নজরুল ওর বাবাকে রাগী ভাবে চিৎকার করে বলছে,
-“তুমি এত্তো বড় সাহস পাইলা কই আমার বউয়ের নামে নালিশ দেও??” নজরুলের বাবা নজরুলের আচরণ দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়। নজরুল আবার বলে,
-“এখন চুপ কেন??আমার টাকায় আরামে খাইতাছো থাকতাছো ভালো লাগে না?? আবার আমার বউয়ের নামে নালিশ দেও!!”নজরুলের মা অন্যরুম থেকে দ্রুত ছুটে এসে নজরুকে গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলে,
-“মুখ সামলে কথা বল নজরুল!! কার সাথে কথা বলছিস জানিস??”নজরুলের স্ত্রী এসেও উপস্থিত হয়। নজরুল রাগী ভাবে বলে,
-“উনি আমারটা খেয়ে পরে কীভাবে ওর(স্ত্রী) নামে নালিশ দেয় হ্যাঁ?? আমি সবসময়ই দেখেছি উনি আমাকে অনেক শাসন করেছে অনেক মেরেছে। এখন আর আমি ছোট নাই। যে যা ইচ্ছা উনি করবে বা বলবে।” নজরুলের কথা শুনে ওর বাবার মন চাচ্ছে, তাকে যেন এখনই দুনিয়া থেকে নিয়ে যায়। নজরুলের বাবা অসহায়ের মতো বসে আসে৷ নজরুলের মা বলে উঠে,
-“অনেক বলেছিস আর একটা কথাও বলবি না। উনি তোর বাবা। আজ যদি এই সুন্দর দুনিয়াটা দেখে থাকিস তাহলে শুধু এই বাবার জন্য। আর সেই বাবার উপর আজ আঙুল তুলছিস?? কোন সাহসে??” নজরুল চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। নজরুলের মা ওর বাবার কাছে গিয়ে জোর দিয়ে বলে,
-“আজ এই মাটির উপর বউকে সাথে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস। বউয়ের জন্য বাবার সাথে খারাপ ব্যবহার করছিস। এই যে দাঁড়িয়ে আছিস, ভাবতো যখন ছোট ছিলি তখন কার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলি?? কে তোর হাত ধরে ধরে তোকে হাঁটা শিখিয়েছে?? মনে কর তো একটু। রাত ২/৩ টার সময় তুই কান্না করতি। এই সেই মানুষ যে তোকে ঘুম পড়াতো। তোর জন্মের পর থেকেই আমি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ি।
এই সেই মানুষ যে দিন রাত এক করে আমাদের দুজনের খেয়াল রাখতো। তোর জন্মের পর খাবার, জামা কাপড়, খেলনা আরো কতো কিছু এসব কিছুর খরচ কে চালিয়েছে?? এই মানুষটা৷ এই মানুষটার অল্প ইনকাম দিয়ে যখন তোর খরচ চলছিলো না তখন সারাদিন কষ্ট করে এসে রাত ১১ টা পর্যন্ত তোকে কোলে করে নিয়ে ছাত্র পড়িয়ে তোকে এত্তো বড় করেছে। আমাকে সুস্থ রেখেছে। কই একটা দিনও তো নালিশ করে নি। কই একবারও তো বলে নি, আমার ভালো লাগছে না। আর কি যেন বলছিলি, কোন সাহসে তোকে শাসন করেছে?? আজ শাসন করেছে বলেই তুই পড়াশোনা করেছিস। আর পড়াশোনা করেছিস বলেই আজ ভালো চাকরি করছিস। আর তুই বলিস তোরটা খেয়ে কীভাবে তোর বউয়ের নামে নালিশ করে!! হায়রে!!” নজরুল মাথা নত করে দাঁড়িয়ে শুধু চোখের পানি ফেলছে। নজরুলের মাও চোখের জল ছেড়ে দিয়ে বলে,
-“বাবা একজন পুরুষ মানুষ। তাই তার কষ্টের গল্পটা কখনো বলা হয়না, কখনো তুলা হয়না। সবসময় মায়ের গল্পটাই তুলে ধরা হয়। এই স্বামীই একজন বাবা। আর এই বাবার ফলেই মা’টা তার সন্তানকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকে। বাবা হলো এমন এক ছায়া বা ঢাল, যে সকল কিছু থেকে মা আর সন্তানকে রুক্ষা করে। এই চার দেয়ালের বাইরে গিয়ে ভালো করে দেখ, বাবা ছাড়া কয়টা পরিবার ভালো আছে?? কয়টা পরিবার সপ্তাহে অন্তত একদিন ভালো খাবার খায়?? কয়টা পরিবার ভালো জামা কাপড় পড়ে??
