০৪. কিরীটী রায়
রাজু যন্ত্রণায় কাতর ক্লিষ্ট স্বরে জবাব দিল, হাতের পাতায় কি যেন ফুটল সুব্রত।
সুব্রত পকেট থেকে টর্চটা বের করে বোতাম টিপল। কিন্তু আশ্চর্য, হাতের পাতায় কিছুই তো ফোটেনি। কিছু বিধেও নেই, এমন কি এক ফোঁটা রক্ত পর্যন্ত পড়েনি। হাতটা ভালো করে টর্চের আলোয় ঘুরিয়ে দেখা হল কোন চিহ্নই নেই। অথচ রাজার হাতের পাতা থেকে কনুই পর্যন্ত ঝিম ঝিম করছে অসহ্য যন্ত্রণায়। যেন অবশ হয়ে আসছে হাতটা।
কই, কিছু তো তোমার হাতে ফুটেছে বলে মনে হচ্ছে না! কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। সুব্রত বলে।
কিন্তু মনে হল হাতে যেন কি একটা ফুটল, ফোটার সঙ্গে সঙ্গে মাথা পর্যন্ত ঝিম ঝিম করে উঠেছে, এখনও হাতটায় যেন কোন জোর পাচ্ছি না। বললে রাজু।
চল ফেরা যাক। সুব্রত আবার বলে।
কিন্তু ঐ বাড়িটা দেখবি না? যে জন্য এলাম!
না, কাল সকালের আলোয় ভাল করে একসময় এসে বাড়িটা না হয় খোঁজ করে দেখা যাবে। কিন্তু আমি ভাবছি ঐ সাইকেল-আরোহী লোকটা কে? কেনই বা এ পথে এসেছিল? লোকটা আচমকা এ পথে এসেছে বলে তো মনে হয় না। ও নিশ্চয়ই আমাদের ফলো করেই এসেছিল।
যা হোক দুজনে আপাতত বাড়ির দিকে অগ্রসর হল।
রাতের আকাশ ফিকে হয়ে আসছে। শেষ রাতের আঁধার তরল ও ম্লান হয়ে এসেছে। নিশিশেষের ঠাণ্ডা হাওয়া ঝিরঝির করে বয়ে যায়। রাজু আর সুব্রত বাড়ি ফিরে এসে নিজেদের ঘরে প্রবেশ করে শয্যায় আশ্রয় নিল এবং শীঘ্রই দুজনের চোখের পাতায় ঘুম জড়িয়ে আসে।
সুব্রতর যখন ঘুম ভাঙল, রাজু তখনও ঘুমিয়ে।
পূর্ব রাত্রের ব্যাপারটা সুব্রতর একে একে নতুন করে আবার মনে পড়ে। আজই একবার কিরীটীবাবুর ওখানে যেতে হবে। চাকরকে ডেকে চা আনতে বলে সুব্রত বাথরুমের দিকে পা বাড়াল।
বাথরুমে ঢুকে ঝর্ণা নলটা খুলে দিয়ে সুব্রত তার নীচে মাথা পেতে দাঁড়াল। ঝাঁঝরির অজস্র ছিদ্রপথে জলকণাগুলো ঝিরঝির করে সারা গায়ে ও মাথায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সুব্ৰত সমস্ত শরীর দিয়ে স্নানটা উপভোগ করল। অনেকক্ষণ ধরে স্নান করার পর শরীরটা বেশ ঠাণ্ডা হল। পূর্বরাত্রের জাগরণ-ক্লান্তি যেন অনেক পরিমাণে কমে গেছে।
ভিজে তোয়ালেটা গায়ে জড়িয়ে সোজা রাজুর কক্ষে এসে সুব্রত দেখে রাজু হাতের মুঠো মেলে কি যেন একটা একাগ্র দৃষ্টিতে দেখছে।
সুব্রত বললে, কি দেখছ অত মনোযোগ দিয়ে?
রাজু, সে কথার কোন জবাব না দিয়ে নিঃশব্দে একটা কার্ড সুব্রতর দিকে তুলে ধরে।
কার্ডটার গায়ে কালি দিয়ে ছোট ছোট করে লেখা—
কালো ভ্রমরের হুল, এমনি মিষ্টি-মধুর। কেমন লাগল বন্ধু!
কোথায় পেলে এটা? সুব্রত শুধাল!
রাজু বলল, জামার পকেটে ছিল এটা।
কার্ডটা রাজুর হাত থেকে টান মেরে নিয়ে রাস্তায় ফেলে দিতে দিতে সুব্রত তাচ্ছিল্যভরে বললে, বড় আর দেরি নেই, হুলের খোঁচা হজম করবার দিন এগিয়ে এল। চল চল, একবার টালিগঞ্জে কিরীটীবাবুর ওখানে যাওয়া যাক। এর পর গেলে হয়তো আবার তাঁকে বাড়িতে নাও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমি ভাবছি, ওরা জানলে কি করে যে অত রাত্রে আমরা গলিপথে যাব?
চর আছে সর্বত্র, যারা হয়তো সর্বদা আমাদের ওপর নজর রেখেছে—এ কি, তুই যে স্নান পর্যন্ত সেরে ফেলেছিস। রাজু বলে।
হ্যাঁ, শরীরটা বড় ক্লান্ত মনে হচ্ছিল।
তবে দাঁড়া, আমিও স্নানটা সেরে নিই চট করে।
***
টালিগঞ্জে সুন্দর একখানা দোতলা বাড়ি। সেই বাড়িখানিই কিরীটী রায়ের।
কিরীটী রায়
রহস্যভেদী।
দ্বিতল বাড়িখানি বাইরে থেকে দেখতে সত্যই চমৎকার, আধুনিক প্যাটার্নের নয়, পুরাতন স্টাইলে সবুজ রংয়ের বাড়িখানি।
বাড়ির সামনে ছোট একটা ফুলফল তরিতরকারির বাগিচা। ওপরে ও নীচে সবসমেত বাড়িতে চারখানি মাত্র ঘর। ওপরের একখানিতে কিরীটী শয়ন করে, একটিতে তার রিসার্চ ল্যাবরেটারী। নীচে একটায় লাইব্রেরী ও আর একটায় বৈঠকখানা : তিনজন মাত্র লোক নিয়ে সংসার-কিরীটী নিজে, একটা আধবয়সী নেপালী চাকর নাম তার জংলী ও পাঞ্জাবী শিখ ড্রাইভার হীরা সিং।
ভৃত্য জংলীর যখন মাত্র ন বছর বয়স, তখন একবার কাশিয়াং বেড়াতে গিয়ে কিরীটী তাকে নিয়ে আসে।
মা-বাপ হারা জংলী এক দূর সম্পকীয় আত্মীয়ের কাছে থাকত। সেবারে কিরীটী যখন কাশিয়াং বেড়াতে গেল, তখন সব সময়ে তার ছোটখাটো ফাইফরমাশ খাটবার জন্য একটা অল্প বয়সের চাকরের খোঁজ করতেই তার এক বন্ধু জংলীকে এনে দেয়।
দীর্ঘ পাঁচ মাস কার্শিয়াং-এ কাটিয়ে কিরীটী যেদিন ফিরে আসবে, জংলীকে মাহিনা দিতে গেলে সে হাত গুটিয়ে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করলে। তাকে ঐ অবস্থায় দাঁড়াতে দেখে কিরীটী সস্নেহে শুধায়, কি রে? কিছু বলবি জংলী?
জংলী কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। কিরীটী বলে, হ্যাঁ রে, কিছু বলবি?
জংলীর মনে এবার বুঝি আশা জাগে, তাই ধীরে ধীরে মুখটা তোলে। তার চোখের কোন দুটি তখন জলে উবুচুবু।
কি হয়েছে রে জংলী?
বাবুজী! আর কি আপনার চাকরের দরকার হবে না?
ও এই কথা!
এতক্ষণে সমস্ত ব্যাপারটা যেন কিরীটীর কাছে জলের মতই পরিষ্কার হয়ে যায়। হাসতে হাসতে বলে, তোর দেশ, তোর আত্মীয়স্বজন—এদের সবাইকে ছেড়ে তুই আমার কাছে কলকাতায় গিয়ে থাকতে পারবি?
চোখের কোলে অশ্রুমাখা হাসি নিয়ে খুশীর উচ্ছলতায় গদগদ হয়ে জংলী জবাব দেয়, কেন পারব না বাবু, খুব পারব। আর এখানে থেকে আমি কি করব। এখানে আমার কেই বা আছে। মা বাপ তো আমার কতদিন হল মারা গেছে। আমার তো কেউ নেই।…শেষের দিকটা বালকের কণ্ঠস্বর কেমন যেন জড়িয়ে যায়।
তাই কার্শিয়াং ছেড়ে আসবার সময় কিরীটী জংলীকে তার আত্মীয়দের কাছ হতে চেয়ে নিয়ে আসে। তারাও ঘাড়ের বোঝা নামল ভেবে বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
সে আজ দীর্ঘ সাত বছর আগের কথা। এখন জংলীর বয়স ষোল বৎসর। সে এখন বলিষ্ঠ যুবা; কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে সর্বদাই ছায়ার মত ঘোরে সে। অনেক সময় কিরীটীর সহকারী পর্যন্ত হয়। যেমনি বিশ্বাসী তেমনি প্রভুভক্ত।
পাহাড়ের দেশ থেকে কুড়িয়ে আনা অনাথ বালক, শ্নেহের মধুস্পর্শ পেয়ে আপনাকে নিঃস্ব করে বিলিয়ে দিয়েছে। মানুষ বুঝি অমনিই স্নেহের কাঙাল!
***
সেদিন সকালবেলায় একটা সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে কিরীটী সেদিনকার দৈনিকটার ওপর চোখ বুলোচ্ছিল। এমন সময় পত্রিকার দ্বিতীয় পাতায় বড় বড় হেডিংয়ে ছাপা সনৎ-এর উধাও হওয়ার সংবাদটা তার চোখে পড়ল।
কিরীটী কাগজের লেখাগুলোর উপর সাগ্রহে ঝুকে পড়েছে, ঠিক এমনি সময়ে সিঁড়িতে জুতোর শব্দ তার কানে এসে বাজল। জুতোর শব্দ আরোও এগিয়ে একেবারে দরজার গোড়ায় এলে কাগজ হতে মুখ না তুলেই হাসিমুখে সংবর্ধনার সুরে বললে, আসুন সুব্রতবাবু! আমি জানতাম আপনি আসবেন, তবে এত শীঘ্র বলতে বলতে কিরীটী হাঁক দিলে, জংলী, বাবুদের চা দিয়ে যা।
কিরীটী রায়ের কথা শুনে, সব্রত ও রাজু যেন হতবাক হয়ে গেছে। লোকটা কি সবজান্তা, তা না হলে না দেখেই জানতে পারে কি করে কে এল।
প্রথমটায় যে কি বলবে তা ওরা যেন ভেবেই পেলে না! বিস্ময়ের ভাবটা কাটবার আগেই কিরীটী কাগজের ওপর হতে চোখ সরিয়ে নিয়ে ওদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, নমস্কার সুব্রতবাবু, রাজেনবাবু, আরে দাঁড়িয়েই রইলেন যে! বসুন বসুন।
দুজনে এগিয়ে এসে দুখানা সোফা অধিকার করে বসল।
তারপর হঠাৎ এই সকালেই কি খবর বলুন শুনি? কিরীটী রায় সাগ্রহে শুধায়। সোফার ওপর বসতে বসতে সুব্রতই বলে, বলছি, কিন্তু তার আগে বলুন তো, কেমন করে আমাদের না দেখেই বুঝলেন যে আমরাই এসেছি। আপনি কি পায়ের শব্দেই লোক চিনতে পারেন নাকি?
কিরীটী মৃদু হেসে বললো, কতকটা হ্যাঁও বটে, আবার নাও বটে। এইমাত্র খবরের কাগজ খুলতেই চোখে পড়ল সনৎবাবুর গায়েব হওয়ার চাঞ্চল্যকর সংবাদ। আর আপনাদের সঙ্গে তো আমার কথাই ছিল, আবার কোন রকম গোলমাল হলে আপনারা দয়া করে আমাকে একটা খবর দেবেন। সহজ নিয়মে দুয়ে দুয়ে চার কষে ফেলতে দেরী হয়নি। এত সকালে জুতোর শব্দ পেয়ে প্রথমেই তাই আমার আপনাদের কথাই মনে পড়ল, আর সেই আন্দাজের ওপরে নির্ভর করে আপনাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছি এবং আপনারাও যখন আমার অভ্যর্থনা শুনে চুপ করে রইলেন, তখন আমি স্থিরনিশ্চিত হলাম, আমার অনুমান মিথ্যা হয়নি।
চমৎকার তো।-রাজু বললে।
না, এর মধ্যে চমৎকারের বা আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। কতকটা সত্যি, কিছুটা মিথ্যে আর বাকিটা অনুমান—এই রীতির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের কার্যপদ্ধতি। বলতে পারেন কমনসেন্স-এর মারপ্যাঁচ মাত্র। একজন শয়তানকে তার দুষ্কর্মের সুত্র ধরে খুঁজে বের করা এমন বিশেষ কিছু একটা কঠিন বা আজব ব্যাপার নয়। দুষ্কর্মের এমন একটি নিখুত সূত্র সর্বদাই সে রেখে যায় যে, সে নিজেই আমাদের তার কাছে টেনে নিয়ে যায় সেই সূত্ৰপথে। এ সংসারে পাপ-পুণ্য পাশাপাশি আছে। পুণ্যের পরিষ্কার ও পাপের তিরস্কার—এইটাই নিয়ম। আজ পর্যন্ত পাপ করে কেউই রেহাই পায়নি। দৈহিক শান্তি বা দশ বছর জেল হওয়া অথবা দ্বীপান্তর যাওয়াটাই একজন পাপীর শাস্তিভোগের একমাত্র নিদর্শন নয়; ভগবানের মার এমন ভীষণ যে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরও তার কাছে একান্তই তুচ্ছ। বিবেকের তাড়নায় মানসিক যন্ত্রণায় চোখের জলের ভিতর দিয়ে তিল তিল করে যে পরিতাপের আত্মগ্লানি ঝরে পড়ে, তার দুঃসহ জালায় সমস্ত বুকখানাই যে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। স্থূল চোখে আমরা অনেক কিছুই দেখতে পাই না বটে, কিন্তু তাই বলে তার অস্তিত্বটাই একেবারে অস্বীকার করে উড়িয়ে দেবার ক্ষমতাই বা আমাদের কোথায় বলুন? গায়ের জোরে সব কিছুকে অস্বীকার করতে চাইলেই কি মন আমাদের সব সময় প্রবোধ মানে সুব্রতবাবু?
হয়তো সব সময় মানে না।
হয়তো কেন, নিশ্চয়ই। আচ্ছা যাক সে-কথা; তারপর আগে সব ব্যাপারটা খুলে বলুন তো, শোনা যাক।
সুব্রত তখন ধীরে ধীরে এক এক করে সমস্ত ব্যাপারটাই খুলে বলল।
সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে কিরীটী কিছুক্ষণ পর্যন্ত চুপ করে বসে রইল, তারপর সোফা থেকে উঠে ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করতে করতে বললে, হ্যাঁ, জাহাজে দুটো সীট তো রিজার্ভ করেছেন। আরও দুটো সীট রিজার্ভ করুন সুব্রতবাব। পরশু সকালে আমাদের জাহাজ ছাড়ছে তা হলে, কি বলেন? কিন্তু আমি ভাবছি, লোকটা আপনাদের চোখে বেশ স্বচ্ছন্দেই ধুলো দিয়ে গেল; আপনারা টেরও পেলেন না?
সুব্রত বললে, বনমালী বসু তো?
না, কালো ভ্রমর স্বয়ং।
হ্যাঁ, আমিও তাই বলছি, বনমালী বসুই স্বয়ং কালো ভ্রমর।
না, বনমালী বসু কালো ভ্রমর নয়।
সে নয়! তবে?
আপনাদের পোড়ো বাড়ির সামনে শিকারী বিড়ালই স্বয়ং কালো ভ্রমর।
কি করে এ কথা আপনি বুঝলেন?
পরে বলব, তবে বনমালী বসুও কালো ভ্রমরের দলের লোকই বটে এবং সে বিষয়েও কোন ভুল নেই। এতে করে এও প্রমাণিত হচ্ছে যে তারা আটঘাট বেধেই কাজে নেমেছে এবারে। অবশ্য বনমালী বসুর কথাবার্তাতেই আপনাদের বোঝা উচিত ছিল, অনেক কিছু অসঙ্গতি তাঁর কথার মধ্যে আছে, ভদ্রলোক ডিব্রুগড়ে বসেই সি, আই, ডি-র তার পেয়েছিলেন মাত্র দিন দশেক আগে, কিন্তু ঐ সময়ের মধ্যে ডিব্রুগড়ে বসে তার পেলেও, ঐদিনকার রেঙ্গুনের সংবাদপত্রের কাটিংটা পাওয়া নিশ্চয়ই সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে! সন্দেহ তো ঐখানেই ঘনীভূত হয়ে ওঠে।
আশ্চর্য, এটা কিন্তু আমাদের আপদেই মনে হয়নি! বলে সুব্রত।
না হওয়াটাই স্বাভাবিক।
এরপর সুব্রত ও রাজু, কিরীটীর নিকট বিদায় নিয়ে রাস্তায় এসে নামল।