০৮. চীনা আড্ডায়
বুড়ীকে বাঁধতে কিরীটীর দুমিনিটও সময় লাগে না।
বুড়ীকে বেধে ফেলে কিরীটী উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল। জাপটে ধরবার সময় বুড়ীর হাতের বাতিটা ছিটকে পড়ে নিভে গিয়েছিল। কিরীটী পকেট থেকে দেশলাই বের করে একটা জালাল; তারপর সেই অন্ধকার গলিপথ দিয়ে খানিকটা অগ্রসর হতেই দেখা গেল, অদূরে একটা ঘরের দরজার পাশে টুলে বসে একটা চীনা যুবক, ঝিমুচ্ছে। দেওয়ালে একটা ওয়াল-ল্যাম্প পিটপিট করে জলছে। তারই প্লান আলো তন্দ্রাচ্ছন্ন চীনাটির মুখের উপর এসে পড়েছে। লোকটা কিছুই টের পায়নি তাহলে। সামনের ঘরের দরজাটা ভেজানো। ঘরের ভিতর থেকে মাঝে মাঝে অস্পষ্ট কথাবার্তার দু-একটা টুকরো আওয়াজ শোনা যায়। কিরীটী একেবারে দেওয়ালের গায়ে গা লাগিয়ে অতি সন্তর্পণে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল। তারপর চীনা লোকটির কাছাকাছি এসে হঠাৎ পিছন দিক থেকে দুহাত দিয়ে খুব জোরে তার গলা জড়িয়ে ধরল।
আধো ঘুমন্ত অবস্থায় অতর্কিত আক্রান্ত হয়ে লোকটি যেমন চমকে উঠেছিল তেমনি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল এবং সেই অবস্থাতেই লোকটাকে জাপটে ধরে মাটিতেই গড়িয়ে গড়িয়ে খানিকটা পিছন দিকে চলে এল কিরীটী।
অতর্কিত আক্রমণে চীনা লোকটা প্রথমটা বিশেষ হকচকিয়ে গিয়েছিল সত্যিই, কিন্তু একটু পরেই নিজেকে সে কিরীটীর বাহু বেষ্টন থেকে ছাড়াবার জন্যে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু কিরীটীর দৈহিক শক্তির কাছে পেরে ওঠে না। এবং পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
প্রথম থেকে কিরীটী লোকটা যাতে কোনরূপ শব্দ না করতে পারে, সেজন্য সতর্ক হয়ে লোকটার মুখে হাত চাপা দিয়েছিল, পরে একটা রুমাল ঠেলে ধরল মুখের মধ্যে। তারপর পকেট থেকে একটা সিল্ক কর্ড বের করে লোকটার হাত-পা বেধে ফেলল। তার পর ক্ষিপ্রগতিতে লোকটার জামা ও মাথার টুপি খুলে নিয়ে নিজে সেগুলো পরে নিল।
পরাজিত রজ্জুবদ্ধ লোকটা তার ছোট কুৎসিত চোখ দুটো মেলে অন্ধকারে হয়তো কিরীটীকে দেখবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু সেদিকে কিরীটীর আদৌ লক্ষ্য ছিল না। মাথার কালো চীনা টুপিটা কপালের নীচে ভুরু পর্যন্ত কিরীটী টেনে দেয়। এই সমস্ত কাজ করতে কিরীটীর দশ-পনেরো মিনিটের বেশী সময় লাগেনি। আর দেরি না করে কিরীটী ঘরের ভেজানো দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল। অতি ধীরে দু আঙুলে চাপ দিয়ে এবারে দরজাটায় একটু ঠেলা দিল। দুটো কপাট সরে গিয়ে সামান্য একটু ফাঁক হয়ে গেল। দেখা গেল, একটা ভাঙা টেবিলের পাশে তিনজন লোক গভীর মনোযোগ সহকারে বসে বসে কি সব কথাবার্তা বলছে। মুখের হাবভাবে মনে হয় যেন অত্যন্ত জরুরী কিছুর গোপন পরামর্শ চলেছে ঘরের লোকগুলোর মধ্যে।
দুজনের মুখ দেখা যায় না, তারা দরজার দিকে পিছন ফিরে বসেছে। যার মুখ দেখা যায়, সেরকম বীভৎস মুখ কিরীটী জীবনে দেখেছে কিনা সন্দেহ। হঠাৎ দেখলে মনে হয় বুঝি কোন শ্মশানচারী প্রেতলোকবাসী! প্রেতলোকের বিভীষিকায় মুখখানা বীভৎস! কি একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন যেন ওর মুখের প্রতি রেখায় রেখায় ফুটে উঠেছে।
লোকটার ডান দিকটার কপাল ও গাল বোধ হয় কবে পুড়ে গিয়েছিল। সর্বগ্রাসী হুতাশন যেন তার নির্মম চিহ্ন রেখে গেছে ডান দিককার কপাল ও গালটাকে টেনে কুকড়ে বীভৎস করে দিয়ে। সেই সঙ্গে ডান দিককার চোখটাও যেন ঠেলে কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। সেই বীভৎস কুৎসিত মুখের ওপরে আলোর ম্লান শিখা পড়ে আরও ভয়াবহ মনে হয়।
লোকটার হাতে একটা তীক্ষ্ণ বাঁকানো ছুরি। সে সেটিকে দু আঙুলে দোলাতে দোলাতে কাকে যেন লক্ষ্য করে বললে, সনৎবাবু আবার ভেবে দেখ। এখনও সময় আছে।
সনৎবাবু নাম শুনেই কিরীটী চমকে উঠল।
লোকটি আবার বললে, হ্যাঁ, এখনও সময় আছে। আমাদের এইভাবে কলকাতায় আসতে বাধ্য করার জন্য খেসারত দশ হাজার না হোক—অন্ততঃ আমার দাবির দশ হাজার এবং কথার খেলাপের জন্য দশ হাজার টাকা—সর্বসমেত কুড়ি হাজার দিলেই মুক্তি পাবে।
আমি তো তোমাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি—টাকা তুমি পাবে না। তোমার যা খুশি আমাকে নিয়ে করতে পার।
সনৎবাবু তোমার দুঃসাহস দেখে সত্যিই অবাক হয়ে যাচ্ছি। নিশ্চিত মত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও কেমন করে যে তুমি নিশ্চিন্ত থাকার ভাব করছ তা তুমিই জান। একটু থেমে আবার বলল, সেবারে বড় ফাঁকিটা দিয়েছিলে। রেঙ্গুনে তোমার বাড়িতে সেই অপমান, শুধু তাই নয়, এত দুঃসাহস তোমার, আমার প্রেরিত মত্যুদূত ড্রাগনকে ঘৃণাভরে মাটিতে আছড়ে ফেলেছিলে। কিন্তু দেখছি তার চেয়ে ঢের বেশী দুঃসাহস ঐ টিকটিকি কিরীটী রায়ের। বলতে বলতে সহসা সে কথার মোড় ফিরিয়ে হাতের তীক্ষ্ণ ছুরিখানা একবার ঘুরিয়েই বোঁ করে চোখের নিমেষে দরজার দিকে লক্ষ্য করে ছুড়ে দিল। সোঁ করে ছুরির তীক্ষ্ণ অগ্রভাগটা এসে কপাটের গায়ে বিধে থর-থর করে কাঁপতে লাগল
ব্যাপারটা এত চকিতে ঘটে গেল যে, কিরীটী ক্ষণপূর্বে স্বপ্নেও তা ভেবে উঠতে পারেনি।
কত বড় খরসন্ধানী দৃষ্টি চারিদিকে সজাগ রেখে লোকটা সদাসতর্ক থাকে, সে কথা ভাবলেও বুঝি সত্যি শ্রদ্ধায় ও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে দরজার কাছ থেকে সরে পড়বার পূর্বেই–ক্ষুধিত নেকড়ের মত দুই হাত দিয়ে টেবিলের ওপর ভর দিয়ে, সামনে উপবিষ্ট লোক দুটোর ঘাড়ের ওপর দিয়েই, সেই কুৎসিত-দর্শন লোকটি দরজার গোড়ায় এসে পড়ল মুহূর্তে এবং এক ঝটকা মেরে দরজাটা খুলেই সে কিরীটীর কাঁধে একটা হাত দিয়ে চীনা ভাষায় কঠোর স্বরে বললে, কি শুনছিলি হতভাগা!
তারপর বিরাট এক ঝাঁকুনি দিয়ে ঘাড় ধরে তাকে সামনের টুলটির ওপর বসাতে যেতেই ঘরের আলোয় অদূরে দড়ি-বাঁধা সেই চীনা যুবকটার দিকে তার নজর পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে সে চমকে দু পা পিছিয়ে গেল।
আর দেরি করা সঙ্গত নয়, শুধু বোকামি– ভেবেই কিরীটী মুহূর্তে জোরে এক ধাক্কা মেরে লোকটাকে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে চকিতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে ভিতর থেকে খিল তুলে দিল।
অদূরে মেঝেয় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে সনৎ। ওদিকে ঘরের মধ্যে উপবিষ্ট লোক দুটো কিরীটীর খিল বন্ধ করার শব্দে চমকে ফিরে তাকাল। ততক্ষণে কিরীটী দরজার গা থেকে সেই ছুরিটা এক টান মেরে তুলে নিয়ে সনৎ-এর কাছে গিয়ে পটাপট করে তার বাঁধন কাটতে শুরু করে দিয়েছে।
লোক দুটো সত্যিই বিস্ময়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছে। কিন্তু সে মুহর্তের জন্য, পরক্ষণেই তারা দুজনেই একসঙ্গে ছুটে এল কিরীটীর দিকে। কিরীটী ফিরে দাঁড়িয়ে প্রথম লোকটির হাতে ছুরি দিয়ে ভীষণভাবে এক আঘাত করলে। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে পিছিয়ে গেল।
এদিকে দরজার গায়ে মুহুর্মুহু ধাক্কা পড়ছে। আর বাঁধন কেটে দিতেই বাকী বাঁধনগুলো পট-পট করে ছিড়ে ফেলে সনৎ এসে উঠে দাঁড়াল।
ইতিমধ্যে সেই লোক দুটো ছুটে এসে আবার ওদের আক্রমণ করল! কিরীটী আর সনৎ কায়দা করে লোক দুটোর কবল থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে ঘরের মধ্যে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে বেড়াতে লাগল।
ওদিকে বাইরে থেকে তখন মুহুর্মুহু ধাক্কায় দরজাটা প্রায় ভেঙে পড়বার যোগাড়, আর লোক দুটো তখন ওদের ধরবার জন্য প্রায় মরীয়া হয়ে উঠেছে। তাদের চোখ-মুখে সে কি ব্যাকুল আগ্রহ!
কিরীটী স্পষ্টই বুঝতে পারছিল, এইভাবে বেশীক্ষণ আত্মরক্ষা করা মোটেই চলবে না। বাইরে থেকে দরজা ভেঙে ফেলবেই, তাছাড়া এদের দলে কজন আছে, তাই বা কে জানে! এখান থেকে বাঁশি হাজার জোরে বাজালেও বাইরে অপেক্ষমাণ সুব্রত বা রাজেনবাব, কেউই শুনতে পাবেন না।
সহসা এমন সময় মড়মড় করে প্রচণ্ড শব্দে দরজাটার খিলটা ভেঙে গেল এবং ভাঙা দরজাপথে অল্প আয়াসেই ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল একটু আগেই আক্রমণকারী কুৎসিত-দর্শন সেই লোকটা পুচ্ছ-মর্দিত ক্রুদ্ধ শার্দূলের প্রচণ্ড জিঘাংসায়।
কিরীটী স্থির হয়ে দাঁড়াল।