অবলার আর্তনাদ

অবলার আর্তনাদ

সেদিন করিম ভাইয়ের বিয়েতে প্রথম শাড়ি পরে ছিল রুমকি কিন্তু খেয়াল রাখতে পারেনি যে ওর পেটের কাছে অনেকটা অংশ খোলাই রয়ে গেছে! কাধের উপর হাত রেখে যখন বিনয় কাকু তার শক্ত হাতটা দিয়ে ওর কাধে হালকা চাপ দিয়েছেন তখনও তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারেনি রুমকি কিভাবেই বা বুঝবে! বিনয় কাকুকে অনেক শ্রদ্ধার চোখে দেখতো সবাই, সব সময় হাসিখুশি থাকেন সবার সাথে। আর তখন রুমকির বয়স ছিল মাত্র পনেরো! তার উপর মেয়েটা বড়ই সহজ সরল।

শাড়িটাও ছিল মায়ের তাই অতটুকুন বয়সে অতো বড় শাড়ি ওর পক্ষে সামাল দেয়া মোটেই সহজতর ছিল না।
ছোট থেকে খুব চঞ্চল প্রকৃতির ছিল বলে নিজেকে উঠতি বয়সী মেয়ে ভেবে কখনো সংযত করার চিন্তাটাও কখনো মাথাতেই আসেনি ওর। সারাদিন পারার এঘরে ওঘরে ঘুরে বেড়াতো ও আর ওর সাথে থাকতো পিলু! পিলু ওবাড়ির অনেক পুরনো সদস্য। রুমকির বড় ভাই একদিন কোথা হতে যেনো একটা ছোট্ট কুকুর ছানা এনেছিল বছর পাঁচেক আগে। আর নাম রেখেছিল পলা! পলা বড় হয়ে বাচ্চা দেয়ার পরে ধীরে ধীরে সব গুলো কোথায় যেনো হারিয়ে গিয়েছিল চাকরির উদ্দেশ্যে ভাইজান বাড়ি ত্যাগ করার পরে রুমকি তখন ছোট ছিল।

একদিন হঠাৎ কোথা হতে যেনো একটি কুকুর ছানা এলো ওদের বাড়িতে আর রুমকি মনে করে নিলো এটা আগের সেই পলার ছেলে! এজন্য ও সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেয় এটা ওদের বাড়ির পুরনো সদস্য বলে পলার ছেলে ভেবে রুমকি এই কুকুরটার নাম রেখেছে পিলু! প্রতিদিন বিকেল হলেই রুমকি বেরিয়ে পরে পিলুকে নিয়ে পারা বেড়াতে। মা সব সময় বকা দিতেন ওরে কারণ ততোদিনে রুমকি কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিয়েছে নিজের পরিবর্তন রুমকি কখনোই আন্দাজ করতে পারেনি, সেই যদি পারতো তবে কি আর ওড়না কোমরে বেধে ঘুরতো! পারায় বিনয় কাকুরা অনেক আগে থেকেই বসবাস করছে কিন্তু তাদের পরিবারের কাউকে কখনো খারাপ চোখে দেখেনি কেউই।

বছর দুই হলো বিনয় কাকুর স্ত্রী অসুস্থ, কোনোরকম রান্নার কাজটা করেন তিনি আর তাদের ছেলে আজিজ থাকে ঢাকাতে। মাসের মধ্যে কয়েকবারই বিনয় কাকুকে হাসপাতালে থাকতে হয় তার স্ত্রীকে নিয়ে। আর খাওয়ার জন্য নিজেই টুকটাক রান্না করেন একা ঘরে মা আজকাল প্রায়ই রুমকিকে বেশ তুলোধুনো করে কটু কথা বলেন! এইতো কাল সন্ধ্যার পরে যখন রুমকি ঘরে ফিরলো, “তোর কি লাজ শরম নাই ছেরি! এতো ডাঙ্গর হইছো এহোনো বুক মেলা দিয়া পারায় ঘোরো!! “কি হইছে মা! আমিতো এমনই চলি আমি কি বড় হইছি কও?” “পোরা কপাল আমার! একটা মাইয়া হইলো তাও কোনো জুইতের হইলো না মায়ের কথা গুলো রুমকির বোধগম্য হয়নি। মা কেনো এসব কথা বলে তাও রুমকির বুঝে আসে না। সহজ সরল এতোই ছিল যে নিজের বাঁক গুলো হেফাজত করার মতো বুদ্ধি বা এমন চিন্তা কখনো ওর মাথা তেই ছিল নাহ কদিন আগে পারা থেকে বড়লোক পরিবার চলে গেছেন, যাওয়ার আগে তারা রুমকিকে কয়েকটা জামা আর কিছু সাজসরঞ্জাম দিয়ে গেছেন। ওগুলো ঘরে নিয়ে এসে রুমকির সে কি খুশি, এমনিতেই ফর্সা গড়নের রুমকি সব সময় সাজগোছ করেই থাকে। সারাক্ষণ চোখ ভর্তিথাকে কাজলে, আর ঠোঁটে থাকে গাঢ় লিপস্টিক! মুখে পাউডার মেখে নেমে পরে পিলুকে নিয়ে।

বড়লোক পরিবারের দেয়া জামা আর সাজসরঞ্জাম নিয়ে যখন খুশি মুখে ঘরে আসছিল তখন রুমকিকে দেখলে যে কারো মনে হবে আকাশের পরী নেমে এসেছে! এতো সুন্দর করে রুমকি হাসতে পারে তা হয়তো মাও কখনো দেখেননি বড়লোক পরিবারের লোকজনের মধ্যে বেশির ভাগই থাকেন ঢাকায়। তাদের বাড়িতে দুটো বুড়ো-বুড়ি, রুমকির বয়সী একটা মেয়ে আর ওর বাবা মা। এ পারায় সবচেয়ে ধনী বলতে ওদেরই চিনে সবাই কারণ মিজান কাকুর দুইভাই ঢাকায় বড় চাকরি করেন আর মিজান কাকু এখানে ঠিকাদারি করেন। রুমকির খুব ভাল বন্ধু হয়ে গেছিল ওবাড়ির প্রিয়ার সাথে। প্রায়ই দ্বিপ্রহরের পরে প্রিয়াদের ছাদে বসে খোশগল্প করতো ওরা। ঘরে এসে প্রিয়ার গুনগান করেনি এমন কোন দিন যায়নি রুমকির কিন্তু খানিক পরে যখন ওরা চলে যাচ্ছে এটা বুঝতেই রুমকির কান্না আর দেখে কে!

ওদের দেয়া উপহার গুলো তখন নিমিষেই মূল্যহীন হয়ে গিয়েছিল রুমকির কাছে রুমকির প্রিয় প্রিয়া চলে যাওয়াই জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে ওর জীবনে! প্রিয়া চলে যাওয়ার পর থেকে প্রায়ই রুমকি ওদের বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করতো বিষন্ন মনে। পাগলীটা তো বুঝতোই না যে কখনো আর হয়তো দেখা হবে না ওর বান্ধবীর সাথে! কখনো কখনো পিলুকে নিয়ে ওদের বাড়ির সিঁড়িতে বসে থাকতো আর পিলুর সঙ্গে একা একা কথা বলতো। কি সহজ সরলই না ছিল রুমকি বিনয় কাকুর ঘরটাও ছিল ঠিক ওবাড়ির সম্মুখে, বিনয় কাকু প্রায়ই দেখতো রুমকিকে ওখানে বসে থাকতে। মাঝে মাঝে সেও রুমকির সাথে এসে কথা বলতো গল্প করতো সিঁড়িতে বসেই। ধীরে ধীরে বিনয় কাকুর সাথে অনেকটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল রুমকির কারণ একাকিত্ব মানুষকে যেকোনো ভাবে পরিবর্তন করে দিতে পারে! প্রিয়া চলে যাওয়ায় রুমকির মনে ওর জন্য যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তার ইতি ঘটেছে বিনয় কাকুর সাথে কাটানো সময় গুলোর মাধ্যমে।

মা আজ হতভম্ব হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে রুমকির দিকে তাকিয়ে, মায়ের হাতের পানির গ্লাসটা নিচে পরে ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে। ওঘরে বাবা বসে রেডিওতে গান শুনছিলেন, গ্লাস ভাঙার শব্দে রুমকির ঘরে এসে দেখে বমি করে ক্লান্ত শরীরে শুয়ে পরেছে রুমকি। মায়ের চোখ দিয়ে পানি ঝরছে অঝোরে অজানা ভয় ঘিরে আছে মাকে! অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে রুমকির, শুধু রুমকির নয় তার সাথে বাবা-মায়ের ও!! গ্লাসের কাচ পারিয়ে রুমকির দিকে ধেয়ে যাচ্ছে মা ভাঙা কাচ পায়ে বেধে রক্তক্ষরণ হচ্ছে মায়ের পা থেকে কিন্তু সেদিকে কোন হুশ নেই মায়ের! বাবার চোখদুটো হঠাৎই কেমন যেনো ছলছল করছিলো।

কান্নার মাঝেই মা গায়ে হাত তুললেন তুমকির! থাপ্পড় দিতে দিয়ে জিজ্ঞেস করছে এই সর্বনাশের কারণ এর জন্য দায়ী ব্যক্তির কথা! কিছুই বুঝতে পারছে না রুমকি, অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে! “আব্বা আব্বা! মা আমারে মারতাছে আব্বা, আব্বা আমার খুব লাগছে তুমি মায়রে কিছু কও না ক্যা! আমি কিছু করিনাই তো আব্বা বাবা ততক্ষণে এঘর প্রস্থান করে তার ঘরে চলে গেছেন। বুকে আজ পাথর বেধে রুমকির ব্যাথা সহ্য করছেন তিনি রেডিওটা বন্ধ করে ঘর থেকে বাইরে চলে গেলেন বাবা। কাল বিকালে রুমকির জন্য পাত্রপক্ষ দেখতে আসার কথা রয়েছে তাই বাবা যাচ্ছেন দোকানের ল্যানলাইন থেকে তাদের আসতে নিষেধ করতে!!

পঞ্চাশঊর্ধ বুড়োর পক্ষে এটা ছাড়া আর করারই বা আছে কি! মেয়ের এই অবস্থার জন্য কার কাছে যাবে! কে করবে তার সাহায্য! সবাই তো উৎসুক জনতার ন্যায় মজা লুটবে মা হাজার চেষ্টা করেও রুমকির কাছ থেকে জানতে পারলো না কিছুই। বাবা আসার পথে কি যেনো কিনে আনলেন দূরবর্তী এক ঔষধালয় থেকে! বাসায় ফিরে মাকে ডাক দিয়ে ওঘরে নিয়ে গিয়ে কি যেনো বললেন বাবা রুমকি স্পষ্ট বুঝতে পারছে মা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছেন বুক ফাঁটা নিশ্চুপ আর্তনাদে।

মায়ের কান্না রুমকি হেসে উড়িয়ে দিতো সব সময়ই, হয়তো বুঝতোনা মায়ের কান্নার কারণ, মায়ের কষ্টটা। কিন্তু আজ রুমকি হাসতে পারছে না, কি যেনো খাইয়েছেন মা রুমকিকে! রক্তক্ষরণ হচ্ছে! পেটে ব্যাথায় রুমকি কাতরাচ্ছে। আশেপাশের মানুষজন টের পাওয়ার ভয়ে মা রুমকির মুখ চেপে গুনগুনিয়ে কাঁদছে বাবা রেডিওর ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে শুয়ে আছেন তার বিছানায়, বালিশে হাত পরতেই তার খেয়াল হলো বালিশটা ভিজে গেছে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত