সময়

সময়

“মা তুমি বাবাকে মারছ কেন? বাবা তো কষ্ট পাচ্ছে।” কথাটা শুনে হাসব কি কাঁদব বুঝতে পারছি না। সদ্য ঘুম ভাঙা মেয়েটার দিকে দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে বললাম দেখো মামনি তোমার মা আমাকে মারছে,,, তোমার মা খুব বাজে,মেয়েটা আধো আধো ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল “মা খুব দুষ্টু হয়েছে পানিশমেন্ট দিতে হবে। আমাদের স্কুলে কেউ দুষ্টুমি করলে মেম তাকে পানিশমেন্ট দেয়।” সিঁথির কথা শুনে নিশি আমার বুক থেকে সরে গিয়ে বলল, “বাবা মেয়ে এক হয়েছে। দুষ্টুমি করবে বাবা মেয়ে দোষ দেবে আমায়।” বলেই লাজুক হাসি দিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো। আমি সিঁথির কপালে একটা চুমু দিলাম। এই মা মেয়ে দুজনকে নিয়েই আমার পৃথিবী। সিঁথি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার। আর নিশিকে আমি যতবার দেখি ততবারই নতুন করে প্রেমে পড়ি।

সকালের নাস্তা করার পর রেডি হচ্ছি দেখি নিশি গাল ফুলিয়ে বসে আছে। ওকে নাকি আজ আমাকে শাড়ি পড়িয়ে দিতে হবে নাহলে সে যাবে না। মেয়েটা এতো অভিমান কিভাবে করে মাঝে মাঝে বুঝিনা। তবে ওর অভিমান ভাঙাতে ভালো লাগে আমার। ও যেদিন রাগ অভিমান করে না সেই দিনটি বরং আমার কাছে লবন ছাড়া তরকারির মতো মনে হয়। তাই মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই রাগাই। ওকে শাড়ি পড়িয়ে নিজে রেডি হয়ে নিলাম। শাড়ি পড়লে নিশিকে অপ্সরীর মতো লাগে। নিশি দেখতে যে আহামরি সুন্দরী তা কিন্তু নয়। কিন্তু আমার চোখে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী। নীল শাড়ির সাথে নীল চুড়ি চোখে হালকা কাজল। সত্যিই ভালো লাগছে।

সৌরভের বাসার সামনে এসে কলিং বেল চাপতেই সৌরভ দরজা খুলে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলো। ওর কান্না‌ দেখে নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আমিও বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকলাম। প্রায় সাত বছর পর বেষ্ট ফ্রেন্ডসদের সাথে দেখা করতে এসেছি। রাত্রির বিয়ের পর ওরা অনেক যোগাযোগের চেষ্টা করলেও আমি যোগাযোগ রাখিনি। “ওনাদের ভেতরে আসতে দিবে তো নাকি দরজাতেই দাড় করিয়ে রাখবে।” নিশির বয়সি একজন মেয়ে এসে কথাগুলো বলল। সৌরভ আমাকে ছেড়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বলল “ভেতরে আয়।” মেয়েটা কে? প্রশ্ন করতেই সৌরভ মুচকি হাসি দিয়ে বলল “তোর ভাবি।আর ইনি মনে হয় আমার ভাবি” বলে সৌরভ নিশির দিকে তাকালো। ওরা আলাপ করতে করতে ভেতরে ঢুকলো। আমিও ওদের সাথে ভেতরে আসলাম।

ভেতরে তাকিয়ে দেখি সোফায় চাঁদের হাট বসেছে।রায়াতকে দেখে চেনাই যাচ্ছে না। এই কয়েক বছরে এতো পরিবর্তন। যাকে সবাই পাতলু খান বলে ডাকতাম সে এখন রীতিমতো কুমড়োপটাশে পরিণত হয়েছে। রায়াতের পাশে একটা মেয়ে মনে হয় রায়াতের বউ। তার পাশেই সীমি । সীমি কে দেখেও চেনার উপায় নেই। অনেকটা শুকিয়ে গেছে। সেই স্টাইলিশ লোক, মেকআপ নেই। সীমির পাশে তাকাতেই চোখগুলো অজানা কারনে ঝাপসা হয়ে আসলো।

সেই মুখ যে মুখের দিকে তাকালে মনে হতো পৃথিবীর সব সৌন্দর্য স্রষ্টা তাকেই দিয়েছে। যার জন্য নিকোটিনের ধোয়ায় নিজেকে পুড়িয়েছিলাম দিন রাত,বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম সেই রাত্রি। এখনো আগের মতোই আছে।কিন্তু আজ ওকে দেখে শুধু মনে হচ্ছে কি পাগলামিই না করেছি এই মেয়েটার জন্য। আজ সে দুই সন্তানের মা। স্বামী সন্তান নিয়ে হয়তো ওর দিনগুলোও ভালোই কাটে। আমাকে দেখেই রায়াত সীমি জড়িয়ে ধরল। শুধু রাত্রি দূর থেকে বসে দেখছে। ওর চোখেও পানি। বন্ধুত্বে ভালোবাসা শব্দটি যোগ না হলে হয়তো রাত্রিও এসে জড়িয়ে ধরতো। মাঝে মাঝে বেশি কাছের মানুষদের সাথে দূরত্বটা একটু বেশি হয়ে যায়। আমি আর রাত্রিও হয়তো তাদেরই দলে।

সৌরভের বাসায় খাওয়াদাওয়া পর্ব সেরে সবাই গল্প করতে বসলাম। গল্প করার মধ্য দিয়েই জানতে পারলাম, রায়াত কলেজের প্রফেসার। ওর বউও প্রভাষক। সৌরভ ব্যাংকের ম্যানেজার। সীমি একটা কোম্পানির সিনিয়র অফিসার। কলেজে সৌন্দর্য আর স্টাইলের জন্য অনেক খ্যাতি ছিলো ওর। স্টুডেন্টরা এমনকি স্যাররাও ওর উপর ক্রাশ খেতো।কিন্তু ও ছেলেদের সাথে টাইমপাস করত শুধু। কিছু ছেলে ওর জন্য দেবদাসও হয়েছে। আমরা ওকে বুঝাতাম কারো মন নিয়ে খেলা ঠিক নয় কিন্তু ও বুঝতে চাইতো না।।আসলে কথায় আছে যে অন্যের সাথে যেমন করে তার জন্যও তেমন কিছুই অপেক্ষা করে। বিয়ে হয়েছিলো ধনাঢ্য পরিবারের ছেলের সাথে। হাজবেন্ডের নির্যাতনের জন্য সংসার করা হয়ে ওঠে নি। তারপর অন্য জায়গায় বিয়ে হয়। হাজবেন্ডও ভালো ছিল। কিন্তু বিয়ের দুবছরের মাথায় মারা যায়। এখন একাই থাকে। রাত্রির হাজবেন্ড বড় বিজনেসম্যান। রাত্রিকে নাকি খুব ভালোবাসে। যে রাত্রি এক গ্লাস পানি নিজ হাতে নিয়ে খেতো না সে আজ দুই সন্তানকে মানুষ করছে।

সংসার করছে গুছিয়ে। মেয়েদের এই এক গুন বাপের বাড়িতে কিছু করুক আর না করুক স্বামীর সংসারে সব গুছিয়ে নিতে পারে। গল্প করতে করতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর নিশি সিঁথিকে নিয়ে বেড়িয়ে এলাম। কেনো জানি মনে হলো অনেকবছরের চাপা কষ্ট অভিমান দূর হয়ে গেলো। রাস্তায় হাটঁছি আর অতীতের কথাগুলো মনে পড়ছে এক সাথে সবার স্কুল কলেজ লাইফ কতো দুরন্ত ছিলাম, আনন্দ কষ্ট ভাগাভাগি করে নিতাম। পাগল ছিলাম এক একটা। হাসি-আড্ডা,হৈচৈ এ দিন কেটে যেতো। এমন ‌সময় ছিলো পাঁচজনের একজনের সাথে এক দিন কথা না বলে থাকতে পারতাম না। আর এখন সবাই ওয়েল সেটেলড ।কিন্তু সেই আড্ডা আর বন্ধুবান্ধবদের কাছে পাওয়া হয় না। সবাই যার যার কাজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত। অতীত যতই মধুর হোক সেখানে যেমন ফিরে যাওয়া যায় না তেমনি বর্তমান যেমনি হোক তা মেনে নিতে হয়।

আমি কখনো ভাবি নি রাত্রি ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসতে পারব। আর এখন নিশিকে পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। সত্যিকার অর্থে সময় বর্তমান আর ভবিষ্যত নির্ধারন করে দেয়। জীবন থেকে কিছু প্রিয় উপাদান যেমন হারিয়ে যায় সময়ের স্রোতে তেমনি সৃষ্টিকর্তা নতুন উপাদান দিয়ে জীবন নব রঙে সাজিয়ে দেয়। হয়তো এটাই বাস্তবতা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত