০৮. বিস্ময়ে একেবারে অভিভূত
আমি তখন বিস্ময়ে যেন একেবারে অভিভূত।
থি’ব নামধারী লোকটিকে না চিনলেও তার সঙ্গিনী নারীকে চিনতে পেরেছিলাম—ম্যাডাম মা’থিন।
থি’বর নার্ভের কিন্তু সত্যিই প্রশংসা করতে হয়। নিঃশব্দে সে তখন কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার দেহের গঠন বেশ বলিষ্ঠ। তার চ্যাপ্টা মঙ্গোলিয়ান টাইপের হলদেটে মুখ দেখলে বুঝতে কষ্ট হয় না সে একজন বর্মীই।
পূর্ণ লাহিড়ী ইতিমধ্যে থি’বর পাশে এসে দাঁড়িয়ছিলেন, তার হাতে পিস্তল। বলা বাহুল্য কালো পাখী লাহিড়ীর অঙ্গে পুলিস অফিসারের ইউনিফর্মই ছিল।
অল্প দুরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে মা’থিন। সেও কিরীটীর মুখের দিকেই চেয়ে ছিল।
থি’বই প্রথমে কথা বললে, কিন্তু আমি তো এর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না মশাই! এভাবে আমার বিনা অনুমতিতে আমার রিজার্ভভ কেবিনে অনধিকার প্রবেশই বা করেছেন কেন আর আমাকে এভাবে ইনসাল্ট করবারই বা দুঃসাহস হল কি করে আপনাদের?
কিরীটী পূর্ণ লাহিড়ীর দিকে তাকিয়ে বললে, মিঃ লাহিড়ী, arest him!
তাই নাকি? ব্যঙ্গভরা কণ্ঠে বলে ওঠে থি’ব, কিন্তু কেন জানতে পারি কি?
ব্লু কুইন ও অন্যান্য কিছু মূল্যবান মুক্তো সরানোর জন্য এবং টেরিটিবাজারের ইউসুফ মিঞাকে হত্যা করবার অপরাধে।
মশায়েরা কি গাঁজায় দম দিয়ে এসেছেন। আবার ব্যঙ্গভরা কণ্ঠে বলে ওঠে থি’ব।
মিসেস জোসেফ, কিরীটী এবারে অদূরে দণ্ডায়মান নির্বাক মা’থিনের দিকে তাকিয়ে বললে, আপনার বুদ্ধির তারিফ করি ম্যাডাম-কিন্তু তাহলেও বলব
কিরীটীর কথা শেষ হল না। আমাদের সকলের দৃষ্টি তখন মা’থিনের উপর গিয়ে পড়েছিল মুহূর্তের জন্য, আর সেই মুহূর্তটুকুরই সুযোগে অঘটনটা ঘটে গেল।
একটা তীক্ষ্ণ আর্ত চিৎকার করে টলে পড়ল মা’থিন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাঘের মত ঐ বয়সেও কিরীটী থি’বর উপরে ঝাপিয়ে পড়ে তাকে যুযুৎসুর পঁচে ধরাশায়ী করে।
শীগগিরি হাতকড়া লাগান মিঃ লাহিড়ী। কিরীটী চেঁচিয়ে ওঠে।
পূর্ণ লাহিড়ী মুহূর্ত দেরি করেন না-পকেট থেকে হাতকড়া বের করে থিবির হাতে পরিয়ে দেন।
হিংস্র দুটো চোখের দৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল, থি’ব যেন কিরীটীকে সুযোগ পেলে মুহূর্তে শেষ করে দেবে–
কিরীটী থি’বর হাতে হাতকড়া পরানো হতেই এগিয়ে যায় ভূপতিত মা’থিনের দিকে।
রক্তে তার সমস্ত জামা লাল হয়ে উঠেছে।
একটা ছোট ছোরা তার বামদিককার বক্ষে সমূলে বিদ্ধ।
থেকে থেকে মা’থিনের সমস্ত দেহটা আক্ষেপ করছে।
হঠাৎ ঐ সময় কেবিনের দরজাটা খুলে গেল, জাহাজের একজন খালাসী একটা খাঁচা হাতে কেবিনের মধ্যে এসে ঢুকল—তার পশ্চাতে ক্যাপ্টেন।
ক্যাপ্টেন কেবিনের মধ্যে পা দিয়েই বলে ওঠেন, Good God! এ কি?
ক্যাপ্টেন, শীগগিরি আপনার জাহাজের ডাক্তারকে ডাকুন-বাঁচবে না বুঝতে পারছি, তবু let us try!
ক্যাপ্টেন ছুটে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলেন।
মা’থিন-মা’থিন।
চমকে আমরা ফিরে তাকালাম।
খাঁচার মধ্যে কালো ময়না পাখীটা বলছে, মা’থিন-মা’থিন।
খালাসীটা তখনও হতভম্ব হয়ে খাঁচাটা হাতে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মিনিট দশেকের মধ্যেই জাহাজের ডাক্তার এল। কিন্তু বাঁচানো গেল না মা’থিনকে। সে মারা গেল।
শুধু মৃত্যুর আগে একটা কথা সে কোনমতে টেনে টেনে জড়িয়ে জড়িয়ে বলে গেল, কিরীটী যেন মুক্তোগুলো পেলে তার স্বামী জোসেফকে পাঠিয়ে দেয়। সে পারল না মুক্তোগুলো উদ্ধার করতে।
স্ট্রেচারে করে ঢাকা দিয়ে মা’থিনের মৃতদেহটা জাহাজ থেকে নামিয়ে আনা হল এবং থি’বকে হাতকড়া পরা অবস্থায় পুলিস-ভ্যানে সশস্ত্র প্রহরীর জিম্মায় তুলে দেওয়া হল।
.
ঐদিনই দ্বিপ্রহরে। গরাদের মধ্যে হাতকড়া অবস্থায় থি’ব। কিরীটী নানাভাবে তাকে প্রশ্ন করল, কিন্তু থি’ব একেবারে যেন বোবা। তার মুখ থেকে একটি কথাও বের করা গেল না। এবং মুক্তোগুলো যে কোথায় আছে তারও কোন সন্ধান করা গেল না।
অবশেষে কিরীটী বললে, ও মুখ খুলবে না মিঃ লাহিড়ী। ডি’সিলভার সন্ধান যতদিন না পাওয়া যায় আমাদের অপেক্ষাই করতে হবে। আপনি সমস্ত জাহাজে জাহাজে ওয়ারলেস মেসেজ পাঠিয়েছেন তো?
হ্যাঁ, আশা করছি দু-চারদিনের মধ্যেই ডি’সিলভার সন্ধান পাব।
ঠিক আছে চলুন, আপনার অফিস-ঘরে যাওয়া যাক। কিরীটী বললে।
সকলে আমরা লাহিড়ীর অফিস-ঘরে এসে ঢুকলাম। চেয়ারে বসে একটা চুরোটে অগ্নিসংযোগ করতে করতে কিরীটী বললে, পাখীটা কোথায়?
আমার কোয়ার্টারেই আছে। কিন্তু পাখীটা যেন ক্রমশঃ কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে মিঃ রায়-কিছু খাচ্ছেও না!
স্বাভাবিক। মুক্তোগুলো হজম করতে পারবে কেন? বেচারী। ইচ্ছা ছিল অমন একটা rare specimen যদি বাঁচানো যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে তা আর সম্ভব হবে না। ও না মরলে আমাদেরই ওকে মারতে হবে-মুক্তোগুলো ওর পেট থেকে উদ্ধার করবার জন্য।
কিন্তু থি’ব যদি জানতই পাখীটার পেটেই মুক্তোগুলো আছে, পাখীটাকে মারেনি কেন? লাহিড়ী প্রশ্ন করে।
এমন একটা আশ্চর্য পাখী—ওর দামও তো কম নয়—তাই ভেবেছিল হয়ত পাখীটার পায়খানার সঙ্গে যদি মুক্তোগুলো বের হয়ে আসে, তাহলে মুক্তোগুলোও পাওয়া যায়, পাখীটাকেও মারতে হয় না।
পরের দিনই পাখীটা মারা গেল। পাখীটার পেট চিরে ফেলা হল-বারোটা বড় আকারের মুক্তো ও রু কুইন পাখীটার পেটের মধ্যেই পাওয়া গেল। নাড়ীর মধ্যে ঘা হয়ে গিয়েছিল। সেই ঘা-ই পাখীটার মৃত্যুর কারণ হয়েছিল।
লাহিড়ী বলেন, চমৎকার পন্থা নিয়েছিল দেখছি লোকটা মুক্তোগুলো সরাবার অন্যের দৃষ্টি থেকে।
নিঃসন্দেহে। আর তারও হয়ত পাখীটার উপরে লোভ ছিল বলে শেষ পর্যন্ত পাখীটা মারতে পারেনি।
আগের পর্ব :
০১. ইউসুফ মিঞা
০২. সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি সংবাদ
০৩. কিরীটী একটু থেমে বলে
০৪. সুইটের সিটিং রুমে
০৫. বৃষ্টি তখনও ঝরছে
০৬. কৃষ্ণা সত্যিই চটে গিয়েছিল
০৭. আকাশ কালির মত কালো
পরের পর্ব :
০৯. তিনদিন পরেই তার পাওয়া গেল