১৬. আবার মগের মুল্লুকে:
রেঙ্গুন শহর।
জাহাজ তখনও জেটিতে লাগেনি।
সুব্রত, কিরীটী, রাজু ও ডাঃ সান্যাল জাহাজের রেলিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে জেটির দিকে তাকিয়ে আছে।
লোকজন, কুলী, কর্মচারী প্রভৃতির সমাগমে স্থানটি একেবারে সরগরম।
প্রভাতী সূর্যের সোনালি আলো দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। জাহাজে বসে রেঙ্গুন নদীর পারে ভাসমান অবস্থায় শহরটিকে যেন একটি ছবির মতই দেখায়।
ডাক্তার বলছিলেন, কাল দুপুরে আমার ওখানে আপনাদের মধ্যাহ্নিক নিমন্ত্রণ রইল। এই নিন আমার কার্ড। বলতে বলতে ডাক্তার কোটের পকেট থেকে একটা ছোট কার্ড বের করে সুব্রতর হাতে দিলেন। তাতে লেখা আছে?
ডাঃ এস, সান্যাল
এম. বি. এম. সি. পি (লণ্ডন)
৩০, কমিশনার রোড, রেঙ্গন।
সুব্রত কার্ডটা পকেটে রেখে দিল।
জাহাজ ততক্ষণে জেটিতে লেগেছে। ক্ৰমে যাত্রী একে একে নামতে শুরু করে।
কিরীটীর পরামর্শমত ঠিক হয়েছিল সবশেষে ওরা নামবে। তাড়াতাড়ি কিছু নেই।
সুব্রত আনমনে রেলিংয়ে ভর দিয়ে যাত্রীদের অবতরণ দেখছিল।
একটা স্ট্রেচারে করে বোধ হয় একজন রোগীকে নামানো হচ্ছিল। দুটো খালাসী স্ট্রেচারটা ধরে নামাচ্ছিল। স্ট্রেচারে শায়িত ব্যক্তির কপাল পর্যন্ত কাপড়ে ঢাকা।
সহসা একজন যাত্রীর হাত লেগে লোকটার মুখের কাপড় সরে যেতেই সুব্রত চমকে উঠল, সেদিকে হাত বাড়িয়ে কি বলতে যেতেই তার মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল যেন, কে? কে?
কিরীটীর চোখেও সে দৃশ্য এড়ায়নি। কিন্তু ততক্ষণে আর একটা লোক, যে স্ট্রেচারের সঙ্গে সঙ্গে চলছিল, ক্ষিপ্রহাতে মুখের কাপড়টা আবার টেনে দিয়েছে স্ট্রেচারে শায়িত লোকটার।
সহসা সুব্রত অদৃশ্যে নিজের হাতের ওপরে একটা চাপ অনুভব করে পাশের দিকে তাকাতেই কিরীটীর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। কিরীটীর চোখে অদৃশ্য কিসের যেন সঙ্কেত।
সুব্রত নিজেকে সামলে নেয় মুহূর্তে।
কিরীটীর মুখে কোন কিছু চিন্তার ছায়া পর্যন্ত যেন নেই, একান্ত নির্বিকার সে মুখ।
পাশেই দণ্ডায়মান ডাক্তারও সুব্রতর সেই অস্ফুট শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, কি হল মিঃ রায়?
কিরীটী ততক্ষণে নীচে নামবার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেছে। রাজু কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়নি, তাই সে হঠাৎ বলে ওঠে, সনৎদা!
সনৎদা? ডাক্তার প্রশ্ন করেন।
কিন্তু ততক্ষণে রাজু সুব্রতর চোখের দিকে দৃষ্টি পড়ায়, নিজেকে সামলে নিয়ে একটু মৃদু হেসে বললে, না কিছু না, আমাদের একজন চেনা লোককে যেন জেটিতে দেখলাম।
চেনা লোক! ডাক্তার বিস্মিত ভাবে তাকান।
হ্যাঁ। মানে, খবর পেয়েছিলাম, তিনি যেন, এই–
তিনি যেন কি? ক্ষমা করুন, যদি বিশেষ কোন গোপনীয় কিছু থাকে, তবে অবিশ্যি আমি শুনতে চাই না।
সুব্রত হেসে বললে, না, এমন বিশেষ কিছু গোপনীয় নয়, আচ্ছা বলবখন আপনাকে। চলুন এবারে নামা যাক।
জাহাজ-ঘাটের বাইরে কিরীটী একটা লাইটপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল অনুসন্ধানী দৃষ্টি ফিরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল।
সুব্রত এসে পিছনে দাঁড়িয়ে ডাকল, মিঃ রায়!
দেরি হয়ে গেছে। পেলাম না সুব্রতবাবু।
পেলেন না?
না, চলুন।
ডাক্তারের প্রকাণ্ড কালো রংয়ের সুদৃশ্য হাম্বার গাড়িটা তার জন্য অপেক্ষা করছিল।
ডাক্তার সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে চেপে বসলেন। গাড়ি ছেড়ে দিল।
একটা গাড়িতে সমস্ত মালপত্র চাপিয়ে ওরা চালককে মিঃ চৌধুরীর বাড়ির ঠিকানা বলে দিয়ে গাড়িতে চেপে বসল।
চলমান গাড়ির মধ্যে বসে একসময় সুব্রত বলে, ডাক্তার সান্যাল চমৎকার লোক, কি বলেন মিঃ রায়?
কিরীটী চলন্ত গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে রাস্তার দুপাশের নানাজাতীয় অগণিত লোকজনের দিকে খরদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দেখছিল।
সুব্রতর কথায় চমকে উঠে বললে, অ্যাঁ! কিছু বলছিলেন সুব্রতবাবু?
কি ভাবছেন মিঃ রায়?
না, কিছু না।
একসময় গাড়ি ডাঃ চৌধুরীর বাড়ির সামনে এসে থামল। চৌধুরীর পুরনো চাকর দাশু দরজার গোড়াতে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল, কারণ তাকে আগেই তার করা হয়েছিল।
ওদের সকলকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে ব্যাকুল কণ্ঠে দাশু প্রশ্ন করে, আমার দাদাবাব-সনৎবাবু, আসেননি বাবু?
সুব্রত আমতা আমতা করে বললে, না দাশু সনৎবাবু আসেননি তো এ জাহাজে, পরের জাহাজে আসছেন।
খাওয়া-দাওয়ার পর কিরীটী একসময় বললে, আজকের দিনটা একেবারে পূর্ণ বিশ্রাম। পাদমেকং ন গচ্ছামি।
কথা শেষ করেই সে কলহাস্যে গান ধরল…
আজ আমাদের ছুটি রে ভাই,
আজ আমাদের ছুটি।
সুব্রত কিরীটীর হঠাৎ হাসিখুশীর কারণ বুঝতে পারল না, তবু হাসতে হাসতে বললে, ছুটি নয়, বরং এই তো সবে শুরু!
কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, না। তারপরই আবার আগের মত গান গেয়ে চলল।
গান থামিয়ে কিরীটী আবার একসময় বললে, এখন একটা লম্বা ঘুম, তারপর জাগরণ। চা-পান ও জলখাবার ভক্ষণ, মোটরে চেপে রেঙ্গুন শহরটা ভ্রমণ, প্রত্যাগমন, স্নান-আহার, অতঃপর সারাটি রজনী ঘুম—এই হল আমার কর্মতালিকা অদ্য।
কিরীটী যেন দুবছরের শিশু। আনন্দে আর কলহাস্যে সে যেন মশগুল হয়ে উঠেছে।
সুব্রত হাসতে হাসতে বলে, ব্যাপার কি বলুন তো মিঃ রায়?
ব্যাপার কিস্তিমাত!
বলেন কি?—রাজু ও সুব্রত ব্যাকুল হয়ে উঠল।
কিরীটী ডান হাতের একটা আঙুল ওষ্ঠের উপর রেখে গভীর ভাবে মাথাটা দোলাতে দোলাতে বললে, চুপ করুন, চুপ করুন। সর্বদা মনে রাখবেন এটা কলকাতা শহর নয়, এটা কালো ভ্রমরের নিজের এলাকা। কিন্তু দেখলেন তো শেষ পর্যন্ত, আমার অনুমান মিথ্যা হয়নি! সনৎবাবুকে ওরা নিয়ে এল। যাক, তাঁর পক্ষে এ একপ্রকার ভালই হল, কি বলেন? বিনা খরচায় সাগরযাত্রাটা হয়ে গেল তাঁর।
কিন্তু তার উদ্ধারের কি করা যায়?
মা ভৈ …হবে হবে, সব হবে। জানেন তো সবুরে মেওয়া ফলে!
কিরীটী মৃদু মৃদু হাসতে থাকে।