আজ আমাকে দেখতে আসার কথা। সবে মাত্র ইন্টার পাশ করে অনার্সে উঠেছি। বাবার ধারণা এটাই হচ্ছে মেয়েদের বিয়ে দেয়ার পারফেক্ট সময়। আমিও তেমন না মত করিনি। যদিও বিয়ের ব্যপারে আমার তেমন আগ্রহ নেই। বাড়ির সবাইকে ছেড়ে গিয়ে নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেয়া আমার জন্য খুব কঠিন পরিক্ষার নাম হবে বলেই আমার ধারণা।
আজ আমার ইনকোর্স পরিক্ষা ছিলো। কিন্তু ভাবী সকালে ঘুম থেকে উঠেই জানালেন আজ আমার পরিক্ষা দেয়ার দরকার নেই। আমাকে দেখতে লোক আসবে। আমিও ভাবীর কথা খুব একটা ফেলতে পারিনা। আমার আর কোনো বোন নেই। কিন্তু বোনের চেয়ে বেশী পেয়েছি আমার ভাবীকে। আমি এটা বুঝিনা যে ভাবীর মতো এমন সুন্দরী আর নিষ্পাপ মেয়েকে ছেড়ে ভাইয়া কেন এক মুটকি কে নিয়ে পড়ে আছে? মুটকি টা নাকি ভাইয়ার বান্ধবী ছিলো! কিন্তু ভাইয়া কি এমন দেখলো যে এমন হিরার টুকরা ভাবীকে ছেড়ে ঐ মুটকির কাছে গেলো? মুটকি টার তো আগেও বিয়ে হয়েছিলো বেশ কয়েকবার। আমি যতদূর শুনেছি মুটকিটার তিনবার ডিভোর্স হয়েছে। আমার ভাইয়া গিয়ে ঐ মুটকি টাকেই বিয়ে করলো।
বাবা সেদিন থেকে এই বাড়ি টা ভাইয়ার জন্য নিষিদ্ধ করলেন। ভাবী হয়তো চাইলেই কোর্ট কাছারি করতে পারতেন কিংবা এই বাড়ি ছেড়ে নিজের বাপের বাড়ি চলে যেতে পারতেন। কিন্তু ভাবী কিছুই করলেন না। এই বাড়ি ছেড়ে তিনি যাবেন না। এই বাড়ি নিয়েই তার স্বপ্নের শেষ ছিলো না। কিন্তু সব স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার পরেও তিনি হাসি মুখে এই বাড়ির মাটি কামড়ে ধরে আছেন। ভাইয়া চলে যাওয়ার পর আমি আর ভাবী এক বিছানায় ঘুমাই। আমি টের পেতাম ভাবী মাঝে মাঝে কাঁদতেন। আমার মনে হচ্ছিলো নিষ্পাপ কোনো শিশু কাঁদছে। ভাবী কাঁদতেন আর আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতাম। ভাবীর জন্য আমার মায়া হতো খুব। কিন্তু, আমরা সবাই ছিলাম নিরুপায়। এক রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখতে পেলাম ভাবী কাঁদছে।
-ঐশি, আমি কি এমন পাপ করেছিলাম যে আমার ভাগ্যে এমন হওয়ার দরকার ছিলো? বলনা প্লিজ। আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। আমার মনে হলো ভাবীর কথাগুলো আমার বুক চিড়ে ঢুকে গেছে।
-বল না ঐশি, কি দোষ ছিলো আমার! আমি কি তোর ভাইয়াকে ভালবাসি নি? আমার কিসের অভাব ছিলো? একবার তো আমাকে জানাতে পারতো! আমি তখনো নিশ্চুপ ছিলাম। আমার এখানে কিছু বলা শোভনীয় নয়।
-ঐশি শোন, মেয়েদের কাছে স্বামী হচ্ছে সব। তাছাড়া সব কিছুই তুচ্ছ। শত অভাবের মাঝে স্বামী পাশে থাকলে তখন আর অভাব থাকেনা। অথচ, গোলা ভরা ধান,পুকুর ভরা মাছ আর বাড়ি ভর্তি মানুষ থাকার পরেও যদি স্বামী পাশে না থাকে তাহলে জীবনের অর্থটাই বৃথা। এরপর বুঝতে পারলাম ভাবী কেঁপে কেঁপে উঠছে। সেই সাথে নিঃশব্দের কান্না। ভাবী আমাকে সাজিয়ে দিলেন। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই চিনতে পারছিনা যেন! আমি কি আসলেই এত সুন্দরী! গালের তিল টা যেন আরো সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাবী আমার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলেন।
-আরে বাপস! ঐশি, আমি যদি ছেলে হতাম নিশ্চিত তোর প্রেমে পড়ে যেতাম।
-কি যে বলো না ভাবী!
-সত্যি বলছি রে।
-যাও! আমার লজ্জা লাগছে এসব শুনতে।
ভাবী আমাকে নিয়ে এলেন বসার ঘরে। আমি মাথা নিচু করে আছি।। আমার মা মিষ্টি আর বিস্কুটের ডিস টা নিয়ে এসেছেন। টেবিলে রেখে চলে গেলেন তিনি। বাবা বসে আছেন বরপক্ষের একজন মুরুব্বির কাছে। এই রুমে আসার সময় বরকে একনজর দেখেছিলাম। দেখতে সুদর্শন বটে। ভাবীর কাছে শুনেছিলাম বর নাকি ইঞ্জিনিয়ার আর সেই সাথে সরকারী চাকরি করেন। হঠাৎ মুরুব্বি টাইপের মানুষ টার কথা শুনতে পেলাম। এবং তখনই বুঝলাম ইনি বরের বাবা।
-মাশাল্লাহ মেয়েকে আমাদের দারুণ পছন্দ হয়েছে।আমরা ঠিক এমন একজন মেয়েকে আমাদের ঘরের লক্ষ্মী বানাতে চেয়েছিলাম।
– আলহামদুলিল্লাহ, তাহলে আমরা কি বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে পারি? বাবা মহা উৎসাহে বলে ফেললেন।
-তা তো অবশ্যই। আমাদের তেমন কিছু চাওয়ার নেই। শুধু আপনার মেয়ে আর জামাইয়ের দিকে সুনজর দিলেই চলবে। বরের সাথে আসা মহিলার কথা শুনে তাকালাম মহিলার দিকে। ভদ্র মহিলার শরীর যেমন তেমন তাল গাছের মতো। চোখে লো পাওয়ারের চশমা। ভাবীর দিকে তাকিয়ে দেখি ভাবী আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
-আপনাদের চাওয়া পাওয়া কিছু থাকলে নিঃসন্দেহে বলতে পারেন। আমার বাবার পিছনে দাড়িয়ে থাকা মা এবার কথাটি বলে বরের বাবার দিকে তাকালেন।
-আমাদের আর কি বা চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে! বিয়ের পর আপনার মেয়ে আর মেয়ে জামাইয়ের যাতায়াতের জন্য এই যুগে ২৫০ একটা পালসার বাইক দেয়া মোটেও আপত্তি হবে না আপনাদের। মেয়ের জন্য অলঙ্কার দিতে নিশ্চয়ই আপনারা অমত করবেন না। আর তাছাড়া, আপনার মেয়ে আর মেয়ে জামাইয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে লাখ পাঁচেক টাকা চাওয়া এমন কিছু না। আপনারা বড় লোক মানুষ। ধুম ধাম করে বিয়েতে শ’খানেক বরযত্রীকে খাওয়াতে পারবেন নিশ্চিন্তে।
মেয়ের থাকার জন্য রুমের বিছানা, আলমিরা, শোকেজ দেয়া তো মডার্ণ যুগের কালচার। কি বলেন বেয়াই? বরের বাবার ঠান্ডা মেজাজের কথাগুলো যেন বরফের মতো কলিজায় ঢুকে যাচ্ছে। ভাবীর দিকে তাকিয়ে দেখি ক্রুদ্ধ স্বরে তাকাচ্ছে বরের বাবার দিকে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি সব কিছু চুরমার করে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। বাবার মুখে শুকনো হাসির চিহ্ন। বরের মুখে একটু তৃপ্তির হাসি। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি চোখে মুখে অবিশ্বাসের আভা। হিন্দুদের বাড়িতে অতিথিকে নারায়ন ভগবানের সাথে তূলনা করা হয়। পাষাণ হৃদয়ের সেই পাঠান দের বাড়িতেও অতিথিকে অসম্মান করানো হয় না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো এই সব অতিথিকে ঝাটাপেঠা করে বিদায় করে দিতে। অভদ্রতা হবে ভেবে কিছু বলতেও পারছিনা।
-কিন্তু আপনারা আর কিছু চাইলেন না কেন? এই যেমন আপনাদের বসার ঘরের টিভি টা পুরাতন হয়েছে নিশ্চয়ই। সেটার পরিবর্তে ৫২” এলইডি চাইতে পারতেন। এরপর, রুমের জন্য এয়ারকন্ডিশনের ব্যবস্থা আর ফ্রিজ চাইতেও পারতেন। আরো ভালো হতো যদি বাথরুমের কমোড চাইতেন। আমরা তো সব কিছু দিতেই পারি৷ আমরা যে বড়লোক। ছেলের হাতে একটা রোলেক্স ব্রান্ডের হ্যান্ড ক্লক আর আইফোন ১১ চাইলেই বা আপনাদের লজ্জা টা কোথায়? এই যুগে কেউ পালসার চায়? একটা মার্সিডিজ মারুতি না হলে কি চলে? স্টাটাস বলে কথা! হঠাৎ ভাইয়া এভাবে বাড়িতে ঢুকবে আর কথাগুলো বলবে সে ব্যপারে কারো ধারণা ছিলো না। ভাবী তাকিয়ে রইলো ভাইয়ার দিকে। আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি ভাইয়া যেন রাগে ফুসছে।
-তুমি কি আমাদের অপমান করছো? ছেলের মা আমার অগ্নিমূর্তি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো।
-আপনারা কি যাবেন নাকি গলাধাক্কা দিয়ে পাঠিয়ে দিবো? বেড়িয়ে যান আমাদের বাড়ি থেকে। বরপক্ষ সুরসুর করে বেড়িয়ে গেলো। ভাইয়া হুট করে বাবার পা ধরে কাঁদতে লাগলো।
-বাবা, তুমি অন্ততপক্ষে জানো যে আমি কোনো অন্যায় করতে পারিনা। আমি সোনিয়াকে বিয়ে করিনি বাবা। ওর স্বামী ওকে ডিভোর্স দিয়েছিলো। সে হঠাৎ আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলো। আমি ওকে সঙ্গ দিয়েছি। এই কয়েকদিন আমি ওর সাথে মিশেছি। কিন্তু আমি কোনো পাপ করিনি। সোনিয়া আমার খুব ভাল বন্ধু ছিলো।কিন্তু অতিরিক্ত মোটা হওয়ার কারণে ওর বিয়ে বিচ্ছেদ যাচ্ছিলো বারবার। আমি নিজেই ওর বিয়ে দিয়ে তবেই চলে এলাম আজ। বাড়ি এসে শুনি ঐশির বিয়ের আলাপ চলছে। এমন একটা লোভী পরিবারে আমার বোন দুই দিনও টিকতে পারতো না! আমাকে মাফ করে দাও বাবা। বাবা হাত দিয়ে ভাইয়াকে উঠিয়ে দিলেন।
-বোকা ছেলে! আমার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে না। তুই বৌ মার কাছে গিয়ে মাফ নে। যা ভাইয়া হাত তুলে করজোরের ভঙ্গিতে ভাবীর দিকে তাকালো। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম ভাবীর চোখ টলমল করছে। এই পানি হতাশার পানি নয়। আর না কোনো দুঃখের পানি। এটা আনন্দের অশ্রু।