ছুটে চলা

ছুটে চলা

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে গিয়ে ই দেখি পুরো ফ্লোরে পানি। সকাল সকাল মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এভাবে পানি পড়ল কিভাবে? আরো বাড়তি একটা কাজ বেড়ে গেল। সবগুলো কাজ সময়মত করেও সময় পাই না নিশ্বাস নেওয়ার।

তখন ই খেয়াল করলাম পানির ফিল্টারের ঢাকনা টা ঠিকমত লাগানো না। বুঝতে বাকি রইল না কেন এমন হয়েছে। ঠিক তখন আমার শাশুড়ি পিছন থেকে এসে বললেন যে, উনি ফিল্টারে পানি নেই ভেবে পানি দিতে গিয়ে এই অবস্থা। কিছু বলতে পারছিলাম না। মনে মনে রাগ হচ্ছিল। গ্রাম থেকে কয়েকদিনের জন্য আসলে ই যত ঝামেলা যায় আমার উপর। সংসারের কাজ সহ নিজের চাকরী সব মিলিয়ে নিজের জন্য আলাদা সময় টুকুও পাই না। তার উপর এসব।

ফ্লোর পরিষ্কার করে নাস্তা বানালাম। একেক জনের একেক রকম নাস্তা রেডি করে টেবিলে ডাকলাম। নাস্তা করে রান্না সেরে আমি স্কুলের জন্য রেডি হলাম। একটা স্কুলে পড়াই আমি। ছেলেকে রেডি করে ওর বাবার কাছে মানে আমার হাজবেন্ড সঙ্গে দিলাম। সবকিছু যা যা দরকার শাশুড়িকে বুঝিয়ে দিয়ে নিজ গন্তব্যে রওয়না হলাম।

স্কুল শেষ করে বিকেল হয়ে যায় আসতে আসতে মাঝখানে স্কুল থেকে ছেলেকে আনতে হয়। সবকিছু মিলিয়ে সন্ধ্যায় একটু সময় পাই চা করে বেলকনিতে টেবিলে ছেলেকে পড়াতে বসাই। মাঝে মাঝে মা মানে শাশুড়ি এখানে এসে গল্প শুরু করেন তখন আরাফ ওর পড়া হোমওয়ার্ক বাদ দিয়ে গল্প শুনতে ব্যস্ত হয়ে পরে। কিছু বলিনা কয়েকটা দিনের জন্যে ই তো এসেছেন। আবার মাঝে মাঝে আরাফকে পড়ানোর সময় উনার ডাক পরে আরেক কাপ চা দিতে। ঠান্ডা পরেছে হয়ত তাই আবার খেতে ইচ্ছে করছে। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে দিতে যাই। একটু ফ্রি সময়েও শান্তি নেই।

ছুটির দিন আজ। সবকাজ শেষ করে সন্ধ্যায় বেলকনিতে গল্প করছিলাম আদিবের সাথে ও দুদিনের জন্য শহরের বাইরে যাবে এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ রুমার কল আসল। রুমা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড অনেক দিন পর। ফোনে কথা বলছিলাম তখন আবার শাশুড়ি ডাক দিলেন। আসছি বলে কথা বলতে বলতে ভুলে ই গেছি ডাকছিলেন যে। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসল।

দৌড়ে গিয়ে দেখি গরম পানি হাতে ফেলে হাত পোড়ে গেছে। ফুসকা পরে গেছে। আদিব এসব নিয়ে খুব রাগারাগি করল আমি কিছু না বলে এই ঝামলার মুক্তি কামনা করছি মনে মনে। কতদিনে এখান থেকে যাবেন। পরদিন আদিব শহরের বাইরে চলে গেল। আমি স্কুল শেষ করে একটু তারাতাড়ি বাড়ি ফিরলাম শরীরটা ভালো লাগছিল না। সন্ধ্যার পরে দেখি বিছানা থেকে উঠতে পারছি না জ্বরে একদম কাবু করে রেখেছে। চা’য়ের সময় আরাফকে পড়াতে হবে এসব কিছু রেখে বিছানায় ই পরে রইলাম চোখ বুজে।

একটু ঘুম ঘুম লেগে আসছিল তখনই অনুভব করলা আমার মাথায় কেউ জলপট্টি দিচ্ছে চোখ খুলতে ই দেখি আরাফ মানে আমার সাত বছরের ছোট্ট ছেলেটা জলপট্টি দিচ্ছে। তখন অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও কোথায় জানি সুস্থ হয়ে গেলাম। সন্তান একসময়ে ভরসার ছায়ার হাতের ছোঁয়া পেয়ে। আরেকটু খেয়াল করতে ই দেখলাম, আমার মাথায় কে জানি হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর মনে মনে কি বলে জানি ফু দিচ্ছেন।

আর বললেন, আমার হাত তো পুড়ে গেছে তাই ওরে বললাম জলপট্টি দিতে আর একটা ফু দিতে জানি জ্বর কমে আমার বাবা দিতেন। ঔষুধের নাম চিনি না তো মূর্খ মানুষ। ( শাশুড়ি) তখন কেন জানি মুখে হাসি ফুটে উঠল আমার। এই অসুস্থতায়ও ঐ মানুষটার জন্য কেন জানি খুব মায়া অনুভব করলাম। এভাবে সারারাত আমার পাশে বসা ছিলেন একহাত দিয়েও জলপট্টি দিচ্ছিলেন আরাফ তো ঘুমিয়ে পরেছে আমার পাশে ই। খুব ভোরে একটু ভালো লাগল মাকে ঘুমাতে বললাম উনি ঘুমালেন না। একটু সুস্থ লাগছিল তাই চা বানালাম দুজনের জন্য। স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে নিলাম।

ঔষুধ খেয়ে আরেকটু ভালো হলাম তবে পুরোপুরি না। আস্তে আস্তে রান্না করছিলাম খেতে তো হবে। বাইরের খাবার আবার খেতে পারেন না মা। আমি যতক্ষণ রান্না করছিলাম সবসময় আমার পিছু পিছু ছিলেন একহাতে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছেন নিজে হাত পোড়া নিয়েও আমি মানা করছিলাম তারপরেও। ভালো লাগছিল খুব এমন কোনো সময় হয়নি তো তাই হয়ত। সবসময় ঝড়ের বেগে কাজ করে কারো দিকে তাকানোর সময় পর্যন্ত পাইনি। কোনো রকম রান্না শেষ করে খেতে বসলাম। আর বললাম, অনেক কষ্ট হচ্ছে মা আপনার আমি অসুস্থ আর তার উপর আপনার হাত পোঁড়া।

আরে না না, আমার ই তো ভালো লাগে না একা একা। অনেকদিন পর এমন কিছু করতে পারছি তাও পুরোপুরি না তার জন্য খারাপ লাগছে। তুমি যাওয়ার পর সারাদিন একা থাকি বাসায় দম বন্ধ হয়ে আসে। তুমি আসলে ভালো লাগে তাইত দাদু ভাইয়ের পড়ার মাঝে গল্প শুরু করে দেই। সেটা আমারও খারাপ লাগে কি করব বল ভালো লাগে না সারাদিন একা একা।

কোথায় গিয়ে আমার অনুশোচনা হল নিজেকে নিজের কাছে খারাপ লাগল। এই যান্ত্রিক জীবনে যেন এরকম ভাবনা ভাবার চিন্তা করার মন বা সময়টুকু আমাদের নেই। এই মা তো শেষ বয়সে এসে একটা ভরসার জায়গা একটা আশ্রয় একটু সবার সাথে হাসিখুশি গল্প করে সময় কাটানো আশা করতে ই পারে। যেমনটা আমি কাল রাতে আমার ছেলের ঐ একটু হাতের ছোঁয়ায় পেয়ে ছিলাম আমার শেষ ভরসা সরুপ।

তাহলে এই মায়ের সেই চাওয়া টুকু তো থাকতে ই পারে। যানন্ত্রিকতা আমাদের কতটুকু দূরে নিয়ে যায় একটা শেষ বয়সে মায়ের আকুঁতি টুকু শোনার মত মন থাকে না আমাদের। আমরা এতটাই রোবট হয়ে যাচ্ছি। খুব ভালো ই কাটল দিন। অনেক দিন পর এক অন্যরকম সুখের দেখা পেলাম। বিকেলে মা কে আমি চুলে তেল দিয়ে চুল আচঁড়ে দিলাম। উনি আমাকে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু হাত পোঁড়া তাই মেয়ে ই না হয় মাকে দিলাম।

স্কুল থেকে দু তিন দিনের ছুটিটা কেমন করে যেন কেটে গেল। আবার যান্ত্রিকতা শুরু আরো দু দিন পর মাও চলে গেলেন গ্রামে তবে এই ১ম মায়ের গ্রামে চলে যাওয়ায় আমার মন খারাপ হল অন্য সময় মনে মনে খুশি ই হতাম। তবে আজ পুরো উল্টো যাওয়ার সময় বলে দিলাম খুব তারাতাড়ি যেন আসেন আবার।

কিছুদিন পর গ্রাম থেকে খবর আসল কোনো জরুরি কাজে সেখানে যেতে হবে। আমরা দেরি না করে চলে গেলাম যে যার মত ছুটি নিয়ে। সেখানে সমস্যা জমিজমা নিয়ে সম্পত্তি নিয়ে। ভাইয়ে ভাইয়ে সমস্যা ঝগড়া আদিবের এসবে এত ইন্টারেস্ট নেই তাই এত কথা বাড়ায়নি। যেভাবে যতটুকু পেয়েছে তাই ঠিক ওর কাছে। কিন্তু এসবে মাঝে একটা মানুষের কথা কেউ খেয়াল ই করল না।

মা আমার শাশুড়ি এসব দেখে কেমন একটা ভেঙে পরেছেন। উনাকে জোর করে নিয়ে আসলাম আমাদের সাথে উনি আসতে চাইছেন না তারপরেও নিয়ে আসলাম। ছুটি নিয়েছিলম মায়ের জন্য আরো দুদিন বাড়িয়ে নিলাম কারণ এখন মায়েদের চাওয়াটুকু বুঝতে পেরেছি আমি। দিন কাটছিল কিন্তু কোথায় যেন মা মন থেকে খুশি নেই সব ই করছেন তবে কেমন মন মরা আড়ালে আড়ালে।

আমি গ্রামে যোগাযোগ করলাম সবার সাথে। সম্পত্তি নিয়ে যাই হোক একজন মায়ের কি মন চায় তা বুঝা উচিত আমি আদিব মিলে ভাইয়াদের এক করে বাসায় আনলাম সেদিন মায়ের মুখে যে হাসি দেখেছি তা আমার বিবাহিত জীবনে এত বছরেও দেখিনি। সব সন্তানদের একসাথে হাসিখুশি দেখে মা কাঁদছিলেন। যতই যতকিছু নিয়ে দ্বন্দ্ব থাক সন্তান তো এতটুকু মায়ের জন্য করতে ই পারে।

খাওয়া দাওয়া শেষে মা আমাকে রান্না ঘরে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। আর কান্না করে আমার জন্য মন ভরে দোয়া করছিলেন। আমি যেন মায়ের সেই দোয়ায় জীবনের সব সুখ এক মুহূর্তে পেয়ে গিয়েছিলাম। এতটাই শান্তি লাগছিল মনে। শেষে একটি কথা বলললেন, মা রে তুই বউ হয়ে এসেছিলি মেয়ে হয়ে থেকে গেলি আমার। সত্যি এই যান্ত্রিক জীবনে মন বুঝে মেয়ে হয়ে উঠা অনেক বড় ব্যাপার এই মায়ের নীড়ে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত