চক্রী: ১৩. একজন সুশ্রী সুবেশা মহিলা

চক্রী: ১৩. একজন সুশ্রী সুবেশা মহিলা

১৩. একজন সুশ্রী সুবেশা মহিলা

বাইশ-তেইশ বৎসর বয়সের একজন সুশ্রী সুবেশা মহিলা কিছু রক্তলাল গোলাপ ও এক বাক্স মিষ্টি-কড়াপাকের সন্দেশ-সঙ্গে নিয়ে শতদলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন! চোখে তাঁর কালো লেন্সের চশমা ছিল অর্থাৎ সুস্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, মহিলা যেই হোন না কেন, তিনি তাঁর মুখখানির স্পষ্ট পরিচয়টা দিতে ইচ্ছুক নন। কিন্তু তার চাইতেও মারাত্মক ব্যাপার, তাঁর দেওয়া মিষ্টি খেয়েই শতদল অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং সংবাদ পেয়ে তাড়াতাড়ি ডাঃ চ্যাটার্জী এসে পড়ায় কোনমতে শতদলকে সুস্থ করে তোলা হয়েছে। মরফিন পয়েজনিং কেস। শতদলকে মিষ্টির সঙ্গে মরফিন দিয়ে কৌশলে তাহলে হত্যা করারই চেষ্টা করা হয়েছিল। আবার শতদলের প্রাণহরণের প্রচেষ্টা এবং এবারে ডাঃ চ্যাটার্জী ঠিক সময়ে শতদলের অসুস্থতার সংবাদ না পেলে তাঁকে হয়তো বাঁচানোই যেত না! পরিকল্পনাটিও চমৎকারই বলতে হবে–মিষ্টির সঙ্গে বিষপ্রয়োগ! কিন্তু কে সেই ভদ্রমহিলা?

ভাল কথা মিস মিত্র, ভদ্রমহিলা তাঁর নাম বলেননি? আমিই প্রশ্ন করি।

না। নাম তো কিছু তিনি বলেননি, তবে একটা মুখ-আঁটা নীল খামে চিঠি দিয়েছিলেন ঐ সঙ্গে, শতদলবাবুর নাম উপরে লেখা। চিঠিটা দিয়ে বলেছিলেন, ঐ চিঠিটা দিলেই সব তিনি বুঝতে পারবেন। আমি সেই চিঠি, ফুল ও মিষ্টির বাক্সটা এনে উপরের ইনচার্জ নার্স মিসেস মহান্তির হাতে দিই।

ও, তাহলে মিসেস মহান্তিই তখন উপরে ডিউটিতে ছিলেন! কথাটা বলে কিরীটী মিস মিত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, মিসেস মহান্তি কি এখন এখানে উপস্থিত আছেন? তাঁকে একটিবার অনুগ্রহ করে যদি এই ঘরে ডেকে আনেন মিস মিত্র।

মণিকার এখন off-duty হলেও বোধ হয় নার্সিং হোমেই আছে। দেখছি যদি না বাইরে গিয়ে থাকে তো পাঠিয়ে দিচ্ছি!

মিস মিত্র ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

কিরীটী চেয়ারের ওপরে বসে অন্যমনস্ক ভাবে সম্মুখের টেবিলের উপর থেকে একটা কাঁচের কাগজ চাপা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। চোখের দৃষ্টি স্তিমিত। অন্যমনা।

বুঝতে পারলাম, কোন একটা বিশেষ চিন্তা ঐ মুহূর্তে তার মনের অবগহনে আলোড়ন তুলেছে। কোন একটা সূত্রকে ধরবার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। তাই তার দেহে ও মনে একটা শিথিল নিষ্ক্রিয়তা।

শতদলকে কেন্দ্র করে একটা দুর্বোধ্য রহস্য ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছিল— সীতার আকস্মিক রহস্যজনক মৃত্যু সেটাকে আরো জট পাকিয়ে তুলেছে।

ঘটনাগুলো যেন পরস্পরের সঙ্গে একান্তভাবেই বিচ্ছিন্ন। শতদলকে হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে সীতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করবার কী এমন কার্য-কারণ থাকতে পারে বুঝতে পারছি না। হত্যার মোটিভ কী? শতদলকে হত্যা করবার তবু, একটা কারণ থাকতে পারে, কিন্তু সীতা নিহত হল কেন? কী উদ্দেশ্য নিহিত আছে তার হত্যার সঙ্গে? তবে কি দুটো ব্যাপারের সঙ্গে কোন পারস্পরিক সম্পর্ক নেই? শতদলকে হত্যা-প্রচেষ্টা ও সীতাকে হত্যা করা—একের উদ্দেশ্যের সঙ্গে অন্যের উদ্দেশ্যের কোন সম্পর্কই নেই? ঘটনাচক্রে একটির সঙ্গে অন্যটি জড়িয়ে গিয়েছে মাত্র?

বাইরে পদশব্দ পাওয়া গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় দরজার ভারী নীল রঙের পর্দাটা তুলে কক্ষে প্রবেশ করলেন ৩০/৩২ বৎসরের একটি নার্স।

ডক্টর চ্যাটার্জী, আপনি আমাকে ডেকেছিলেন?

মিসেস মহান্তি! হ্যাঁ, আসুন। পরিচয় করিয়ে দিই, ইমি মিঃ রায় উনিই আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চান। ডাঃ চ্যাটার্জীই মিসেস মহান্তিকে আহ্বান জানালেন।

মুখের দিকে চেয়ে কেবলমাত্র মুখাবয়ব থেকে মিসেস মহান্তির বয়স নিরুপণ করা কষ্ট। বেশ গোলগাল স্থূল চেহারা-চোখেমুখে একটা সরল নিরীহ বোকা বোকা ভাব।

মিসেস মহাতি ডাঃ চ্যাটার্জীর কথায় কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়েই বারেকের জন্য দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন।

মিসেস মহান্তি, আপনি তো আজ উপরে ডিউটিতে ছিলেন?

মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালেন মিসেস মহান্তি।

কেবিনে শতদলবাবু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে আপনি বোধ হয় ডক্টর চ্যাটার্জীকে সংবাদ পাঠান?

হ্যাঁ, সে সময় আমিই ঘরে ছিলাম। মৃদুকণ্ঠে জবাব এল।

কিরীটী হঠাৎ সোজা হয়ে বসল, আপনি সেই সময় শতদলবাবুর কেবিনের মধ্যেই উপস্থিত ছিলেন?

হ্যাঁ।

আগে থাকতেই আপনি কেবিনের মধ্যে ছিলেন, না ঠিক ঐ সময়টিতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন?

ওঁর সঙ্গে বসে গল্প করছিলাম। সরলা আমাকে কিছু গোলাপ ফুল, একটা চিঠি ও একবাক্স মিষ্টি এনে দেয় শতদলবাবুকে দেবার জন্য। সেগুলো নিয়ে কেবিনে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু উনি আমাকে কথায় কথায় আটকে রেখেছিলেন।

আপনার সামনেই তাহলে শতদলবাবু মিষ্টি খান?

হ্যাঁ।

মিসেস মহান্তি, যদি কিছু মনে না করেন তো in details আজকের ঘটনাটা আমাকে খুলে বলুন!

জিনিসগুলো নিয়ে শতদলবাবুর কেবিনে ঢুকতেই তিনি প্রশ্ন করলেন, ওগুলো কী? আমি জিনিসগুলো তাঁর হাতে দিয়ে সব বললাম। তারপর বেরিয়ে আসতে যাব, শতদলবাবু আমাকে ডেকে বললেন, সিস্টার, ঐ ভাসে এই ফুলগুলো একটু সাজিয়ে দিন না, please! ভাসের ফুল যা ছিল সেগুলো তুলে নিয়ে গোলাপ ফুলগুলো সাজিয়ে দিচ্ছিলাম যখন, শতদলবাবু সে-সময় চিঠিটি পড়ছিলেন। তারপরই মিষ্টির বাক্সটা খুলে বললেন, How lovely! কড়াপাকের সন্দেশ! বলতে বলতেই গোটা-দুই সন্দেশ মুখে পুরে দিলেন। এবং আমাকে বললেন একগ্লাস জল দিতে। ঘরের কোণায় কুজোতে জল ছিল। গ্লাসে জল ভরে তাঁর সামনে নিয়ে দাঁড়াতেই দেখি, শতদলবাবুর সমস্ত চোখেমুখে যেন একটা আতঙ্ক। কোনমতে ঢোঁক গিলতে গিলতে বললেন, সিস্টার, শীগগির ডক্টর চ্যাটার্জীকে খবর দিন। আমি অত্যন্ত অসুস্থ বোধ করছি। Quick! যান। সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রায় ছুটে গিয়ে ডক্টর চ্যাটার্জীকে ডেকে আনি।

সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কিরীটী নিশ্চলভাবে বসে মিসেস মহান্তি বর্ণিত কাহিনী শুনছিল, হঠাৎ যেন তার নিশ্চল দেহটা একটা বিদ্যুৎস্পর্শে সজাগ প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। কিরীটীর ক্ষণপূর্বের স্তিমিত চোখের তারা দুটো যেন আচমকা বিদ্যুৎ-শিখার মত জলে উঠল। ঝকঝক করে উঠলো ধারালো ছুরির ফলার মত। কিরীটীর ঐ দৃষ্টিকে আমি চিনি। সহসা উপবিষ্ট কিরীটী চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করে। দু-চার মিনিট কেটে গেল একটা অখণ্ড নিস্তব্ধতার মধ্যে। ঘরের আমরা বাকি তিনজন নির্বাক হয়ে আছি। আমি আর ডক্টর চ্যাটার্জী উপবিষ্ট। মিসেস মহান্তি আমাদের সামনেই দণ্ডায়মান।

হঠাৎ আবার কিরীটীই ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলে, ডক্টর, এবারে আমরা শতদলবাবুকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি কি?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। চলুন।

সকলে আমরা কেবিনে এসে প্রবেশ করলাম।

চক্ষু দুটি মুদ্রিত। শতদলবাবু শয্যার ওপরে শুয়েছিলেন। আমাদের পদশব্দে চোখ মেলে তাকালেন। ডাঃ চ্যাটার্জীই সর্বপ্রথমে এগিয়ে গিয়ে শতদলের পালসটা দেখলেন, এখন বেশ সুস্থ বোধ করছেন তো শতদলবাবু?

হ্যাঁ, ধন্যবাদ। অতঃপর কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনি কখন এলেন মিঃ রায়?

এই তো কিছুক্ষণ হল।

ডক্টর চ্যাটার্জীর মুখে সব শুনেছেন বোধ হয়! There was another attempt! স্মিতকণ্ঠে শতদল বললে।

হ্যাঁ, শুনলাম। ভয় পাবেন না মিঃ বোস—this is last! কিরীটীর কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত একটা দৃঢ়তা।

আর কারো কানে সেটুকু না ধরা পড়লেও আমার শ্রবণেন্দ্রিয়কে সেটা ফাঁকি দিতে পারে না।

সত্যি! ভাবতেই পারিনি সন্দেশের মধ্যে

শতদলকে বাধা দিয়ে কিরীটী বললে, কে আপনাকে ফুল ও মিষ্টি পাঠিয়েছিল শতদলবাবু?

সত্যি কথা বলতে কি, মিঃ রায়, এতক্ষণে শুয়ে শুয়ে সেইটাই ভাবছিলাম। আপনিও তাকে চেনেন– রাণু!

বজ্রের মতই যেন দু-অক্ষরের নামটি আমার কর্ণে ধ্বনিত হল, রাণু!

কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সেও কম বিস্মিত হয়নি। এবং কণ্ঠস্বরেও তার সে বিস্ময়টুকু ধ্বনিত হয়ে উঠল, রাণু দেবী!

হ্যাঁ। এই দেখুন না চিঠি, বলে শয্যার আশেপাশে চিঠিটা খুজতে থাকে শতদল চিঠি চিঠিটা গেল কোথায়

মিসেস মহান্তি এমন সময় এগিয়ে এলেন এবং বালিশের তলা থেকে নীল খাম সমেত খোলা চিঠিখানা বের করে শতদলের হাতে তুলে দিলেন, এই যে!

কিরীটী চিঠিটা শতদলের হাত থেকে নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরল। আমিও আরো এগিয়ে গেলাম। নীল রঙের পর, লেটার-পেপারে রয়েল ব্লু কালিতে লেখা চিঠি।

মুক্তোর মতো ঝরঝরে পরিষ্কার হাতের গোটা অক্ষর। এবং হাতের লেখা দেখলে কোন পুরুষের নয়—মেয়ের বলেই মনে হয়। সংক্ষিপ্ত চিঠি।

শতদল,
একান্ত ইচ্ছা থাকলেও তোমার সঙ্গে দেখা করবার উপায় নেই। কড়া হকুম কিরীটী রায়ের।
নার্সিং হোমে প্রবেশ নিষেধ। তুমি রক্তগোলাপ ভালবাস, তাই কিছু রক্তগোলাপ ও তোমার বান্ধব
মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের প্রিয় কড়াপাকের সন্দেশ পাঠালাম। ভালবাসা নিও। ‘রাণু’।

চিঠিটি পড়ে ভাঁজ করতে করতে কিরীটী শতদলের দিকে তাকিয়ে বললে, চিঠিটা আমার কাছে থাক শতদলবাবু।

বেশ।

কিরীটী চিঠিটা জামার পকেটে রেখে দিল, চলুন ডাক্তার। ওঁকে আমাদের বিশ্রাম দেওয়াই প্রয়োজন। উনি বিশ্রাম করুন।

আমরা সকলে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।

ডাক্তারের কাছে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ কিরীটী ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে, তুই এগো সুব্রত, আমি ডাক্তারকে একটা কথা বলে আসি!

কিরীটী আবার উপরে চলে গেল। মিনিট পনের বাদে কিরীটী ফিরে এল।

***

হোটেলে ফিরে এলাম। ডাক্তারের টমটমই আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে গেল।

কিরীটীর পকেটে যে নীল লেটার-প্যাডের কাগজে লেখা চিঠিটা ছিল, আমার মনের মধ্যে সবটুকু সেটাই অধিকার করে ছিল। চিঠিটা সম্পর্কে কিরীটী আর কোন উচ্চবাচ্য করলেও আমি কিন্তু চিঠিটার কথা কোনমতেই ভুলতে পারছিলাম না। আশা করেছিলাম, হোটেলে ফিরেই কিরীটী রাণুকে ডেকে নিশ্চয়ই চিঠিটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবে কিন্তু কিরীটী সেদিক দিয়েই গেল না। সোজা ঘরে ঢুকে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল।

আমি বাইরের বারান্দায় একটা আরামকেদারার উপরে গা এলিয়ে দিলাম।

শীতের ঘনায়মান সন্ধ্যায় চারিদিক অস্পষ্ট। একটানা সমুদ্রগর্জন দূরের সন্ধ্যার অস্পষ্টতার মধ্য হতে কানে এসে প্রবেশ করছে। ইতিমধ্যেই হোটেলের ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠেছে।

কতক্ষণ অন্ধকারে চেয়ারটার ওপরে বসেছিলাম মনে নেই, হঠাৎ রাণুর কণ্ঠস্বরে চমক ভাঙল।

কে, সুব্রতবাবু নাকি?

কে–ও মিস মিত্র!

অন্ধকারে চুপটি করে বসে আছেন যে?

না, এমনিই। বসুন।

রাণু পাশের চেয়ারটায় বসল।

উঃ, আজ অনেক ঘুরেছি। একা একা বেড়াতে যাব না বলে আপনাদের খুঁজতে এসেছিলাম। বেয়ারাটা বললে, বিকেলের দিকে টমটম করে আপনি আর মিঃ রায় শহরের দিকে গিয়েছেন। কোথায় গিয়েছিলেন? রাণু, জিজ্ঞাসা করে।

ডক্টর চ্যাটার্জীর নার্সিং হোমে।

শতদল কেমন আছে? বেচারা একটু সামলাতে পেরেছে কি?

হ্যাঁ। অদম্য কৌতূহলটাকে আর নিজের মধ্যে চেপে রাখতে পারলাম না। প্রশ্ন করলাম আপনি তো আজ ফুল আর মিষ্টি পাঠিয়েছিলেন রাণু দেবী শতদলবাবুকে!

হ্যাঁ, পেয়েছে?

শান্তকণ্ঠে উচ্চারিত রাণুর কথাটা যেন মুহর্তে একটা বৈদ্যুতিক তরঙ্গাঘাতে আমাকে একেবারে বিবশ করে দিল। কয়েক মুহূর্ত আমার যেন বাক্যস্ফূর্তি হল না। আমি বোবা হয়ে গিয়েছি। অন্ধকারেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম রাণুর মুখের দিকে, কিন্তু অন্ধকারে রাণুর মুখখানা অস্পষ্ট একটা ছায়ার মত মনে হয়।

আপনিই তাহলে শতদলবাবুকে আজ ফুল আর মিষ্টি পাঠিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, কিন্তু কেন বলুন তো? উৎকণ্ঠা-মিশ্রিত কণ্ঠে রাণু, প্রশ্ন করে।

সেই সন্দেশ খেয়ে শতদলবাবু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন!

বলেন কি?

হ্যাঁ, ডক্টর চ্যাটার্জীর ধারণা সেই সন্দেশের মধ্যে মরফিন ছিল।

মরফিন! কী বলছেন যা-তা সুব্রতবাবু!

বললাম তো, ডাক্তারের তাই বিশ্বাস। সন্দেশ আপনি কি নিজে হাতে কিনেছিলেন?

না।

তবে?

সন্দেশ হোটেলের বেয়ারাকে দিয়ে কিনিয়ে আনিয়েছিলাম।

আর ফুলগুলো? অকস্মাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বর, শুনে আমি ও রাণু দুজনেই যুগপৎ পশ্চাতের অন্ধকারে ফিরে তাকালাম।

ইতিমধ্যে আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে কখন যে কিরীটী পশ্চাতের অন্ধকারে এসে দাঁড়িয়েছে নিঃশব্দে এবং আমাদের পরস্পরের কথোপকথন শুনেছে, তার বিন্দুমাত্র টের পাইনি। কয়েকটা মুহূর্ত আমরা দুজনেই চুপ করে থাকি। কিরীটী দ্বিতীয়বার আবার প্রশ্ন করে, আর গোলাপ ফুলগুলো?

ওগুলো শরৎবাবুর মেয়ে মিস কবিতা গুহ পাঠিয়েছিলেন।

মিস গুহ—মানে সে-রাত্রে নিরালায় যার সঙ্গে আলাপ হল? কিরীটীই প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ।

কবিতা গুহর সঙ্গে কি শতদলবাবুর পূর্ব-পরিচয় ছিল?

কবিতা আমার ক্লাস-ফ্রেণ্ড। শতদলের সঙ্গে কবিতার আমাদের বাড়িতেই আলাপ হয়।

হুঁ।

পরের দিন প্রত্যুষে আমি ও কিরীটী রাণুকে সঙ্গে নিকে কবিতা গুহর বাসায় গেলাম।

কবিতা ভিতরে ছিল। রাণুকে পাঠানো হল তাকে ডেকে আনবার জন্য। কিরীটী অবশ্য রাণুকে নিষেধ করে দিয়েছিল, পূর্বাহ্নে কবিতাকে কোন কথা না বলতে।

একটু পরেই রাণুর সঙ্গে কবিতা বাইরের ঘরে এল। শরৎ উকিল ঐ সময় বাসায় না থাকায় আমাদের কথাবার্তা বলবার বিশেষ সুবিধাই হল।

দু-চারটে মামুলী কথাবার্তার পর কিরীটী ফুলের প্রসঙ্গে এল।

আপনি কাল শতদলবাবুকে নার্সিং হোমে গোলাপফুল পাঠিয়েছিলেন কবিতা দেবী?

হ্যাঁ। হাসপাতাল থেকে শতদলবাবুর কাছ হতে কাল সকালে একজন লোক এসে বললে, শতদলবাবু কিছু ফুল পাঠাতে বলেছেন—আমাদের বাগানের গোলাপ। এ-ও সে বলেছিল, ফুলগুলো যেন আমি রাণুর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিই। তাই–

আশ্চর্য! লোকটা কী রকম দেখতে বল তো কবিতা? কথাটা বললে রাণু।

এখানকার স্থানীয় লোক বলেই মনে হয়। বোধ হয় নার্সিং হোমেই কাজ করে। কবিতা জবাব দেয়, কালো ঢ্যাঙা লম্বা মত। একটু খুঁড়িয়ে চলে।

Exactly! সেই লোকটা কাল সকালে আমার সঙ্গে হোটেলে দেখা করে বলে, শতদলবাবু কিছু কড়াপাকের সন্দেশ তাঁকে পাঠাতে বলেছেন। কথাগুলো বললে রাণু।

এবারে কথা বললে কিরীটী, রাণু, ও কবিতা দুজনকেই সম্বোধন করে, তাহলে আপনারা দুজনেই সেই লোকটির মুখে সংবাদ পেয়েই ফুল আর মিষ্টি নার্সিং হোমে পাঠিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। দুজনেই একসঙ্গে জবাব দেয়।

বলাই বাহুল্য, অতঃপর শরৎ উকিলের বাসা থেকে সোজা আমরা রাণুকে নিয়েই নার্সিং হোমে গেলাম। এবং ডাক্তার চ্যাটার্জীকে সব বলে কিরীটী ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলে, কবিতা ও রাণু, বর্ণিত ঐ ধরনের বা চেহারার কোন লোক নার্সিং হোমে আছে কিনা!

ডাক্তার শুনে তো বিস্মিত, কই, ও-ধরনের চেহারার কোন লোকই তো আমার এখানে কাজ করে না! চারজন সুইপার, দুজন দারোয়ান ও দুজন কুক। তাদের ডাকা হল, কিন্তু রাণু, বললে, ওদের মধ্যে কেউ নয়।

কিরীটী আর আমি তখন শতদলের সঙ্গে দেখা করলাম।

তাকে প্রশ্ন করায় সে বিস্ময়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। বললে, সে কি! সন্দেশ কড়াপাকের আমি খেতে ভালবাসি সত্য এবং লাল গোলাপও আমার খুব প্রিয়, কিন্তু মনের অবস্থা কদিন ধরে আমার এমন চলছে যে, ওসব তুচ্ছ কথা ভাববারই অবকাশ পাইনি!

নার্সিং হোম হতে বিদায় নিয়ে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। সত্যি কথা বলতে গেলে, মনের মধ্যে কিছুটা হতাশা ও ঘনীভূত একটা বিস্ময় নিয়েই।

হোটেলে আমাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য যে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছে। তা বুঝতে পারিনি। হোটেলের বারান্দায় উঠতেই দেখি, থানার দারোগা রসময় ঘোষাল আমাদের জন্য অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে বসে আছেন। আমাদের দেখেই রসময় বললেন, এই যে কিরীটীবাবু, কোথায় ছিলেন? কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি!

ব্যাপার কী? কিরীটী প্রশ্ন করে।

কাল রাত্রে যে নিরালায় চোর এসেছিল!

নিরালায় চোর এসেছিল?

হ্যাঁ, স্টুডিও-ঘরের তালা ভেঙে চোর ঢুকেছিল—

কিরীটী কথাটা শুনে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকে ওঠে, কী বললেন, স্টুডিও-ঘরে চোর ঢুকেছিল?

হ্যাঁ। কিছু চুরি গিয়েছে জানেন?

তা তো বলতে পরি না, তবে অবিনাশের হাত দিয়ে হরবিলাস ঘোষ চিঠি পাঠিয়েছেন। এই সেই চিঠি।

রসময় ঘোষাল একটা চিঠি কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিলেন।

আগের পর্ব :

০১. সাগর-সৈকত হোটেল
০২. আবার সমুদ্রের দিকে
০৩. হিরন্ময়ী দেবীই প্রথমে কথা বললেন
০৪. ভদ্রমহিলা রাণুর দিকে তাকিয়ে
০৫. শতদলবাবুর কথায় তাকিয়ে দেখলাম
০৬. দ্রষ্টব্য বটে ভুখনা
০৭. দ্বিতীয় প্রশ্ন করল কিরীটী
০৮. একটা ভারী বস্তু পতনের শব্দ
০৯. শেষ নির্দেশ
১০. এগিয়ে আসছে ছায়া-মূর্তি দুটো
১১. হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের প্রায় কাছাকাছি
১২. একটা বেদনার ঝড়

পরের পর্ব :

১৪. থানা-অফিসার রসময় ঘোষাল
১৫. হিরণ্ময়ী দেবীর কণ্ঠস্বর
১৬. দেওয়ালে টাঙানো অয়েল-পেন্টিং
১৭. কালো অন্ধকার রাত
১৮. রাস্তায় পৌঁছে হনহন করে
১৯. নিরালাতেই আমরা সকলে উপস্থিত ছিলাম

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত