তীব্রতা

তীব্রতা

ছোট থেকেই মেয়েটাকে বিরক্ত লাগে।আমার এই সুন্দর জীবনে ওকে কাঁটার মত মনে হতো । খুব বেশি এড়িয়ে চলতাম। জীবনে ছোট একটা বোন থাকা নাকি হাজারও সুখের সমান ! কিন্তু এই মেয়েটা জন্মের আগ পর্যন্তই আমি সুখী ছিলাম।খুব সুখী ! এই মেয়েটার জন্মের পর আমার সুখ,আদর,ভালবাসাগুলো ক্রমশ ভাগ হতে লাগলো।যেটা আমি কখনওই চাইতাম না। বাবা আগে আমাকে চোখের মণি বলে ডাকতো।আর এখন সেটাও বিভক্ত হয়ে গেছে।আমার সাথে সাথে ও নাকি বাবার চোখের মণি ? কিন্তু সেটা আমার বিরক্ত লাগতো। খুব বিরক্ত ! আমারতো মনে হতো ও চোখের মণি নয়, ও হলো চোখের বিষ ! চোখের সামনে এই মেয়েটা ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো।খুব চাইতো আমার পাশে বসতে বা রুপকথার গল্প শুনতে।কিন্তু কখনো আমি ওকে সেই সুযোগ দেইনি।

তখন মেয়েটা ক্লাস সেভেনে পড়ে।অবশ্য ওর একটা নাম আছে , তীব্রতা । তীব্রতা মানে ধার বা প্রখরতা।এই মেয়েটার প্রখরতা আসলেই নিখুঁত ছিলো।অল্প সময়ে কেমন করে সবাইকে আপন করতে হয় তা হয়তো এই মেয়েটা বেশ জানতো বা আল্লাহ্ তার মধ্যে সেই গুণটা নিপুণভাবে দিয়েছেন ! যদিও আল্লাহর সকল সৃষ্টির তুলনার কথা বলা বাহুল্য ।

আমি যতটা ওকে এড়িয়ে চলি ও ঠিক ততটাই বা তারও বেশি প্রায়োরিটি আমাকে দেয়।ওর জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবল তাড়না নিয়ে সবসময় আমাকে পাগল করে ছাড়ে।বিশ্বাস করুন, খুব যে খারাপ লাগতো তা নয় তবে চেষ্টা করতাম ওকে ভালো না বাসার। বাবা খুব ছোটোখাটো একটা ব্যবসায় করতেন।আমাদের পরিবারটা খুব একটা সচ্ছল পরিবার ছিলো না।আমরা দু’বোন বাবা আর মা’কে নিয়েই সংসার।বাবার উপার্জনে পুরো পরিবারটা চলে। তীব্রতা বেশ সৃষ্টিশীল ছিলো।বাবার সামনে বসে বসে নিখুঁত দৃষ্টিতে তার কাজকর্ম দেখতো।ও ছোট থেকেই বেশ আগ্রহ নিয়ে বাবাকে অনুসরণ করতো।আর আমি ছিলাম পুরোপুরিভাবে তার বিপরীত।

হঠাৎ করে একসময় বাবা মারা গেলেন।আমাদের পরিবারে প্রায় হতাশা নেমে আসলো।বাবাকে হারিয়ে সব ওলটপালট হয়ে গেলো।আমাদের দু’বোনের লেখাপড়াও প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে । চরম বাস্তবতার সম্মুখে আমরা তিনজন ব্যক্তি ! কিন্তু পরিবারের হাল তো ধরতেই হবে। তখন আমার ছোট বোনটি পরম যত্নে বাবার ব্যবসায় চালিয়ে যেতে লাগলো।পাশাপাশি মা আর আমার দেখাশোনা করার প্রতিজ্ঞা যেন ও করেই ফেলল !তীব্রতা সেদিন আমার পাশে বসে একটি কথা বলেছিলো,

–দিদিয়া, তুই পড়াশোনা কর।বাবার তোকে নিয়ে খুব আশা ছিলো রে।আর আমি বাবার ব্যবসায়টা চালিয়ে যাই পাশাপাশি লেখাপড়াটাও। তোদেরকে তো দেখতে হবে বল ? এতটুকু মেয়ের এমন কথা শুনে আমি সেদিন খুব ই অনুতপ্ত ছিলাম।কারণ এই মেয়েটা এখনও আমাকে খুব প্রায়োরিটি দিচ্ছে । আর আমি ওকে ছোট থেকেই …! কিছুই বলিনি ওকে।কেবল হাত দুটো ধরে সামনে নিয়ে এসে জড়িয়ে ধরিছিলাম।

–দিদিয়া, খুব ভালবাসি তোকে।আমাকে দূরে ঠেলে রাখিস নারে।

ভাবছি, বাবা নিজে মারা গিয়ে আমাকে একটা হীরের টুকরো দিয়ে গেলো ! যার মূল্য এতটা বছর আমি বুঝতেই পারলাম না ? কিন্তু আফসোস , বাবা দেখে যেতে পারলেন না । তারপর বোন বাবার ব্যবসায় দেখাশোনা আর পড়াশোনা দুটোই শুরু করলো। আমিও আবার লেখাপড়া শুরু করলাম।বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে আমাদের দিন চলতে লাগলো । এক এক করে অনেকটা বছর পেরিয়ে যেতে লাগলো।

পরবর্তীতে আমি লেখাপড়া শেষ করে একজন উকিল হই।এখন আমার উপার্জনে পরিবারটা চলে।কারণ বাবার ব্যবসায় খুব একটা লাভ হচ্ছিলো না। আর পাঁচজন নাম করা উকিলের সাথে আমার উঠাবসা।ওদের সাথে আমার সবদিকে যায় কিন্তু পরিবারের দিক দিয়ে আমি সর্বদা নিম্মতম ছিলাম।ওরা সবাই হাই সোসাইটির ছিলো বললেই চলে।তাই ওদের কাছ থেকে সবসময় নিজের পরিচয় গোপন করে রাখতাম।

সেদিন মা আর বোনকে ছেড়ে চলে আসি।বিশেষ কাজে দেশের বাহিরে যেতে হবে এরকম একটা উছিলা দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি।কারণ ওদেরকে নিয়ে পড়ে থাকলে আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার প্রায়।তাই এছাড়া আমার কিছুই করার ছিলো না। মাঝে অনেকটা বছর কেটে যায়।মা অথবা বোনের খোঁজখবর কখনোই নেই নি।কেন নিবো ?ওরা আমার জন্য যা করেছে আমি প্রায় ৪/৫বছরে তার থেকে বেশি করেছি।আমি তো আর ওদের জন্য কম খরচ করিনি ! আমি এর মধ্যে বিয়ে করে বেশ সংসার করছি।ছেলেমেয়ে নিয়ে খুব সুন্দরভাবে দিন অতিবাহিত হতে লাগলো।সবদিক দিয়ে খুবই সুখী ছিলাম।

বিয়ের প্রায় ১৯বছর ৪মাস পর নতুন একটা মোকদ্দমা (case) হাতে পাই।যদিও এর মধ্যে অনেক মোকদ্দমা হাতে নিয়েছি তবে এই বিষয়ে প্রথম পক্ষ নিলাম। বিষয়বস্তু ছিলো এক মায়ের তিন সন্তান ও রেখে যাওয়া সম্পত্তি নিয়ে। মা মারা যাওয়ার পর তার সম্পত্তি নিয়ে তিন ভাইবোনের মধ্যে মনকষাকষি। আমি ছিলাম বিষয়বস্তুর পক্ষে। আর বিপক্ষে ছিলেন একজন নতুন উকিল।যদিও তা নিয়ে আমার তেমন ইন্টারেস্ট ছিলো না।

পরদিন যথারীতি আদালতে এসে উপস্থিত হলাম।বিপক্ষের উকিলকে দেখে ভীষণ অবাক হলাম।মুখ দিয়ে অস্পষ্টে ‘তীব্রতা ‘ নামটা বেরিয়ে আসলো ! কিন্তু তীব্রতা মনে হলো আমাকে চিনতেই পারলোনা ! তীব্রতার বিপক্ষে তার বোন নিদ্রিতা আছে।আমার নাম নিদ্রিতা। অবশ্য ব্যাপারটা ছোট থেকেই এমন ছিলো। নিয়মঅনুযায়ী মোকদ্দমা শুরু হয়ে গেলো।

–মৃত মহিলার তিন সন্তান ঠিকই ছিলো কিন্তু তার ঠাঁই কোনো সন্তানের কাছে হলোনা।বৃদ্ধাশ্রমের বিষাক্ত কুঠুরিতে মহিলার শেষ জীবন অতিবাহিত হয়।তারপরেও বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রিত প্রতিটি মায়ের বিষাক্ত ঘরগুলোতে যে জানালা থাকে তার প্রতিটি গ্রিল জানে, একজন মা কতটা স্বার্থপর ! তা না হলে কিভাবে সে জানালার গ্রিলটা আকড়ে ধরে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে তার সন্তান যেন ভালো থাকে।কেন সে নামাজ শেষ করে মোনাজাতে সন্তান নামের অমানুষগুলোর ভালো থাকা কামনা করে ? কেন তাদের দীর্ঘায়ু কামনা করে ? তীব্রতার এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ওখানে থাকা তিন সন্তান, আমি অথবা আদালতে উপস্থিত থাকা কেউই দিতে পারলো না।

–তিনজন যখন একজন মা’কে লালনপালন করতে পারলো না সেক্ষেত্রে তার সম্পত্তির ভার কিভাবে নিবে ? পারবে তো সম্পত্তিগুলো লালন পালন করতে ?

তখন মৃত ব্যক্তির বড় মেয়ে সহ বাকি সন্তানরা বললো, এই সম্পত্তি তাদের প্রাপ্য নয়। এটা বরং সেইসব মায়েদের জন্য থাকুক যারা তীলে তীলে বৃদ্ধাশ্রম তাদের নিজেদের জন্য তৈরি করছে। মুদ্রার উল্টাপিঠ আবার ঠিকই ফিরে আসে।ব্যস সেটা কেবল সময়ের অপেক্ষা । অতঃপর মোকদ্দমার সমাপ্তি ঘটলো। তীব্রতা কাগজপত্র গুঁছিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিলো। ঠিক তখন আমি ওর হাতটা ধরে থামিয়ে দিলাম।

–কেমন আছিস তীব্রতা ?

–ভালো । তুই ?

–মা কেমন আছেরে ?

–চিন্তা করিস না দিদিয়া।মা’কে আমি ছেড়ে কখনোই আসবোনা।তোর মত উছিলাও খুঁজবো না।

কারণ আল্লাহর রহমতে আমার জান্নাতকে আমি ঠিকই লালনপালন করতে পারবো। আর শোন, অতীতকে যত্ন করতে শিখিস, কখনো ভুলে যাসনা।কারণ তোর এই অতীতই তোর ভবিষ্যৎ তৈরি করবে । হোক সেটা আমার মায়ের ক্ষেত্রে তুই আর তোর ক্ষেত্রে তোর সন্তানেরা।মা কখনো আমাদের অযত্ন করেনি।তারপরেও কেন এই ত্রুটির সৃষ্টি হলো জানিনা ! শুনেছি বিয়ে করেছিস, দুই সন্তানের জননী তুই।

আমার মায়ের জীবনতো পার হয়ে যাচ্ছে,দোয়া করি তোর জীবনটাও যেন এইরকম সুখে পার হয়। মুদ্রার অপর পিঠটা যেন কখনোই তোকে স্পর্শ না করে দিদিয়া।কারণ তোকে খুব ভালবাসি দিদিয়া। তীব্রতা চলে গেলো।কিন্তু তীব্রভাবে আমার বুকে পিনপিন করে ব্যথা অনুভব হলো । আমার জন্য কি সেই বিষাক্ত ঘরটা অপেক্ষা করছে ? আমি কি নিজের হাতেই তা আমার জন্য তৈরি করছি ? মা আমাকে ক্ষমা করবে তো ?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত