বাভাবিক থাকার ভঙ্গিতে কথা বলার চেষ্টা করছে সে, কী ব্যাপার? কাকে চায়? পুলিশকে এভাবে প্রশ্ন করা ঠিক কি না বুঝতে পারছে না সে। পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করল, এটা কি ৩নং ভূতের গলি, বাসা নং ৩৬?
-হ্যাঁ।
-আমাদের কাছে খবর আছে, এই বাসায় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে।
আমতাআমতা করে বলল, এখানে দুর্ঘটনা ঘটে নাই। আপনারা যেতে পারেন। পুলিশ অফিসার ফাইল থেকে একটা ছবি বের করে বলল, আপনি কি এই মেয়েকে চেনেন? নিজের মেয়ে নীলিমার খুবলেখাওয়া শরীরে রক্তের ছোপছোপ দাগ দেখে কান্তার ভিরমি খাওয়ার উপক্রম। পুলিশ অফিসার জিয়া কান্তার সাথে ঘরের মধ্যে গেলেন। জিয়া আর সব পুলিশের মত ভণিতা করে না, যা বলার স্পষ্টভাবে বলে।
-দেখুন, আমাদের ধারণা, অপরাধী নিজেই আমাদেরকে এই ব্যাপারে জানিয়েছে। রাতে একটা পার্সেল দিয়ে চলে যায়। সেখানে আমরা এই বাড়ির ঠিকানা এবং ছবি পেয়েছি। এখন আপনারা যদি সাহায্য করেন, তাহলে অপরাধীকে ধরতে পারব।
-দেখুন, আমি আমার মেয়ের সম্মান নষ্ট করতে পারব না। আমি কোন কেস করব না।
-সেটা আপনার ব্যাপার। আপনি কেস না করলে পুলিশ বাদী হয়ে এই কেস চালাতে পারে। আর আমার ধারণা সে এটা শুধু আমাদের দেয়নি, মিডিয়াতেও দিয়েছে। জিয়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই কনস্টেবল এসে বলল, স্যার, বাইরে পত্রিকা ও টেলিভিশনের লোকজন এসেছে। তাদেরকে আটকে রাখা সম্ভব হবে না। জিয়া কান্তার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখুন। এখন আপনি কী চান? আমাদেরকে ব্যাপারটা জানালে আপনাদেরই ভাল হবে। আর না হলে পত্রিকার লোক ভুলভাল খবর ছাপাবে। আপনি কিছুক্ষণ ভাবুন, আমি ওদিকটা দেখছি। ইনস্পেকটর জিয়া বাইরে গেলেন। কান্তা উঠে নীলিমার ঘরে গেলো।
জিয়া বাইরে আসার সাথেসাথে সাংবাদিকের দল হুমড়ি খেয়ে পড়ল। অনেক প্রশ্ন করছে। ইনস্পেকটর জিয়া শুধু একটা কথা বললেন, এখনো ভিক্টিমের সাথে কথা বলা হয়নি। কথা বলার পর সব জানা যাবে। তবে ধর্ষণের ঘটনা সত্য-এটা প্রমাণিত। নীলিমার সাথে কথা বলার পর কান্তা সিদ্ধান্ত নিল যে সাংবাদিককে ব্যাপারটা জানানোই ভাল হবে। তা নাহলে ওরা উল্টাপাল্টা খবর ছাপবে।
‘অজ্ঞাত এক যুবকের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে নীলিমা’ এমন একটা সংবাদ শিরোনাম সমেত পত্রিকাটা জাকিরের হাতে। মাথা নষ্ট হওয়ার উপক্রম তার। পত্রিকা নিয়েই নীলিমাদের বাসার দিকে রওনা দিল সে। বাসাটা সে চেনে কিন্তু কখনো যাওয়া হয়নি। নীলিমার সাথে যখন সম্পর্ক ছিল, তখন এখান দিয়ে মাঝেমাঝে যাওয়া হতো। আর আজ এমন একটা দিনে যেতে হচ্ছে ভেবেই মনটা খারাপ হয়ে গেল জাকিরের। বাসার সামনে অনেক লোকজন। এর কানে ও ফিসফিস করে কিছু বলছে। লোকজনের ভিড় ঠেলে জাকির এগিয়ে গেলো বাসার দিকে। গেটের কাছে দাঁড়ানো পুলিশ তাকে আটকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?
-জ্বি, আমি জাকির, নীলিমার বন্ধু।
কনস্টেবল ওয়াকিটকিতে কল করে জাকিরের কথা বলল। বাসায় ঢোকার আগে খেয়াল করল জাকির, কিছু উটকো টাইপের ছেলেপেলে বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে হাসছে। জাকিরকে দেখে নীলিমা রাগ করবে নাকি খুশি হবে বুঝতে পারছে না। কিছুদিন আগেই জাকিরের সাথে নীলিমা তার প্রেম শেষ করেছে। এখন তাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। ‘জাকির কি মজা নিতে এসেছে?’ এই ভাবনাটা শেষ হওয়ার আগেই নীলিমার মনে অকস্মাৎ আরেকটা প্রশ্ন এলো, সেই মুখোশের আড়ালে জাকির ছিল না তো? জাকিরকে যতদিন ধরে নীলিমা চেনে, তাতে অন্তত এই ভাবনাটা করা নিছক বোকামি। একবছরের মত তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল কিন্তু জাকির কোনদিন কখনো খারাপ কিছু করেনি বা খারাপ কোন কথা বলেনি। পুলিশ অফিসার জাকিরকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ওর কেমন বন্ধু?
এই সহজ প্রশ্নের উত্তরটা সহজভাবে দেওয়া সম্ভব না। জাকির কি বলবে যে সে নীলিমার প্রাক্তন প্রেমিক? ওটা বলা যায় না। আমতাআমতা করতে লাগল, তখন নীলিমাই বলল, ও আমার বয়ফ্রেন্ড। কান্তা এমন উত্তর শুনে লজ্জিত হবে নাকি রাগ করবে তা বুঝতে পারছে না। জাকির ইতস্ততভাব কাটিয়ে বলল, বাইরে কয়েকটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, ওদের আচরণ কেমনযেন লাগছে। খুব হাসাহাসি করছে। মনে হচ্ছে এই দুর্ঘটনায় তারা খুবই আনন্দিত। ইন্সপেক্টর জিয়া বলল, আচ্ছা। আমি দেখছি। জাকির কান্তার কাছে এসে বলল, আন্টি মন শক্ত করুন। সব ঠিক হয়ে যাবে। কান্তা জাকিরের হাত ধরে নিঃশব্দে কাঁদছে। তার আরেক পাশে এসে নীলিমা জাকিরের পাশে বসে হাত ধরল। দুজনেই কাঁদছে। উষ্ণ চোখেরজল পড়ছে জাকিরের হাতে। জল গড়িয়ে পড়ছে না, মনে হচ্ছে লোমশ হাতের লোমকূপ দিয়ে উষ্ণ জল জাকিরের শরীরে প্রবেশ করবে।
বাইরে হাউকাউ শুনে জাকির বেরিয়ে এলো। সাংবাদিকদের এলোমেলো প্রশ্ন শুনে ইন্সপেক্টর জিয়া বেফাঁস কিছু কথা বলেছে। সম্ভবত সাংবাদিকদের গালি দিয়েছে। জাকির বাইরে এসে চিৎকার করে উঠল, সমস্যা কী আপনাদের, হ্যাঁ? একটা মেয়ে ধর্ষণ হয়েছে একবার আর আপনারা কি তাকে সিরিয়ালি ধর্ষণ করার চেষ্টা করছেন? তাকে কি সুস্থভাবে বাঁচতে দিবেন না? সাংবাদিকরা এবার কোন কথা বলল না। জাকির খেয়াল করল সেই ছেলেগুলো এখনো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছে। ছেলেগুলোকে দেখিয়ে ইন্সপেক্টর জিয়ার কানে কিছু বলল জাকির। জিয়া দুজন কনস্টেবলকে বলল ছেলেগুলোকে ধরে আনতে। ভিড় ঠেলে পুলিশ বের হওয়ার আগেই ছেলেগুলো দৌড়ে পালিয়ে গেলো।
ইনস্পেক্টর জিয়া কেস নিতে চাইলে জাকির অনেক বুঝিয়ে বলল, দেখুন। আপাতত কেস নেওয়াটা সম্ভবত ঠিক হবে না। তাই একটা সাধারণ ডায়রি করাই ভাল হবে। কেন না আপনি বা কেউ জানে না যে আসল আসামী কে।
ইনস্পেক্টর জিয়া জাকিরের কথায় সহমত পোষণ করে বলল, তা ঠিক। তো, জাকির সাহেব, ঠিক আছে। আজ আমরা উঠছি। কোন সমস্যা হলে বা কোন তথ্য দেওয়ার থাকলে অবশ্যই আমাকে জানাবেন। জাকির বলল, ওকে। থ্যাংক ইউ। সেদিন অনেক সময় ওদের সাথে কাটিয়ে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরল জাকির। সারাদিনে খাওয়াদাওয়া, গোসল কোনকিছুই হয়নি। শাওয়ার ছেড়ে তার নিচে চোখে মেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জাকির।
পত্রিকা, টেলিভিশন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন একটাই ইস্যু আর তা হল ‘নীলিমার ধর্ষণ’। পুলিশ এখনো ধর্ষককে সনাক্ত করতে পারেনি। কোন আলামত ছেড়ে যায়নি সে। আর মেডিকেল রিপোর্টে নীলিমার শরীরে আঘাতের চিহ্ন পেলেও সেখানে ধর্ষকের কোন প্রমাণ নেই। আর নীলিমার জবানবন্দীতেও কোনকিছু পাওয়া যায়নি। চেয়ারে গা এলিয়ে সিগারেট ধরিয়ে জিয়া ভাবছে, একদম ফুলপ্রুফ ক্রাইম। কোনভাবেই ট্রেস করা যাচ্ছে না।
জিয়ার ভাবনায় ছেদ পড়ল কন্সটেবলের ডাকে, স্যার, ওই লোকটা এসেছে।’ কোন লোকটা সেটা জিজ্ঞেস না করে জিয়া বললেন, আচ্ছা, একটা কথা বল তো, ধর্ষকরা আজকাল কনডম পরে ধর্ষণ করে নাকি? এই প্রশ্নের উত্তর একটা কনস্টেবল কী দিবে? সে চুপ করে রইল। জিয়া বলল, লোকটাকে পাঠিয়ে দাও। জাকির ভিতরে ঢুকতেই জিয়া বললেন, ও আপনি? বসেন।
-আচ্ছা, আপনারা সেই ছেলেগুলোকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন?
-ওদেরকে কি সন্দেহ হয়?
-হ্যাঁ। আর সন্দেহ করাটাই স্বাভাবিক। ছেলেগুলো ওকে প্রায়ই বিরক্ত করত, ইভটিজিং করত।
-এগুলোর জন্য কাউকে ধর্ষণের দায় দেওয়া যায় না।
-হ্যাঁ, জানি। কিন্তু জিজ্ঞাসা তো করা যায়, নাকি?
-যায় যদি ছেলেগুলোর ফ্যামিলি সাধারণ ফ্যামিলি হয়। বাংলাদেশে সাধারণের তুলনায় অসাধারণ লোক বেশি। বুঝছেন ব্যাপারটা? জাকির শুধু বুঝল না। খুব ভাল করেই বুঝল। জিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো সে।
নীলিমার ধর্ষণের পনেরো দিন হয়ে গেলো। কোন সুরাহা হয়নি। কিন্তু ফেসবুকে ঠিকই আলোচনা চলছে। এদিকে পুলিশের উপরে আছে চাপ। জিয়া নীলিমাদের বাসায় এসে দেখে সেখানে জাকির আছে। জিয়া স্পষ্টভাবে বলল, দেখুন, আমার ধারণা আপনার মেয়ে অনেক কিছু লুকিয়েছে। যার কারণে আমরা কোন সমাধানে যেতে পারছি না। আপনার মেয়ের মঙ্গলের জন্যই বলছি। আপনিই বলুন, এখন কে আপনার মেয়েকে বিয়ে করবে? অপ্রাসঙ্গিক ভাবে এই কথাটা বলায় চোখ লাল করে জিয়ার দিকে তাকালো জাকির। উঠে বলল, কী বললেন আপনি?
-না মানে, বলছিলাম কী, যদি আমরা ধর্ষককে ট্রেস করতে না পারি, মেয়েটাকে বিয়ে করবে কে? আপনি তো ওর বন্ধু, আপনি বলেন, আপনি বিয়ে করবেন? জাকির কোনকিছু না ভেবেই বলল, হ্যাঁ। ওকে আমিই বিয়ে করব। জিয়া তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, এরকম সবাই বলে। পরে কাউকে পাওয়া যায় না।
জাকির নীলিমার মা কান্তার কাছে গিয়ে বলল, আন্টি, আমি নীলিমাকে এখনি বিয়ে করতে চাই, আপনি আপনার মেয়েকে আর সাথে বিয়ে দিবেন। আর হ্যাঁ, আমার এই বিয়ে করতে চাওয়াটাকে ভুলেও করুণা ভাববেন না। আমি তাকে ভালবেসেই বিয়ে করতে চাচ্ছি। কান্তার পক্ষে না বলা সম্ভব না। এদেশে একটা ধর্ষিতা কতটা অপমানের মধ্য দিয়ে যায়, তা বুঝতে বাকি নেই কান্তার। নীলিমার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, তোর কোন আপত্তি আছে? নীলিমা মাথা নেড়ে বলল, না। অর্থাৎ সে রাজী। তখনি কাজী ডেকে কলমা পড়িয়ে নীলিমা আর জাকিরের বিয়ে হল। ধর্ষণ কেসের সমাপ্তি এখানেই বন্ধ। কিন্তু নতুন সংবাদে মুখরিত সংবাদপত্র, টেলিভিশন এব ফেসবুক, ‘ধর্ষিতা নীলিমাকে বিয়ে করেছে জাকির। সত্যিই মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে সে।’
বাসায় এসে বিয়ে করার কথা বললে জাকিরের পরিবারের, আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে অনেক কথা বলাবলি করেছিল। জাকির শুধু একটা কথা বলল, ও তো কোন অপরাধ করেনি। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমি ওকে ভালবাসি। এই ব্যাপার নিয়ে আর কোন কথা শুনতে চাই না। পরদিন পারিবারিকভাবে লোকজন এসে নীলিমাকে জাকিরের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। বাসর রাতে নীলিমা শুধু একটা কথা বলল, আমি তোমাকে শুধু ভালবেসেছিলাম কিন্তু কখনো তোমার হৃদয়টা ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করিনি। ক্ষমা করে দিও আমাকে। সত্যিই তুমি অনেক ভাল একটা মানুষ। তার উত্তরে জাকির কোন কথা বলেনি। নীলিমার কপালে চুমু খেয়ে বলল, আমি তোমাকে ভালবাসি। আর তোমার জন্য আমি সব করতে পারি। কথাগুলো কেমনযেন নাটকীয়। কিন্তু জাকিরের গলায় নীলিমা সেই নাটকীয় সুর পেলো না, পেলো এক ভালবাসার প্রতিশ্রুতি।
পাঁচ বছর পরের কথা। ঢাকা শহরের একটা ফ্লাটে থাকে নীলিমা আর জাকির। খুব সুন্দর জীবন যাপন করছে তারা। তাদের অন্যতম সুখী পরিবারে আরও সুখ এসেছে মাইশার আগমনে। মাইশার বয়স তিন বছর। পাকা কথার ফুলঝুরিতে সবসময় মাতিয়ে রাখে বাসা। সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। আজ অফিস থেকে আগে ফিরেছে জাকির। বেলকনিতে বসে গান শুনছে সে। শ্রীকান্ত আচার্য্যের কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে, mযে ছিল আমার স্বপনচারিণী তারে বুঝিতে পারি নি। দিন চলে গেছে খুঁজিতে খুঁজিতে॥ শুভক্ষণে কাছে ডাকিলে, লজ্জা আমার ঢাকিলে গো,তোমারে সহজে পেরেছি বুঝিতে॥
পাশে এসে জাকিরের উরুর উপর বসে গলা জড়িয়ে ধরল নীলিমা। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে জাকির বলল, পাগলকরা বৃষ্টি, তাই না? এরকম বৃষ্টি দেখলে আমার মাথা নষ্ট হওয়ার মত অবস্থা হয়। বৃষ্টির কথা শুনে নীলিমার মুখটা শুকিয়ে গেল। জাকির তার ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? মুখটা এমন মরা কেন? খুবই ক্ষীণস্বরে নীলিমা বলল, তুমি তো জানো, শুধুমাত্র এইরকম বৃষ্টি দেখলেই আমার জীবনের কালরাত্রির কথা মনে পড়ে। জাকির নীলিমার মন খারাপের কারণ বুঝতে পেরে বলল, শোন, তোমাকে একটা কবিতা শোনাই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতা ‘কেউ কথা রাখেনি’ আবৃত্তি শুরু করল জাকির। কবিতার শেষ প্যারায় এসে গলা ছেড়ে দিল, সেই সুর বৃষ্টির শব্দের সাথে মিশে এক অন্যরকম রোমাঞ্চকর পরিবেশ তৈরি করল।
বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল, যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে! ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয়ে প্রাণ নিয়েছি দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড় বিশ্বসংসার তন্নতন্ন করে খুঁজে এনেছি একশো আটটা নীল পদ্ম তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ এখনো সে যে-কোনো নারী। কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না! নীলিমা জাকিরকে জড়িয়ে ধরে বলল, বাহ! খুব সুন্দর আবৃত্তি করেছ। তো বল, ভালবাসার জন্য তুমি কী করেছ?
-কতকিছুই তো করলাম। তোমাকে পাওয়ার জন্য কম করেছি নাকি?
-কী করেছ, শুনি?
-সেদিন তো আমি….
কথাটা শেষ করল না জাকির। নীলিমা বলল, সেদিন কী? কোনদিনের কথা বলছ? জাকির ঘামছে। সে গুছিয়ে মিথ্যাটা বলতে পারছে না। মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। কেমনযেন কেঁপেকেঁপে উঠছে সে। তার এমন আচরণে বেশ অবাক হচ্ছে নীলিমা। জাকিরের উরুর উপর থেকে নেমে নীলিমা বলল, তুমি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছ, বল কী? আর কোনদিনের কথা বলছ? গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো জাকির। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস পাঁচ বছর ধরে বুকে পুষে রেখেছে সে। আজই সেই দীর্ঘশ্বাস বের হওয়ার মোক্ষম সময়। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, তোমাকে কে রেপ করেছিল, জানো? আমি, আমিই করেছিলাম। কারণ তুমি আমাকে বলেছিলে, আমার মত অপদার্থকে তুমি কখনো বিয়ে করবে না। তাই, হ্যাঁ তাই আমি তোমাকে রেপ করে ছবি তুলে টিভি, পত্রিকায় দিয়েছিলাম। তার পরের ঘটনা তো জানোই।
নীলিমা এখন সেই গন্ধটা বুঝতে পারছে। ওটা তো জাকিরেরই গন্ধ। এই বুকে পাঁচটা বছর মাথা রেখে শুয়েছে সে। কিন্তু এতদিন তাহলে সে কেন বুঝতে পারেনি? জাকির জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। নীলিমা ঘরে ঢুকতেই বিদ্যুৎ চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর জাকিরের কানে কেমনযেন হিংস্র একটা শব্দ এলো, ঘাড় ঘুরাতেই সে বজ্রপাতের আলোয় বটি হাতে নীলিমার হিংস্র মুখটা দেখতে পেল সে। আর মৃত্যুর আগেই এটাই ছিল তার দেখা শেষ দৃশ্য।