কিরীটীর আবির্ভাব: ১৩. ডাঃ সান্যাল

কিরীটীর আবির্ভাব: ১৩. ডাঃ সান্যাল

১৩. ডাঃ সান্যাল

পরের দিন।

সন্ধ্যা হতে তখন আর খুব বেশী দেরি নেই। সাগরের কালো জলে– সাঁঝের ধূসর ছায়া ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। মেঘপুরীর বাতায়নে বাতায়নে সবেমাত্র দিগাঙ্গনারা দু-একটি করে তারার প্রদীপ জ্বালিয়ে গেল বুঝি।

বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলরাশির ওপর দিয়ে ঢেউয়ের তালে তালে নেচে চলেছে বিরাট অর্ণবপোত কত যাত্রী বুকে নিয়ে!

সাগরের বুক থেকে কেমন একটা যেন ঠাণ্ডা হাওয়া আসে, শীত-শীত করলেও তা বেশ আরামদায়ক।

ডেকে সেই বিকেল চারটে হতে এতক্ষণ পর্যন্ত অনেক যাত্রীই সাগরের সান্ধ্যশোভা উপভোগ করছিল। সবাই এখন কেবিনে চলে গেছে; শুধু যায়নি কিরীটী সুব্রত, রাজু ও একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক।

ভদ্রলোকের চেহারা যেমন প্রশান্ত, তেমনি ধীর ও গম্ভীর, দার্শনিকের মত এলোমেলো কাঁচা-পাকা চুল, চোখে একজোড়া সোনার ফ্রেমের চশমা। পরনে একটা ঢোলা জাপানী সিল্কের পায়জামা। গায়ে স্ট্রাইপ-দেওয়া কিমনো। সেলুন ডেকের উপর পাতা একটা বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে ভদ্রলোক এতক্ষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা কি মোটা ইংরাজী বই পড়ছিলেন। ডেকের ওপর সমবেত বহু লোকজনের নানা জাতীয় কণ্ঠস্বরে একটিবারের জন্যও তাঁর মনযোগ নষ্ট হয়নি।

সাঁঝের আঁধার গাঢ় হয়ে আসবার সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক হাতের বইখানি মুড়ে সামনের অস্পষ্ট আলো-ছায়াঘেরা সাগরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন।

কিরীটী আপনমনে গুনগুন করে গাইছিল—

বনের ছায়ায়, জল ছল ছল সুরে
হৃদয় আমার, কানায় কানায় পুরে
ক্ষণে ক্ষণে ঐ গুরুগুরু তালে তালে
গগনে গগনে গভীর মৃদঙ্গ বাজে
আমার দিন ফুরাল!

সহসা কিরীটী চমকে উঠল। ঠিক পাশ থেকে কে যেন বললে, চমৎকার গলাটি তো আপনার! যেমন মিষ্টি, তেমনি দরদভরা। আহা, থামলেন কেন? শেষ করুন না গানটা?

কিরীটী মুখ ফিরিয়ে দেখে কথা বলছেন সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি, যিনি এতক্ষণ নিবিষ্ট মনে বই পড়ছিলেন।

আপত্তি যদি না থাকে, তাহলে শেষ করুন গানটা। ভদ্রলোক পুনরাবৃত্তি করলেন।

কিরীটী মৃদু হাসলেন, তারপর ধীরে ধীরে আবার শুরু করে–

কোন দূরের মানুষ এল আজ কাছে।
মনের আড়ালে নীরবে দাঁড়ায়ে আছে!

সত্যি, কিরীটীর গলাটি ভারী মিষ্টি!

কিরীটী তিন-চারবার সমগ্র গানটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গেয়ে থামল।

ভদ্রলোক বললেন, সত্যি বড় ভাল লাগল আপনার গান। বসেছিলাম ওখানটায়, হঠাৎ গানের সুর কানে যেতেই উঠে এসেছি।

কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক যেন কেমন একটু অনিমনা হয়ে যান। তারপর আবার ধীরে ধীরে বলে চললেন, সংসারের কোলাহল, জীবনের নানা ত্রুটি বিচ্যুতি, প্রতিহিংসা, কর্তব্য-অকর্তব্য—সব যেন মুহূর্তে ভুলিয়ে দেয় এই গানের সুর। গানের সুরে আমি ভুলে যাই আমার নিজেকে।..কেউ বোঝে না, কেউ জানে না, কত দুঃখ আমার সমস্ত বুকখানায় জমাট বেধে আছে।

আমি কাঁদতে চাই; কিন্তু কই, কাঁদতে যে পারি না!…শেষের কথাগুলো যেন অনেকটা স্বগতোক্তির মতই শোনায় এবং শেষদিকে ভদ্রলোকের গলার আওয়াজও ক্রমে যেন ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে জড়িয়ে যায়।

সহসা ভদ্রলোক আরও কি বলতে বলতে যেন চমকে উঠে থেমে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর এক টুকরা মৃদু হাসিতে মুখখানি ভরিয়ে বললেন, কিছু মনে করবেন না যেন; আমার কেমন একটা স্বভাব যে কথা বলতে বলতে হঠাৎ এমনি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি..আপনারাও বুঝি বর্মাতেই চলেছেন?

হ্যাঁ। সুব্রত ও কিরীটী একসঙ্গেই জবাব দিল।

বেড়াতে? না অন্য কোন কাজে? ভদ্রলোক ফিরে প্রশ্ন করলেন।

না, ঠিক বিশেষ কোন কাজেও নয়—আবার কাজেও বটে। আমাদের এক ছেলেবেলার বন্ধু ওখানে থাকে। অনেকদিন থেকে সে আমাদের তার ওখানে যাওয়ার জন্য লিখছিল, কিন্তু যাওয়া আর হয়ে ওঠে না। সময়ের অভাব। এখন পরীক্ষা হয়ে গেছে, সামনে লম্বা ছুটি। ভাবলাম বিদেশ বেড়াবার এই তো সুযোগ। তাই রওনা হয়ে পড়া গেল।

বেশ বেশ। পাশ্চাত্ত্য দেশের ছেলেমেয়েরা ছুটির সময় কখনও আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের মত দিনদুপুরে পড়ে পড়ে শুধু ঘুমিয়ে অথবা আড্ডা দিয়ে দিনগুলো কাটায় না—দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়।…মন ওদের বহুমুখী। দিবারাত্র অজানা ও অচেনার হাতছানি ওদের দেহ ও মনকে আকুল করে। নিত্য নতুনকে জানবার জন্য ওদের দেহ ও মনে ইচ্ছার অন্ত নেই। ঘরের চাইতে ওরা পথকেই ভালবাসে, তাই তো ওরা ঘরের বাধন ছিড়ে সাতসমুদ্র তেরো নদী ডিঙিয়ে দিকে দিকে ছোটে। কখনও আকাশপোতে চেপে সুদূরের পথে পাড়ি জমায়, কখনও বা সাঁতার কেটে দুরন্ত সাগর পার হয়, কিংবা সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গের উদ্দেশে অভিযান চালায়। ওরা এমনি দুরন্ত, এমনি দুর্বার, এমনি সদা-চঞ্চল। জীবন আর মরণ তো ওদের কাছে ছেলেখেলা। আর আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা দেখুন, সযতনে জীবনীশক্তিকে বাঁচিয়ে চলতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে জীবনকে ক্ষয় করে ফেলে। ছোটবেলার কথা আমার এখনও বেশ মনে পড়ে। স্কুলের ছুটি হলেই বাবা আমাকে নিয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতেন। খুব ছোট বয়সেই মাকে হারাই, সংসারে আমরা দুটি ভাই-বোন, বাবাকেই শুধু জানতাম ও চিনতাম। বলতে বলতে ভদ্রলোক আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন।

আপনিও রেঙ্গুনে চলেছেন বুঝি? সহসা কিরীটী প্রশ্ন করে।

রেঙ্গুনে আমি প্র্যাকটিস করি। আমার নাম সৌরেন্দ্র সান্যাল। সকলে আমায় ডাক্তার সান্যাল বলে ডাকেন। জন্ম হতেই আমি রেঙ্গুনে, বাবার মস্ত বড় ব্যবসা ছিল রেঙ্গুনে।

বাড়িতে আপনার আর কে কে আছেন?

কেউ না। আমি নিজে ও আমাদের এক পুরনো চাকর ভোলা। একটিমাত্র বোন ছিল, আমার চাইতে বয়সে প্রায় দশ বৎসরের বড়, তা তিনিও অনেকদিন হল আমার মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন। আর কোন বন্ধনেরই বালাই নেই—একা। ছোটবেলায় মা মরে যাবার পর দিদিই আমায় বুকে-পিঠে করে মানুষ করেছিলেন মায়ের মত করে।

আচ্ছা, রেঙ্গুন শহরটা আপনার কেমন লাগে ডাক্তার সান্যাল? প্রশ্ন করল কিরীটী।

জন্ম হতেই ওখানে আছি। দীর্ঘদিনের পরিচয় ঐ শহরের প্রতি ধুলিকণার সঙ্গে, কেমন যেন একটা মায়ার বাঁধন গড়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে কি কোনও দিন আর ফিরবেন না?

ফিরব নিশ্চয়ই, অন্ততঃ মনে মনে সেই আশাই তো রাখি। চির শস্যশ্যামল, দোয়েল শ্যামার কলকাকলী-মুখরিত আমার বাংলাদেশ। ওরই শীতল মাটির বুকে যেন আমার শেষ শয্যা রচনা করতে পারি—এটাই আমার জীবনের শেষ সাধ। কিন্তু মৃত্যু তো কারও ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না। যদি বর্মার মাটির কোলেই আমার জীবনের শেষের দিনটি ঘনিয়ে আসে, তবে কি আর করব বলুন?…কিন্তু দেখেছেন, নিজের কথাতে মশগুল হয়ে আছি। আপনাদের পরিচয়টি পর্যন্ত নেবার কথা মনে নেই।

কিরীটী মৃদু হেসে বলল, আমার নাম ধূর্জটি রায়, এর নাম সত্যব্রত সেন, আর ওর নাম জীবেন্দ্রপ্রসাদ রায়। আমরা সকলেই স্টুডেন্ট।

ইচ্ছা করেই কিরীটী নিজেদের নাম ও পরিচয়ের মধ্যে খানিকটা গোপনতার আশ্রয় নিল।

বেশ বেশ, আপনারা যখন বন্ধুর ডাকে চলেছেন, তখন ওখানে গিয়ে সেই বন্ধুর বাড়িতেই তো উঠবেন। যাবেন আমার ওখানে, ভুলবেন না তো? কমিশনার রোডেই আমার বাড়ি, তাছাড়া যাকে জিজ্ঞেস করবেন, সে-ই ডাঃ সান্যালের বাড়ি দেখিয়ে দেবে। ডাক্তার থামলেন।

নিশ্চয়ই যাব, বিশেষ করে যখন পরিচয় হয়ে গেল। কিরীটী জবাব দেয়।

রাত্রি বোধ করি আটটা হবে। কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি। বিশ্বচরাচরে কালো আঁধার ছড়িয়ে পড়েছে।

জাহাজের সার্চলাইট সমুদ্রের কালো জলে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। মাঝে মাঝে সেই আলো সমুদ্রবক্ষে চারিদিকে ঘোরানো হচ্ছে।

কিছুক্ষণ আগে থেকেই কিরীটী লক্ষ্য করছিল, ডাক্তার সান্যাল কেমন যেন একটু চঞ্চল হয়ে উঠেছেন।

সুব্রত প্রশ্ন করলে, আপনার শরীরটা কি অসুস্থ ডাঃ সান্যাল?

ডাক্তার জবাব দিলেন, হ্যাঁ, না—মানে, বছরখানেক থেকে রাত্রির দিকে শরীরের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বস্তি অনুভব করি। মানে আমার মনে হয় যেন কারা আমার চারিপাশে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, আপন মনে কত কি বলে— আবার সময় সময় আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে। তাদের গরম শ্বাস-প্রশ্বাসে আমার সমস্ত শরীর জ্বলতে থাকে। কত চেষ্টা করি তাদের ভুলতে, কিন্তু পারি না।…উঃ, আমি যাই—আমি যাই! বলতে বলতে ডাক্তার সান্যাল অনেকটা মাতালের মতই একরকম টলতে টলতে যেন ডেক থেকে কেবিনের দিকে চলে গেলেন দ্রুত চঞ্চল পদবিক্ষেপে।

সুব্রতরা আশ্চর্য হয়ে ডাক্তারের গমনপথের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত