১৮. রাতের আঁধারে অনুসরণ:
রাত্রি কত হবে কে জানে? সুব্রত আর কিরীটী পাশাপাশি এক শয্যায় শুয়ে। সুব্রত বোধ হয় অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। তার গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ বেশ স্পষ্ট শোনা যায়।
ও-পাশের একটা খাটে ঘুমিয়ে আছে রাজু। সেও গভীর নিদ্রায় অচ্ছিন্ন।
গত দু রাত্রি কিরীটীর ভাল করে ঘুম হয়নি। কাজেই দু চোখের পাতা এবারে ঘুমে ভারী হয়ে আস্তে আস্তে বুজে আসে।
কিন্তু সহসা মাঝরাত্রে অত্যন্ত গরম বোধ হওয়ায় কিরীটীর ঘুম ভেঙে গেল।
রাত্রি কত হয়েছে ঠিক নেই। কিসের যেন একটা অস্পষ্ট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মনে হল যেন পাশের অন্ধকার ঘর থেকে শব্দটা আসছে!
কিরীটী উৎকর্ণ হয়ে ওঠে। পাশেই সুব্রত গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন, তার নিদ্রার কোন ব্যাঘাত হয়েছে বলে তো মনে হয় না।
হ্যাঁ, কার যেন সাবধানী পায়ের নিঃশব্দে চলাচলের অপষ্ট মদ, আওয়াজ। এত রাত্রে পাশের ঘরে কে?
খানিক পরে সে শব্দটা আর শোনা গেল না।
কিন্তু আবার! হ্যাঁ, ঐ তো আওয়াজটা আবার পাওয়া যাচ্ছে। কেউ নিশ্চয়ই নিঃশব্দে ঘরে হেটে বেড়াচ্ছে! না, দেখতে হল!
কিরীটী উঠে বসে। শয্যা ত্যাগ করে দু ঘরের মধ্যবর্তী যে দরজাটা আছে তার সামনে গিয়ে সে কান পেতে দাঁড়াল। তারপর দরজাটার গায়ে হাত দিয়ে ঠেলতে গিয়ে দেখল দরজাটা ওদিক হতে বন্ধ। আশ্চর্য, শোয়ার সময়ও তো দরজাটা খোলাই ছিল! তবে? কিরীটী আরও একটু জোরে দরজাটা ঠেলা দিল। কিন্তু দরজা খুলল না। কিরীটী বিস্মিত, বিমূঢ়।
সহসা মনে পড়ে ওদিককার বারান্দার দিকেও ঘরটার দুটো জানালা আছে। সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী এ ঘরের দরজা দিয়ে ওদিককার বারান্দায় গেল।
অন্ধকার বারান্দা।
নীচের বাগান থেকে ঝিঁঝি পোকার একঘেয়ে ঝিঁঝি শব্দ ভেসে আসে। রাতের হাওয়া নিঃশব্দে চোরের মতই আনাগোনা করে ফেরে। নাম-না-জানা একটা মিষ্টি ফলের গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়।
কিরীটী পায়ে পায়ে নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে দেখে জানালাটি খোলা! দেওয়ালের গা ঘেষে চোরের মত চুপি চুপি এসে সে জানালাটার আড়ালে দাঁড়াল।
অন্ধকারে ঘরের মধ্যে একটা সরু আলোর রশ্মি এদিক-ওদিক ঘুরছে। চোখের দৃষ্টি যতটা সম্ভব প্রখর করে কিরীটী ঘরের ভিতরের সব কিছু দেখবার চেষ্টা করতে লাগল।
যেখানে ওদের সুটকেস ও বাক্সগুলো সাজানো আছে, সেখানে একটা ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে টর্চের আলো ফেলে কি যেন দেখছে। লোকটা কে? কিই বা দেখছে?
কিরীটী উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠে।
খট করে একটা শব্দ হল—হ্যাঁ, বাক্সের ডালা খোলার শব্দ বটে! বাক্সের মধ্যে আঁতিপাঁতি করে লোকটা কি খুজছে অমন করে?
কিরীটী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে সব ব্যাপার দেখতে লাগল।
ওপরের বাক্সটা নামিয়ে রেখে লোকটা আর একটা বাক্স খোলবার জন্য তার হাতের চাবির গোছার এক-একটা চাবি দিয়ে চেষ্টা করতে লাগল। আবার খট, করে একটা শব্দ হল—সঙ্গে সঙ্গে বাক্সের ডালাটাও খুলে গেল।
এবারে অল্পক্ষণ হাতড়াতে কি একটা কাগজ পেয়ে লোকটা টর্চের আলোয় সেটা মেলে ধরে দেখলে এবং সেটা পকেটে পরে টর্চ নিবিয়ে ওদিককার জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, তারপর জানালা টপকে ওদিকে চলে গেল।
কিরীটীও সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে জানালা টপকে ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। জানালাটার কাছে ছুটে এসে সে দেখে জানালার গায়ে একটা দড়ির মই ঝলছে, আর লোকটা নিঃশব্দে সেই দড়ির মই বেয়ে নীচের বাগানে নেমে যাচ্ছে দ্রুত।
আর দেরি না করে কিরীটী একপ্রকার ছুটেই বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে বাগানের দিকে চলে যায়।
রাতের অন্ধকারে বাগানটি অস্পষ্ট। ভাল করে কিছু দেখাও যায় না বোঝাও যায় না।
বাগানের পিছন দিক দিয়ে একটা স্বল্পপরিসর রাস্তা ঘরে এসে এদিককার বড় রাস্তায় মিশেছে। যেতে হলে লোকটিকে বাগানের প্রাচীর টপকে ওই রাস্তা দিয়ে এই বড় রাস্তায় আসতেই হবে। কিরীটী মনে মনে এই চিন্তা করে দ্রুতপদে সদর দরজার দিকে চলল, তারপর দরজা খুলে রাস্তার ওপরে এসে দাঁড়াল।
সহসা তার নজরে পড়ে রাস্তার ঠিক ওপরেই ছোট একটা টু-সীটার মোটরগাড়ি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে।
একটু পরে কার পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। শব্দটা বাগানের পিছনের সরু রাস্তার দিক থেকেই যেন আসছে মনে হয়। শব্দটা ক্রমে স্পষ্ট হতে স্পষ্টতর মনে হয়।
কিরীটী দরজার কপাটের আড়ালে একটু সরে দাঁড়িয়ে দেখল, সরু রাস্তা দিয়ে একটা লোক বড় রাস্তার দিকে আসছে। লোকটার গায়ে একটা কালো রংয়ের কিমনো চাপানো, মাথায় একটা নাইট ক্যাপ। লোকটা আস্তে আস্তে মোটরটির কাছে এসে দরজা খুলে গাড়ির ভিতর গিয়ে বসল।
কিরীটী দ্রুতপদে এগিয়ে এসে গাড়ির পিছনে যে চাকার ক্যারিয়ারটা ছিল, সেটার ওপর চট করে উঠে বসে কোনমতে, তারপর গাড়ির হুড আটকাবার জন্য পিছনে যে দুটো লোহার হক ছিল, দু হাতে সে দুটোকে বেশ শক্ত করে চেপে ধরল।
গাড়ি ততক্ষণে স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করেছে। গাড়ির বেগ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সামান্য একটা চাকার ওপর ঠিক হয়ে বসে থাকা সত্যি বড় কষ্টকর। গাড়ি রাত্রির অন্ধকারে রেঙ্গুন শহরের বিভিন্ন পথ ধরে ছুটে চলেছে।
সামান্য জায়গায় একই ভাবে বসে থেকে কিরীটীর হাত-পা সব টনটন করছে। অনেকক্ষণ পরে গাড়িটা এসে একটা বাগানের মধ্যে প্রবেশ করল। গাড়ির গতি ধীরে ধীরে কমে আসতেই কিরীটী লাফ দিয়ে গাড়ির পিছন থেকে নেমে পড়ল। গাড়িটা আরও একটু গিয়ে ছোট গাড়িবারান্দার নীচে দাঁড়াল।
কিরীটী অন্ধকারে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। খানিক পরেই গাড়িবারান্দার আলোটা জ্বলে উঠল। সেই আলোয় কিরীটী দেখতে পেল, মোটর থেকে সেই কিমনো পরিহিত লোকটি বেরিয়ে দেওয়ালের গায়ে একটি বোতাম টিপতেই সামনের একটি দরজা ফাঁক হয়ে রাস্তা করে দিল। লোকটি দরজা দিয়ে ভিতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল। আলোটাও নিভে গেল।
কিরীটী উঠে গাড়িবারান্দায় এল, কিন্তু অন্ধকারে গাড়িবারান্দাটা ভাল করে দেখা যায় না। কোনমতে দেওয়াল ধরে ধরে আন্দাজে ভর করে কিরীটী সেই বোতামটি খুজতে লাগল, কিন্তু কিছুই ঠাওর করে উঠতে পারলে না। একটি দরজা যদিও বা হাতের কাছে পাওয়া গেল, কিন্তু হাত দিয়ে ভাল করে দেখতে গিয়ে কিরীটী বুঝল, একই রকমের দরজা পর পর আরও দুটো আছে। তার সব কিছু, যেন গুলিয়ে যায়। কোন দরজাটা দিয়ে এক মুহূর্ত আগে যে লোকটি অদৃশ্য হয়ে গেল তা সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। কিরীটী ভাবল বড় ভুল হয়ে গেছে, আসবার সময় যদি টর্চটাও অন্তত নিয়ে আসতাম!
রাগে দুঃখে কিরীটীর নিজের হাত নিজেরই কামড়াতে ইচ্ছা করে। কিন্তু উপায় কি? কি এখন করা যেতে পারে? এতদূর এসে সে কি বিফল হয়ে ফিরে যাবে শেষটায়?
এমন সময় সামনেই কোথাও একটা ওয়াল-ক্লক ঢং ঢং ঢং ঢং করে রাত্রি। চারটে ঘোষণা করলে। কিরীটী চেয়ে দেখল পুবের আকাশে রাত্রিশেষের লালচে আভা জেগে উঠেছে। রাত্রি শেষ হয়ে আসছে। আর এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সমীচীন নয়। কিরীটী নিঃশব্দে গেট পার হয়ে রাস্তায় চলে আসে।