রিমুর বাঁ গালে কষিয়ে চড় মেরে ফারজানা রহমান জিজ্ঞেস করলেন,
-“কোথায় গিয়েছিলি রিকশায় করে ঐ ছেলের সাথে”? মায়ের সব জানতে পারা নিয়ে না ঘাবড়ালেও মায়ের কাছ থেকে বাবা জেনে যাবে ভেবেই ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিলো রিমু। মা কে এড়িয়ে ঘরে ঢুকতে যাবে অমনি তার বাবা রাসেল শেখ ঘরে চলে এলেন। মেয়ের গালে আঙ্গুলের ছাপ আর স্ত্রীর তিরস্কার শুনে কিছু ঢাকা রইলো না তার কাছে। ফারজানা রহমান চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, “স্কুলে না গিয়ে রিকশায় করে একটা বস্তির ছেলের সাথে ফ্যান্টাসি করে বেড়ায় তোমার মেয়ে!! ছিঃ লজ্জায় আমি মরে যাবো”! রাসেল শেখ আগাগোড়া সব জেনে শান্ত গলায় মেয়েকে বুঝিয়ে বলেন,
– “ঐ ছেলে কে ভুলে যাও রিমু..” বাবার মুখ থেকে একথা শুনে ফুঁসে উঠে রিমু বললো,
-“কেন ভুলে যাবো? আমার নিজের পছন্দের কোন দাম নেই?
আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি বাবা, আমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমায় নিতে দাও।” ১৫ বছর বয়সেই মেয়ের মুখ থেকে এমন উত্তর শুনে কিছু সময়ের জন্য মৌন হয়ে গেলেন রাসেল। রেগে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে পানি ভর্তি জগটা নিচে ছুঁড়ে ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি ।
জগের ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো গুলো সারা ঘরে ছড়িয়ে আছে, ফ্লোরে ছোপ ছোপ রক্ত। হয়তো কাঁচ লেগে রিমুর পা কেঁটেছে। রাগে ফুঁসে কাঁদতে কাঁদতে রুমের দরজা লাগালো রিমু। ঘরের ভেতর হঠাৎই ঝনঝন আওয়াজ, হয়তো ঘরের কর্ণার ফুলদানি টা ভেঙ্গে ফেলেছে রিমু। মেয়েটা স্বভাবে কিছুটা তার বাবার মতো, রাগ হলে জিনিসপত্রে তা মিটায়। অশান্তি তে মাথাটা ধরে এসেছে ফারজানার , মাথায় হাত দিয়ে দেয়াল ঘেঁষে মেঝেতে বসে পরলেন তিনি।মাথায় একটাই কথাই ঘুরছে, কিভাবে বুঝাবেন মেয়েকে যে ছেলে টা ভালো নয় নেশাখোর! প্রায় মাঝ রাত্রে বাড়ি ফিরেন রিমুর বাবা রাসেল শেখ, তার দু’চোখ লাল। তিনি সচরাচর ধূমপান করেন না তবে যখন করেন তখন মাত্রাতিরিক্ত করেন, সেটা তার চোখ দেখলেই বুঝা যায়। ফারজানা রহমান শুয়ে ছিলেন, রিমু সারাদিন না খাওয়া ভাবতেই তার রাগ গুলো কেমন যেন চুপসে গেলো। রিমুর ঘরের দরজা টা ভিরানো, ফারজানা রহমান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নীরস গলায় ডেকে বললেন,
-“রিমু খেতে আয়।” ভেতর থেকে কোন সাড়া না পেয়ে তিনি ধাক্কা দিয়ে দরজা টা পুরো পুরি খুলে দিলেন, লাইটের সুইচ অন করতেই দেখেন সারা ঘর এলোমেলো, রিমু নেই! বাথরুম, বারান্দায় খুঁজে এসে ব্যস্ত গলায় ডেকে উঠেন,
-“রিমুউউ কোথায় গেলি??”
বিছানার এক কোণে বইয়ের নিচে একটা কাগজ, কাগজ টা দেখেই হাত পা কেমন অবশ হয়ে এলো ফারজানা রহমানের। কাঁপা হাতে কাগজ টা তুলে নিলেন তিনি, কাগজ টায় গোটা গোটা অক্ষরে দুই লাইন লেখা, “আমাকে ক্ষমা করে দিও মা, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে আজ তোমার অবাধ্য হলাম! ”
লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলেন ফারজানা রহমান, সারা শরীর ঘেমে নেয়ে গেছে তার। বিছানার পাশে রাখা পানির গ্লাস টা হাতে নিয়ে এক শ্বাসে সব টুকু পানি শেষ করলেন। ” ইসসস কি জঘন্য দুঃস্বপ্ন! ” বিরবির করে বললেন ফারজানা, ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় রাত ৩ টা বাজে। চশমা টা চোখে দিয়ে স্যান্ডেল গুলো পরতে পরতে মেয়ের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন ফারজানা রহমান। ড্রীমলাইটের আলোয় স্পষ্ট নয় রিমুর মুখচ্ছবি, গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে রিমু। এইতো সবে ৯ম শ্রেণীতে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে মেয়েটা, বয়স কেবল পনেরো। বড্ড চঞ্চল আর জেদি মেয়ে, অথচ ওকে নিয়ে রাত বিরাতে কতো দুঃস্বপ্ন! চোখ দুটো ভিজে ওঠে ফারজানা রহমানের, মেয়ের কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসেন ফারজানা। বিছানায় শুতে যাবেন অমনি রাসেল শেখ বলেন,
– “এক দুঃস্বপ্ন আর কতদিন ফারজু? তোমাকে ডা. দেখাতে হবে। ” ফারজানা রহমান জবাব দেন না পাশ ফিরে চোখ মুছেন। সকাল সকাল ব্যাগ গোছাতে দেখে রিমুর বাবা রাসেল শেখ কিছুটা অবাক হয়ে তার স্ত্রী কে জিজ্ঞেস করেন,
-“ফারজু কোথাও যাবে?” ফারজানা রহমান কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দেন,
-“মাফ চাইতে যাবো।” রাসেল শেখ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন,
-“কার কাছে??”
-“বাবা মায়ের কাছে!” মুহূর্তেই রাসেল শেখের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। নিস্তেজ স্বরে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন,
-“আজ এত বছর পর?”
ফারজানা রহমানের চোখ ছলছল করছে, স্বামীর দিকে চেয়ে ভাঙ্গা গলায় উত্তর দেন, “সেদিন বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে সুখে থাকতে না চাইলে দুঃস্বপ্নে সারাটা জীবন কাটাতে হতো না, নিজ কৃতকর্মের ফল স্বরূপ আমি আমার সন্তান কে হারাতে পারবো না রাসেল ”! রাসেল শেখ প্রতিউত্তর করেন না শক্ত করে স্ত্রীর হাত চেপে ধরে চোখ বুজেন।
গাড়ি ছুটে চলেছে, ফারজানা রহমান গাড়ির জানালায় মাথা রেখে চোখ বুজে আছেন, “চোখের সামনে স্পষ্ট ভাসছে আজ বাবার সহজসরল মুখটা। সেই উচ্চমাধ্যমিকে ফাস্টক্লাস পাওয়ার পর বাবার গর্বিত মুখখানি! হয়তো আমি পালিয়ে আসার পর আর কখনো বাবা আমাকে ভেবে গর্বিত হননি! আচ্ছা আমার মত বাবাও কি সন্তান হারিয়ে ফেলার ভয়ে মাঝ রাত্রে এভাবে লাফিয়ে উঠতেন? খুঁজতেন আমায়? আমি নিজের সুখ খুঁজে নেওয়ার পর অবুঝের মতো কাঁদতেন? ইসস সন্তান হারানোর বেদনা যে মৃত্যুসম, কি করে সইতেন তিনি ? ক্ষমা করবেন কি আমায়?” ভাবতে ভাবতে ফারজানা রহমানের চশমার ফাঁকে পানি বেয়ে পরে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়! গাড়ি যত সামনে ছুটে যাচ্ছে ততই যেন তার মনে হচ্ছে পরিনতী এইতো আর কয়েক পা দূর! হয়তো করে যাওয়া অন্যায় টা সয়ে যেতে হবে শীঘ্রই, কারণ পৃথিবীটা যে গোলাকার!