গরল

গরল

-“তুমি কী চৈতি কে বিয়ে করতে চাও?” মাধুর্যের প্রশ্নে খানিকটা সময় নিরবতা পালন করে মৃন্ময় জবাব দিল।
-“হ্যাঁ..”
-“আর আমরা?”
-“টিয়াকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। টিয়া আমার সঙ্গেই থাকবে।”
-“আমি?”
-“প্রতিমাসের শুরুতে তোমার একাউন্টে টাকা চলে যাবে।”

মৃন্ময়ের কথায় বুকচিরে বেরিয়ে আসা একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মাধুর্য এগুলো শোবার ঘরের দিকে। আলমারির উপরে রাখা ট্রলি ব্যাগটি নামাতেই পেছন থেকে মৃন্ময় বলে উঠলো,

-“তা যাচ্ছো কোথায়?”
-“জানি না..”
-“যেখানেই যাও এড্রেসটা দিয়ে যাবে।

ডিভোর্স নিয়ে কোনো ঝামেলা হোক, এটা মোটেও আমি চাচ্ছি না।”
কথা বাড়ালো না মাধুর্য। আলমারি খুলে নিজের প্রয়োজনীয় সব জিনিষপত্র বের করে ভরতে শুরু করলো ট্রলি ব্যাগে। ইদানীং মৃন্ময়ের বলা কথাগুলো তার বুকে এসে বিঁধে তীরের মত। একেকটি তীরের আঘাতে রক্ত ঝরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় বুকের ভেতরটা। তবে ভেতরের এই রক্তক্ষরণ দেখার কেউ নেই। আজকাল নিজেকে বড্ড বেশিই অসহায় মনে হয়। আচ্ছা.. মানুষের জীবনে প্রেম আসে কয়বার? একবার, দু’বার নাকি লক্ষলক্ষ বার? একজন কে ভালোবেসে পুরো পরিবার ছেড়ে নতুন এক দুনিয়ায় ঘর সাজানোর পরও কি নতুন সেই জীবনে আবারো প্রেম আসে? যার কারণে বাবামা ভাইবোনের সঙ্গে একসময় সম্পর্ক শেষ করে এসেছিল, তাকেই ফেলে কী নতুন এক সম্পর্ক জড়ানো যায়? অবশ্য যে একটি মেয়ের কারণে রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করে অতীতের সব স্মৃতি ভুলে যেতে পারে, তার পক্ষে সেই মেয়েটির সঙ্গেও সম্পর্ক চুকিয়ে নতুন এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া কোনো কঠিন ব্যাপার নয়।

-“তোমার চৈতি ম্যামকে তোমার কেমন লাগে, মা?”
-“ম্যাম খুবই সুইট.. ডেইলি পড়াতে আসতে আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসে।”
-“তাহলে তো তুমি ডেইলি অনেক অনেক চকলেট খেতে পারো.. না?”
-“উহু.. আম্মু তো বেশি খেতেই দেয় না।”
-“ভেরি ব্যাড! আমার মা কে চকলেট কেন খেতে দেয় না! আচ্ছা মা.. চৈতি ম্যাম তোমার আম্মু হলে কেমন হয়? ডেইলি অনেক অনেক চকলেট খেতে পারবে।”বাবার বলা কথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেললো টিয়া। গম্ভীর মুখে বললো,

-“চৈতি ম্যাম আম্মু হবে কেনো? ম্যাম তো ম্যাম.. আর আম্মু তো আম্মু। আমার তো একটা আম্মু আছেই। আম্মুই আমার আম্মু।”

-“আচ্ছা.. আচ্ছা। চলো বাইরে থেকে একটু ঘুরেফিরে আসি। বাপ বেটি মিলে বিকালের সৌন্দর্য্য টা উপভোগ করে আসি।”

পাশের ঘর থেকে বাবা মেয়ের কথোপকথন শুনে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললো মাধুর্য। নিজের নেয়া সিদ্ধান্ত বদলে সে ট্রলি ব্যাগে রাখা জিনিষগুলো আবারও আলমারিতে গুছিয়ে রাখতে লাগলো। জীবিত থাকা অবস্থায় নিজের মেয়ের মুখ থেকে অন্য কোনো মেয়েকে মা ডাকা টা শুনতে পারবে না সে। দীর্ঘ দশমাস কষ্টের পর যখন টিয়া এল এই পৃথিবীর বুকে, তখন যেনো তার খুশির কোনো সীমা ছিল না। সদ্যোজাত সেই ছোট্ট শিশুকে বুকে নিয়ে রাতের পর রাত জেগে কাটিয়েছে সে। আরেকটুখানি বড় হবার পরই মেয়ের মুখ থেকে মা ডাকটি শোনার জন্য অস্থির হয়ে থেকেছে তার মন। তার ছোট্ট হাতের মাঝে নিজের আঙুলকে অবলম্বন করে তাকে উঠে দাঁড়াতে শিখিয়েছে।

পায়ে পা মিলিয়ে চলতে শিখিয়েছে। অথচ আজ সেই মেয়েই কিনা অন্য এক মেয়েকে মা বলে ডাকবে! অসম্ভব.. জীবনটা কী এতটাই সহজ? যখন যেভাবে যা চাইবে মৃন্ময়, তখন সেভাবে তাই হবে? লম্বা কিছু দম ছেড়ে বিছানার এক কোণায় বসে পড়লো মাধুর্য। চোখজোড়া বন্ধ করে তাদের সংসার জীবনের মধুর কিছু মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করতে লাগলো।

টিয়ার বয়স তখন এক কি দেড় বছর হবে। হামাগুড়ি দিয়ে পুরো বাড়িজুড়ে ঘুরে বেড়ায় সে। মাঝেমধ্যে ঘরে থাকা জিনিষপত্র গুলি অবলম্বন করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করে। কিছু সময় সফল হলেও প্রায় সময়ই বিফলে যায়। আছাড় খেয়ে চিৎকার করে কেঁদেকেটে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে। এমনি এক রাতের ঘটনা.. আছাড় খেয়ে কেঁদেকেটে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়লো টিয়া। শোবার ঘরে তাকে শুয়িয়ে মাধুর্য ড্রয়িংরুমে এসে বসতেই পাশ থেকে মৃন্ময় বললো,

-“সিগারেটের প্যাকেট টা একটু এনে দেবে?”
-“না.. নিজের জিনিষ নিজে এনে খাও।”
-“এনে দাও না! আমি নিজেই এখন যেতে পারতাম, কিন্তু এই মুহূর্তে মুভিটা এক সেকেন্ডের জন্য ফেলে যাওয়া মানে.. ইশ! এনে দাও না।”
-“হয়েছে.. হয়েছে। যাচ্ছি আমি।”

ঠোঁটে হাসির রেখে ফুটিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে পড়লো মাধুর্য। শোবার ঘরে ঢুকেই উঁচু গলায় সে ডেকে উঠলো মৃন্ময়কে। বিছানায় মাঝবরাবর বসে সিগারেট ভেঙে তা অনায়াসে মুখে পুড়ে যাচ্ছে টিয়া। এ দৃশ্য দেখামাত্র আঁতকে উঠলো মৃন্ময়। ততক্ষণে মাধুর্য এগিয়ে গিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে মুখের ভেতর হাত ঢুকিয়ে সিগারেটের টুকরো বের করতে করতে বললো,

-“তোমাকে বারবার বলেছি সিগারেট ঠিক জায়গা মত রাখবে। বিছানার উপর কেউ সিগারেট রাখে? এটা সিগারেট রাখার জায়গা?”

-“তো কোথায় রাখবো?”
-“জাহান্নামে রাখো.. আমার একটা কথা শোনো তুমি?

এসব ছাইপাঁশ না খেলে কি হয়? এখন যদি আমি সময় মত না আসতাম? আমার মেয়েটার কী হতো? তুমি কেনো খাও এসব? এসব যে শরীরের ক্ষতি করে তা তুমি বোঝো না? তুমি কেনো বোঝো না, তোমার বা টিয়ার কিছু হলে আমি মরেই যাব জবাবে বিছানার উপরে থাকা সিগারেটের প্যাকেট টি জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেললো মৃন্ময়। ধীর পায়ে মাধুর্যর পাশে এসে দাঁড়িয়ে দু’জনকে আঁকড়ে নিল বুকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

-“আর কখনওই খাবো না তোমার এই ছাইপাঁশ। খুশি তো?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মাধুর্য। এগুলো রান্নাঘরের দিকে। ওইদিনের পর সত্যিই আর কখনো সিগারেট হাতে নেয় নি মৃন্ময়। সেদিনের মৃন্ময় আর আজকের মৃন্ময়! কতটা বদলে গেছে.. না? সেদিনের মৃন্ময়ের চোখে ছিল মাধুর্যকে নিয়ে সুন্দর ভাবে বাঁচার স্বপ্ন, মনে ছিল তার জন্য একরাশ ভালোবাসা। অথচ আজকের এই মৃন্ময়ের চোখে এর ছিটেফোটাও অবশিষ্ট নেই। আচ্ছা.. সময় মানুষকে এতটা কেন বদলে দেয়?

বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ৯ টার মত বেজে গেল মৃন্ময়ের। কোলে থাকা ঘুমন্ত টিয়াকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়েই সে ফ্রেশ হতে ঢুকে পড়লো ওয়াশরুমে। মেজাজ তার প্রচুর বিগড়ে আছে। টিয়াকে নিয়ে বের হবার তার একটিমাত্র উদ্দেশ্য ছিল৷ যেন এই সময়টুকুর মাঝে মাধুর্য বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারে। টিয়াকে নিয়ে কোনো ধরনের বাধাবিপত্তি যেন না আসে তাদের মাঝে। অথচ সেই মাধুর্যরই যাবার নাম নেই। নির্দিধায় সে পড়ে রয়েছে এ বাড়িতে! দীর্ঘসময় ধরে শাওয়ার নিয়ে মেজাজটা ঠান্ডা করলো মৃন্ময়। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে চুলে হালকা চিরুনী লাগিয়ে সে এগুলো ডাইনিংয়ের দিকে।

-“তোমাকে আর কতবার বলবো, আমার প্লেটে খাবার বেরে রাখবে না! জিনিসটা আমার খুবই অপছন্দ।”
-“আর তো কখনওই এমন হবে না। আজই শেষ.. আসলে অনেকদিনের অভ্যাস তো এত জলদি পরিবর্তন করা যায় না… তাই না?” সেকথার জবাব না দিয়ে মৃন্ময় বললো,

-“এখনও যাও নি কেনো? আর পোলাও মাংস কেন করেছো? কিসের এত খুশি তোমার মনে?” বিপরীতে মৃদু হেসে মাধুর্য বললো,

-“আরে বাহ! তুমিই তো বললে এড্রেস দিয়ে যেতে। আর সেই তোমারই পাত্তা নেই। এড্রেস দিয়ে যাবো না?” মুখে খাবার তুলতে তুলতে মৃন্ময় জবাব দিল,

-“এড্রেস কোথাও লিখে রেখে গেলেও পারতে।”

-“হুম পারতাম… তা টিয়া আর চৈতি কে নিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরলে? কোনো রেস্টুরেন্টে বসো নি? এভাবে খাচ্ছো যেন কত জনম হলো না খেয়ে আছো!” কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল মৃন্ময়। মাধুর্যের সঙ্গে অযথা কথাবার্তা চালানোর কোনো মানেই হয় না। তাই চোখমুখ কুঁচকে আবারো খাবারে মন দিল সে।

রিকশার ভাড়া মিটিয়ে চৈতি পা বাড়ালো সবুজ রঙের লোহার গেটটির দিকে। চোখেমুখে তার একরাশ দুশ্চিন্তা। কাল রাতে বাসায় ফিরে মৃন্ময়ের কল দেয়ার কথা থাকলেও এখনো পর্যন্ত কোনো কল দেয় নি। এমনকি চৈতির দেয়া কলও রিসিভ করে নি। কোনো সমস্যা হলো না তো? মৃন্ময়ের মতে, গতকাল বিকেলেই চলে যাবার কথা ছিল ওর স্ত্রী মাধুর্যর। সে কি গিয়েছে? নাকি যাওয়া নিয়ে আবার কোনো সমস্যা হয়েছে? সদর দরজা খোলা পেয়ে কোনো বাধা ছাড়াই ফ্লাটে ঢুকে পড়লো চৈতি। ভেতরে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কী নেই? এভাবে ফ্লাটের দরজা খুলে কোথায় গেল মৃন্ময়? আর টিয়াই বা কোথায়? টিয়াকেও কী ওর মা সঙ্গে নিয়ে গেছে? অবশ্য নিয়ে গেলেই তার জন্য ভালো। অন্যের মেয়েকে পালার মত মনমানুসিকতা তার নেই। কেন যে মৃন্ময় এই টিয়ার জন্য পাগল হয়ে পড়েছে! পুরো বাড়ি ফাঁকা পেয়ে মৃন্ময়কে জোর গলায় কয়েকবার ডাকলো চৈতি।

তবে ওপাশ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় খানিকটা খটকা লাগলো তার। শোবার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বেলকনিতে উঁকি দিতেই পুরো শরীরজুড়ে শীতল এক রক্তশ্রোত বয়ে গেল। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে জমে যেতে লাগলো সে বরফের মতো। নীল টিশার্ট গায়ে, মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে একটি দেহ নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে ফ্লোরে। মুখ থেকে সাদা ফ্যানা জাতীয় কিছু পদার্থ বেরিয়ে তা শুকিয়ে লেগে রয়েছে ঠোঁটের চারিপাশে। হাত দুটো খানিকটা বেঁকে রইলেও পা দুটো টানটান হয়ে পড়ে রয়েছে। চোখ জোড়া খুলে উলটে রয়েছে। নিশ্বাসের ফলে বুক উঠানামার কোনো চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না। প্রাণহীন এই দেহটি শিথিল ভাবে লেগে রয়েছে ফ্লোরের সাথে। ছাদ থেকে চৈতিকে এলোমেলো পায়ে দ্রুত বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে রিকশায় উঠতে দেখেই ঠোঁটে হাসি ফুটলো মাধুর্যর। পিছন ফিরে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা টিয়ার উদ্দেশ্যে বললো,

-“মা, ক্ষুধা পেয়েছে কী?”

মায়ের করা প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না টিয়া। হাতে থাকা তিনটি পুতুল নিয়ে আপনমনে খেলতে লাগলো সে। টিয়ার উত্তরের জন্য খানিকটা সময় অপেক্ষা করে মাধুর্য পা বাড়লো সিঁড়ি ঘরের দিকে। বেলা তো অনেক হলো। নিচে গিয়ে এবার রান্নাটা চড়ানো দরকার। মেয়েটা আর কতক্ষণই বা এভাবে ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকবে? অবশ্য রাতের বেঁচে যাওয়া খাবার এখনো তিনদিন আরামসে খাইয়ে কাটিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু সেসব খাবারে তো আবার বিষ মেশানো ফ্লাটে ঢুকেই মাধুর্য এগুলো বেলকনির দিকে। ফ্লোরে পরে থাকা মৃন্ময়ের প্রাণহীন দেহের পাশে বসে ছোট্ট কিছু নিঃশ্বাস ফেলে একসময় বলে উঠলো,

-“আজ তোমার সঙ্গে হয়তো আমার প্রাণহীন দেহটিও এখানে পড়ে থাকতে পারতো। যদি তুমি একটিবার সব ভুলে আমার কাছে জানতে চাইতে আমি রাতে খেয়েছি কিনা! তুমি শুধু একবার বললেই আমি নিঃসংকোচে তোমার সঙ্গে খেতে বসে যেতাম, মৃন্ময়। কিন্তু তুমি বলো নি..” চোখের কোণা বেয়ে নোনা পানির ধারা গড়িয়ে পড়তেই উঠে দাঁড়ালো মাধুর্য। ঝাপসা চোখে আকাশপানে চেয়ে বললো,

-“জানো… কেউ হারিয়ে গেলে যতটা না কষ্ট হয়, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি কষ্ট হয় কেউ বদলে গেলে?”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত