১১. কালো ভ্রমরের হূল
চোখের পলক ফেলার আগেই কিরীটী চীনা লোকটির ছুরিসমেত হাতখানা ধরে এক হেচকা টানে নিজের দিকে টেনে নিয়ে কনুইটা চেপে ধরে লোকটার হাতটা মুচড়ে দিল।
একটা অস্ফুট চীৎকার করে চীনাটা ছরিখানা ফেলে দিল। আর ঠিক সেই মুহুর্তে কিরীটী বাম হাত দিয়ে ছোট্ট একটা বাঁশি বের করে তাতে সজোরে ফুঁ দিল।
বাঁশির আওয়াজ পেয়ে দ্রুতপদে অপেক্ষমান কনেস্টবল দুজন এসে দোকানে প্রবেশ করল। লালপাগড়ির শুভাগমন দেখে চীনাদের মুখের ভার যেন নিমেষে বদলে যায়। তারা একান্ত নিরীহ পোষা জীবটির মত একপাশে সরে দাঁড়াল মাথা নীচু করে সঙ্গে সঙ্গে।
কিরীটী একজন কনস্টেবলকে চোখের ইশারায় ডেকে নিয়ে, দরজাটা খুলে একটু আগে সেই চীনা লোক দুটো ঢুকেছিল সেই দরজার দিকে এগিয়ে গেল নির্ভীক পদক্ষেপে।
দরজা খুলে কিরীটী, সুব্রত ও একজন কনস্টেবল গিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। সামনেই একটা মাঝারিগোছের ঘর। ঘরটা দিনের বেলাতেও বেশ অন্ধকার। উপরে ছোট ছোট দুটো স্কাইলাইট বসানো আছে বটে এবং ওদিকে আর একটা দরজাও আছে, কিন্তু সেটার কপাট ভেজানো থাকার জন্য ঘরটা অন্ধকার।
বাইরের আলো আসবার কোন পথ তো নেই-ই, কৃত্রিম আলোরও তেমন কোন বন্দোবস্ত নেই ঘরটার মধ্যে। স্কাইলাইটের ফাঁক দিয়ে সামান্য যে আলোটকু ঘরে আসে তাতেই সামান্য যেন এক মৃদু আলো-আঁধারির সৃষ্টি হয়েছে।
কিরীটী খরসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে চারিদিকে দেখতে লাগল। ঘরের এক কোণে স্তুপাকার করা একগাদা কাগজের তৈরী জুতোর বাক্স। আর এক কোণে একটা জুতো সেলাইয়ের কল। দেওয়ালে একটা ওয়াল-ল্যাম্প। ল্যাম্পটার চিমনির গায়ে একরাশ কালি জমেছে। কতকাল পরিষ্কার করা হয়নি কে জানে!
ওরা এগিয়ে এসে প্রথমেই ওদিককার দরজাটা খুলে ফেলল। সামনেই একফালি বারান্দা। সেখানে তবু যা হোক খানিকটা আলো এসে পড়েছে বাইরে।
বারান্দার সংলগ্ন পর পর দুখানা ঘর। প্রথম ঘরটা নেহাৎ ছোট নয়। সেখানে কতকগুলো চেয়ার-টেবিল ওলট-পালট হয়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। মনে হয় কারা বুঝি ঘরটার মধ্যে এসে হুটোপুটি করে গেছে। ঘরের মেঝেয় একটা টেবিল লাম্প উল্টে পড়ে আছে, খানিকটা জায়গায় কেরোসিন তেলের দাগ। ভাঙা চিমনির টুকরোগুলো ঘরময় ইতস্তত ছড়ানো। কিরীটী ভাল করে সব দেখতে দেখতে বুঝতে পারে, এই ঘরটিই গতরাত্রের সেই ঘটনাস্থল। এই ঘরেই গতরাত্রের খণ্ডপ্রলয় ঘটে গেছে। শূন্য ঘরখানি যেন প্রলয়কাণ্ডের মৌন সাক্ষী হয়ে রয়েছে এখনও।
ঘরের বাতাসটা যেন কেরোসিনের তেলের উগ্র গন্ধে ভরে আছে। নাক জালা করে। কিরীটী আরও একবার ভাল করে ঘরের চতুষ্পার্শ্বটা দেখে নিল। ভাঙা চেয়ার-টেবিলগুলো ছাড়া আর কিছুই নেই। কিরীটী অতঃপর ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে পাশের ঘরে এসে প্রবেশ করল।
এ ঘরটা অবশ্য আগের চাইতে অনেক ছোট এবং আগের ঘরটার চাইতে এ ঘরটা যেন আরো একটু বেশী অন্ধকার। মুক্ত দরজাপথে সামান্য যে আলো এসে ঘরে প্রবেশ করেছে, তাতে দেখা গেল একটা ভাঙা খাটিয়ার ওপরে আপাদমস্তক একটা মলিন দুর্গন্ধ চাদর মুড়ি দিয়ে কে একজন পড়ে আছে।
কিরীটীই এগিয়ে এসে চাদরটা টেনে তোলে।
একটা অস্ফুট কাতর শব্দ শোনা গেল। কিরীটী দেখলে একটা চীনা বুড়ী।
ভাল করে শায়িত বুড়ীটার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই কিরীটী যেন চমকে ওঠে।
চিনতে এতটুকুও কষ্ট হয় না।
বুড়ীটার বোধ হয় সুখনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটছিল, সে তার অসহিষ্ণু ক্রুদ্ধ দৃষ্টি মেলে পিটপিট করে কিরীটীর দিকে চেয়ে থাকে।
বুড়ীর জীবনে এ ধরনের উৎপাত হয়তো খুব কম দেখা দিয়েছে।
কিরীটী চমকে উঠেছিল বুড়ীটাকে চিনতে পেরেই। এই তো সেই চ্যাপ্টামুখ বুড়ী যাকে সে গতরাত্রে দড়ি দিয়ে বেধেছিল।
হঠাৎ বুড়ী কিচির-মিচির করে যেন কি বলতে বলতে উঠে বসল। কিরীটী ওর মুখের দিকে একবার চেয়ে সুব্রতকে বললে, চলুন সুব্রতবাবু দেখা যাক আর কোন ঘরটর আছে কিনা!
বারান্দাটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একটা টিনের বেড়া। বেড়ার গায়ে একটা দরজা; সেই দরজায় একটা দুর্গন্ধ পুরনো চটের পর্দা ঝুলছে।
কিরীটী এগিয়ে এসে হাত দিয়ে পর্দাটি তুলে ধরল। ঘরের ভিতর দেখা গেল তিনটি চীনা মেয়ে। তাদের একজন উনুনে হাঁড়ি চাপিয়ে কি যেন রাঁধছে, একজন একটা ছুরি দিয়ে তরকারি কেটে কেটে একটা ভাঙা সানকিতে রাখছে। অন্যজন একটা ভাঙা মোড়ার উপরে বসে একটা জামা সেলাই করছে। কিরীটীদের এমনি অতর্কিত ভাবে প্রবেশ করতে দেখে তিনজনেই বিস্মিত ও চমকিত হয়ে একই সময়ে যে যার হাতের কাজ ফেলে উঠে দাঁড়াল।
কিরীটী আফসোসের স্বরে বললে, না, কোন ফল হল না। চলুন। কিরীটীর কণ্ঠে রীতিমত একটা হতাশার সুর যেন ফুটে ওঠে।
সকলে আবার দোকান থেকে বেরিয়ে এল। রাস্তায় নেমে সুব্রত কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কিছুই পাওয়া গেল না, এখন কি করবেন ঠিক করলেন, মিঃ রায়
কনস্টেবল দুজনকে বিদায় দিয়ে কিরীটী অন্যমনস্ক ভাবে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে বললে, কালকের জাহাজে আমাদের রওনা হতেই হবে সুব্রতবাবু। সেভাবেই আমরা যেন প্রস্তুত হই।..
সুব্রত কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল, সেখানে যাওয়ার কি কোন প্রয়োজন আছে, মিঃ রায়? সনৎদাকে যখন ওরা এখানেই রেখেছে, তখন শুধু শুধু অত দূর দৌড়ে কি হবে?
সনৎবাবুকে অক্ষত দেহে ফিরে পেতে হলে আমাদের কালকের জাহাজে যেতেই হবে। কেননা একটু আগেই আপনাদের বলেছি, ওরা কালকের জাহাজেই রওনা হবে।
কিন্তু–
এর মধ্যে আর কোন কিন্তুই নেই সুব্রতবাবু। পাশার দান উল্টে গেছে, এ কথা খুবই সত্যি। কিন্তু আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীর পাশার ঘুটি আবার নতুন করে সাজাবার মত বুদ্ধি বা ক্ষমতা বেশ আছে। এবং এবারে তার প্রথম ও প্রধান চেষ্টাই হবে, যাতে গতবারের মত ভুলের জের আর তাকে না টানতে হয়। সে যে একজন দস্তুরমত শয়তান সে বিষয়ে কোন মতদ্বৈধই নেই। সেই সঙ্গে এ কথাটাও যেন আমরা মুহূর্তের জন্য না ভুলি যে, বুদ্ধি তার অসম্ভব রকম তীক্ষ্ণ। কাজেই বুদ্ধির কৌশলে তাকে পরাস্ত করতে হলে ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের একান্তই প্রয়োজন। বলতে বলতে হঠাৎ চমকে উঠে উৎকণ্ঠামিশ্রিত কণ্ঠে কিরীটী বলে উঠল, সরে যান সরে যান!
কিন্তু সরে যাওয়ার আগেই সাইকেল-সমেত একজন আরোহী এসে হড়মড় করে একেবারে সুব্রতর ঘাড়ের ওপর পড়ল। এবং সঙ্গে সঙ্গে সুব্রত উঃ করে একটা অস্ফুট চিৎকার করে একদিকে ছিটকে পড়ল।
সকলে মিলে ভূপতিত সুব্রতকে সামলাবার আগেই সাইকেল-আরোহী সাইকেল ফেলে একছুটে সামনের একটা সরু গলিপথে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কিরীটী এগিয়ে এসে সুব্রতকে তুলতে তুলতে স্নেহ ও উদ্বেগপূর্ণ স্বরে প্রশ্ন করল, লেগেছে কি? কোথায় লাগল?
সুব্রত ডান হাত দিয়ে বাম দিককার কোমরটা চেপে ধরে উঠতে উঠতে কাতর-স্বরে বললে, কোমরে একটু লেগেছে।
ততক্ষণে রাস্তায় কৌতুহলী পথিকদের মধ্যে অনেকেই সেখানে এসে জুটেছে। নানারকম প্রশ্ন ও মন্তব্যে স্থানটি বেশ মুখর হয়ে উঠেছে। ভিড় ও অবান্তর প্রশ্নোত্তর এড়াবার জন্য কিরীটী হাতের ইশারায় একখানা চলন্ত ট্যাক্সি ডাকল এবং সকলে ট্যাক্সিতে উঠে বসে বললে, আমহার্স্ট স্ট্রীট।
ট্যাক্সি ছুটে চলল।
কৌতূহলী হুজুগপ্রিয় পথিকেরা এমন একটা সরল ব্যাপার সহসা বিনা গোলমালে থেমে যেতে বেশ একটু মনঃক্ষুণ্ন হল এবং অগত্যা যে যার গন্তব্যপথে চলে গেল।
চলমান ট্যাক্সিতে বসে গভীরভাবে বললে কিরীটী, চারিদিকে চেয়ে পথ চলতে হয় সুব্রতবাবু!
সুব্রত সে কথায় কান দিল না। সে ততক্ষণে বাঁ হাত দিয়ে একটা মোটা পিনসমেত একখানি গোল কার্ড কাপড় থেকে টেনে বের করে হাতের পাতার উপর মেলে দেখছিল। এ সেই রকমের একখানি কার্ড, যেমনটি রাজু-র গায়ে পরশু রাতে বিধেছিল। তাতে খুব ছোট ছোট অক্ষরে কি যেন লেখা। কার্ডখানা চোখের কাছে নিয়ে সুব্রত পড়লে–
বন্ধু, কালো ভ্রমরের হুল শুধু হুলই নয়, এতে বিষের জ্বালাও আছে। সেই বিষ একবার শরীরে ঢুকলে আর নামে না। সাবধান!