কিরীটীর আবির্ভাব: ০৯. সংকট মুহূর্ত

কিরীটীর আবির্ভাব: ০৯. সংকট মুহূর্ত

০৯. সংকট মুহূর্ত

কেবল কিরীটীই নয়।

ভীষণ-দর্শন লোকটা দরজার কপাট ভেঙে ঘরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের অন্য দুজনও একেবারে চুপ করে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল মুহূর্তের জন্য। যেন মন্ত্ৰপূত বারি ছিটিয়ে সকলকে মোহাচ্ছন্ন করা হয়েছে।

কয়েক সেকেণ্ড ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে পলকহারা দৃষ্টিতে তাকিয়ে লোকটা আচমকা একটা বাজের মত তীক্ষ্ণ হাসি হেসে ওঠে। বীভৎস হাসিতে ঘরটা যেন ঝম ঝম করে ওঠে। সেই ভীষণ-দর্শন লোকটি হাসছে হা হা করে। হাসির ধমকে যেন ভেঙে গড়িয়ে পড়ছে। পরক্ষণেই সহসা ঝন ঝন করে কাঁচ ভাঙার শব্দ হল এবং সঙ্গে সঙ্গে জমাট অন্ধকারে সমস্ত ঘরটা ভরে গেল। কিরীটী পকেট হতে পিতলের ভারী সিগারকেসটা নিক্ষেপ করে ঘরের বাতি ভেঙে দিয়েছে বলেই কাঁচ-ভাঙার শব্দ উঠেছে।

আচমকা অন্ধকারে যেন মুহূর্তের জন্য সব নিস্তব্ধ হয়ে গেছে আবার। কিন্তু সেও অতি অল্পক্ষণের জন্যই।

ততক্ষণে অন্ধকারে ঘরের মধ্যে একটা বিশ্রী হুটোপুটি বেধে গিয়েছে। কিরীটী বাঁ হাত দিয়ে সনৎ-এর একটা হাত আগে থেকে ধরে রেখেছিল, এখন গোলমালের মধ্যে সনৎকে নিয়ে ঘর থেকে বেরোবার চেষ্টা করল এবং চাপা গলায় সনৎকে বললে, সনৎবাবু, চেষ্টা করুন পালাবার।

কিন্তু সহসা কে যেন এমন সময় পিছন থেকে তাকে দু হাতে জাপটে ধরল।

অন্ধকারেই কিরীটী একটা প্রবল ঝটকা দিয়ে আততায়ীর আক্রমণ থেকে আপনাকে মুক্ত করবার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারে আততায়ীর দৈহিক শক্তি অপরিসীম। কাজেই সনৎ-এর হাতটা ছেড়ে দিয়ে দু হাতে সবলে আপনাকে মুক্ত করে নেবার জন্য সচেষ্ট হল।

দৈহিক শক্তির দিক দিয়ে কেউ কম যায় না। উভয়েই প্রাণপণে যুঝে চলেছে।

কিরীটী যত যুযুৎসর প্যাঁচ প্রয়োগ করে, আততায়ী ঠিক তার উল্টোটি দিয়ে আপনাকে অক্লেশে মুক্ত করে নেয়। ওদিকে ঘরের মধ্যে ক্রমে আরও গোলমাল বেড়ে উঠেছে। সহসা ঐ সময় অন্ধকারে একটা ক্ষীণ যন্ত্রণাকাতর চিৎকার শোনা গেল।

সেই চিৎকারের শব্দে সকলেই চমকে উঠল। সেই যন্ত্রণাকাতর শব্দে মুহর্তের জন্য কিরীটী ও তার আক্রমণকারীর শক্ত মুষ্টিও বোধ হয় শিথিল হয়ে গিয়েছিল।

কিরীটী ঐ সুযোগ হেলায় হারালে না। আততায়ীকে জোরে এক ধাক্কা দিয়ে সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়তেই, খোলা দরজাপথে বাইরের সরু গলিপথের মধ্যে এসে ছিটকে পড়ল। সেই চীনা যুবকটি তখনও তেমনি হাতপা বাঁধা অবস্থায় পড়েছিল সেইখানেই।

এক লাফ দিয়ে সেই লোকটিকে ডিঙিয়ে কিরীটী দরজার দিকে ছুটল। ছুটতে ছুটতে সদর দরজার কাছাকাছি এসে দেখতে পেল চেপ্টা-মুখ বুড়ীটা তখনও দরজার কাছে তেমনি ভাবে পড়ে আছে।

কিরীটী যেমন দরজার খিলটায় হাত দিতে যাবে, ঠিক সেই সময় দরজার বাইরে শুনতে পেল খট-খট-খট একটা শব্দ।

দরজা খোলবার সাংকেতিক শব্দ। খিল খুলতে উদ্যত হাতখানি যেন সহসা অর্ধপথেই থেমে যায়। কিরীটী অল্পক্ষণের জন্য রুদ্ধনিঃশ্বাসে স্থির অচঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে হল—এক-একটি মুহূর্ত যেন এক একটি যুগ।

কি ব্যাকুল প্রতীক্ষা! প্রতি লোমকূপ—প্রতি রক্তকণা—দেহের ও মনের সমগ্র বোধশক্তি যেন এক অসীম প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে উঠেছে। এমন সময় অদূরে একই সঙ্গে অনেকগুলো দ্রুত পায়ের শব্দ শোনা গেল। শব্দ শুনে মনে হয়, কারা যেন শশব্যস্তে ঐদিকেই ছুটে আসছে।

কিরীটী চঞ্চল হয়ে ওঠে। আবার বাইরে থেকে শব্দ হল-খুটখুটখুট ঐ সময়।

ওদিকে পায়ের শব্দ তখন একেবারে কাছে এসে পড়েছে। আর অপেক্ষা করা বিপজ্জনক, সনৎও এল না। এক ঝটকায় খিলটা খুলেই সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল কিরীটী।

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ঐ আড্ডারই বোধ হয় একজন লোক কপাটে সংকেতধ্বনি করছিল। দরজা খুলে কিরীটী আঁধারে আচমকা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই লোকটা হড়মড় করে ধরাশায়ী হল। কিরীটীও মাটিতে পড়ে গিয়ে ছিল, কিন্তু তড়িৎবেগে উঠে দাঁড়িয়েই পশ্চাতের দিকে দৃষ্টিপাতমাত্র না করে গলিপথে বড় রাস্তার দিকে দৌড় দিল। ততক্ষণে আড়ার সকলে দরজার কাছে এসে জড়ো হয়েছে।

কিরীটী গলিটার প্রায় শেষাশেষি এসে পড়েছে, ঠিক এমন সময় একটা তীক্ষ্ণ ছুরির অগ্রভাগ এসে তার বাঁ হাতের মাংসপেশীর উপর বিধে গেল। বিষম যন্ত্রণায় অস্পষ্ট শব্দ করে দাঁড়িয়ে পড়ে মুহূর্তের জন্য কিরীটী।

কিন্তু এইভাবে অন্ধকার গলিপথে শত্রুর সীমানার মধ্যে আর বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাও নিরাপদ নয় ভেবে কিরীটী অতি কষ্টে ডান হাত দিয়ে ছুরিটাকে টান দিয়ে খুলে, ডান হাতের পাতা দিয়ে ক্ষতস্থানটা সজোরে চেপে ধরে টলতে টলতে এগিয়ে চলল বড় রাস্তার দিকে।

সরত ও রাজ, নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করছিল বটে, কিন্তু কিরীটী তাদের খোঁজ করলে না। সম্ভবতঃ নিদারুণ পরিশ্রমে এবং বারংবার আক্রান্ত হয়ে সেসব কথা চিন্তা করবারও বুঝি তার দেহের বা মনের অবস্থা ছিল না।

বড় রাস্তার ওপরে এসেই প্রথমে সে রুমাল দিয়ে ক্ষতস্থানটা চেপে ধরল। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে, মাথাটাও গুর পরিশ্রমে ঝিমঝিম করছে তখন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত