১৮. রাস্তায় পৌঁছে হনহন করে
রাস্তায় পৌঁছে হনহন করে হাঁটতে শুরু করে। আমি আর কুমারেশবাবু তাকে অনুসরণ করি।
কিরীটীর শেষের কথাগুলো সমস্ত সংশয়ের অবসান ঘটিয়েছে।
অথচ আশ্চর্য! বার বার ঐ কথাটাই মনে হচ্ছিল। এই দিকটা একবারও আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি কেন? আগাগোড়া ঘটনাটা একটিবারও ঐ দিক দিয়ে আমি বিশ্লেষণ করে দেখিনি কেন?
তাড়াতাড়ি একটু পা চালিয়ে আয় সুব্রত! কুমারেশবাবুর উণ্ডটা dress করাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
কিরীটী চলতে চলতেই আমাকে একবার তাড়া দিল।
নার্সিং হোমে পৌঁছে দেখি, সেখানে আবার বেশ শোরগোল পড়ে গিয়েছে। ডাঃ চ্যাটার্জী নিজেই একজন ভৃত্যের সঙ্গে কী যেন কথা বলছিলেন।
আমাদের প্রবেশ করতে দেখে বলে উঠলেন, এই যে মিঃ রায়! আবার শতদলবাবুর life-এর ওপরে another attempt হয়েছে। ওকেই আপনার কাছে পাঠাচ্ছিলাম।
ডাঃ চ্যাটার্জীর কণ্ঠস্বরে একরাশ উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ে। কিন্তু প্রত্যুত্তরে কিরীটীর কণ্ঠস্বরে কোনোরূপ উৎকণ্ঠাই প্রকাশ পেল
অত্যন্ত শান্ত ও নিরুৎসক কণ্ঠে প্রশ্ন করলে, আবার হয়েছিল বুঝি?
হ্যাঁ।
এবারেও poison, না বুলেট!
সেই পূর্বের মতই মরফিন হাইড্রোক্লোর
হুঁ। চলুন দেখা যাক।
এবারেও ঠিক সময়মত ব্যাপারটা জানতে পারায় কোনমতে ভদ্রলোককে বাঁচানো গিয়েছে। কিন্তু আর না মশাই। ও ঝঞ্চাট আর আমার নার্সিং হোমে রাখতে সাহস হচ্ছে না মিঃ রায়, আপনারা অন্য ব্যবস্থা করুন।
ভয় নেই ডক্টর চ্যাটার্জী, হত্যাকারীর এইটাই last show! খেলা তার ফুরিয়েছে, কিন্তু এবারেও কি কড়াপাকের সন্দেশ নাকি?
না, এবারে আরও serious
কি রকম?
হাসপাতালের দেওয়া দুধ পান করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।
হুঁ। তা দুধটা দিয়ে এসেছিল কে কেবিনে?
নার্সই। সে বললে, রাত দশটায় দুধ নিয়ে এসে শতদলবাবুর কেবিনে ঢুকে দেখে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে ঘরের আলো নিবিয়ে শতদলবাবু ঘুমোচ্ছেন তাই আর তাঁকে বিরক্ত না করে দুধটা মাথার ধারে মেডিসিন ক্যাবার্ডের ওপরে একটা কাঁচের প্লেট দিয়ে ঢেকে রেখে কেবিন থেকে বের হয়ে আসে।
তারপর? কিরীটী পূর্ববৎ নিরাসক্ত ভাবেই প্রশ্ন করে।
তারপর রাত যখন দেড়টা, নার্স বদলির সময় নতুন ডিউটি-নার্স মণিকা গুহ শতদলবাবুর কেবিনের সামনে দিয়ে যেতে যেতে একটা অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি কেবিনের মধ্যে প্রবেশ করে আলো জেলে দেখে, শতদল শয্যার উপরে গোঁ-গোঁ করছে। তাড়াতাড়ি আমাকে খবর দেয়, আমি ছুটে যাই—
এখন কেমন আছেন?
এখন একটু ভাল।
হুঁ। ভাল কথা ডাঃ চ্যাটার্জী, কুমারেশবাবুর হাতটা জখম হয়েছে, একটু দেখে ব্যবস্থা করে দিন
নিশ্চয়ই। কিন্তু
সব বলব আপনাকে। আগে হাতটা পরীক্ষা করে ব্যবস্থা করুন—আমরা ততক্ষণ শতদলবাবুর সঙ্গে একটিবার দেখা করে আসি। কথাগুলো বলতে বলতে আরো একটু ডাঃ চ্যাটার্জীর দিকে এগিয়ে গিয়ে নিম্নকণ্ঠে কিরীটী তাঁকে যেন কী নির্দেশ দিল, তারপর আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, চল সুব্রত!
***
নির্জীবের মত শতদলবাবু তার নির্দিষ্ট কেবিনের মধ্যে শয্যায় শুয়ে ছিল। মাথার সামনে একজন নার্স একটা টুলের উপর বসে ছিল। আমাদের দুজনকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে উঠে দাঁড়াল।
কিরীটী চোখের ইঙ্গিতে নার্সকে কক্ষত্যাগ করতে বললে। নিঃশব্দে নার্স কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।
কিরীটী অতঃপর শয্যার সামনে এগিয়ে গিয়ে ক্ষণকাল শয্যায় শায়িত নির্জীব শতদলের দিকে তাকিয়ে রইল।
তারপর এগিয়ে গিয়ে উদ্যানের দিকে খোলা জানলাটার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়াল। এবং জানালাপথে ঝুঁকে কী যেন দেখতে লাগল বাইরে।
এমন সময় শতদলবাবু চোখ মেলে তাকাল এবং ক্ষীণকণ্ঠে ডাকল, নার্স!
আমি নার্সকে ডাকতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কিরীটী চোখের ইঙ্গিতে আমাকে নিষেধ করে শয্যার কাছে এগিয়ে এল।
শতদলবাবু!
কে?
আমি কিরীটী, কেমন আছেন?
মিঃ রায় এসেছেন। আবার আমার life-এর ওপরে attempt নিয়েছিল!
তাই তো শুনলাম।
এবার দুধের সঙ্গে
হ্যাঁ, বড্ড কাঁচা কাজ করে ফেলেছে।
কাঁচা কাজ!
হ্যাঁ। আর সেই জন্যেই সে আমার চোখে ধরাও পড়ে গিয়েছে।
ধরা পড়েছে! শতদলবাবুর কণ্ঠে বিস্ময়।
হ্যাঁ, শতদলবাবু। জানেন একটা কথা, আপনি যে রণধীর চৌধুরীর চিঠিটা আমাকে দিয়েছিলেন—তার মর্মার্থ আমি উদ্ধার করতে পেরেছি।
চিঠি!
হ্যাঁ, মনে নেই আপনার? যে চিঠিটা আপনার কাছ থেকে আমি চেয়ে নিয়েছিলাম?
ও
আর সেই চিঠির মর্মোদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে হত্যাকারীও আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
হত্যাকারী?
হ্যাঁ সীতাকে যে হত্যা করেছে। চিঠিটা শিল্পীর একটা অদ্ভুত খেয়ালই বলতে হবে। আর আপনার কথাই ঠিক শতদলবাবু। ঐ চিঠিটাই রণধীর চৌধুরীর উইল!
আমি তো আপনাকে সেই দিনই বলেছিলাম, কিন্তু দিদিমা মানতে চাননি
ভুল করেছিলেন তিনি।
আমি আর নিজের কৌতুহলকে দমন করতে পারলাম না। প্রশ্ন করলাম কিরীটীকে, সত্যি তুই চিঠিটার মর্মোদ্ধার করতে পেরেছিস কিরীটী?
হ্যাঁ রে। চিঠিটার প্রত্যেকটি লাইলেন পাশে পাশে যে সাংকেতিক অঙ্ক বসানো আছে সেইটাই চিঠিটার মর্মোদ্ধারের সংকেত। এই দেখ পড়। বলতে বলতে চিঠিটা পকেট হতে বের করে কিরীটী আমার হাতে দিয়ে বললে, মোটামুটি চিঠিটায় বলেছে বটে, নিরালা বাড়ি ও তার যাবতীয় সব কিছু আমাদের শতদলবাবুই পাবেন—তবে তার মধ্যে আরো একটা নির্দেশ আছে, সেটা হচ্ছে ঐ সাংকেতিক অঙ্কগুলোর মধ্যে। অঙ্ক অনুসারে প্রত্যেক লাইনের সমানসংখ্যক কথাগুলো নিলে তার অর্থ এই দাঁড়ায়
নির্দেশঃ আমার মত্যুর পর স্টুডিওতে প্রপিতামহের ছবির স্বত্ব কুমারেশের হইবে।
কী বলছেন আপনি মিঃ রায়? শতদল বলে ওঠে।
হ্যাঁ শতদলবাবু। আমার কথা যে মিথ্যা নয় এই চিঠিই তার প্রমাণ দেবে এবং নিরালা ও তার মধ্যেকার যাবতীয় সম্পত্তি আপনি পেলেও, রণধীর চৌধুরীর প্রপিতামহের ছবিটা কুমারেশ সরকারই পাবেন।
কুমারেশ সরকার!
হ্যাঁ, কুমারেশ সরকার। তিনিও আজ এখানে উপস্থিত।
কুমারেশ! কুমারেশকে তাহলে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে?
নিশ্চয়ই। ঐ যে—
ঠিক সেই সময় ডাঃ চ্যাটার্জীর সঙ্গে সঙ্গে কুমারেশ সরকার হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা অবস্থায় কেবিনের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন।
কুমারেশবাবু, let us hear your story! আপনি কেমন করে হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিলেন, আর কোথায়ই বা এতদিন বন্দী হয়ে ছিলেন কেমন করে?
বিস্মিত কুমারেশ সরকার কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, আপনি সে কথা কী করে জানলেন মিঃ রায়?
অনুমান। অনুমানের ওপর নির্ভর করেই জেনেছি মিঃ সরকার। এখন তো বুঝতে পারছেন, অনুমান আমার ভুল হয়নি! Now let us have the story! কিরীটী বললে।
আশ্চর্য মিঃ রায়, সত্যি আগাগোড়া ব্যাপারটা এখনো আমার কাছে একটা দুর্বোধ্যের মতই মনে হয়। মনে হয় সবটাই যেন প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত একটা দুঃস্বপ্ন। তবু, বলছি শুনুন। কুমারেশ সরকার তাঁর কাহিনী শুরু করলেন– আপনি হয়তো জানেন না মিঃ রায়, শিল্পী রণধীর চৌধুরীর আমি দৌহিত্র হলেও তাঁর সঙ্গে আমাদের কোনদিন কোন সম্পর্ক ছিল না। আমার মাকে তিনি ত্যাজ্য করেছিলেন। আমরাও অর্থাৎ আমার মা-বাবা বা আমি কোনদিন তাঁর সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখবারই চেষ্টা করিনি। সেই দাদুর কাছ হতে তাঁর মত্যুর মাসখানেক আগে একটা আবোল-তাবোল লেখা চিত্রবিচিত্র চিঠি পেলাম। আশ্চর্যই হয়েছিলাম। এবং চিঠিটার মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারিনি বলে সে চিঠিটা ড্রয়ারের মধ্যেই অবহেলায় পড়ে ছিল, তারপর সাত-আট মাস পরে হঠাৎ হরবিলাস দাদুর একখানা চিঠি পেলাম—
হরবিলাসবাবুর চিঠি? কিরীটী প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। চিঠিতে তিনি লেখেন, অবিলম্বে কোন বিশেষ অথচ গোপনীয় ব্যাপারের জন্য যেন চিঠি পাওয়া মাত্রই এখানে এসে তাঁর সঙ্গে নিরালায় সাক্ষাৎ করি। অন্যথায় আমার নাকি সমূহ ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে। চিঠিতে এ-ও লেখা ছিল, যাবার আগে তাঁকে যেন আমি পত্র দিয়ে জানাই কবে যাচ্ছি।
হুঁ। তারপর?
চিঠি পেয়ে আমি এখানে আসব কিনা ভাবছি, এমন সময় রাণুর একখানা চিঠি পাই। সেও আমাকে দার্জিলিং থেকে লিখেছে দু-এক দিনের মধ্যেই তারা এখানে আসছে। তখন স্থির করলাম এখানে আসব। মনে মনে যে একটা কৌতূহল হয়নি তাও নয়। যা হোক, এখানে এসে পৌঁছলাম রাত্রের ট্রেনে এবং বলাই বাহুল্য, আগে হরবিলাস দাদকে চিঠিও দিলাম। কুমারেশ থামলেন।
থামলেন কেন? বলুন শেষ করনে। কিরীটী তাগিদ দেয়।
স্টেশনে নেমে বাইরে আসতেই একজন ঢ্যাঙামত লোক এগিয়ে এসে আমাকে প্রশ্ন করল, আমার নাম কুমারেশ সরকার কিনা এবং আমি কলকাতা হতেই আসছি কিনা। জবাবে আমি তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে সে বললে সে নিরালার হরবিলাসবাবুর লোক। আমাকে সে নিতে এসেছে। একটা ট্যাক্সি স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছিল। তার মধ্যে তার কথামত উঠে বসতেই অন্ধকারে ট্যাক্সির মধ্যে থেকেই কে যেন মাথায় আমার অতর্কিতে আঘাত হানল। সঙ্গে সঙ্গে আমি জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরে আসবার পর দেখি, ছোট্ট একটা ঘরে আমি বন্দী। পরে জেনেছিলাম সেটা নিরালার পিছনে জঙ্গলাকীর্ণ বাগানের মধ্যের আউটহাউস
একটা কথা মিঃ সরকার, আপনি চেঁচামেচি করে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করেননি কেন বন্দী অবস্থায়?
সেও এক বিচিত্র ব্যাপার। ঢ্যাঙা লোকটা আমাকে শাসিয়েছিল, তারা নাকি চিঠি দিয়ে আমার রক্তচাপের রোগী বৃদ্ধ অধ্যাপক বাপকেও নাকি আমারই মত এখানে ধরে এনে অন্য একটা ঘরে আটকে রেখেছে। আমি যদি চেঁচামেচি করি বা গোলমাল করি তারা আমার বৃদ্ধ বাপকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেবে। আর যদি চুপচাপ থাকি তো এক মাস বাদে ছেড়ে দেবে। বাবাকে যে আমি কতখানি ভালবাসি ঐ শয়তানরা জানত বোধ হয়। বাধ্য হয়েই তাই আমাকে কতকটা ঐ বন্দী জীবন মেনে নিতে হয়েছিল। একটিমাত্র জানালা ছিল ঘরের। সেই জানালাপথে সেই ঢ্যাঙা লোকটা প্রত্যহ এসে আমাকে খাবার দিয়ে যেত রাত্রে একবার করে। বন্ধী অবস্থায় আমার কেবলই ঘুম পেত।
Is it?
হ্যাঁ, কেবলই ঘুম পেত। উপযুক্ত আহার না পেয়ে এদিকে ক্রমেই দুর্বল হয়েও পড়ছিলাম।
আপনি টেরও পাননি মিঃ সরকার খাদ্যের সঙ্গে মরফিয়া দিয়ে আপনাকে ঘুম পাড়াত আর উপযুক্ত পরিমাণ আহার না দিয়ে ক্রমে আপনাকে দুর্বল করে ফেলছিল! কিরীটী বললে।
পরে বুঝতে পেরেছিলাম সব।
তারপর?
তারপর যে রাত্রে সীতা মারা যায়—সেই দিন বিকেলের দিকে ঐ উদ্যানের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে সে একসময় ঐ outhouse-এর কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎ আমাকে দেখতে পায় এবং সীতাই আমাকে উদ্ধার করে ঐদিন সন্ধ্যার দিকে। এবং আমাকে সে অবিলম্বে এখান থেকে চলে যেতে বলে। কারণ, তার বাপ ব্যাপারটা জানতে পারলে নাকি আমাকে হত্যা করবে। আমিও তার নির্দেশমত চলে যাই, কিন্তু পথে গিয়ে মনে হয় শতদলকে সব ব্যাপারটা জানানো উচিত। সঙ্গে সঙ্গে নিরালায় ফিরে আসি। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে সামনেই সীতার দেখা পাই। সে তখন ছাদ থেকে নীচে নেমে আসছে। সীতা আমাকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি বসবার ঘরে টেনে নিয়ে যায়।
সে আমাকে বলে, এ কী! আবার আপনি এখানে এসেছেন কেন? একটা সর্বনাশ না করে আপনি ছাড়বেন না দেখছি! বাবা নীচে আছেন এখন, যদি তাঁর চোখে পড়ে যান?
শতদলের সঙ্গে একবার আমি দেখা করতে চাই। তুমি একবার যেমন করে হোক শতদলকে এই ঘরে ডেকে নিয়ে এস।
কিন্তু
না, তার সঙ্গে দেখা না করে আমি যাব না। আমি বললাম সীতাকে। কিন্তু কথা আমার শেষ হল না, ঠিক এমনি সময় দরজার ওপাশ থেকে একটা গুলির আওয়াজ এল ও সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্ত চিৎকার করে সীতা মাটিতে পড়ে গেল। আমিও আকস্মিক সেই ব্যাপারে ভয়ে বিহবল হয়ে পড়েছিলাম। এবং ঐ মুহূর্তেই সেখান থেকে পালালাম। পালাই যখন তখন সিঁড়ি দিয়ে কে যেন একটি মহিলা ছাদ থেকে নেমে আসছিল। সে বোধ হয় আমাকে দেখে ফেলেছিল—
হ্যাঁ, শরৎ গুহর মেয়ে কবিতা গুহ। কিরীটী বললে, কিন্তু সে-রাত্রে ভয়ে আপনি যদি অমন করে হঠাৎ না পালিয়ে যেতেন তো আজ রাত্রে আপনাকে গুলি খেতে হত না। তবু, ভাগ্য বলতে হবে যে, গুলিটা আপনার হাতের উপর দিয়েই গিয়েছে। যাক, শেষ করুন আপনার কথা।
নিরালা থেকেও আমি পালালাম। কিন্তু এখান থেকে যেতে পারলাম না। কটা দিন আত্মগোপন করে বেড়িয়েছি আর ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করেছি—কী হল। হঠাৎ সীতাকে কে গুলি করে মারল? এমন সময় হরবিলাস দাদু অ্যারেস্ট হয়েছেন আজ সকালে শুনতে পেলাম। তখন ঠিক করলাম সীতার মা হিরণ্ময়ীদির সঙ্গে দেখা করব। এবং তাঁকে সব ব্যাপারটা খুলে বলব। কিন্তু সদর গেট দিয়ে নিরালা ঢুকতে সাহস হল না, সুদূরে পুলিস মোতায়েন দেখে। একটা বাঁশ যোগাড় করে পোলভল্টের সাহায্যে প্রাচীর টপকে নিরালার পিছনের বাগানে প্রবেশ করলাম। তারপর এগুচ্ছি–
এই সময় কিরীটী বাধা দিল, দেখলেন ভুখনা ও কালো কাপড়ে সর্বাঙ্গ আবৃত ছায়ামূর্তিকে বাগানের মধ্যে—তাই না?
হ্যাঁ, আমার ইচ্ছে ছিল লোকটাকে পিছন থেকে গিয়ে জাপটে ধরব, কিন্তু তার আগেই সে আমার উপস্থিতি টের পেয়ে।
গুলি করে! কিন্তু he missed the chance! এবং হত্যাকারী জানতে না যে তার আগেই বাগানে প্রবেশ করে একটা ঝোপের মধ্যে অনতিদূরে আমি আর সুব্রত আত্মগোপন করে আছি!
ঘোষাল-সাহেব এই সময় এসে ঘরে প্রবেশ করলেন। ব্যাপার কি কিরীটীবাবু! এত জরুরী তলব কেন? ঘোষাল প্রশ্ন করেন।
এই যে আসুন ঘোষাল সাহেব। আপনার নিরালা ও সীতা-হত্যা রহস্যের মীমাংসা হয়েছে। কিরীটী আহ্বান জানাল ঘোষালকে।
সত্যি!
হ্যাঁ।
কিন্তু ইনি—ইনি কে?
বিখ্যাত স্পোর্টসম্যান আমাদের কুমারেশ সরকার।
নমস্কার। তা উনি—
ঘটনাচক্রে উনিই তো যত অনর্থের মূল! কিরীটী জবাব দেয়।
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়? প্রশ্নটা করল শতদল।
হ্যাঁ। বর্তমান রহস্যের উনিই নিউক্লিয়স! ওঁকে কেন্দ্র করেই সব কিছু ঘটেছে!
তার মানে?
তার মানেটা আপনার চাইতেও কারো বেশী জানবার কথা নয় শতদলবাবু। গম্ভীর কিরীটীর কণ্ঠস্বর।
আমি!
হ্যাঁ আপনি। চমৎকার খেলা খেলেছেন শতদলবাবু কিন্তু বড়ের চালে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছেন—তাতেই কিন্তু মাত হয়ে গিয়েছেন!
আপনি—
শতদলবাবু আমি কিরীটী রায়।
মিঃ রায়! ঘোষাল সাহেব সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকান কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ মিঃ ঘোষাল, উনি– আমাদের শতদল বোসই এই নাটকের প্রধান চরিত্র। সকল রহস্যের মেঘনাদ। সীতা দেবীর হত্যাকারী।
ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল।
আগের পর্ব :
০১. সাগর-সৈকত হোটেল
০২. আবার সমুদ্রের দিকে
০৩. হিরন্ময়ী দেবীই প্রথমে কথা বললেন
০৪. ভদ্রমহিলা রাণুর দিকে তাকিয়ে
০৫. শতদলবাবুর কথায় তাকিয়ে দেখলাম
০৬. দ্রষ্টব্য বটে ভুখনা
০৭. দ্বিতীয় প্রশ্ন করল কিরীটী
০৮. একটা ভারী বস্তু পতনের শব্দ
০৯. শেষ নির্দেশ
১০. এগিয়ে আসছে ছায়া-মূর্তি দুটো
১১. হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের প্রায় কাছাকাছি
১২. একটা বেদনার ঝড়
১৩. একজন সুশ্রী সুবেশা মহিলা
১৪. থানা-অফিসার রসময় ঘোষাল
১৫. হিরণ্ময়ী দেবীর কণ্ঠস্বর
১৬. দেওয়ালে টাঙানো অয়েল-পেন্টিং
১৭. কালো অন্ধকার রাত
পরের পর্ব :
১৯. নিরালাতেই আমরা সকলে উপস্থিত ছিলাম