দ্য সিঙ্গেল মাদার

দ্য সিঙ্গেল মাদার

আমি একজন সিঙ্গেল মাদার। আমার ৬ বছর বয়সী কন্যা রাফাকে নিয়ে আলাদা থাকি। না, বাবা মা ভাই বোন কারো কাছে জায়গা হয়নি আমার। সবাই যে যার মত দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে। অথচ একটা সময়ে তাদের কতই না সাহায্য করেছিলাম আমি।

ছোট ভাইটা বেকার ঘুরতো। বড় ভাসুরকে বলে একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছিলাম। বাসা থেকে কত কষ্ট করে টাকা ম্যানেজ করে বাবাকে বন্ধকী জমিটা ছাড়িয়ে দিয়েছিলাম। যৌতুকের টাকার জন্য ছোট বোন লায়লার বিয়েটা প্রায় ভাঙতে বসেছিল। নিজের বিয়ের সমস্ত গহনা দিয়ে, সেভিংসের সব জমানো টাকা দিয়ে নিজের হাতে বোনটার বিয়ে দিয়েছিলাম। বড় বোন নায়লা আপা যখন চাকরি করতেন তার দুই ছেলে মেয়েকে দেখাশোনা করার জন্য আমাকে রেখেছিলেন। মায়ের মত সারাদিন আগলে রাখতাম ওদের। আজকে সেই বোন একটা বারও আমার মেয়েটার খোঁজ নেয়নি। বড় ভাবীর সিজারিয়ানের সময় প্রায় মরতে বসেছিলেন। ৪ মাসের প্রেগন্যান্সি নিয়ে ঢাকা থেকে ছুটে গিয়েছিলাম যশোর। রক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছিলাম তাকে। আজকে সেই রক্ত বিরক্ত হয়ে গিয়েছে। ঘরেই ঢুকতে দেয়নি। সাফ জানিয়ে দিয়েছে, অন্যের সংসারের ঝামেলা উনি মাথায় নিতে পারবেন না। বড় ভাইও চুপ ছিল। বউয়ের পিছে পিছে উঠে চলে গেল।

আমরা ৫ ভাইবোন, সাথে বাবা মা। বিশাল পরিবার। কিন্তু আজকে আমার কেউ নেই। দুঃসময়ে রক্ত ও বেঈমানী করে। শাহেদের সাথে বিয়ের প্রথম দিকে খুব সুখেই ছিলাম। কিন্তু এরপরই ওর জীবনে অন্য কেউ আসে। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু একেরপর এক প্রমাণ যখন পেলাম, তখন কি করে আর অবিশ্বাস করি!! খুব ঝগড়া হতো এ নিয়ে। বাজে ভাষায় গালিগালাজ করতো আমাকে। ছোটবেলা থেকেই গালিগালাজ আমি সহ্য করতে পারিনা। প্রতিবাদ করতে গেলেই মার খেতাম। এরপর এটা নিয়মিত রুটিনে পরিণত হলো। বাপের বাড়িতে, আত্মীয় স্বজনদের কাছে নালিশ দিলাম। সবাই একই উপদেশ দিতো, “মানিয়ে নাও”

কালশিটে পড়া ক্ষত বিক্ষত শরীরের যন্ত্রনাটা কেউ বোঝেনি, হয়তো বুঝতে চায়নি। এরপর যখন প্রমাণ দেখালাম, ভেবেছিলাম এবার হয়তো তারা বিশ্বাস করবে। বিশ্বাস করেছে, আবার এও বলেছে, “কেমন মাইয়া হইছো যে নিজের সোয়ামী রে আঁচলে বাইন্ধা রাখতে পারো না?? আরেক বেটির কাছে যায় ক্যামনে!!”

এটা আমাদের সমাজের নিয়ম। মেয়ের জামাই যতই অন্যায় করুক না কেন মেয়ের পরিবার মেয়েকেই দোষারোপ করে ঠেলেঠুলে ঐ সংসারেই ফেরত পাঠাবে। একবারও বুঝতে চাইবে না,মেয়েটা কত যন্ত্রনার মধ্যে আছে!!

আমার অবস্থা ও হয়েছিল তেমন। সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছিলো তো সেদিনই যেদিন ঐ নষ্টা মেয়েটাকে ঘরে এনে তুলল। আর সহ্য করতে পারিনি। এক কাপড়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু কোথাও ঠাঁই হয়নি আমার। সবার মুখে একই কথা, “আরেকটু সহ্য করতে পারলে না??” “মেয়ে মানুষ এত অধৈর্য হলে চলে??”

তারা কি কখনো খোঁজ নিয়েছে, কতটা অমানুষিক যন্ত্রনার মধ্যে আমি ছিলাম!! একটা মেয়ে কতটা কষ্ট পেলে নিজের সংসার ত্যাগ করে আসে!! সমাজ কখনোই জানবে না একটা মেয়েকে কতটা অমানুষিক যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়। তারা শুধু জানে কীভাবে একটা অসহায় মেয়ের দিকে নোংরা আঙুল তুলতে হয়!!

জীবন যুদ্ধে একাই নেমে গেলাম, মেয়েকে বুকে চেপে। হন্যে হয়ে একটা চাকরি খুঁজছিলাম। কিন্তু কে দেবে চাকরি?? ইন্টার পাশের সার্টিফিকেট দিয়ে এই শহরে কি আর ভালো চাকরি পাওয়া যায়?? তবুও আশায় বুক বেঁধে ছিলাম, ছোটখাটো একটা চাকরি হলেই হবে। মা মেয়ের ঠিক চলে যাবে।

চাকরি সে তো সোনার হরিণ!! ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে কত লোলুপ দৃষ্টির শিকার হয়েছি,কত মোটা অঙ্কের অফার পেয়েছি!! না খেয়ে থেকেছি কিন্তু নিজেকে বিলিয়ে দেইনি। অবশেষে এই পোড়া কপালে একটা চাকরি জুটলো। তাও পি এস এর পোস্ট। লোকে মেয়েদের এই পোস্টে চাকরি করা ভাল নজরে দেখে না। কিন্তু আমি নিরুপায়।

চাকরি তো জুটলো, কিন্তু বাসা ভাড়া নিতে গিয়েই পড়লাম বিপদে। পুরুষ মানুষ ছাড়া কোন যুবতী মেয়েকে তারা ঘর ভাড়া দিবে না। বললাম আমার একটা ছোট মেয়ে আছে। তখন তো আরো প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম, মেয়ের বাবা কোথায়, সাথে থাকে না কেন, কত দিন ধরে আলাদা থাকি, কি সমস্যা… যত্তসব ফালতু বিরক্তিকর প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আমি ক্লান্ত। তারপর ও সব হাসিমুখে জবাব দিচ্ছি, যদি একটা ঘর ভাড়া পাই।

কিন্তু সবাই মুখের উপর না করে দিলো। এক মহিলার সাথে সাবলেট থাকতে চাইলাম। কিন্তু উনি মুখের উপর স্রেফ জানিয়ে দিলেন, আমি থাকলে নাকি তার সংসারে ঝামেলা হবে। অবশেষে এক মধ্যবয়সী মহিলার সাথে সাবলেট থাকার সুযোগ পেলাম। কিন্তু দুই মাসের বেশি থাকতে পারলাম না। আমার জন্য নাকি তার ছেলেরা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ইমিডিয়েটলি বাসা ছাড়তে বললেন। বুঝতে পারছিলাম না, কি করবো, কোথায় যাবো?? কিন্তু আল্লাহর দুনিয়াটা অনেক বড়। কোথাও না কোথাও ঠিক ঠাঁই মিলে যায়। নতুন একটা পরিবারের সাথে সাবলেট থাকার সুযোগ পেলাম। তারা খুব ভাল মনের মানুষ। তাদের ও দুটো ছোট বাচ্চা ছিল। আমার মেয়েটাকে খুব কেয়ার করতো। তাদের কাছে রেখেই নিশ্চিন্তে অফিসে যেতে পারতাম। অফিসের মধ্যবয়সী বসকে বাবার চোখে দেখতাম। কিন্তু কিছুদিন পর বুঝলাম উনি আমাকে কখনোই মেয়ের চোখে দেখেনি বরং তার উল্টোটা। এত নোংরামি সহ্য হয়নি। চাকরিটা দরকার ছিল, কিন্তু সম্মান বিসর্জন দিয়ে নয়।

জানপ্রাণ দিয়ে একটা নতুন চাকরি খুঁজতে লাগলাম।ছোটখাটো একটা নতুন চাকরি পেয়ে গেলাম। রিসিপশনিস্ট, বেতন খুবই কম। তারপর ও মোটামুটি নিরাপদ ছিল। বাকি সময় দু চারটা টিউশনি ও করতাম। টেনেটুনে মাসটা পার করে দিতাম। মেয়েটাকে একটা ভাল স্কুলে পড়ানোর খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সামর্থ্য ছিল না। এলাকার সাধারণ একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলাম। ভালই চলছিল আমাদের মা মেয়ের দিনগুলি।

কিন্তু আমার কপালে সুখ বেশিদিন সয় না। শাহেদ মেয়ের কাস্টোডির জন্য মামলা করেছে। আর সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে “শায়লা আমার মেয়েটাকে আমার কাছে আসতে দেয় না” অথচ কোনদিন ফোন দিয়ে মেয়েটার খোঁজ খবর নেয়নি। আমি খুব ভাল করেই জানতাম ও আমাকে শাস্তি দেয়ার জন্য এসব করছে, মেয়ের জন্য না। শ্বশুর বাড়ির লোকজন ওকেই সাপোর্ট দিচ্ছিল। আমার শাশুড়ি ফোন করে বললেন, “তুমি জাহান্নামে যাও, আমাদের নাতনীকে আমাদের কাছে দিয়ে যাও”

আমি আমার মেয়েকে আগলে রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারলাম না। মামলায় হেরে গেলাম। মেয়ের কাস্টোডি পেলো ওর বাবা। আমার কলিজাটা ছিঁড়ে কলিজার টুকরাটাকে নিয়ে গেল। একটুও দয়া হয়নি তাদের। প্রতিদিন বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম, এক নজর মেয়েকে দেখার জন্য, ওরা দেখা করতে দিতো না। নতুন করে মামলা লড়বো, সেই টাকা পয়সা ও ছিল না আমার। আল্লাহর দরবারে মাথা ঠুকতাম, “আমি শুধু আমার মেয়েটাকে চাই, আর কিচ্ছু না ”

শাহেদ ফোনে আমাকে হুমকি ধমকি দিতো, “তোর সামর্থ্য আছে মেয়ের ভরণ পোষণ দেয়ার?? পারবি আমার মতো ইংলিশ মিডিয়ামে মেয়েকে পড়াতে?? ওর এক মাসে যা বেতন, তোকে বেচলেও তো অত টাকা হবে না। কোত্থেকে দিবি মেয়ের ভরণপোষণ??” কিন্তু আমার জেদ চেপে গেল। আমার মেয়েকে আমি চাই ই চাই!!

কতজনের দ্বারে দ্বারে ঘুরলাম, ভিক্ষা চাইলাম কিন্তু কেউ ফিরে ও তাকায়নি। মানবাধিকার কমিশনে গেলাম। তারা আমার সব কথা শুনলেন, বুঝলেন। তারাই আমার হয়ে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করলেন। আমি যেন আশার আলো দেখতে পেলাম। অবশেষে শত কাঠখড় পুড়িয়ে এক বছর পর আমার বুকের মানিককে আমার বুকে ফিরে পেলাম।

এরপর শুরু হলো আমার নতুন যুদ্ধ। মেয়ের স্কুল বদলাইনি, ওকে আমি ইংলিশ মিডিয়ামেই পড়াবো। শাহেদকে আমি চ্যালেঞ্জ করেছিলাম, ওকে আমি দেখিয়েই ছাড়বো!!

চাকরির পাশাপাশি একটা বুটিকসের দোকানে নাইট শিফটে কাজ করতাম। সাথে ব্যাচে দু চারটা স্টুডেন্ট পড়ানো। দম ফেলার সময়টাও ছিল না। তাও নিজেকে কখনোই ক্লান্ত মনে হয়নি। মাথার উপর ছাদ ছিল না, পায়ের নিচে মাটি ছিল না। কিন্তু কখনো হাল ছাড়িনি আমি।

নিজে বেশি পড়ালেখা করতে পারিনি আমি। খুব ইচ্ছে ছিল মেয়েটাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবো। আজ আমার মেয়ে বিমান বাহিনীর ফ্লাইং অফিসার হিসেবে কর্মরত। আমার পরিশ্রম সার্থক। সারা দুনিয়াকে আমি দেখাতে পেরেছি, একা একটা মা ও সংগ্রাম করে মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

“সেরা রত্নগর্ভা সম্মাননা “র জন্য আমাকে মনোনীত করা হয়েছে। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে গর্ব করি। বাপের অর্থবিত্ত, ভোগ বিলাসিতার লোভে ও কখনোই আমাকে ছেড়ে যায়নি। বরং অভাব অনটনের মাঝেও এই বুকের সাথে আকঁড়ে ছিল। দামি পোশাক, খেলনা কিছুই দিতে পারিনি। কোন অভাব অভিযোগ ছিল না তার, হাসিমুখে সব মেনে নিতো। এমন একটা সোনার টুকরো মেয়ে জন্ম দিতে পেরে আমি সত্যিই রত্নগর্ভা মা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত