এই শীতের সময় রাজশাহী শহরে মেয়েরা সাধারণত রাত এগারোটার পর রাস্তায় বের হয় না। এমন পরিস্থিতিতে রাত সাড়ে এগারোটার পর কোন মেয়ে যদি আপনাকে পেছন থেকে ডাক দেয় তাও আবার রাস্তার এমন কোন জায়গায় যেখানে আশে পাশে কোন মানুষ নেই। ব্যাপারটা যেকোন মানুষের কাছে বেশ অদ্ভুত ঠেকবে। আমার কাছেও তেমনই লেগেছিলো।
আমার একটা অভ্যাস আছে। ভালো নাকি খারাপ, বলতে পারবো না। তবে বেশ রাত করে আমি রাস্তায় হাঁটতে বের হই। এমনিতে দিনের বেলাতেও রাজশাহী শহর বেশ পরিষ্কার, ঝকঝকে। কিন্তু রাত! রাতের একটা মোহনীয় ব্যাপার থাকে। রাজশাহীতে সিএনবি নামের একটা জায়গা আছে। ঐখানের রাস্তাজুড়ে বেশ সুন্দর লাইটিং, সবমিলিয়ে হাঁটাহাঁটির জন্যে বেশ সুন্দর পরিবেশ । রাজশাহীর বেশিরভাগ উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তারা এই এলাকায় থাকেন, তাই এলাকাটা বেশ নিরাপদ। এজন্য সেখানেই আমার রাতের হাঁটাহাঁটি চালাতাম।
প্রতিরাতের মতো সেবারও হাঁটতে বেরিয়েছি এগারোটার দিকে। আমার মতো আমি হেঁটে চলছি, হুট করে পেছন থেকে একটা মেয়ে কণ্ঠের ডাক। “এইযে একটু থামবেন। ” আমি বেশ অবাক হয়েই পিছনে ফিরে তাকালাম। ল্যাম্পপোস্টের হালকা আলোতে মেয়েটার মুখ পুরোপুরি দেখতে পেলাম না। মেয়েটা দ্রুত পায়েই কাছে চলে আসলো। এইবার স্পষ্ট দেখতে পেলাম। হালকা-পাতলা গড়নের, আমায় বয়সী হবে হয়তো।
আমি বেশ কৌতূহল নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, “আমাকে বলছেন?” মেয়েটা উত্তর দিলো, ” হ্যা। আপনাকেই বলছি।” আমি বললাম, “জ্বী! বলুন।” মেয়েটা বললো, ” আমি আসলে অনেকক্ষণ থেকে আপনার পেছনেই ছিলাম। আজকে একা হাঁটতে ভালো লাগছিলো না, তাই ভাবলাম আপনার সাথে হাঁটি। কথা বলতে বলতে হাঁটা হবে।” কথাগুলো শোনার পর প্রথম যেই চিন্তা আমার মাথায় আসলো তা হলো মেয়েটা নির্ঘাত ছিন্তাইকারীদের কেউ। কিছুদিন আগে এই রাস্তাতে ছিনতাইয়ের খবর শুনেছিলাম।
মেয়েটার দিকে আবার ভালো করে তাকালাম। বেশ আধুনিক শীতের পোশাক কিন্তু যেই জিনিসটা দেখে বেশ ধাক্কা খেলাম সেটা হচ্ছে মেয়েটার পায়ে কোন জুতা নেই। একদম খালি পা। আমি যে কোন কথা না বলে মেয়েটার পায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম মেয়েটা বুঝতে পেরে নিজে থেকেই বললো, “আপনি হয়তো আমার খালি পা দেখে আমাকে পাগল কেউ ভাবছেন। আসলে শীতের সময় কেন জানি খালি পায়ে হাঁটতে আমার বেশ ভালো লাগে। একটু ঠান্ডা লাগে কিন্তু অনুভূতিটা সুন্দর।”
মেয়েটা তাগাদা দিলো, “এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি হাঁটবেন?” বেশ খানিকটা কনফিউশান আর ছিনতাইয়ের ভয় নিয়ে আমি মেয়েটার পাশাপাশি হাঁটা শুরু করলাম। ভাবলাম নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করি একটু হলেও ঘটনা বুঝতে পারবো। “আপনার নাম কি?” প্রশ্ন শুনে মেয়েটা আমার মুখের দিকে তাকালো একটু মুচকি হেসে বললো, “আমি তো ভেবেছিলাম আপনি কোন কথাই বলবেন না। এভাবে হুট করে রাস্তার মধ্যে আপনাকে বিরক্ত করলাম!”
আমি বললাম, ” আরে বিরক্ত বলছেন কেন। তবে অবাক হয়েছি, মিথ্যে বলবো না।” মেয়েটা জিজ্ঞেস করলো, “অবাক হয়েছেন কেনো?” আমি উত্তর দিলাম, “অবাক হবো না কেনো! যেভাবে হুট করে পেছন থেকে ডাক দিয়ে বললেন আমাকে অনেকক্ষণ থেকে হাঁটতে দেখেছেন এখন সাথে হাঁটতে চান। তাও আবার রাতের এই সময়ে। যে কেউ অবাক হবে।” মেয়েটা হেসে বললো, ” তা অবশ্য ঠিক। এখন তো বোধহয় বেশ রাত তাই না?” আমি ঘড়ি দেখলাম। দেখে বললাম, ” হ্যা। সাড়ে এগারোটা বাজে।” জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কিন্তু এখনো আপনার নাম বলেন নি?”
মেয়েটা আবারও হাসলো। রাতের আবছা আলোছায়াতে মেয়েটার হাসি অন্যরকম দেখালো। সুন্দর কিন্তু অন্যরকম। হয়তো এভাবে হুট করে রাতে দেখা হওয়াতে আমার এমন মনে হচ্ছে তবুও মেয়েটা বেশ আলাদা। তাড়াছা এতো রাতে কেউ খালিপায়ে হাঁটতে বের হয়। মেয়েটা হাসিমুখেই বললো, ” ভুলে গিয়েছিলাম। আমার নাম ইলোরা। আপনার নাম? ” আমি বললাম, “আমার নাম আশিক।” আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি কি প্রায় এভাবে রাতে হাঁটতে বের হন?” ইলোরা বললো, “প্রায় বের হই না। যেদিন খুব খারাপ লাগে সেদিন বের হই। তাহলে বুঝতেই পারছেন আজকে আমি বেশ খারাপ আছি।” কথাটা শেষ করেই একটু হাসলো।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এখনো কি খারাপ আছেন?” আমার কথা শুনে মেয়েটা হুট করে থেমে গেলো। মুখে হালকা আতঙ্কের ছাপ। আমার দিকে তাকিয়ে বেশ অদ্ভুতভাবে বলে উঠলো, ” আপনার সাথে আর যেতে পারছি না। আমার রাস্তা এখানেই শেষ। ভালো থাকবেন।”আমি কিছু একটা বলার আগেই মেয়েটা হুট করে আমার পাশ থেকে রাস্তার ঐপাশে চলে গেলো। তারপর পেছনের দিকে হেঁটে অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে গেলো। আমি তখনো অদ্ভুত হয়ে ঐদিকেই তাকিয়ে আছি। আরো অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম যখন দেখলাম আমার সামনে রাস্তায় লাইটগুলো জ্বলছে কিন্তু ইলোরা মানে মেয়েটা যেদিকে হেঁটে অন্ধকারে মিশে গেলো ঐদিকে রাস্তায় সব লাইট বন্ধ।
ভয়ের ব্যাপারটা তখনো আমার মাথায় আসে নি কারন আমি নিয়মিত এই রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করি। আর আমার মেস এই এলাকার পাশেই তাই সবকিছু আমার বেশ ভালো করে চেনা। কিন্তু পুরো ঘটনা আমার কাছে বেশ অদ্ভুত ঠেকলো। তারপরে আমি আর ঐখানে দাঁড়ালাম না, দ্রুত রুমে চলে আসলাম কিন্তু মাথা থেকে কেন জানি মেয়েটার কথা বের করতে পারছিলাম না। বেশ অদ্ভুত ভাবে আসলো আবার হুট করে চলে গেলো।যাইহোক ঐ রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে আকিবের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আকিব আমার রুমমেট, দুইজন আলাদা কলেজে পড়লেও সমবয়সী হওয়াতে আমরা বেশ ভালো বন্ধু।
আমি আড়মোড়া নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, ” কি হয়েছে ডাকিস কেন?” আকিব বললো, “তোকে কাল রাতেই বলবো ভেবেছিলাম কিন্তু তুই রুমে এসেই ঘুমিয়ে পড়লি তাই বলা হয়নি।” আমি একটু উঠে বসে জিজ্ঞেস করলাম, ” কি বলবি বল?” আকিব বললো, “তুই তো প্রায় আমাকে কলেজে রেখে আসিস। তো আমার ক্লাসের একটা মেয়ে অনেকদিন থেকেই তোকে দেখে। দেখে বলতে কি পছন্দ করে আর কি। এই কথা মেয়েটা গতদিনেই আমাকে বলেছে।”
এই কথা শুনে তো আমি বেশ খুশি। আকিবের কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি বললাম, ” এসব কথা কেউ দেরি করে বলে? তুই কালকেই বলে ফেলতি।” আকিব বললো, ” হ্যা কালকেই বলবো ভেবেছিলাম কিন্তু সকালে উঠেই আরেকটা খারাপ খবর শুনলাম।” আমি বললাম, “তোর খারাপ খবর রাখ। আগে মেয়েটাকে দেখা।” আকিব বললো, “আগে আমার কথা শেষ করতে দে!” আমি জোর করে বললাম, “আগে মেয়েটার ছবি দেখা তারপর বাঁকি কথা শুনছি।” আমার জোড়াজুড়িতে আকিব তার ফোনে মেয়েটার ছবি দেখালো।
ছবি দেখে মুহুর্তের মাঝে আমি থমকে গেলাম। গতরাতের সব ঘটনা মনে পড়ে গেলো। এটা তো গতরাতের সেই অদ্ভুত মেয়েটার ছবি। আমি বেশ অবাক হয়েই আকিবকে বললাম, “আরে এই মেয়েটার সাথে তো আমার গতকাল রাতে দেখা হয়েছে, কথাও হয়েছে।” আকিব আরো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” কখন দেখা হয়েছে?” আমি বললাম, ” এইতো কাল রাতে যখন হাঁটতে বের হলাম তখন। ঠিক করে বললে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে।” আকিব জিজ্ঞেস করলো, ” তুই সত্যি বলছিস তো? মজা করছিস না তো?” আমি বললাম, ” মজা করবো কেনো? সত্যিই গতরাতে এই মেয়েটার সাথেই আমার দেখা হয়েছে। মেয়েটার নাম ইলোরা না?”
আকিব অনেকটা উত্তেজিত হয়ে উত্তর দিলো, ” হ্যা নাম তো ইলোরা। কিন্তু মেয়েটা তো গতরাতে দশটার দিকে মারা গেছে। আমি এই খবরটাই তোকে এতোক্ষণ থেকে বলতে চাচ্ছিলাম। তুই সিওর গতরাতে এগারোটার পর এই মেয়েটার সাথেই তোর দেখা হয়েছিলো?” আকিবের কথা শোনার পর আমি পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমার নিশ্চিতভাবে মনে আছে গতরাতের পুরো ঘটনা। মেয়েটার পেছন থেকে ডাকা, মেয়েটার নাম, অদ্ভুত ভাবে চলে যাওয়া, সবকিছু স্পষ্ট মনে আছে।
সেদিন আকিব আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করে নি। আকিব ভাবছে আমি আগে থেকেই ইলোরাকে চিনতাম। তাকে ভয় দেখানোর জন্য আমি এমন কথা বলেছি। কিন্তু সত্যিটা আমি জানি। ইলোরা সেদিন রাত দশটায় মারা গেছে। কিন্তু আমার সাথে রাত সাড়ে এগারোটায় যেই মেয়েটার পরিচয় হয় সেই মেয়েটাও ইলোরাই ছিলো। কিভাবে হলো, কেনো এমনটা হলো আমি জানি না। আমি শুধু এতটুকু জানি আমার সাথে সেদিন রাত্রেই ইলোরার প্রথম পরিচয় হয়েছিলো আর সম্ভবত শেষ পরিচয়।