অনার্স ৩য় বর্ষের এক্সাম শুরু হবে জানুয়ারি থেকে। আবিদ ওর বড় বোনের বাসায় এসে এক্সামেরই প্রস্তুতি নিচ্ছে। ২৫ কি.মি. দূর থেকে এক্সাম দিতে এসে টানা ৪ ঘন্টা এক্সাম শেষে পুনরায় বাসে চেপে বসা আবিদের কাছে বরাবরই বিরক্ত আর অসস্থিকর অবস্থায় ফেলে দেয়। তাই ২য় বর্ষ থেকে আবিদ ওর বড় বোন জেসিকার বাসা থেকে এক্সাম দেয়ার কথা ভেবেছিল। তবে পরক্ষণেই ভাবনাটার ইতি ঘটেছিল লজ্জা নামক শব্দে। দুলাভাই কি ভাব্বে? আপার শ্বাশুড়ি কি ভাব্বে??
বিষয়টা কেমন ভাবে নেবে ওনারা এই নিয়ে আবিদ একপর্যায়ে বাসা থেকেই এক্সাম দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু বাবা মা আর ওদিকে আপা দুলাভাইয়ের জোরাজুরিতে শেষমেষ ২য় বর্ষের এক্সামটা বোন জেসিকার বাসা থেকেই দিয়েছিল আবিদ। এবারও তাই জানুয়ারির আগেই বোনের বাসায় চলে এসেছে আবিদ। বাসায় অনেক কাজ। ক্ষেতের কাজে প্রায় অনেক সময়ই আবিদের চলে যেত৷পড়াশোনার কিছুই হত না। তাই বোন জেসিকার সাহায্যে এক্সামের ১৫ দিন আগেই বোনের বাসায় এসে উঠেছে আবিদ। জেসিকা ওর ভাইকে অনেক ভালোবাসে। ছোট্ট সময়ে ওদের মা যখন অসুস্থ হয়ে পড়ত, তখনি আবিদ বুঝতে পারত একজন বোন থাকা ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আর আল্লাহ তায়ালা, মেয়েদেরকে কেনই বা রহমত বলে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন।
যাহোক, পড়াশোনার প্রয়োজন সাপেক্ষে শেষ রাত্রে উঠতে হয় আবিদকে। দিনেতে দুলাভাইয়ের কাজে সাহায্য করে দেয়ার কারণে, আর লজ্জায় পড়াশোনাটা তেমন হয়না বিধায় এই ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে লেপের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে বিছানার উপরে বসে পড়তে হচ্ছে আবিদকে।
— শীতেযে কেনো স্যাররা এক্সাম দেয়, আমরা কি মানুষ না?? আমাদের কি ওনাদের মতো শরীর না??
কথাগুলো একবার ভাবছে তো পরক্ষণেই পড়ার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে আবিদ। প্রায় দু ঘন্টা পড়ার পরে কাছের মসজিদ থেকে আজান ভেসে এলে আবিদ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। শীতে যেন পুরো শরীর জমে যাচ্ছে। পাশের ঘর থেকে জেসিকার কন্ঠের আওয়াজ পাচ্ছে আবিদ। জেসিকা ওর একমাত্র ছেলে জিসানকে বকা দিচ্ছে এটা আবিদ স্পষ্ট বুঝতে পারছে।
কিন্তু কি কারণে এটাই আবিদের বুঝে আসছে না। সে যাই হোক, আবিদ দরজা খুলে বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে পশ্চিমের আকাশের চাঁদের অপরুপ সৌন্দর্য দেখাতে মনোযোগ দিলো৷ এত সুন্দর্যতা মালিকের দ্বারাই শুধু দেয়া সম্ভব ভেবে আবিদ মুচকি হেসে দিলো। উঠানে নেমে আবিদ কিছুটা হাটাহাটি করে, ওয়াশরুমের কাছে গিয়ে ট্যাপের পানি ছেড়ে দিলো । হাতে ট্যাপের পানি লাগতেই যেন আবিদের কলিজায় গিয়ে তার তোড়টা লাগল। সামান্য এটুকু পানিই যেন ওকে জমিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আবিদের তখন মনে হলো, এখন এই মুহুর্তে যদি এটুকু কষ্ট সহ্য না করি তো, জাহান্নামের আগুনও আমার কলিজাতেই প্রথম লাগবে। অযু শেষে রুমে আসার পথে বোনের আবার সেই রাগী কন্ঠ।
–জিসান, বাহিরে যেতে বারণ করছি না?? এত দুষ্ট কেন হয়েছ তুমি?? বাহিরে যেই শীত পড়ছে, ঠান্ডা লেগে যাবে। বার বার একই কথা বলছি। কথা কি কানে যাচ্ছে না??
–আম্মু, আমি মামার কাছে যাব। আমিও অযু করে নামাজ পড়ব।
–কত্ত নামাজী হয়েছে রে। বড় হও পড়বা। এখন না। তুমি অনেক ছোট। ঘুমাও।
বোনের এমন কথায় আবিদের মনটা খারাপ হয়ে যায়। কারণ জিসানের বয়স ১০ গিয়ে ১১ পড়েছে আর বাচ্চাদের নামাজের হুকুম ছোট থেকেই দেয়ার কথা আছে সেখানে আর কত বড় হলে জিসান নামাজ পড়বে?? আর এখন যখন জিসান নিজ উৎসাহে নামাজের দিকে মনোযোগ দিতে চায়ছে সেখানে জেসিকা নিজে বাধা দিচ্ছে শুধুমাত্র শীতের কারণে, ঠান্ডা লাগবে ভয়ে।
কাঁপাকাঁপা শরীর নিয়ে রুমে এসে তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে জায়নামাজে বসে পড়ল আবিদ। নামাজ শেষে আবিদ মোনাজাতে এই প্রার্থণা করল যে, আমার আপুটা যেন সঠিক বুঝটা পায় মালিক। সকাল ৯ টায় তাড়াহুড়ো করে ছেলে জিসানকে রেডি করে স্কুলে পাঠিয়ে, বাসার সব কাজ শেষ করে, ভাই আবিদের পাশে এসে বসল জেসিকা।
–তোর সাথে কিছু কথা ছিল আপু।
–হু বল। জেসিকা বিছানায় শুয়ে পড়ল।
–কিছু মনে নিস না। জিসানের সাথে রাত্রে যে কথাগুলো বলেছিস আমি সব শুনছি। কিন্তু একটা কথাকি জানিস?? তোর ছেলের নামাজের সময় হয়ে গিয়েছে আপু। ১১ বছরের ছেলেকেও যদি বাচ্চা আর ছোট বলে নামাজে যেতে বারণ করিস তো বড় হয়েও তো বলবি ও আগে নামাজ বুঝুক তারপর পড়বে।
–জেসিকা বিছানা ছেড়ে উঠে টিভি ছেড়ে বলল, দেখ, আবহাওয়ার অবস্থা দেখ। আর তাছাড়া জিসানের এমনিতেই ঠান্ডা পানি সহ্য হয়না। এরপর নিউমোনিয়া হলে কি হবে বুঝতে পারছিস??তোর দুলাভাই তো আমাকে জেরা করবে, আমি কেন ছেলের যত্ন নেয় নি??কেন ঠান্ডা লাগল ইত্যাদি।
–এই ভয়ে তোর ছেলেকে নামাজে দিস না আপু?? হায়রে! আচ্ছা আপু তুই জান্নাত বিশ্বাস করিস??
–এ কেমন কথা?? অবশ্যই করি।
–তাহলে তার বিপক্ষ জাহান্নাম?? করিস তো বিশ্বাস??
–কি শুরু করলি?? কেন বিশ্বাস করব না। জেসিকা বিরক্ত মুখে বলল।
–তুই যদি জাহান্নাম বিশ্বাস করতি তাহলে নিশ্চয় এই কথাটা জানতি কোন হারাম বা পাপ কাজের জন্য কোন ব্যক্তিকে যখন জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। জাহান্নামের আগুন প্রথমে তার কলিজায় এসে লাগবে। তুই কি চাস তোর সন্তানের কলিজায় জাহান্নামের আগুন লাগুক?? সহ্য করতে পারবে জিসান?? কিংবা তুই নিজেও?? কারণ তুই তোর সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দেয়ার পরিবর্তে আরো বিপদে ফেলার চেষ্টা করছিস তাহলে পাপী তো তুই নিজেও।
–কিন্তু আমিতো ওর ভালো চাই আবিদ?
–আমরা সবাই ভালো চাই। কেমন ভালো জানিস?? ধর, তোর ছেলের কষ্ট হবে ভেবে নামাজে যেতে দিবি না, স্কুলে বড়লোকদের ছেলেপুলেদের সাথে বন্ধুত্ব করতে বলবি, গরীবদের সাথে না। তাই না?? আবার ধর, আম্মার সময় কাটে না জন্য বাসায় টিভি দিয়ে এসে জি বাংলা স্টার জলসার কারণে সন্ধায় নামাজ না, বাসায় উলুধনি শুনার মতো ভালো কাজ করবি। অনেক ভালো চাই আমরা তাই না বল??
–কিন্তু আম্মা যে বাসায় একা থাকে। সময় যায় না তাই!
–তাই বলে পাপ বৃদ্ধির কাজটা করে দিয়ে এসেছিস না আপু?? জানিস এই টিভি যে মাঝেমধ্যে খারাপ হয় বলে আম্মা তোকে বলত, ওটা এমনি এমনি খারাপ হত না। আমি নিজে টিভির জ্যাক কেটে ভেতরে তারগুলো উল্টো পালটা করে দিতাম। সরাসরি আম্মুকে বললে আম্মু কষ্ট পাবে তাই এই চিন্তা করেছিলাম কিন্তু তুই প্রতিবারের ন্যায় গিয়ে ঠিক করে দিয়ে আসতি।
–জেসিকা নিশ্চুপ।
–আপু, কারোর ভালো করার অনেক হালাল জিনিস/মাধ্যম আছে। আম্মু যেহেতু পড়তে জানে না সেহেতু আম্মুকে একটা সাধারণ ফোন কিনে ওতে কয়েকটা ওয়াজ সেট করে দিলে কি সে শুনতে পারত না?? এতে খারাপ হত নাকি ভালো বল?? শোন আপু, ভালোর মধ্যে থাকলে তুই ভালো কিছু চিন্তা কিংবা ভালো কিছু করার কথা ভাববি কিন্তু খারাপের মধ্যে থাকলে খারাপ তোকে সেদিকেই টানবে।
আবিদ পড়ার দিকে মনোযোগ দিলো। আর জেসিকা জানালার বাহিরে চেয়ে রইল। আবিদ মনে মনে ভাবছে, বলার দায়িত্ব আমার। করা না করার দায়িত্ব তোদের। কারণ ইসলামে কোনকিছুরই জোরাজুরি নেই। জোর করে কাউকে আর যাই হোক, ইবাদাতে মনোযোগী করানো যায় না।