কয়টা পরিবার সুখে আছে?? দেখে এসে আমাকে বলিস। শোন, বাবা এমন একজন মানুষ যার মনে সারাদিন একটা কথাই চলে,”আজ যদি আমি মরে যাই তাহলে আমার পরিবার কীভাবে চলবে??” একজন বাবা কখনো শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। তার সর্বদাই চিন্তা থাকে কীভাবে পরিবারটা চালাবে। প্রথমে চিন্তা হয় ছেলে মেয়েকে মানুষ করা তাদের বড় করা আর তাদের পড়াশোনা। এরপর যখন বড় হয় তখন চিন্তা হয় বিয়ে দেওয়া। একজন মেয়ের বাবার কতটা যে চাপ সইতে হয় তা একমাত্র আল্লাহ আর উনিই জানেন। কারণ মেয়ের সাথে তাকে সারাজীবন সুখী রাখার জন্য অনেক কিছুই দিতে হয়। এইযে অনেক কিছু দেওয়া হয় তা কে আনে?? মা?? মা কি পারে এতোকিছুর যোগাড় করতে?? এতোগুলা টাকা কি মা পারে আয় করতে?? সমাজে বাবা ছাড়া মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায়না।
কারণ তারা জানে, বাবা যেহেতু নাই তাই কিছুই দিতে পারবে না। এই হলো সেই বাবা। যাকে কেন্দ্র করেই আমাদের বাঁচা মরা। বাবা থাকলে মুখে উঠে সোনার চামচ আর না থাকলে একবেলা ভাত খেতেই অনেক কষ্ট করতে হয়। এই সেই তোর বাবা। বাবারা কখনো মুখ ফুটে বলে না আমার কষ্ট হচ্ছে। বরং মুখ বুঝে হাজার কষ্টকে গিলে নেয় শুধু পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। স্কুল,কলেজ এবং মাদ্রাসা সব জায়গায়ই বাবার পরিচয়টা আগে লাগে। বাবার হাত ধরেই রাস্তাটা পার করে পুরো পরিবার। বাবার উপর নির্ভর করেই চলে একটা সংসার। আর সেই বাবার উপর তুই কে এমন যে আজ আঙুল তুলিস?? কে তুই??” নজরুল আর পারে না। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বাবার পায়ে পড়ে সাথে ওর স্ত্রীও। নজরুল বলে,
-“বাবা আমি তোমার কুলাঙ্গার সন্তান। তোমার মতো বাবার সন্তান হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। তুমি শুধু আমাকে মাফ করে দেও বাবা আমাকে মাফ করে দেও।” নজরুলের বাবাও কাঁদতে কাঁদতে নজরুলকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“আজ আমি বাবা। একদিন তুইও বাবা হবি। জেনে রাখিস, বাবারা হলো একেকটা নিশ্চুপ সৈনিক। যারা সারাজীবন শুধু লড়ে যায় পরিবারটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। আল্লাহর পরে মা হলেও তারপর কিন্তু বাবা। কারণ মা ১০ মাস ১০ দিন কষ্ট করে তোকে জন্ম দেয়। যা সব কিছুর ঊর্ধ্বে। আর বাবা কিন্তু সারাজীবন কষ্ট করে তোদেরকে বাচিঁয়ে রাখে। কখনো এটা ভুলিস না। বাবা-মাকে যে কষ্ট দিবে সে জীবনে কখনো ইহকাল কিংবা পরকাল কোথাও ভালো থাকবে না।” নজরুল ওর বাবা-মার কাছে শুধু মাফ চাচ্ছে। কিন্তু ও জানেই না, ওর বাবা-মা ওকে সেই কবেই মাফ করে দিয়েছে।
-“বাবা এমন একজন মানুষ যে পাশে থাকলে তুমি রাজা আর না থাকলে তুমি অন্যের প্রজা।”