১১. হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের প্রায় কাছাকাছি
ইতিমধ্যে আমরা হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছিলাম। হাতঘড়ির রেডিয়ম-ডায়েলের দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় দেড়টা।
কুব্জী মন্থরা বা প্রিয়সখী ললিতা! কিরীটীর শেষোচ্চারিত কথাটারই জের টেনে কী যেন আমি বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কিরীটী আমাকে বাধা দিয়ে নিরস্ত করলে, বড্ড ঘুম পেয়েছে রে। চোখ আর খুলে রাখতে পারছি না।
কথাটা উচ্চারণ করতে করতেই কিরীটী আমাদের নির্দিষ্ট ঘরের দিকে একেবারে এগিয়ে গেল সোজা। বুঝলাম এখন আর কোনরূপ আলোচনা করতে কিরীটীর ইচ্ছে নেই, তাই তার অকস্মাৎ মৌনভাব।
সত্যি-সত্যিই কিরীটী অতঃপর সোজা পায়ের জুতোটা খুলে শয্যার ওপরে চটপট চাদরটা গলা অবধি টেনে নিয়ে টান-টান হয়ে শুয়ে পড়ল।
অগত্যা নিরুপায় আমাকেও গিয়ে বাকি রাতটকুর জন্য শয্যা আশ্রয় নিতে হল। কিন্তু আমার চোখে আর তখন ঘুম নেই। বাকি রাতটুকু আমায় জেগেই কাটাতে হবে। শতদলের ব্যাপারটা ক্রমেই যেন বেশী অস্পষ্ট বলে মনে হচ্ছে। নিজে সেই সন্ধ্যা হতে মনে মনে সব কিছু বিশ্লেষণ করে একটা ব্যাপার বুঝতে পারছিলাম, নিরালার মূল্য একমাত্র সেই বাড়িটাই নয়, আর কিছু আছে এবং সেইখানেই এ রহস্যের মূল। শতদল ও সীতার কথাগুলো মনে পড়ছে। শতদল বাড়িটা বিক্রি করতে চায় এবং কয়েকজন খরিদ্দারও ইতিমধ্যে জুটেছে এবং আশাতীত মূল্য দিয়ে তারা বাড়িটা ক্রয় করতে চায়। কিন্তু কেন?
তা ছাড়া আরও একটা কথা। কিছুক্ষণ আগে হোটেলের পথে কিরীটী যা বলছিল, হিরণ্ময়ী দেবী নাকি পঙ্গু নন! কী উদ্দেশ্যে তিনি নিজেকে এভাবে পঙ্গু সাজিয়ে রেখেছেন? আর পঙ্গুই যদি তিনি নন—পঙ্গুর অভিনয়ই বা করে যাচ্ছেন কেন? আর কতদিন থেকেই বা এ অভিনয় করছেন? আর ভুখনাও নাকি কালা নয়! ভুখনা শতদলের নিজের চাকর। তার কথা নিশ্চয়ই শতদল জানে। শতদল কি জানে হিরণ্ময়ী দেবীর রহস্য? আশ্চর্য! এও তো বোঝা যায় না, একজন এমনি করে সুস্থ হয়েও দিনের পর দিন রাতের পর রাত পঙ্গুর অভিনয় করে যাচ্ছেন। আর ভুখনাই বা কেন কালা সেজে থাকে!
ইতিপূর্বে আরো কত জটিল রহস্যের মীমাংসা করেছি, কিন্তু এতখানি জটিলতার সম্মুখীন ইতিপূর্বে হয়েছি বলে মনে পড়ে না।
***
কিরীটীর অনুমান যে এত তাড়াতাড়ি সত্যে পরিণত হবে, এমন পৈশাচিক নিষ্ঠুরতায় সত্য রূপ নেবে, সত্যিই সেদিন সন্ধ্যাতে ভাবিনি। এবং সত্য কথা বলতে কি, শতদলের ব্যাপারটাকে প্রথম হতেই আমি খুব বেশী একটা গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু কিরীটী বুঝেছিল, তাই বোধ হয় দু-চারবার অবশ্যম্ভাবী সেই সর্বনাশের ইঙ্গিত দিয়েছিল।
শুধু শতদলের ব্যাপারেই নয়, ইতিপূর্বে আমিও দুচারবার দেখেছি কিরীটীর অদ্ভুত বিশ্লেষণ-শক্তি—অন্ধকারের মধ্যে যেন ভবিষ্যতের পদসঞ্চার সে শুনতে পায়। পঞ্চ অনুভূতির বাইরে তার যে একটা বিচিত্র ষষ্ঠ অনুভূতি, যার সাহায্যে অনেক সময় অসাধ্য সাধন করেছে সে, ভাবতে গেলে যেন বিস্ময়ের অবধি থাকে না। কিরীটী বলে ওটা নাকি তার common sense, স্বাভাবিক বুদ্ধির বিচারশক্তি।
কিন্তু যাক, যে কথা বলছিলাম।
দিন দুই পরের কথা। মেলার উৎসবে ছোট শহরটিতে যেন প্রাণ-চাঞ্চল্যের একটা সাড়া পড়ে গিয়েছে।
রাত্রে বিস্তীর্ণ সমুদ্রের বালুবেলার ওপরে বাজির প্রতিযোগিতা হবে। অ্যামেচার ও পেশাদার বাজিকরদের ভিড়ে সৈকতের নিদিষ্ট স্থানটি গমগম করছে। রাত আটটা হতে বিভিন্ন দলের প্রতিযোগিতা শুরু হবে। নিরালার উন্মুক্ত গেট খুলে দেওয়া হয়েছে বিকাল হতেই। সর্বসাধারণের কাছে আজ অবারিত নিরালার লৌহ-ফটক। আমি, কিরীটী ও স্থানীয় থানা-ইনচার্জ গিয়ে দাঁড়িয়েছি। শতদল সকলকে অভ্যর্থনা করতেই ব্যস্ত। হোটেল হতে রাণু দেবীও এসেছে। আসেননি তার মা মিসেস মিত্র। হঠাৎ ঠাণ্ডা লেগে নাকি ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। দুবেলাই স্থানীয় ডাক্তার চ্যাটার্জী যাতায়াত করছেন হোটেলে।
আজকের রাতের শীতটা বেশ আরামদায়ক। স্থানীয় দু-চারজন অফিসারের স্ত্রী ও কন্যারা এবং স্থানীয় ভদ্রলোকেরাও অনেকে স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে বাজি প্রতিযোগিতা দেখতে এসেছেন।
পরিষ্কার আকাশ। ঝকঝক করছে তারাগুলো।
হঠাৎ একটা মিষ্টি হাসির তরঙ্গোচ্ছাসে সামনের দিকে চেয়ে দেখি, সীতা রাণুর সামনে দাঁড়িয়ে উচ্ছসিতভাবে হাসছে।
সীতার এমন হাসিখুশি আনন্দ-রূপ এ কয়দিনের পরিচয়ের মধ্যে এক দিনের জন্যেও দেখিনি।
সীতাকে মানিয়েছেও আজ ভারি চমৎকার। সাদা চওড়া জরির পাড় বসানো কালো জর্জেট শাড়ি, গায়ে সিফনের সাদা ব্লাউজ, মাথার চুল বেণীর আকারে পৃষ্ঠদেশে লম্বমান।
রাত্রি ঠিক আটটার সময় বাজির প্রতিযোগিতা শুরু হল।
বিচিত্র সুন্দর দৃশ্য। কালো আশমানের বুকে লাল নীল সাদা হরেক রঙের আগুনের ফুলকিগুলো যেন আলোর ফুলঝুরি ছড়িয়ে চলেছে। হাউইগুলো সোনালী সর্পিল রেখায় কালো আকাশের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যেন এক-একটা অগ্নি-ইঙ্গিত এঁকে চলে যাচ্ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে।
সকলেই আমরা যেন আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে উঠেছি। হঠাৎ সেই কলগুঞ্জনের মধ্যে শতদলের কণ্ঠস্বর কানে এল।
শতদল সীতাকে বলছে, এই ঠাণ্ডার মধ্যে গরম জামা গায়ে দাওনি কেন সীতা?
ঠাণ্ডা আবার কোথায়!
হঠাৎ ঠাণ্ডা লাগতেই বা কতক্ষণ? যাও, নিচে গিয়ে একটা গরম জামা গায়ে দিয়ে এস।
কিছু হবে না।
না। আমার এই শালটাই না হয় গায়ে দাও।
না, না—তোমার ঠাণ্ডা লাগবে।
না। আমার গায়ে জামা আছে। নাও-
কতকটা জোর করেই যেন শতদল সীতার গায়ে ডীপ লাল রঙের কাশ্মীরী শালটা নিজের গা হতে খুলে জড়িয়ে দিল।
ঠিক ভিড়ের মধ্যে নয়, ছাদের একেবারে কিনার ঘেষে একধারে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কথা বলছিল সীতা ও শতদল। আমি ওদের থেকে হাততিনেক মাত্র দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলেই ওদের পরস্পরের কথাগুলো প্রায় স্পষ্টই শুনতে পেয়েছি। একটু পরেই দেখলাম শতদল ভিতরের দিকে চলে গেল।
ভিড় বাঁচিয়ে ছাদের অন্য দিকে দাঁড়িয়ে কিরীটী ও থানা-ইনচার্জ রসময় ঘোষাল নিম্নকণ্ঠে পরস্পরের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে আলাপ করছে।
বাজি পোড়ানোর ব্যাপারে কিরীটীর যে খুব বেশী মনোযোগ আছে বলে মনে হয় না। আজকের উৎসবে যোগ দিলেও সে যেন উৎসবকে বাঁচিয়ে চলেছে।
অতিথি—বিশেষ করে বিশিষ্ট অতিথিদের প্রতি যে শতদলবাবুর লক্ষ্য আছে বুঝলাম যখন কিছুক্ষণ বাদে ভৃত্য অবিনাশ ট্রেতে করে কেক, বিস্কিট ও ধূমায়িত চা পরিবেশন করে গেল আমাদের।
আরো আধ ঘণ্টাটাক পরে। কালো আকাশ-পটে তখন বিচিত্র বাজির অপূর্ব আলোর খেলা চলেছে।
প্রত্যেকেই আমরা তন্ময় হয়ে একেবারে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। ঐ মুহূর্তে ছাদের উপরে উপস্থিত সকলেরই মনোযোগ ও দৃষ্টি আকাশের দিকে কেন্দ্রীভূত।
হঠাৎ আমরা চমকে উঠলাম একটা মেয়েলী কণ্ঠের আর্ত তীক্ষ্ণ চিৎকারে।
ভয়ার্ত আকুল চিৎকার।
কী হল? ব্যাপার কী? সকলেই পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। সকলের চোখেই একটা প্রশ্ন যেন।
চিৎকারটা এসেছিল কোন দিক থেকে তাও ভালো করে প্রথমটায় বোঝা যায়নি। সকলেই আমরা যেন বিস্ময়ে চকিতে হতভম্ব বিমূঢ়।
ঠিক সেই সময় একটি সুবেশা তরুণী একপ্রকার চেঁচাতে চেঁচাতেই ছাদে এসে দাঁড়ালেন, খুন! খুন হয়েছে!
কথা বলতে বলতে তরুণীটি হাঁপাচ্ছিলেন। ভয়ে আতঙ্কে চোখের মণি দুটো যেন তাঁর ঠিকরে বের হয়ে আসছে।
মুহর্তে চারপাশ হতে সকলে এসে তরুণীটিকে ঘিরে ধরে।
খুন! কোথায় হয়েছে? কে খুন হল? যুগপৎ একসঙ্গে বহু কণ্ঠ হতে প্রশ্ন উত্থিত হল।
হঠাৎ এমন সময় কিরীটীর শান্ত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, একটু অনুগ্রহ করে আপনারা সরে দাঁড়ান তো। সরুন। পথ ছেড়ে দিন।
তাকিয়ে দেখি, কিরীটী ও তার পাশে থানা-ইনচার্জ রসময় ঘোষাল।
সরুন না! পথ ছাড়ুন না! শতদলের কণ্ঠস্বর।
শতদল মধ্যবর্তী তরুণীর কাছে এগিয়ে যাবার জন্য সকলকে পথ ছেড়ে দেবার মিনতি জানাচ্ছে।
বহু কষ্টে আমরা তরুণীর সম্মুখবর্তী হলাম।
শতদল প্রথমে প্রশ্ন করে, আপনি কে? কে খুন হয়েছে? কোথায়?
তরুণী তখনও হাঁপাচ্ছে। চোখে-মুখে ভয়ার্ত ব্যাকুলতা।
এবারে কিরীটী তরুণীর সামনে এগিয়ে যায়, কোথায় খুন হয়েছে বলুন তো?
নীচের বসবার ঘরে-
কিরীটী বলে, আসুন শতদলবাবু। আপনিও আসুন।
সকলে অতঃপর আমরা দোতলায় নেমে এলাম। অভ্যাগতদের বসবার জন্য দোতলার স্টুডিও-ঘরের পাশের ঘরটা খুলে কতকগুলো চেয়ার ও সোফা ঐদিনের জন্য সাজানো হয়েছিল।
ঐদিনকার উৎসবোপলক্ষে ঝাড়বাতিটাও সন্ধ্যা হতেই জেলে দেওয়া হয়েছিল। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন সর্বাগ্রে তরুণীটি এবং তাঁর ঠিক পশ্চাতে আমি ও কিরীটী।
ঘরের মধ্যে পা দিয়েই চমকে উঠেছিলাম। ঘরের ঠিক মাঝখানে মেঝের ওপর কাত হয়ে পড়ে আছে যে মৃতদেহটি তাকে দেখামাত্রই চিনতে আমার কষ্ট হয়নি।
সীতা!
শতদলের সেই রক্তবর্ণ কাশ্মীরী শালটায় তখনও তার দেহ আবৃত।
পশ্চাৎ হতে পৃষ্ঠদেশে গুলি করা হয়েছে। গায়ের শাল ও জামা ভিজিয়ে রক্তধারা ঘরের মেঝেতে—সেদিনই পরিষ্কার করা পরিচ্ছন্ন মসৃণ পাথরের মেঝেতে ছড়িয়ে জমাট বেধেছে।
মৃতদেহের চোখ দুটো বিস্ফারিত। যেন ভয় ও জিজ্ঞাসার চিহ্ন। হস্ত দুটি প্রসারিত।
স্তব্ধ বিস্ময় যেন আমার বাক্যরোধ করেছিল। মুখটা একপাশে কাত হয়ে আছে। শতদলও আমাদের পাশেই নিশ্চল পাষাণের মত দাঁড়িয়ে নির্বাক। তার সমগ্র মুখখানা জুড়ে একটা অসহায় আতঙ্ক যেন ফুটে উঠেছে। চোখে ভীত প্রশ্নভরা দৃষ্টি।
কিরীটীও স্তব্ধ হয়ে মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে। তার পাশে রসময় ঘোষাল। এবং রসময় ও কিরীটীর কাছ হতে বেশ কিছুটা ব্যবধান বাঁচিয়ে ভীত নর-নারীর দল চিত্রাপিতের মতই নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে গা-ঘেষাঘেষি করে। ঘরের মধ্যে পাথরের মতই জমাট একটা স্তব্ধতা যেন থমথম করছে।
বোধ হয় মিনিট চার-পাঁচ ঐভাবেই কেটে গেল।
কিরীটী এগিয়ে গেল সর্বপ্রথম মৃতদেহের খুব কাছে। ঝুঁকে নীচু হয়ে মৃতের অবশ শিথিল হাতটা তুলে আবার যেমনটি ছিল ঠিক সেইভাবে নামিয়ে রাখলে সন্তর্পণে আলগোছে।
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পৃষ্ঠদেশে গুলি করা হয়েছে।
সীতা! সীতা খুন হল! অস্ফুট ভাবে কথাগুলো শতদলের কণ্ঠ হতে উচ্চারিত হল। এবং সঙ্গে সঙ্গে দু হাতে মুখ ঢাকল শতদল।
বসুন শতদলবাবু বসুন। শতদলবাবুকে ধরে বসিয়ে দিলাম একটা চেয়ারের উপর, নার্ভ হারাবেন না।
আপনিই দেখেছিলেন? আপনার নামটা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি? কিরীটী সেই তরুণীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে।
উনি মিস গূহ। এখানকার উকিল শরৎবাবুর মেয়ে। জবাব দিলেন পার্শ্বেই দণ্ডায়মান প্রৌঢ়বয়স্কা একটি ভদ্রমহিলা।
দেখুন! এবারে কিরীটী সমবেত সমস্ত নরনারীকে সম্বোধন করে বললে, আপনারা সকলে এইভাবে এই ঘরে ভিড় করলে তো চলবে না। অবশ্য আপনাদের সকলের সঙ্গেই আমাদের কথা বলার প্রয়োজন হবে—তবে একে একে, পৃথক পৃথক ভাবে। কী বলেন রসময়বাবু? কিরীটী তার বক্তব্য শেষ করলে শেষ মুহূর্তে থানা-ইনচার্জ রসময়বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে।
হ্যাঁ, আপনাদের আমার প্রয়োজন হবে।
থানা-ইনচার্জ রসময় ঘোষালকে সকলে চিনতেন না। কেউ কেউ যাঁরা চিনতেন, তাঁরাই বোধ হয় ইতিমধ্যে পাশাপাশি যাঁরা জানতেন না তাঁদের ফিসফিস করে জানিয়ে দিয়েছিলেন রসময় ঘোষালের সত্যিকারের পরিচয়টা। এবং কিরীটীকে রসময়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দেখে তার সত্যিকারের পরিচয়টা না জেনেই বোধ হয় তাকেও ঐ পর্যায়ে ফেলে ওদের দুজনার সম্পর্কেই হঠাৎ যেন সকলে বেশ একটু চঞ্চল হয়ে ওঠে।
আকস্মিক মৃত্যুর ব্যাপারে প্রথমটায় সকলে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু যে মুহূর্তে তারা বুঝতে পারলে এর মধ্যে থানা-পুলিশও উপস্থিত, সমস্ত ঘটনার চেহারাটাই যেন বদলে গেল। প্রথমটায় যে গুরুত্ব এতক্ষণ আকস্মিকতার মধ্যে ঠিক প্রকাশ পায়নি, থানা ও পুলিশের পরিচয়ের মধ্যে দিয়ে সেই গুরুত্ব যেন সহসা সুস্পষ্ট ও কঠিন হয়ে দেখা দিল। আকস্মিক বিমূঢ়তার মধ্যে ফুটে উঠল একটা ভয়-ব্যাকুল চাঞ্চল্য। সকলেই ভিতরে ভিতরে অবিলম্বে স্থানত্যাগের জন্য যেন চঞ্চল ও ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
যুগপৎ নিঃশব্দে উপস্থিত সকলেরই মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী নিঃসংশয়ে ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারে। মৃদু হেসে যেন সকলকেই সাহস দেয়, আপনাদের ব্যস্ত হবার বা ভয় পাবার কোন কারণ নেই। সামান্য দু-চারটে প্রশ্ন প্রয়োজনমত আপনাদের কাউকে কাউকে উনি রসময়বাবু ও আমি জিজ্ঞাসা করব মাত্র। তার পরই আপনারা যে যার গৃহে প্রত্যাবর্তন করবেন। কিছুক্ষণের জন্য বাইরের বারান্দায় আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। আমরা বেশীক্ষণ সময় নেব না। কেবল মিস গুহ, আপনি ঘরে থাকুন।
দেখতে দেখতে ঘর খালি হয়ে গেল।
ঘরের মধ্যে এখন আমি, কিরীটী, থানা-ইনচার্জ রসময় ঘোষাল, শতদলবাবু ও মিস গুহ।
মিস গুহ, মনে হচ্ছে আপনিই বোধ হয় সর্বপ্রথম আমাদের মধ্যে ঐ মৃতদেহ দেখেছেন?
কিরীটীর প্রশ্নে মিস গুহ কিরীটীর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে বোবাদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, কোন জবাব দেন না। মৃতদেহ দেখার পর আকস্মিক ভাবে যে চাঞ্চল্য তরুণীর মনের মধ্যে জেগেছিল, তার কিছুমাত্র যেন এখন আর অবশিষ্ট নেই। একেবারে স্তব্ধ। বোবা হয়ে গিয়েছেন যেন তিনি।
আপনি নীচে এসেছিলেন কেন?
জলপিপাসা পেয়েছিল তাই এধারে এসেছিলাম। কিন্তু ঘরে ঢুকেই, মিস গুহ আবার মৃতদেহের দিকে দৃষ্টিপাত করে চুপ করে গেলেন।
কিরীটী বারেকের জন্য তার মণিবন্ধে বাঁধা হাতঘড়ির দিকে তাকাল। পরে মৃদু কণ্ঠে বললে, তা এখন ঠিক নটা বেজে দশ মিনিট। আপনি তাহলে পৌনে নটা নাগাদ এ ঘরে এসেছিলেন!
তাই হবে।
সে সময় এ ঘরে আর কেউ ছিল না?
না।
নামবার সময় বাইরের বারান্দায় বা সিঁড়িতেও আর কারো সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?
না।
আপনি জল খেতে নামবার আগে আগাগোড়া ছাদেই ছিলেন? একবারের জন্যও নীচে নামেননি?
না।
অতঃপর কিরীটী একে একে সকলকেই ডেকে তাদের গত এক ঘণ্টার গতিবিধি ও অবস্থান সম্পর্কে প্রশ্ন করতে লাগল।
নবম জনকে প্রশ্ন করা হল। মধ্যবয়েসী একজন ভদ্রমহিলা। তিনি জবাবে বললেন, রাত তখন আটটা আন্দাজ হবে, তিনি এ বাড়িতে আসেন। আসতে তাঁর একটু দেরিই হয়েছিল। এখানকার স্থানীয় স্কুলের তিনি একজন মিসট্রেস। নাম মালিনী সেন। মিস। অবিবাহিতা।
মিস সেন বললেন, সিঁড়ি দিয়ে সবে দোতলার বারান্দায় উঠেছি, হঠাৎ এখন মনে পড়ছে, দেখেছিলাম যেন—উনি ও আর একজন পুরুষ এই ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিম্নকণ্ঠে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছিলেন। কিন্তু আমি তখন তাঁদের বিশেষ লক্ষ্য করিনি। সোজা উপরে ছাদে উঠে যাই।
মিস সেনের কথা মুহূর্তের জন্য লক্ষ্য করলাম শতদল যেন তাঁর দিকে মুখ তুলে তাকালেন।
সেই পুরুষটি দেখতে কেমন বা তার পরিধানে কী পোশাক ছিল আপনার মনে আছে কি মিস সেন? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
ভাল করে ঠিক তো লক্ষ্য করিনি, তবে মনে আছে ভদ্রলোকের বয়স খুব বেশী হবে না। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। লম্বা ও বেশ গাঁট্টাগোট্টা চেহারা! পরিধানে বোধ হয় ফুলপ্যাণ্ট ও একটা হাফশার্ট ছিল।
তাঁদের কোন কথাবার্তা আপনার কানে গিয়েছিল?
না। তাঁরা এত আস্তে কথাবার্তা বলছিলেন যে, তাঁদের কোন কথাই আমি শুনতে পাইনি। তাছাড়া ওঁদের দিকে আমি তত নজরও তো দিইনি।
সামান্য ঐ সংবাদটকু ছাড়া আর বিশেষ কোন প্রয়োজনীয় তথ্যের সন্ধানই আর কারো কাছ হতে প্রশ্ন করে পাওয়া গেল না।
হঠাৎ এমন সময় বাইরে হরবিলাসের উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা গেল, শতদল! শতদল!
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হরবিলাস এসে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করলেন এবং কক্ষে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই ভূপতিত একমাত্র কন্যার মৃতদেহটা জমাট রক্তের মধ্যে দেখে হঠাৎ যেন স্তব্ধ হয়ে পাষাণের মত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। কারো মুখে একটি শব্দ পর্যন্ত নেই। নির্বাক কয়েকটি কঠিন মুহূর্ত।
তারপর হঠাৎ সেই স্তব্ধতা ভঙ্গ হল, সীতা! সীতাকে মেরে ফেলেছে! সীতা নেই! সীতা মারা গিয়েছে!
পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে মৃত কন্যার শিয়রের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লেন হরবিলাস। নিঃশব্দে একখানি হাত মৃত কন্যার হিমশীতল মাথার ওপরে রেখে বার-দুই কেবল উচ্চারণ করলেন, সীতা! সীতা! সত্যিই তুই মরে গিয়েছিস মা!
সমস্ত কক্ষখানি যেন এক মর্মন্তুদ বেদনায় ঐ কথা কয়টির মধ্যে গুমরে গুমরে হাহাকার করে উঠল।
নিঃশব্দে হাতখানি মৃত কন্যার মাথার ওপরে বুলোচ্ছেন হরবিলাস। আমরা যেন স্তব্ধ বিমূঢ়। হঠাৎ হরবিলাস কিরীটীর মুখের দিকে তাকালে, কী হবে কিরীটীবাবু! হিরণএখনও কিছু জানে না। অবিনাশ আমাকে খবর দিতেই তাড়াতাড়ি আমি উপরে ছুটে এসেছি। হিরাণ রান্নাঘরে—সে এখনও কিছু জানে না। তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই বললেন, জানতাম। আমি জানতাম এ লোভের দণ্ড! লোভের দণ্ড! এত বড় মাশুল দেওয়া আমাদের বাকি ছিল বলেই হিরাণ এ বাড়ি ছেড়ে যেতে চায়নি। কিছুতেই তাকে মত করাতে পারিনি।
বলতে বলতে আচমকা হরবিলাস উঠে দাঁড়ালেন, না, না—এ আমি সহ্য করতে পারছি না। এ আমি সহ্য করতে পারছি না! সীতা! সীতা!
টলতে টলতে হরবিলাস কক্ষ হতে বের হয়ে গেলেন।
আগের পর্ব :
০১. সাগর-সৈকত হোটেল
০২. আবার সমুদ্রের দিকে
০৩. হিরন্ময়ী দেবীই প্রথমে কথা বললেন
০৪. ভদ্রমহিলা রাণুর দিকে তাকিয়ে
০৫. শতদলবাবুর কথায় তাকিয়ে দেখলাম
০৬. দ্রষ্টব্য বটে ভুখনা
০৭. দ্বিতীয় প্রশ্ন করল কিরীটী
০৮. একটা ভারী বস্তু পতনের শব্দ
০৯. শেষ নির্দেশ
১০. এগিয়ে আসছে ছায়া-মূর্তি দুটো
পরের পর্ব :
১২. একটা বেদনার ঝড়
১৩. একজন সুশ্রী সুবেশা মহিলা
১৪. থানা-অফিসার রসময় ঘোষাল
১৫. হিরণ্ময়ী দেবীর কণ্ঠস্বর
১৬. দেওয়ালে টাঙানো অয়েল-পেন্টিং
১৭. কালো অন্ধকার রাত
১৮. রাস্তায় পৌঁছে হনহন করে
১৯. নিরালাতেই আমরা সকলে উপস্থিত ছিলাম