চক্রী: ১৪. থানা-অফিসার রসময় ঘোষাল

চক্রী: ১৪. থানা-অফিসার রসময় ঘোষাল

১৪. থানা-অফিসার রসময় ঘোষাল

কিরীটী হাত বাড়িয়ে থানা-অফিসার রসময় ঘোষালের প্রসারিত হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরল।

আমিও কৌতুহল দমন করতে না পেরে পশ্চাৎ দিক হতে ঝুঁকে কিরীটীর হস্তধৃত খোলা চিঠিটায় দৃষ্টিপাত করলাম।

সংক্ষিপ্ত চিঠি। হরবিলাস ঘোষ লিখেছেন থানা-অফিসার রসময় ঘোষালকে সম্বোধন করে।

থানা ইনচাজ শ্রীরসময় ঘোষাল সমীপেষু,
সবিনয় নিবেদন, দারোগাবাবু, আপনাকে জানানো কর্তব্য বলিয়া জানাইতেছি—গতকাল
রাত্রে ‘নিরালা’য় চোর আসিয়াছিল এবং চোর কিছু চুরি করিয়া গিয়াছে কিনা বলিতে পারি না;
তবে দ্বিতলের স্টুডিও-ঘরের ও শতদলের ঘরের তালা দুটি ভগ্ন অবস্থায় দরজার কড়ার সঙ্গে
ঝুলিতেছে দেখিতে পাই এবং উভয় ঘরের দরজাই খোলা ছিল। শতদলের ঘর হইতে কোন
মূল্যবান কিছু চুরি গিয়াছে কিনা বলিতে পারি না। কারণ ইতিপূর্বে তার ঘরে আমি প্রবেশ করি
নাই এবং সে-ঘরে তাহার মূল্যবান কিছু ছিল কিনা বলিতে পারি না। যাহা হউক, এ ব্যাপারে
কোন কিছু করণীয় থাকিলে করিতে পারেন। আর একটা কথা—এই সপ্তাহের শেষেই আমি ও
আমার স্ত্রী এখান হইতে চলিয়া যাইতে চাই। নমস্কার।
ইতিঃ হরবিলাস ঘোষ

কিরীটী চিঠিটা একবার মাত্র পড়ে রসময় ঘোষালের হাতে প্রত্যর্পণ করল।

চিঠিটা হাতে নিয়ে রসময় কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, যাবেন নাকি একবার নিরালায়?

হ্যাঁ, যেতে হবে বৈকি। চলুন, এখুনি না হয় একবার ঘুরে আসা যাক!

এখুনি যাবেন?

হ্যাঁ-না, আর একটু দেরি করাই ভাল।

রাণুও এতক্ষণ আমাদের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে এবারে মন্থর পায়ে উপরের সিঁড়ির দিকে চলে গেল।

আমরা তো প্রস্তুত হয়েই ছিলাম সকলে নিরালায় যাবার জন্য। রাস্তায় নেমে সমুদ্রকিনারের পথ ধরে পাহাড়ের দিকে চলতে শুরু করলাম। রসময় ঘোষালের সঙ্গে যে লাল পাগড়ি এসেছিল সেও আমাদের অনুসরণ করে। শীতের রোদ আরামদায়ক হলেও এখনো বেশ কনকনে। কষ্টকর মনে হয়। বেলা প্রায় পৌনে এগারোটা হবে।

এখনো সমুদ্রে স্নানার্থীদের ভিড় কমেনি। বহু পুরুষ-নারী বালকবালিকা যুবক-যুবতী হৈ-চৈ করে সমুদ্রের জলে লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি করছে। তাদের উল্লাস কানে আসে। নিঃশব্দে কিরীটী ও রসময় ঘোষাল পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। ওদের পশ্চাতে আমি। নিরালায় স্টুডিও-ঘরে বা শতদলের ঘরে এমন কী ছিল যার জন্য কাল রাত্রে চোরের আবির্ভাব হল! শতদলের ঘরে তবু কিছু থাকতে পারে, কিন্তু স্টুডিও-ঘরে কেবল কতকগুলো ছবি আর স্ট্যাচু! খেয়ালী ধনী আর্টিস্টের বাড়ি—স্টুডিও-ঘরের মধ্যে কোন গুপ্ত কক্ষ বা আলমারি বা চোরা জায়গা ছিল না তো? ছিল না তো তার মধ্যে এমন কোন মূল্যবান বস্তু, যার জন্য চোরের উপদ্রব হয়েছিল গতরাত্রে? ইতিপূর্বেও রাত্রে নিরালায় যার আবির্ভাব ঘটেছিল একবার, সে শতদলের প্রাণহরণের চেষ্টা করেছিল এবং দ্বিতীয়বারের উদ্দেশ্যটা ঠিক পরিস্ফুট না হলেও সীতার কুকুরটাকে জখম করে গিয়েছিল!

হঠাৎ আবার সীতার কথা মনের মধ্যে ভেসে ওঠে।

সীতা!

মনে হয় সে বুঝি মরেনি। নিষ্ঠুরভাবে অদৃশ্য আততায়ীর হাতে পিস্তলের বুলেটে নিহত হয়নি। সে যেন এখনো মনে হয় নিরালাতেই আছে। এই যাচ্ছি—গেলেই দেখা হবে! শ্যামাঙ্গী অপরাজিতার মত ঢলঢলে মেয়েটি। স্মৃতির পাতাগুলো যেন জ্বলজ্বল করছে।

মরে গিয়েছে– চোখের সামনে তার রক্তাক্ত মৃতদেহটা অসাড় অসহায় অবস্থায় ঘরের মেঝের ওপরে কার্পেটে আমরা সকলেই পড়ে থাকতে দেখেছি। মৃতদেহের অবস্থায়—ভিতর থেকে রিভলভারের বুলেটও পাওয়া গিয়েছে, তবু মনে হচ্ছে মরেনি সে, এখনো বেঁচে আছে!

কেন এমন হয়?

কিন্তু কে অমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলে মেয়েটিকে, আর কী উদ্দেশ্যেই বা হত্যা করলে? সীতার কুকুর টাইগার যে-রাত্রে জখম হয়, সে-রাত্রেও আততায়ী সীতাকে হত্যা করবার চেষ্টা করেছিল। আচমকা কুকুরটা সামনে পড়ায় শেষ পর্যন্ত তাকেই জখম করে পালিয়ে যায়। হঠাৎ রসময়ের কথা কানে এল, রসময় কিরীটীকে প্রশ্ন করছেন, সক্কালবেলাতেই কোথায় গিয়েছিলেন মিঃ রায়?

শরৎবাবু উকিলের বাসায় তাঁর মেয়ে কবিতা গুহর সঙ্গে দেখা করতে।

হঠাৎ?

নার্সিং হোমে ফুল-সন্দেশ তারই পরামর্শমত শতদলবাবুকে রাণু দেবী পাঠিয়েছিলেন!

তার মানে? বিস্মিত রসময় কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।

তার মানে ঐটাই সব ও শেষ নয়। ওটা তো প্রদীপের আলো। আলো জ্বালাবার ইতিহাস আরো পশ্চাতে। সে আর এক ভগ্নদূত-সংবাদ! কিরীটী মৃদু হাস্যসহকারে জবাব দেয়।

ভগ্নদূত-সংবাদটি আবার কী!

কে এক খোঁড়া দূত শতদলবাবুরে পরিচিত কবিতা দেবীকে এসে জানায়, শতদলবাবু নাকি অনুরোধ করে পাঠিয়েছেন তাঁকে যেন কিছু লাল গোলাপ নার্সিং হোমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যে কারণেই হোক, কবিতা দেবী নিজে ফুলটা না পাঠিয়ে ফুলগুলো রাণু দেবীকে পাঠিয়ে দিতে অনুরোধ জানায়। রাণু দেবী সেই ফুলই শুধু নয়—ঐ সঙ্গে মিষ্টি যোগ করে দেন, অর্থাৎ কিছু; কড়াপাকের সন্দেশ দিয়ে আসেন।

ঐ হোটেলের বেয়ারাদের মধ্যেই তাহলে কেউ একজন সন্দেশ কিনে এনে দিয়েছিল?

হ্যাঁ। কিন্তু ঘোষাল সাহেব, জল সেখানেও গভীর। অনুসন্ধানে জেনেছি রামকানাই নামে এক বেয়ারাই সন্দেশ কিনে এনে দিয়েছিল এবং রাণু দেবী স্বয়ং সন্দেশ ও ফুল নার্সিং হোমে পৌঁছে দিয়ে আসেন।

রাণু দেবীকে আপনি ঐ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করেননি?

সুব্রতই গতরাত্রে করেছিল। দু-একটা আমিও করেছি, কিন্তু যে মৎস্যটি গভীর জলে থেকে ল্যাজের ঝাপটা মেরেছেন, সে তো রাণু দেবী নন! রাণু দেবীর বুদ্ধি ও চিন্তারও অগোচরে। কিন্তু তিনি যত গভীরেই থাকুন, তাঁর ল্যাজের আঁশ আমার চোখে পড়েছে।

বলেন কী! কাউকে সন্দেহ–

হ্যাঁ, অন্ধকারে আলো দেখতে পাওয়া গিয়েছে ঘোষাল সাহেব। কিন্তু মাত্র একটি জায়গায় সূত্র এসে একটা জট পাকিয়ে রয়েছে। সেই জটটি খুলতে পারলেই সব বোঝা যাবে।

কিরীটীর কথায় বিস্মিত আমিও কম হইনি। কিরীটী তাহলে সমাধানে প্রায় পৌঁছে গিয়েছে! নিরালা-রহস্য মীমাংসার চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছে!

বলতে বলতে কিরীটী থেমে গিয়েছিল। যতটুকু কিরীটী এইমাত্র বললে, তার চাইতে একটি কথাও বেশী এখন আর সে বলবে না, এও আমার জানা। তাই সে ঐ পর্যন্ত বলে থেমে গেল, কিন্তু কিরীটীর চরিত্রের সঙ্গে রসময় ঘোষালের সম্যক পরিচয় নেই, তাই তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেন, লোকটি কে?

দু-একদিনের মধ্যেই জানতে পারবেন! গম্ভীর কণ্ঠে কিরীটীর সংক্ষিপ্ত জবাব শোনা গেল।

ইতিমধ্যে আমরা আমাদের গন্তব্য স্থান নিরালার গেটে পৌঁছে গিয়েছিলাম। সেই দিকেই কিরীটী রসময়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, চলুন দেখা যাক নিরালা কী বলে!

দরজা বন্ধ ছিল।

বন্ধ দরজার একপাশে দরজা খোলবার জন্য ভিতরে সাংকেতিক ঘণ্টার সঙ্গে ঝুলন্ত সংযুক্ত দড়িটার প্রান্ত ধরে কিরীটী বার-দুই টান দিল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে গেল। খোলা দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে হরবিলাস।

আসুন। হরবিলাস আমাদের আহ্বান জানালেন।

হরবিলাস এগিয়ে চললেন, পশ্চাতে রসময় ঘোষাল, আমি ও কিরীটী। সর্বশেষে সঙ্গের সেই কনস্টেবলটি।

সীতার মত্যুর প্রায় পাঁচদিন পরে নিরালায় এসে আমরা প্রবেশ করলাম। হঠাৎ নজরে পড়ল, হরবিলাস যেন ডান পা-টা একটু টেনে টেনে চলেছেন মন্থর ভাবে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় কিরীটীর কণ্ঠস্বর শুনলাম।

ডান পায়ে আপনার কী হল হরবিলাসবাবু?

চলতে চলতেই হরবিলাস জবাব দিলেন, কয়েক দিন আগে বাগানে কাজ করবার সময় পায়ে একটা কাঁটা ফুটেছিল। সেটাই পেকে গিয়ে নচেৎ নিজেই আপনাদের কাছে যেতাম।

কাঁটা ফুটেছিল! কিরীটী পালটা প্রশ্ন করে।

কিরীটীর প্রশ্নের জবাবে হরবিলাস কী জবাব দিতেন জানি না, কিন্তু জবাব দেবার পূর্বেই কথা বললেন রসময় ঘোষাল।

কদিন বাড়ি থেকে তাহলে বের হননি বলুন!

না, মেয়েটা বুকটা একেবারে ভেঙে দিয়ে গিয়েছে। অশ্রুরুদ্ধ হয়ে এল হরবিলাসের কণ্ঠস্বর।

কিন্তু আপনি মিথ্যা কথা বলছেন হরবিলাসবাবু! কঠিন কণ্ঠে বললেন এবারে রসময় ঘোষাল কথাগুলো।

মিথ্যা কথা বলছি! প্রশ্নটা যেন পালটা উচ্চারণ করে ঘুরে দাঁড়ালেন হরবিলাস রসময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে।

চোখ দুটো তাঁর অদ্ভুত একটা দীপ্তিতে ঝকঝক করছে কিসের এক প্রত্যাশায়।

আমরাও নির্বাক।

হ্যাঁ, মিথ্যা বলেছেন। বলতে বাধ্য হচ্ছি, কারণ পরশু সকালে বাজারে একটা ওষুধের দোকানের সামনে আপনাকে আমি দেখেছি। দোকান থেকে আপনি বের হয়ে আসছেন, হাতে আপনার একটা প্যাকেট ছিল।

ক্ষণপূর্বে যে বিস্ময় ও চাপা একটা ক্রোধ হরবিলাসের মুখখানার ওপরে থমথমে হয়ে উঠেছিল, মুহূর্তে যেন সেটা মেঘমুক্ত চাঁদের মত নির্মল হাস্যদীপ্তিতে ঝলমল করে উঠল। স্মিতকণ্ঠে হরবিলাস এবারে বললেন, ভুল দেখেছেন দারোগা সাহেব! আমি নয়—এই পাঁচদিন বাড়ি থেকে এক পা-ও আমি বের হইনি কোথাও!

স্পষ্ট দিনের আলোয় স্পষ্টই দেখেছি হরবিলাসবাবু! ভুল হতে পারে না।

পারে বৈকি। ভুল তো আমরা কত সময়েই করি। বিশেষ করে দেখার ভুল-দেখবার ভুল!

হরবিলাসের শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয়, যেন কোন একটি শিশুকে অসীম ধৈর্যের সঙ্গে কিছু বোঝাচ্ছেন। কিরীটীর দিকে একবার বক্রদৃষ্টিতে না তাকিয়ে পারলাম না। কিন্তু সে-মুখ যেন পাষাণে কুঁদে তোলা। কোথায়ও এতটুকুও উত্তেজনা বা দীপ্তিমাত্রও নেই। এতটকু আগ্রহের চিহ্ন পর্যন্তও যেন ওর মুখের ভাবে চোখের দৃষ্টিতে নেই।

দেখবার ভুল! আপনি বলছেন দেখবার ভুল? রসময় ঘোষালের স্পষ্ট কণ্ঠস্বরে যেন এবারে একটা পলিসী কাঠিন্য ফুটে ওঠে।

তা ছাড়া আর কী বলি বলুন! চারদিন পায়ের যন্ত্রণায় পায়ের পাতা ফেলতে পারি নি, নিজে বসে হট ফোমেন্টশন দিয়েছি—আজই সবেমাত্র একটু যা হাঁটা-চলা শুরু করেছি। আর আপনি কিনা দেখলেন আমায় বাজারে!

হরবিলাসবাবু, শাক দিয়ে মাছ ঢাকবার মিথ্যা চেষ্টা করছেন! পনের বছর এই পুলিশ লাইনে চাকরি করছি। অত সহজে আমাদের দৃষ্টিভ্রম হয় না। আপনি সাপ নিয়ে খেলা করছিলেন, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, গতকাল হঠাৎ নার্সিং হোমে শতদলবাবু কড়াপাকের সন্দেশ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন

মুহূর্তে যেন রসময় ঘোষালের কথাটা শুনে হরবিলাসের কৌতুকোভাসিত উজ্জল মুখখানা নিষ্প্রভ হয়ে গেল। হরবিলাসের মুখের চেহারার হঠাৎ পরিবর্তন আমার দৃষ্টিতেও এড়ায় না, কিন্তু হরবিলাস ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন। মৃদু উৎকণ্ঠামিশ্রিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, তাই নাকি? সন্দেশ খেয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল কেন?

কারণ সে সন্দেশের মধ্যে বিষ ছিল!

বিষ! একটা আর্ত শব্দের মতই হরবিলাসের কণ্ঠ হতে কথাটা উচ্চারিত হল।

হ্যাঁ, বিষ। মরফিন।

হরবিলাস স্থির অচঞ্চল দৃষ্টিতে কয়েকটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন ঘোষালের মুখের দিকে।

রসময় ঘোষালের তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিও হরবিলাসের দুটি চোখের প্রতি অপলক হয়ে আছে। চারজোড়া চোখের দৃষ্টি যেন পরস্পরকে লেহন করছে।

আপনি কী বলতে চান ঘোষাল সাহেব?

শতদলবাবুকে নার্সিং হোমে লাল গোলাপ ও কড়াপাকের সন্দেশ পাঠাতে হবে, আপনিই কবিতা দেবীকে অনুরোধটা জানিয়ে এসেছিলেন গত পরশু কোন এক সময়, তাই নয় কি?

একেবারে স্পষ্টাস্পষ্টি মুখের ওপরে অভিযোগ। একেবারে সম্মুখযুদ্ধে আহ্বান। আবার কয়েক সেকেন্ডের জন্য কঠিন স্তব্ধতা।

ওঃ, আপনি এতক্ষণ ধরে তাহলে এই কথাটাই আমাকে বলতে চাইছিলেন ঘোষাল সাহেব! হরবিলাসের শান্ত-গম্ভীর কণ্ঠস্বরে যেন একটা অস্পষ্ট ব্যঙ্গের হুল উদ্যত হয়ে ওঠে।

রসময় কোন জবাব দেন না। কেবল স্থিরদৃষ্টিতে ঘোষালের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

আপনার অনুমান তাহলে আমিই শতদলকে সন্দেশের মধ্যে বিষ দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলাম? হরবিলাসই দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ। যতক্ষণ না বলছেন কেন আপনি গত পরশু সকালে বাজারে গিয়েছিলেন এবং ওষুধের দোকানে ঢুকেছিলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে আমি সন্দেহ করব।

কিন্তু শতদলকে মেরে আমার লাভ কী ঘোষাল সাহেব?

মারবার কথা তো এর মধ্যে উঠছে না হরবিলাসবাবু! এতক্ষণে কিরীটী কথা বলে, আপনার ঐ সময়ে সেদিন বাজারে উপস্থিতিটাই ওঁর মনে সন্দেহ আনছে কতকগুলো ব্যাপারে।

কিন্তু সেইটাই তো মিথ্যা!

মিথ্যা নয়। কিরীটীর কণ্ঠস্বরটা যেন বজ্রের মত ধ্বনিত হল, উনি ঠিকই বলেছেন।

তার মানে? মিনমিনে গলায় হরবিলাস কথাটা বললেন।

আপনার ডান হাতের আংটির প্রবাল পাথরটা কই? প্রবাল পাথর! বিস্ময়ে যেন স্তম্ভিত হরবিলাস।

হ্যাঁ, প্রবালটা! কোথায় সেটা? দেখুন তো হাতের আঙুলের আংটিটা আপনার!

তাই তো! পাথরটা? চোখের সামনে ডান হাতটা তুলে আংটিটার দিকে তাকালেন হরবিলাস।

সত্যি হরবিলাসের হাতের আঙুলের আংটিটার পাথরটা নেই!

লক্ষ্যও করেননি হরবিলাসবাবু; যে, আংটির পাথরটা আপনি ইতিমধ্যে হারিয়েছেন! যাক, এই নিন পাথরটা বলতে বলতে কিরীটী জামার পকেটে হাত চালিয়ে একটি বড় মটরের দানার মত প্রবাল পাথর বের করে হাতের পাতায় পাথরটা নিয়ে এগিয়ে ধরলে হরবিলাসের সামনে। দেখুন এটাই আপনার অজ্ঞাত হারানো প্রবাল। দেখুন ঠিক আংটিটায় বসে যাবে।

সত্যি হরবিলাসেরই আংটির পাথর সেটা।

সকলেই আমরা বিস্মিত ও নির্বাক। অকস্মাৎ অন্ধকার কক্ষের মধ্যে যেন রৌদ্রালোক এসে পড়েছে। কিরীটী আবার বলে, পাথরটা আজই সকালে শরৎবাবু উকিলের বাসার বৈঠকখানায় কুড়িয়ে পেয়েছি হরবিলাসবাবু। একটু আগে রসময়বাবু, যখন আপনাকে গত পরশু সকালে বাজারে দেখেছেন বলে জেরা করছিলেন, হঠাৎ আপনার হাতের আঙুলের আংটিটার প্রতি আমার নজর পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হয়, এই পাথরটাই ইতিপূর্বে আপনার আঙুলের আংটিতে বসানো আমি দেখেছি। একেবারে সাধারণ যোগ-দুয়ে দুয়ে চার। এখন আর নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না হরবিলাসবাবু, যে আপনি এতক্ষণ যা বলছিলেন তা সত্য নয়!

হরবিলাস একেবারে নির্বাক। স্তব্ধ নিশ্চল। প্রাণহীন পাষাণমূর্তির মত দাঁড়িয়ে।

এবারে বলতে বাধা নেই নিশ্চয়ই হরবিলাসবাবু, কেন গত পরশু সকালে আপনি বাজারে গিয়েছিলেন আর কেনই বা কবিতা দেবীর বাড়িতে গিয়ে শতদলকে ফুল ও সন্দেশ পাঠাবার জন্য বলে এসেছিলেন! ঝাঁজিয়ে উঠলেন ব্যঙ্গে রসময় ঘোষাল।

কিন্তু নির্বাক হরবিলাস। টু শব্দটি বের হয় না মুখ দিয়ে।

কী, চুপ করে কেন? জবাব দিন?

আমার কিছুই বলবার নেই দারোগা সাহেব। আপনার যা খুশি করতে পারেন।

আমার প্রশ্নের আপনি জবাব দেবেন না?

না।

বেশ, তাহলে শতদলবাবুকে সন্দেশের মধ্যে বিষ মিশিয়ে হত্যা করবার প্রচেষ্টার জন্য আপনাকে আমি আরেস্ট করতে বাধ্য হচ্ছি। কান সিং!

বেশ, আপনার যেমন অভিরুচি। বললেন শান্তভাবে হরবিলাস। কান সিং এগিয়ে এল জুতোর মচমচ শব্দ তুলে। বাবুকে থানায় নিয়ে গিয়ে হাজতঘরে রাখ। রসময় বললেন।

দাঁড়ান!

নারীকণ্ঠ শুনে সকলেই আমরা একসঙ্গে ফিরে তাকালাম।

ইতিমধ্যে কখন একসময় নিঃশব্দে আমাদের পশ্চাতে হিরণ্ময়ী দেবী তাঁর ইনভ্যালিড চেয়ার চালিয়ে নিয়ে এসেছেন তা টেরও পাইনি।

আমার স্বামীকে আরেস্ট করবার আগে আমার কিছু বক্তব্য আছে কিরীটীবাবু! হিরণ্ময়ী দেবী শান্তকণ্ঠে বললেন।

আগের পর্ব :

০১. সাগর-সৈকত হোটেল
০২. আবার সমুদ্রের দিকে
০৩. হিরন্ময়ী দেবীই প্রথমে কথা বললেন
০৪. ভদ্রমহিলা রাণুর দিকে তাকিয়ে
০৫. শতদলবাবুর কথায় তাকিয়ে দেখলাম
০৬. দ্রষ্টব্য বটে ভুখনা
০৭. দ্বিতীয় প্রশ্ন করল কিরীটী
০৮. একটা ভারী বস্তু পতনের শব্দ
০৯. শেষ নির্দেশ
১০. এগিয়ে আসছে ছায়া-মূর্তি দুটো
১১. হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের প্রায় কাছাকাছি
১২. একটা বেদনার ঝড়
১৩. একজন সুশ্রী সুবেশা মহিলা

পরের পর্ব :

১৫. হিরণ্ময়ী দেবীর কণ্ঠস্বর
১৬. দেওয়ালে টাঙানো অয়েল-পেন্টিং
১৭. কালো অন্ধকার রাত
১৮. রাস্তায় পৌঁছে হনহন করে
১৯. নিরালাতেই আমরা সকলে উপস্থিত ছিলাম

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত