২৩. চিঠিটা আমার পড়তে বসে
চিঠিটা আমার পড়তে বসে চিঠির শেষে প্রেরকের নামটা যে আপনি শুরুতেই পড়ে দেখবার কৌতূহলটা দমন করতে পারবেন না সেটা আমি জানি বলেই নামটা শুরুতেই আমার জানিয়ে দিচ্ছি—আমি কিরীটী রায়।
এবারে বোধ হয় বুঝতে আর আপনার কোন অসুবিধা হবে না, হঠাৎ কিরীটী রায়ের আপনাকে চিঠি লিখবার কি এমন প্রয়োজন হলো! আর কেনই বা এই চিঠি।
চিঠির শুরুতেই আরো একটা কথা আপনার অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি, এই চিঠির অন্য দুটি কার্বন কপির একটি শিবপুর থানার ও. সি. সুশীল নন্দী ও অন্যটি কলিকাতার পুলিস কমিশনারের কাছে একই সঙ্গে যাচ্ছে। অবশ্যই স্বীকার করবো, সুশীলবাবুর সক্রিয় সাহায্য না পেলে এত তাড়াতাড়ি আপনাকে হয়ত চিহ্নিত করতে পারতাম না।
অস্বীকার করবো না, আপনার হত্যা করবার প্ল্যান বা পরিকল্পনাটা আপনি সুনিপুণভাবে নিখুঁত করবার চেষ্টা করেছিলেন একই ঢিলে দুই পাখী মারতে। এক— মিত্রানীকে হত্যা করতে ও দুই—সেই হত্যার অপরাধটা সম্পূর্ণ নির্দোষ এক তৃতীয় ব্যক্তির কাঁধে চাপিয়ে দিতে। যদিও প্রধানত উদ্দেশ্য ছিল আপনার মিত্রানীকে হত্যা করা।
হত্যার উদ্দেশ্য বা মোটিভ কিন্তু পোস্টমর্টেম বা ময়না তদন্তের রিপোর্টটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
মৃতদেহের উপরে হত্যাকারী তার যৌন লালসা মিটিয়েছে যখনই জানতে পারলাম তখন আর বুঝতে আবার বাকী ছিল না—হত্যাকারীর মিত্রানীর দেহকে ঘিরে ছিল একটা দীর্ঘদিন ধরে যৌনলালসা—যেটা পরিতৃপ্তির কোন পথ না খুঁজে পেয়ে তার রক্তের মধ্যে যেমন একটা ঘূর্ণি সৃষ্টিই যে করেছিল তা নয়, সেই সঙ্গে ঐ নিষ্কলঙ্কতাকে ঘিরে জন্মেছিল একটা দুর্নিবার আক্রোশ এবং ঐ দুটিরই বহিঃপ্রকাশ প্রথমে হত্যা ও পরে ধর্ষণের মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
হয়তো আপনার পরিকল্পনা বা প্ল্যানটা এত সহজে বানচাল হয়ে যেতো না, যদি না আপনার ক্রুয়েল ডেস্টিনির অলিখিত নির্দেশ আমাকে ঘটনাচক্রে টেনে না নিয়ে আসতে মিত্রানীর হত্যার ব্যাপারে। মিত্রানীর বাবা আমার পরম শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই শ্ৰীযুক্ত অবিনাশ ঘোষালের মুখের দিকে তাকিয়েই আমি হত্যা-রহস্যের মীমাংসার ব্যাপারটা হাতে তুলে নিয়েছিলাম।
আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না—সেই নিরীহ, একান্ত শান্তিপ্রিয় অজাতশত্রু বৃদ্ধ মানুষটির বুকে কি নির্মম আঘাতই না আপনি হেনেছেন, মিত্রানীর দেহকে ঘিরে আপনার দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত লালসা ও তাকে পরিতৃপ্ত করবার কোন পথ না খুঁজে পেয়ে সেই আক্রোশে অন্ধ হয়ে।
আপনাকে আমি সত্যি বলছি, যে মুহূর্তে হত্যার মোটিভটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম এই কথা ভেবে যে মানুষ তার গোপন লালসার তাগিদে কোন্ গভীর ভয়াবহ অন্ধকারে নেমে যেতে পারে।
সত্যি আমার ভাবতেও দুঃখ লাগে, মিত্রানীর মত অমন একটি মেয়ের মধ্যে আর কিছুই আপনি খুঁজে পেলেন না পেলেন কেবল তার দেহটাকে ঘিরে একটা জঘন্য কুৎসিত যৌনলালসা দীর্ঘদিনের পরিচয়ে! একবারও কি আপনার মনে হয়নি, তার দেহের স্থূল যৌন আকর্ষণের চাইতে তার সুন্দর পবিত্র মনের আকর্ষণ অনেক বেশী সুষমাকে ছেড়ে আপনি নরকের দুর্গন্ধ কাদা নিয়ে ঘাঁটলেন।
যখনই ভাবি মানুষ কোন্ স্তরে নামলে ঐভাবে একজনের কোমল গলায় রুমালের মৃত্যু-ফাস দিতে পারে, আমি যেন ক্ষমার কথাই ভুলে যাই।
মিত্রানীকে যে আপনি কোনদিনই পাবেন না, সে সুহাসকে ভালবাসে এবং সুহাসও তাকে ভালবাসে বুঝতে পেরেই বোধ হয় শেষ পর্যন্ত মরীয়া হয়ে উঠেছিলেন—
কিন্তু সেই সঙ্গে যখন ভাবি নিরপরাধ সুহাসকে আপনি ফাঁসিকাঠের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিলেন, একটা প্রায় দৃষ্টিহীন লোককে আপনি কি চরম দুর্গতির দিকে ঠেলে দিতে উদ্যত হয়েছিলেন তখন আপনার যোগ্য বিশেষণ কি খুঁজে পাই না—
(১) আপনি ভেবেছিলেন সুহাস জীবনে যখন কখনো মিত্রানীকে ফোন করেনি, সে সুনিশ্চিত তার গলাটা চিনতে পারবে না—অন্যের গলাকে ফোনে সুহাসের গলা বলেই ভুল করবে-তাতে করে আপনার উদ্দেশ্যও সফল হবে—সজলকে দিয়ে মিত্রানীকে ফোন করালে।
অস্বীকার করবো না—সফল হয়েছিলেন মিত্রানীও ভুলই করেছিল, কিন্তু অমন সুষ্ঠু প্ল্যানটা বানচাল হয়ে গেল মিত্রানীর ডাইরী থেকে। সে ডাইরীতে ঐ ফোনের কথা লিখে রাখবে আপনি কল্পনাও করতে পারেননি। আর সেই ডাইরীটা আবার একদিন আপনার মৃত্যুবাণ হয়ে আমারই হাতে আসবে—
(২) তারপর ঐ সিল্কের রুমালটা। সুহাসবাবুর যে ক্ষীণদৃষ্টির সুযোগ নিয়ে সেদিন তার অফিসে পিকনিকের কথা বলতে গিয়ে নিঃশব্দে হাতসাফাই করেছিলেন—আপনি কল্পনাও করতে পারেননি সুহাসবাবুর সেই ক্ষীণদৃষ্টিই আপনার মৃত্যুবাণ হয়ে আপনার দিকেই ফিরে আসবে। একেই বলে অদৃষ্টের পরিহাস।
(৩) সুহাসবাবুর দুচোখের ঐ ক্ষীণদৃষ্টি আপনার পরিকল্পনার বা সুষ্ঠু প্ল্যানের আরো একটা ব্যাপার বানচাল করে দিয়েছে সেটা হচ্ছে সেই চোখে চশমা, মুখে দাড়ি, মাথায় বেতের টুপি পরা ভদ্রলোকটি—যাকে আপনিই সাজিয়ে এনেছিলেন ঐদিন বটানিক্যাল গার্ডেনে এবং সম্ভবত আপনার ইচ্ছা ছিল সেই লোকটির প্রতি সুহাসবাবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কানের কাছে কথাটা বলে করেছিলেন তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ।
কেবলমাত্র দলের মধ্যে সুহাসবাবুকেই সেই দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার পিছনে আপনার প্ল্যান ছিল—পুলিসের দৃষ্টি যাতে সেই অজ্ঞাত পরিচয়নামার প্রতি পড়ে। সকলকে সে কথা বলেননি—ঝামেলা এড়াবার জন্য আপনার কথামতই সুহাসবাবু পুলিসের কাছে লোকটির বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাও প্রথমটায় নয়, আমার প্রশ্নের জবাবে সেদিন থানায়। কাজেই বুঝতে পারছেন সুহাসবাবুর ব্যাপারটা মনে ছিল না–মনে থাকবার কথাও নয়।
কিন্তু আপনি আবারও ভুল করে বসলেন—মারাত্মক ভুল, যেটা আমার কাছে অস্পষ্ট থাকেনি—সুহাসবাবুর দৃষ্টি এত ক্ষীণ ছিল যে দূর থেকে সেই আপনার সাজানো ব্যক্তিকে দেখে তার নিখুঁত একটা বর্ণনা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না—তিনি যা বলেছেন আমার কাছে সেটা আপনারই লোকটির সম্পর্কে বিবরণের কেবল পুনরাবৃত্তি মাত্র। তারপর সেই টুপি ও বায়নাকুলার—আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় সেও আপনিই লোকটিকে সাপ্লাই করেছিলেন। আপনি একজন ফিল্মের নামী ডিরেক্টরের প্রধান অ্যাসিস্ট্যান্ট-অনেক একস্ট্রা নিয়ে আপনার কাজ-কারবার যেমন, তেমনি অনেকেই ফিল্মে একটু চান্স পাওয়ার জন্য হয়ত আপনার আশেপাশে ঘুরঘুর করে তোষামোদ করে, তাদেরই একজনকে ঐভাবে সেদিন মেকআপ দিয়ে বেগার দেওয়াতে আপনার অসুবিধা হবার কথা নয়—কিন্তু সেখানেও আবার ভুল করলেন আপনি, অকুস্থানে তার টুপি ও বায়নাকুলারটা তাকে দিয়ে ফেলে রেখে। সে আপনার কথা মতই কাজ করেছে—সেগুলো ফেলে পালিয়েছে—আর অন্য দিকে আপনার তৈরী ফাদে আপনিই আটকা পড়ে গেলেন।
তার নিজের যদি ঐ বায়নাকুলারটা হতো–তাহলে সে অত দামী জিনিসটা ঐভাবে ফেলে পালাত না—তাছাড়া লোকটা পরে নিজের বিপদের সম্ভাবনা দেখেই থানায় সুশীলবাবুর কাছে অকপটে সেদিনকার কথাটা প্রকাশ করে দিত না, বুঝেছেন তো—আবার সেই ভাগ্যের পরিহাস!
(৪) এবারে আসবো সেই মুহূর্তের ঘটনায়। এ কথা সত্যি, আপনি একটা সুযোগ পেয়ে তা ব্যবহার করেছেন এবং সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য দুই বলবো আপনার—সেদিনকার সংবাদপত্রের ফোরকাস্ট-মত ঠিক সময়ে ধুলোর ঝড় উঠলো—আপনার হাতের মধ্যে এসে গেল সুযোগ—আপনি হত্যা করলেন মিত্রানীকে
(৫) কিন্তু আপনার প্রতিদিনকার লালসা, মিত্রানীকে ঘিরে যা আপনাকে ক্ষিপ্ত করেছিল—সেই লালসাতেই আপনি সেই মৃতদেহের উপরই ঝাপিয়ে পড়লেন। মার্ডারার সাধারণত দুই রকমের হয়—একটা হয় হ্যাবিচুয়াল মার্ডারার-যারা কোন স্বার্থে বা উদ্দেশ্যে হত্যা করে—আর এক শ্রেণীর খুনী হচ্ছে যারা লুনাটিক ম্যানিয়াক—আপনি শেষোক্ত শ্রেণীর—লালসা আপনাকে উন্মাদ করে তুলেছিল।
(৬) প্রোবাবিলিটি ও চান্সের দিক দিয়ে আপনাকেই আমি চিহ্নিত করেছি, কারণ আপনিই ছিলেন ধুলোর ঘূর্ণিঝড় ওঠবার পূর্বমুহূর্তে মিত্রানীর একেবারে ঠিক পাশেই এবং মোটিভের কথা তো আগেই বলেছি আপনার। তবু অদৃষ্টের পরিহাস আপনাকে দিয়ে মোক্ষম ভুলটি করিয়ে নিয়েছিল—আপনার মাথার চুলই দলের মধ্যে একমাত্র কটা—সেই রকম একটি চুলই নিহত ও পরে ধর্ষিতা মিত্রানীর ব্লাউজের মধ্যে আটকে ছিল। কাজেই হত্যা করবার পর যদি তাকে না ধর্ষণের চেষ্টা করতেন, ঐ চুলটা তার ব্লাউজে যদি না। আটকে থাকতো আপনাকে সনাক্ত করা কিছুটা কঠিন হতো। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন তো, ধর্ষণটা আপনার কত বড় মারাত্মক ভুল হয়েছিল এবং যেটা আপনার আসল এবং আদি ও অকৃত্রিম চেহারাটা আমার চোখের সামনে স্পষ্ট করে তুলেছে।
আগের পর্ব :
০১. প্রস্তাবটা তুলেছিল সজলই
০২. সজলের একটা কমপ্লেক্স ছিল
০৩. ঐ ঘটনারই পরের দিন
০৪. সকলেই সজলের অনুপস্থিতিটা
০৫. মিত্রানীকে বেশী খুঁজতে হয়নি
০৬. সে রাত্রে ছাড়া পেতে পেতে
০৭. ঐদিনই দ্বিপ্রহরে লালবাজারে
০৮. ওদের সকলের পৌঁছাবার আগেই
০৯. সুব্রত এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি
১০. সজল চক্রবর্তীর পর এলো সুহাস মিত্র
১১. কিরীটী আর সুব্রত সেদিন
১২. ছুটির দিন বলেই হয়ত
১৩. পরের দিন ভোরবেলাতেই
১৪. ডাইরীখানা নিয়ে
১৫. কিরীটী পাতার পর পাতা পড়ে চলে
১৬. দিন দুই আর কিরীটী কোথাও বেরই হলো না
১৭. মিত্রানীর হত্যা-রহস্যের একটা জট
১৮. রবিবার সকালের দিকে
১৯. কিরীটীর ওখান থেকে বের
২০. বাড়িতে ফিরে সারাটা দিন
২১. সজল চক্রবর্তী এলোই না
২২. সুহাস মিত্রকে তার অফিসে পাওয়া গেল না
২৩. চিঠিটা আমার পড়তে বসে
পরের পর্ব :
২৪. থানায় বসে সুশীল নন্দী