০৫. শতদলবাবুর কথায় তাকিয়ে দেখলাম
শতদলবাবুর কথায় তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই ঘরময় ছোট-বড় কাঁচের টুকরো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কিরীটী সাবধানে পা ফেলে এগুতে এগুতে বললে, ইসু কাঁচের টুকরোগুলো এখনো এইভাবে ঘরময় ছড়িয়ে রেখে দিয়েছেন! কাউকে বলুন ঘরটা তাড়াতাড়ি পরিষ্কার করে দিতে!
হ্যাঁ, এক্ষুনি পরিষ্কার করাচ্ছি। বলে শতদল ভৃত্য অবিনাশকে ডেকে ঘরটা পরিষ্কার করে দিতে আদেশ দিল।
ঘরটা বেশ বড় আকারের হবে। ঘরের মেঝেটা লাল সিমেন্টের তৈরী এবং পুরাতন হলেও এখনো ঝকঝক করে এমন চমৎকার পালিশ। একধারে মস্ত বড় একটা পালঙ্ক এবং তারই একপাশে একটা লোহার সিন্দুক, কাঠের একটা চৌকির ওপরে বসানো। ঘরের অন্য কোণে একটা জানলার একেবারে বরাবর একটা লিখবার টেবিল; ঐ টেবিলটি এখন বিশেষ ব্যবহৃত হয় বলে মনে হয় না, কারণ টেবিলের উপরে নানা কাগজপত্র ও বই এলোমেলো ভাবে ছড়ানো রয়েছে। সেই টেবিলটা থেকে হাতচারেক দূরে অনেকটা ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় ছোট একটি রাইটিং টেবিল, তারই উপরে টেবিল ল্যাম্প বোধ হয় বসানো ছিল এবং জানালাপথে নিক্ষিপ্ত গুলির আঘাতে ল্যাম্পটি মেঝেতে ছিটকে পড়ে চিমনিটা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে।
অবিনাশই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে একটা ঝাড়নের সাহায্যে কাঁচের টুকরোগুলো তুলে, তখনও মেঝের উপরে উলটে-পড়ে-থাকা ল্যাম্পটা তুলে রাখতে যাচ্ছে, কিরীটী এগিয়ে গিয়ে অবিনাশের হাত থেকে একদিকে খানিকটা টোলখেয়ে-যাওয়া ল্যাম্পটা হাতে নিলে চেয়ে, দেখি অবিনাশ, ল্যাম্পটা?
অবিনাশ ল্যাম্পটা কিরীটীর হাতে এগিয়ে দিয়ে ঘর হতে চলে গেল। বারকয়েক ল্যাম্পটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে কিরীটী এগিয়ে গিয়ে ল্যাম্পটা সামনের টেবিলের উপর বসিয়ে রাখল। এবং হঠাৎ শতদলের একেবারে মুখোমখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, গুলিটা কোন দিক দিয়ে এসে ঢুকেছিল শতদলবাবু?
সামনের ঐ বাগানের দিককার জানালাটাই রাত্রে খোলা ছিল। ঐ জানালাপথেই গুলিটা এসেছিল।
শতদলবাবু হাত তুলে ঘরের অনেকটা মধ্যস্থলে রক্ষিত রাইটিং-টেবিলটার ঠিক মুখোমুখি যে জানালাটা তখনও বন্ধ ছিল, সেইটার দিকে হাত তুলে দেখাল।
কিরীটী আর দ্বিতীয় প্রশ্ন উচ্চারণ না করে নিজেই এগিয়ে গিয়ে ছিটকিনিটা তুলে হাত দিয়ে ঠেলে জানালার বন্ধ কবাট খুলে দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে কী যেন গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখতে লাগল।
কৌতুহলভরে আমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
এ বাড়ির পশ্চাতের অংশ সেটা। দেখলেই বুঝতে কষ্ট হয় না, দীর্ঘদিন জমিটা অসংস্কৃত অবস্থায় পতিত হয়ে আছে। বড় বড় ঘাস ও আগাছায় জায়গাটা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে বললেও অত্যুক্তি হয় না। মধ্যে মধ্যে শেয়াকুলের ঝোপ ও ঝাউগাছ। শেষপ্রান্তে জমির সীমানা দেড়-মানুষ-সমান উঁচু, প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রাচীরের ওদিক দিয়ে জমি ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে, সমুদ্র বেশ কিছুটা দূরে সেখান থেকে। ঐসব ঝোপ ও আগাছার মধ্যে আত্মগোপন করে থেকে আততায়ীর পক্ষে এই ঘরের মধ্যে অবস্থিত কাউকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়াটা এমন কিছু কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়, কারণ নিচের ঐ জমিতে দাঁড়িয়ে ঘরের এই জানালাটা খোলা থাকলে ঘরের ভিতরের অনেকটা অংশই চোখে পড়া সম্ভব মনে হল।
আততায়ী ঐখান থেকেই বোধ হয় শতদলবাবুকে রাত্রে আলোর সামনে বসে থাকতে দেখে গুলি ছুড়েছিল। কথাটা কিরীটীকে সম্বোধন করেই নিম্নস্বরে বললাম আমি।
কিরীটী বোধ হয় নিজের আত্মচিন্তায় অন্যমনস্ক ছিল, আমার প্রশ্নে চমকে ফিরে তাকাল, কী বলছিলি সুব্রত?
বলছিলাম, ঐখান থেকে অনায়াসেই গুলি ছোঁড়া যেতে পারে।
তা পারে। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী জবাব দিল। কিরীটীর কণ্ঠস্বরে যেন কোন আগ্রহের সুরই নেই।
রাণু এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করা অবধি, এবারে সে শতদলকে বলছে শুনতে পেলাম, তুমি কিন্তু সত্যিসত্যিই কাল খুব বেঁচে গেছ শতদল!
হ্যাঁ, তাই তো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি রাণু, এখনো যেন এর মাথামুন্ডু, কিছুই আমি বুঝে উঠতে পারছি না! আমাকে কারো হত্যা করে কী লাভ থাকতে পারে। তা ছাড়া তুমি তো জান, এ জগতে কারো সঙ্গেই আমার কোন শত্রুতা নেই।
কিন্তু ব্যাপারটা যে রকম দাঁড়াচ্ছে–
রাণুর কথায় প্রতিবাদ জানিয়ে শতদল বলে, সে যাই হোক, ব্যাপারটা ক্ৰমে এমন দাঁড়াচ্ছে যে, এর একটা হেস্তনেস্ত না করে চুপ করে বসে থাকাটাও হয়তো আর উচিত হবে না। আপনি কি বলেন মিঃ রায়?
হ্যাঁ, তা বইকি। We must see to its end! কিরীটী ফিরে দাঁড়িয়ে জবাব দিল।
তাহলে এখন আমার কী করা উচিত? আপনার পরামর্শ কী?
সেইটাই এতক্ষণ আমি ভাবছিলাম, শতদলবাবু। দুটো কাজ সর্বাগ্রে আপনাকে করতে হবে। কিরীটী শতদলের দিকে তাকিয়ে বলে।
কী, বলুন?
প্রথমত সমস্ত ব্যাপারটা এখানকার স্থানীয় থানা-ইনচার্জকে জানাতে হবে। কারণ তাঁদের বাদ দিয়ে আমরা এসব ব্যাপারে এক পাও এগুতে পারব না, তাছাড়া সেটা একেবারেই আইনসঙ্গতও হবে না।
হ্যাঁ, গতরাত থেকে আমিও ঐ কথাটাই ভাবছিলাম। মৃদুভাবে শতদল বলে।
শুধু, ভাবা নয় মিঃ বোসু আপনার উচিত ছিল ইতিমধ্যে থানা-ইনচার্জকে সমস্ত ব্যাপার বলে তাঁর পরামর্শ নেওয়া। যাক আর দেরি করবেন না, এখুনি কোন একজনকে থানায় পাঠিয়ে দিন এবং লিখে পাঠান তিনি যেন এখনি একবার অনুগ্রহ করে এখানে আসেন, লিখবেন বিশেষ জরুরী।
এখনি দেব? হ্যাঁ, আর এক মুহূর্তও দেরি করা উচিত হবে না।
কিরীটীর নির্দেশমত তখুনি শতদল একটা কাগজে স্থানীয় থানা অফিসারকে সংক্ষেপে ব্যাপারটা লিখে এবং কিরীটীর নামটাম ঐ সঙ্গে যোগ করে মালী রঘুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিল।
থানা অফিসার আসুন, ততক্ষণ আমরা চা-পান-পর্বটা শেষ করে নিই, কি বলেন শতদলবাবু!
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আমি এখনি আসছি, শতদল বোধ হয় সকলের চায়ের ব্যবস্থা করতেই ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
রাণু দেবী সমুদ্রের দিককার খোলা জানালাটার ধারে গিয়ে চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
আমি কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ওঁরা দুজনেই যে নার্ভাস হয়ে গিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে!
কিরীটী পকেট থেকে সিগার-কেসটা বের করে একটা সিগার কেস থেকে টেনে নিয়ে সেটাতে অগ্নিসংযোগের চেষ্টায় ছিল, আমার কথার কোন জবাব দিল না। বুঝতে পারলাম তার নিঃশব্দতার কারণ। কোনো একটা বিষয়ে যখনই সে গভীরভাবে চিন্তা করে, সেই চিন্তার মধ্যেই সে বরাবর এমনভাবে অন্যমনা হয়ে যায় যে বাইরের পারিপার্শ্বিকের থেকে সে যেন অনেক দূরে চলে যায়।
আমি আর একবার কতকটা অনন্যোপায় হয়েই ঘরটার চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। ঘরটার দিকে তিনটে তিনটে করে ছটা জানালা। দক্ষিণের দিকে সমুদ্র, উত্তরের দিকে একটু পূর্বে দেখা সেই খোলা জমিটা— প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাড়িটার পশ্চাতের অংশ। ঘরের দেওয়ালে বড় বড় সব অয়েল-পেনটিং এবং সবগুলোই নারী ও পুরুষের প্রতিকৃতি। বোধ হয় শিল্পী রণধীর চৌধুরীর পূর্বপুরুষদের প্রতিকৃতি। প্রত্যেকটি প্রতিকৃতি যেন একেবারে সজীব, প্রাণবন্ত। কী অদ্ভুত শিল্পচাতুর্য!
শতদল এসে প্রবেশ করল অবিনাশকে সঙ্গে নিয়ে, অবিনাশের হাতে চায়ের ট্রে।
চা পরিবেশন করল রাণু দেবী কিরীটীরই অনুরোধে। চা-পান করতে করতেই একসময় কিরীটী তার অর্ধসমাপ্ত কথার জের টেনেই যেন বলতে লাগল, যে কথাটা আপনাকে বলতে বলতে থেমে গিয়েছিলাম, আমার কিন্তু মনে হয়, এর পর আর আপনার এইভাবে একা একা এ বাড়িতে থাকা উচিত হবে না। এবং যুক্তিসঙ্গতও হবে না মিঃ বোস।
রাণু যেন কিরীটীর কথাটা কতকটা লুফে নিল। সে বলে ওঠে, আমিও সেই কথাটাই বলব বলব ভাবছিলাম তোমাকে শতদল। কিরীটীবাবু, ঠিকই বুলেছেন। এ বাড়িতে আর তোমার এভাবে risk নিয়ে একা একা থাকা উচিত নয়।
তোমার যেমন কথা রাণু! একা একা আবার আমি এ বাড়িতে আছি কোথায়? ভিতরের মহলে অবিনাশ আছে, দিন দুই হল অবিনাশের এক ভাইপো এসেছে, রমেশ। তাকেও এ বাড়ির কাজে আমি নিযুক্ত করেছি, তাছাড়া দাদুর একমাত্র বোন হিরন্ময়ী দিদি ও হরবিলাস দাদা এবং তাঁদের মেয়ে সীতা আছে। এতগুলো লোক বাড়িতে আছে। প্রতিবাদ জানায় শতদল।
তা হোক শতদলবাবু হরবিলাসবাবু ও তাঁর স্ত্রী-কন্যা তাঁরা সকলেই থাকেন বাইরের মহলে। ভিতরে এত বড় মহলটায় বলতে গেলে আপনি তো একাই থাকেন। অবিনাশের বয়স হয়েছে, সেও হয়তো থাকে ভিতরের দিকে, কিন্তু এ অবস্থায় রাত্রে যদি আচমকা একটা বিপদ-আপদ ঘটে তো সময়মত কারো সাহায্যও তো আপনি পাবেন না! তা ছাড়া আমি এমন একজন লোককে সর্বদা আপনার কাছে কাছে রাখতে চাই, যিনি সর্বতোভাবে আপনাকে সাহায্য তো করতেই পারবেন এবং সর্বদা আপনার প্রতি দৃষ্টিও রাখতে পারবেন। কিরীটী জবাব দেয়।
কিন্তু এমন কোন একজন সহচর আমি এখন পাই বা কোথায় মিঃ রায়? শতদল যেন একটু চিন্তিতই হয়ে ওঠে।
এমন কোন আত্মীয় কেউ কি আপনার নেই, যিনি অন্ততঃ কিছুদিন এসে আপনার কাছে থাকতে পারেন?
কিছুদিন মানে! সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় শতদল কিরীটীর মুখের দিকে।
এই ধরুন, দিন ১৫।২০! দেখুন না ভেবে কেউ আছেন কিনা? কিরীটী আবার শতদলের মুখের দিকে তাকায় কথাটা বলে।
না, এমন কাউকেই মনে পড়ছে না। তবে আমার দাদার বোন ঐ হিরন্ময়ী দেবী, ওঁদেরই না হয় আমি অনুরোধ জানাতে পারি ভিতরের মহলে এসে থাকতে-শতদল বলে।
আমার মনে হয়, সেইটাই সব চাইতে ভাল ব্যবস্থা হবে। আমিই কথাটা বলি।
হরবিলাসবাবু ও তাঁর স্ত্রীকে অনুরোধ জানাতে তাঁরা শেষ পর্যন্ত স্বীকৃত হলেন অন্দরমহলে এসে থাকতে এবং মনে হল হরবিলাস যেন প্রস্তাবটা আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করলেন। কিন্তু কেন যেন আমার মনে হল কিরীটীর এ প্রস্তাবে হরবিলাসবাবু, সম্মত হওয়ায় শতদল খুব বেশী সন্তুষ্ট হতে পারেনি। হরবিলাসবাবুকে প্রস্তাবটা জানাবার জন্য আমরাই সকলে নিচে বাইরের মহলে গিয়েছিলাম। হরবিলাস-পরিবারের স্থান পরিবর্তনের ব্যবস্থাটা যাতে ঐদিনই সম্ভব হয়, কিরীটী শতদলকে সেই অনুরোধ জানাল।
শতদল বললে, রঘু ফিরে আসুক, সে এলেই অবিনাশ ও রঘু সব ব্যবস্থা করে দেবেখন।
ঠিক এই সময় রঘু এসে ঘরে প্রবেশ করল এবং বললে, দারোগাবাবু এসেছেন নিজেই। বাইরে অপেক্ষা করছেন।
চলুন শতদলবাবু উপরে আপনার ঘরে যাওয়া যাক। রঘু, দারোগাবাবুকে উপরের ঘরে নিয়ে এস। রঘুর দিকে তাকিয়ে কিরীটী নির্দেশ দিল।
শতদলবাবুকে নিয়ে আমরা অন্দরমহলে তাঁর ঘরের দিকে অগ্রসর হলাম, রঘু বাইরে চলে গেল দারোগাবাবুকে ডাকতে।
স্থানীয় থানা-ইনচার্জ রসময় ঘোষাল, বয়স তেত্রিশের বেশী হবে না।
ভদ্রলোকের বোধ হয় নিয়মিত ব্যায়াম করা অভ্যাসু বেশ বলিষ্ঠ পেশীবহুল চেহারা। লোকটি কথাবার্তায় অত্যন্ত অমায়িক। আমি কিরীটীর পরিচয় দিতে তিনি সোল্লাসে এগিয়ে এসে কিরীটীর সঙ্গে করমর্দন করলেন, কী সৌভাগ্য, আপনিই মিঃ কিরীটী রায়?
ভদ্রলোকের অমায়িক ব্যবহারে আমিও যেন মনে মনে অনেক স্বস্তি পাই। অন্ততঃ এর পর প্রতি পদে যার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে, তাঁর মধ্যে কোন পলিসী অহমিকা বা গাম্ভীর্য নেই। সত্যিই ভদ্রলোক।
কিরীটীই শতদলবাবুর সঙ্গে ঘোষাল সাহেবের পরিচয়টা ঘটিয়ে দিল, ইনিই শতদলবাবু এই বাড়ির মালিক; ইনিই আপনাকে চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছিলেন মিঃ ঘোষাল।
বলতে লজ্জা নেই মিঃ রায়, আমি কিন্তু ওঁর চিঠিতে আপনি এখানে উপস্থিত জেনেই, থানার সমস্ত কাজ ফেলে তাড়াতাড়ি এখানে ছুটে এসেছি। কী আশ্চর্য দেখুন, আপনি এখানে এসেছেন জানতেও পারিনি।
মিঃ ঘোষালের কথা শুনে শতদল একবার ঘোষালের দিকে তাকালেন।
কিরীটীর দিকে চেয়ে দেখি, কিরীটী কিন্তু মৃদু মৃদু হাসছে। ব্যাপারটার মধ্যে যে হাসির কি কারণ থাকতে পারে সেদিন ঐ মুহূর্তে বুঝিনি, পরে যখন রহস্যটা উপলব্ধি করেছিলাম—থাক, সে কথা, বহুবার বহু ক্ষেত্রে দেখেছি, কিরীটীর অত্যাশ্চর্য অনুসন্ধানী দৃষ্টি রহস্য উদঘাটনের ব্যাপারে সর্বদা এমন ভাবে সজাগ থাকে যে, ভাবতেও বিস্ময়ে যেন অভিভূত হয়ে যেতে হয়। শুধুমাত্র তাই নয়, বহুক্ষেত্রে তুচ্ছাদপি তুচ্ছ ঘটনা, অনেক সময় যার কোন তাৎপর্যই হয়তো আমরা খুঁজে পাই না,—কিরীটী প্রবলভাবে সেইটার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। এবং বারংবার সেইটা নিয়েই নাড়াচাড়া করতে থাকে নিজের মনের গভীর তলদেশে। কিরীটীকে ঐ সম্পর্কে পরে প্রশ্নও করেছি। জবাবে সে বলেছে, প্রত্যেক মানুষেরই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ আছে সুব্রত এবং তার বিচার-পদ্ধতিটাও মানুষ-বিশেষে বিভিন্ন। সামান্য একটা তুচ্ছ ঘটনা, যা হয়তো অনেকেরই চিন্তায় রেখাপাতও করে না, অনেক সময় সেই তুচ্ছর মধ্যেই আমি রহস্যেরই ইঙ্গিত পাই।
কিরীটীর কথায় আবার আমার সম্বিৎ ফিরে এল, তাহলে আপনাকে আগাগোড়া ব্যাপারটা খুলেই বলি, মিঃ ঘোষাল। যদিও ব্যাপারটার মধ্যে কাল পর্যন্তও শতদলবাবু কোন গুরুত্বই আরোপ করেন নি এবং গতরাত্রি থেকে কতকটা বাধ্য হয়েই মত পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন, সেটা হচ্ছে ভদ্রলোক বর্তমানে সত্যিই বিপন্ন হয়ে পড়েছেন। আমরা সোজা করে বললে বলা উচিত, শতদলবাবুর প্রাণ কয়েক দিন থেকে বিপন্ন হয়ে উঠেছে।
বিপন্ন হয়ে উঠেছে, কী রকম? প্রশ্ন করে ঘোষাল মশাই কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
Somebody is after his life!
বলেন কী? সত্যি?
হ্যাঁ, চার-চারটে attempt, অর্থাৎ অত্যন্ত সাধুপ্রচেষ্টা ওঁর জীবনের ওপরে হয়ে গিয়েছে!
চার-চারবার attempt হয়েছে?
হ্যাঁ। প্রথমবার, ঐ যে দেখছেন খাটের পাশে মাটিতে নামানো বড় অয়েল পেনটিংটা, ঐটাই বোধ হয় ওঁর অজ্ঞাতে কোন এক সময় এমন কায়দা করে ফিট করে রাখা হয়েছিল, যাতে করে রাত্রে ঘুমের ঘোরে কোন এক সময় সহসা ছবিটা মাথার উপরে ছিড়ে পড়ে ওঁর মাথাটা থেতলে দিয়ে ওঁর মত্যু ঘটায়। যদিও ব্যাপারটা গতকালই মাত্র ওঁর মুখে শোনা, আজ ঘরে ঢুকে একসময় ইতিপূর্বে ঐ ছবিটার প্রতি নজর দিয়েই আমি দেখেছি এবং আপনিও ইচ্ছা করলে এগিয়ে গিয়ে দেখে আসতে পারেন, ছবিটা টাঙানো ছিল একটা মোটা তার দিয়ে এবং সে তারটাকে এমন ভাবে সামান্য একটু অংশ বাকি রেখে কাটা হয়েছে যে ছবির ভারে বাকি তারের অংশটুকু ছিড়ে পড়া একসময় এমন কিছুই বিচিত্র নয়।
কিরীটীর কথা শুনে আমরা সকলেই খাটের পাশে নামিয়ে রাখা ছবিটির দিকে তাকালাম এবং বুঝলাম কিরীটীর কথাটা মিথ্যা নয়। গতকাল সকালে হোটেলের সামনে সী-বীচে শতদলবাবু ছবি সম্পর্কে কিরীটীকে কী বলেছিলেন ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ আবার হঠাৎ কিরীটীর কথায় মনে পড়ে গেল।
এগিয়ে গেলাম সকলে কিরীটীর সঙ্গে-সঙ্গেই ছবিটার দিকে।
যে তারের সাহায্যে ছবিটা দেওয়ালে পেরেকের সঙ্গে পাকাপোক্তভাবে টাঙানো ছিল, দেখলাম পরীক্ষা করে, সত্যি সত্যিই সে তারটা কোন কিছুর সাহায্যে এমন ভাবে কাটা যে বাকি যে অংশটুকু কাটা ছিল না সেটা ছবির ভারেই ছিড়ে গিয়েছে। কিরীটী কথাটা ভোলেনি এবং আজ ঘরে প্রবেশ করে অন্যান্য কথাবার্তার মধ্যেও ছবিটাকে লক্ষ্য করেছে এবং বেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেই সবটকু লক্ষ্য করেছে ইতিমধ্যেই। কিরীটী আবার বলতে লাগল, তারপর দ্বিতীয়বার attempt হয় এই বাড়ির বাইরে। এখানে আসবার সময়ই লক্ষ্য করে থাকবেন হয়তো মিঃ ঘোষাল, বাড়ির গেট থেকে যে রাস্তাটা বরাবর সামনের দিকে চলে গিয়েছে, বাড়িটা পাহাড়ের উপর অবস্থিত বলে রাস্তাটা ক্ৰমে ঢালু হয়ে নিচে গিয়েছে, সেই ঢালু রাস্তা দিয়ে একসময় শতদলবাবু যখন অন্যমনস্ক হয়ে নিচে নেমে যাচ্ছেন, পিছন থেকে কেউ একটা বড় পাথরের চাঁই গড়িয়ে দিয়ে ওঁকে পিষে মেরে ফেলবার চেষ্টা করেছিল।
ঘোষাল শতদলের মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
হ্যাঁ। মৃদু কণ্ঠে শতদল বললে, প্রথমটায় আমি বিশ্বাস করিনি। ব্যাপারটা, ভেবেছিলাম হয়তো সাধারণ ভাবেই হঠাৎ পাথরের চাঁইটা নিচের দিকে গড়িয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, কিরীটীবাবুর কথাই ঠিক, that was also an attempt on my life!
তারপর তৃতীয় প্রচেষ্টা গতকাল সকালে সমুদ্রসৈকত হোটেলের সামনে সী বীচে কিরীটী আবার বলে।
বলেন কি মিঃ রায়? হ্যাঁ, and that was a bullet! কিন্তু আততায়ী লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ফলে
উনি তো বেঁচে যানই, আমার পৈতৃক প্রাণটাও—মানে প্রাণ ঠিক নয়, মাথাটাও বেঁচে যায়।
সত্যি? বিস্ময়ে যেন একেবারে হাঁ হয়ে গিয়েছেন ঘোষাল কিরীটীর কথায়।
হ্যাঁ, আমার মাথার টুপিটা ফুটো করে এ-ফোঁড় ওফোঁড় হয়ে বুলেটটা বের হয়ে যায়। এবং সেই ব্যাপারের পরই আকস্মিকভাবে ওঁর সঙ্গে আমাদের চেনা-পরিচয়। আমি আর সুব্রত তখন ঠিক ঐ সময় সী-বীচে বসে রৌদ্রসেবন করছিলাম।
কই, এ কথা তো তুমি কাল আমাকে বলনি শতদল! এতক্ষণে প্রশ্ন করল রাণু শতদলকে।
কী বলব তোমাকে, গতকাল ব্যাপারটা আমি কি বিশ্বাস করেছিলাম! শতদল বিষণ্ণ ভাবে জবাব দেয়।
কিন্তু দিনের আলোয় অমন জায়গায় কাউকে গুলি করে হত্যা করবার প্রচেষ্টা, এ যে তাজ্জব ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে মিঃ রায়! আপনি না হয়ে অন্য কারো মুখে ব্যাপারটা শুনলে তো আমি বিশ্বাসই করতাম না, হেসেই উড়িয়ে দিতাম। ঘোষাল বললেন।
ব্যাপারটা অবশ্য কতকটা সেই রকমই বটে, মিঃ ঘোষাল। তবে অনেক সময় দেখা গিয়েছে, সত্যিকারের তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন ক্রিমিন্যাল দু-একটা ঐ প্রকারের দুঃসাহসের কাজ করে থাকে। যাই হোক, এর পর আমি কতকটা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই শতদলবাবুকে fourth attempt সম্পর্কে বিশেষভাবে সতর্ক করে দিই!
দিয়েছিলেন ওঁকে সতর্ক করে?
হ্যাঁ। And the fourth attempt was rather too early! ভাবতেই পারিনি, এত দ্রুত আবার আততায়ী ওঁর জীবনের উপরে attempt নেবে! এবারেও গুলি এবং এই ঘরের মধ্যে।
এই ঘরের মধ্যে?
হ্যাঁ। পিছনের বাগান থেকে কেউ ওঁকে গতরাত্রে টেবিলের সামনে আলোয় বসে লেখাপড়া করতে দেখে নিশ্চিন্ত মনে বন্দুক চালায়। এবং সৌভাগ্যবশতঃ এবারের নিক্ষিপ্ত মত্যুবাণটিও লক্ষ্যভেদ করতে সক্ষম হয়নি আততায়ীর। আলোর চিমনিটার উপর দিয়ে গিয়েছে। এরপর আপনাকে সংবাদ না দিয়ে থাকাটা এবং সব কিছু আপনার গোচরীভূত না করাটা বিবেচনার কাজ হবে না বুঝেই আপনাকে সংবাদ পাঠানো হয়েছে। Now you are in the spot, এবারে আপনি এর একটা বিহিত করুন, কারণ আইন আপনাদেরই হাতে। আমরা সম্পূর্ণ তৃতীয় ব্যক্তি, বুদ্ধি বা মৌখিক সাহস দিতে পারি ওঁকে, কিন্তু সত্যিকারের সাহস বলতে যা বোঝায় একমাত্র তা উনি আপনাদের কাছেই আশা করতে পারেন ও পেতে পারেন। কিরীটী চুপ করল।
ঘোষালের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সমস্ত ঘটনা শোনবার পর তাঁর অবস্থা কতকটা ন যযৌ ন তস্থৌ।
ভদ্রলোক বিমুঢ় ও বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। অসহায়ের মতই ঘোষাল কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
কিন্তু এ ব্যাপারে আমি যে ঠিক কি ভাবে ওঁকে সাহায্য করতে পারি, সেটা তো বুঝে উঠতে পারছি না মিঃ রায়। অবশ্য যদি উনি ভালো বোঝেন তো জন-দুই পাহারাওয়ালা এ বাড়িতে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য মোতায়েন করতে পারি!
কিন্তু তাতে করে বিশেষ কোন ফল হবে বলে কি আপনার মনে হয়, মিঃ ঘোষাল? কিরীটী ঘোষালের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
তবে কি ভাবে আমি সাহায্য করতে পারি বলুন! I would be always at your service! ঘোষাল বললেন।
তার চাইতে যদি কোন plain dress-এর গোয়েন্দাকে সর্বদা শতদলবাবুকে পাহারা দেবার জন্য নিযুক্ত করা যায়, কথাটা আমি বললাম।
না, না মিঃ ঘোষাল, ও-সব কিছুর প্রয়োজন নেই। তার চাইতে যা বলছিলেন, রাত্রে জন-দুই যদি পাহারাওয়ালা আমার এ বাড়িটা পাহারা দেবার জন্য পাঠাতে পারেন, আমি নিশ্চিত হতে পারি। শতদলবাবু আমার কথার প্রতিবাদ জানান।
কিরীটী নিঃশব্দে চোখ বুজে আপন মনে চেয়ারটার উপর বসে পা নাচাচ্ছিল, শতদলবাবুর প্রতিবাদে একটিবার মাত্র বোজা চোখ দুটি খুলে শতদলের মুখের দিকে তাকিয়েই আবার পূর্ববৎ পা নাচাতে লাগল।
শতদলবাবুর প্রস্তাবে কতকটা যেন নিশ্চিত হয়েছেন বলে ঘোষালকে মনে হল। তিনি কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তাহলে সেই ব্যবস্থাই করি, মিঃ রায়?
কিরীটী সহসা উঠে দাঁড়ায়, হ্যাঁ, আপাততঃ তাই করুন। আচ্ছা শতদলবাবু আমরাও তাহলে উঠি। আপনি তাহলে হরবিলাসবাবুদের অন্দরমহলে আনার ব্যবস্থা করুন আজই।
হ্যাঁ, তাই করব। তবে আপনার সাহায্যও কিন্তু আমি চাই, মিঃ রায়!
কিরীটী হাসল, তা অবশ্যই পাবেন বইকি। তা ছাড়া ব্যাপারটায় আমি নিজেও কম interested নই। চল সুব্রত,—কিরীটী দরজার দিকে অগ্রসর হয়। ঘোষালও আমাদের অনুসরণ করলেন।
সিঁড়ির শেষ ধাপে অবিনাশের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
কিরীটী হঠাৎ থেমে দাঁড়াল, অবিনাশ?
আজ্ঞে বাবু!
অনেকদিন এ বাড়িতে আছ, না?
হ্যাঁ, বাবু, মশাইয়ের কাছেই আমি তো পনের বছর চাকরি করেছি
হঠাৎ কিরীটী শতদলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, আচ্ছা শতদলবাবু কতদিন আগে আপনার ঘরের সেই ছবিটা ছিড়ে পড়েছিল বলুন তো?
তা দিনচারেক আগে হবে। শতদলবাবু জবাব দেন।
ব্যাপারটা তুমি জান অবিনাশ? কিরীটী ঘরে দাঁড়িয়ে এবারে অবিনাশকে প্রশ্ন করে, শতদলবাবুর ঘরের ছবি ছিড়ে পড়ে গিয়েছিল!
হ্যাঁ বাবু, দেখেছি। তাজ্জব ব্যাপার! অমন মোটা তারটা যে কী করে ছিড়ল—
ছেড়েনি তো–কেউ কেটে রেখেছিল তারটাকে! কিরীটী জবাব দেয়।
বলেন কি বাবু! বিস্মিত অবিনাশ কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
হ্যাঁ। তুমি আর রঘু ছাড়া তো বাড়ির মধ্যে কেউ ঢোকে না? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
আজ্ঞে না। তবে দিনকতক হল আমার ভাইপো এসেছে, বাবু তাকে চাকরিতে বহাল করেছেন দয়া করে।
ও! বাবুর রান্নাবান্না করে কে?
হিন্দুস্থানী ঠাকুর আছে একটা, বাবুর সঙ্গেই তো এসেছে। অবিনাশ জবাব দেয়।
কই, আপনি তো সেকথা বলেননি শতদলবাবু? কিরীটী প্রশ্ন করে শতদলের মুখের দিকে তাকায়।
মনে ছিল না। হ্যাঁ, ভুখনা আছে, আমার সঙ্গেই এসেছে, লোকটা বোবা আর কালা।
বোবা আর কালা! এমন রত্নটি কোথায় পেলে শতদল? প্রশ্নকারী রাণু দেবী।
লোকটা অনেকদিন থেকেই আমার কাছে আছে। জাতে ছত্রী। রান্না করে চমৎকার। শতদল জবাব দেয়।
কই ডাকুন তো, দেখি লোকটাকে! আমিই বলি।
অবিনাশ, ভুখনাকে ডেকে নিয়ে এস তো! শতদল অবিনাশের দিকে তাকিয়ে আদেশ করে।
অবিনাশ ভুখনাকে ডাকতে চলে গেল। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম সকলে।
আগের পর্ব :
০১. সাগর-সৈকত হোটেল
০২. আবার সমুদ্রের দিকে
০৩. হিরন্ময়ী দেবীই প্রথমে কথা বললেন
০৪. ভদ্রমহিলা রাণুর দিকে তাকিয়ে
পরের পর্ব :
০৬. দ্রষ্টব্য বটে ভুখনা
০৭. দ্বিতীয় প্রশ্ন করল কিরীটী
০৮. একটা ভারী বস্তু পতনের শব্দ
০৯. শেষ নির্দেশ
১০. এগিয়ে আসছে ছায়া-মূর্তি দুটো
১১. হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের প্রায় কাছাকাছি
১২. একটা বেদনার ঝড়
১৩. একজন সুশ্রী সুবেশা মহিলা
১৪. থানা-অফিসার রসময় ঘোষাল
১৫. হিরণ্ময়ী দেবীর কণ্ঠস্বর
১৬. দেওয়ালে টাঙানো অয়েল-পেন্টিং
১৭. কালো অন্ধকার রাত
১৮. রাস্তায় পৌঁছে হনহন করে
১৯. নিরালাতেই আমরা সকলে উপস্থিত ছিলাম