১৭. মিত্রানীর হত্যা-রহস্যের একটা জট
সুহাসবাবু!
বলুন।
মিত্রানীর হত্যা-রহস্যের একটা জট আমি কিছুতেই খুলতে পারছিলাম না— আপনার স্বীকারোক্তি সেই জটটা খুলে দিল। আচ্ছা সুহাসবাবু, একটা কথা
বলুন—
মিত্রানীর প্রতি সজলবাবু যে আকৃষ্ট ছিলেন সে কথাটা কি আপনি বুঝতে পেরেছিলেন কখনো?
জানতাম–
জানতেন? কি করে জানলেন?
বিদ্যুৎ একদিন আমাকে বলেছিল—
বিদ্যুৎবাবু আপনাকে কথাটা বলেছিলেন?
হ্যাঁ। কথাটা শুনে আমি, বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবু, সুখীই হয়েছিলাম। সজল জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—মিত্রানীকে সে বিয়ে করলে মিত্রানী সুখীই হবে। এ
আচ্ছা ঐ দুর্ঘটনার আগে এবং গার্ডেনে সকলে মিলিত হবার পূর্বে শেষ কার কার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল বন্ধুদের মধ্যে?
সকালে বাড়িতে এসেছিল সজল এবং বিদ্যুৎ—সে এসেছিল অফিসে আমায় পিকনিকের কথাটা জানাতে পরের দিন দুপুরে।
ভাল কথা, কিরীটী বললে, দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল—১৪ মে, শনিবার—তাই না?
হ্যাঁ, তারিখটা আমার চিরকাল মনে থাকবে কিরীটীবাবু।
তারপর একটু থেমে বললে সুহাস, সেদিনটা—সরকারী এবং বেসরকারী অফিস সব বন্ধ ছিল–তাই তো শনিবার পিকনিকের জন্য স্থির করেছিল বিদ্যুৎ
আচ্ছা বৃহস্পতিবার সকালের দিকে আপনি মিত্রানীকে ফোন করেছিলেন!
আমি মিত্রানীকে ফোন করেছি—কে বললে একথা!
মিত্রানীর ডাইরীতেই কথাটা লেখা আছে—
মিত্রানী তার ডাইরীতে লিখেছে, আমি বৃহস্পতিবার সকালে তাকে ফোন করেছিলাম?
হ্যাঁ—
আশ্চর্য! আমি তাকে জীবনে কখনো ফোন করিনি—
আপনি জানতেন তার বাড়িতে ফোন ছিল?
জানতাম বৈকি।
কি করে জানলেন?
মিত্রানীই কলেজে একদিন আমাকে কথাটা বলেছিল।
তাহলে ১২ই মে সকালে আপনি মিত্রানীকে ফোন করেননি সুহাসবাবু?
না।
সকাল সাতটা থেকে আটটার মধ্যে সেদিন আপনি কোথায় ছিলেন, কি করছিলেন?
দোতলায় আমাদের বাসাবাড়ির বাড়িওয়ালার ছেলেকে পড়াচ্ছিলাম। মঙ্গল, বৃহস্পতি হপ্তায় দুদিন তাকে আমি পড়াই কিন্তু সত্যিই অবাক লাগছে, মিত্রানী তার ডায়েরীতে ঐ কথা লিখলো কেন? মিত্রানী তো কখনো মিথ্যা বলতো না—
হয়ত এমনও হতে পারে—
কি?
আপনার নাম করে অন্য কেউ তাকে ফোন করেছিল?
কিন্তু তাই বা কেউ করতে যাবে কেন?
আপনার ঐ প্রশ্নের জবাব হয়ত কয়েক দিনের মধ্যেই আমি দিতে পারবো সুহাসবাবু —কারণ অন্ধকার অনেকটা কেটে গিয়েছে–
কি বলছেন আপনি আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কিরীটীবাবু—
কিরীটী হেসে বললে, কথামালা পড়েছিলেন ছোটবেলায়?
পড়েছি—
কথামালায় সেই নীলবর্ণ শৃগালের গল্পটা নিশ্চয়ই মনে আছে?
আছে—
শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। ধোপার গামলায় পড়ে সেই ধূর্ত শৃগালের গায়ে যে রং লেগেছিল–তার সেই নীলবর্ণ বনের অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারদের মনের মধ্যে প্রথমটায় একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করলেও অনতিকাল পরে অকস্মাৎ দৈবচক্রে তার কণ্ঠের চিরাচরিত হুক্কাহুয়া ধ্বনিই তার আসল স্বরূপটি উঘাটিত করে দিয়েছিল। তবে হ্যাঁ, ঐ শৃগালের ব্যাপারটা ছিল আকস্মিকই একটা ঘটনা মাত্র কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা আকস্মিক নয়, সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত এবং স্থির মস্তিষ্কের কাজ।
কতকটা বোকার মতই যেন সুহাস কেমন অসহায় ভাবে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
কিরীটী স্মিতহাস্যে বললে, বুঝলেন না তো সুহাসবাবু?
না–মানে—
আমি বলতে চাই, কিরীটী শান্ত গলায় বললে, নো ক্রাইম ইজ পারফেক্ট!
কিছুক্ষণ হলো সুহাস মিত্র বিদায় নিয়েছে।
কিরীটী সুব্রত ও কৃষ্ণা দ্বিতীয় প্রস্থ চা নিয়ে বসেছিল। সুব্রত এতক্ষণ নির্বাক শ্রোতা ছিল, একটি কথাও বলেনি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে এক সময় সুব্রত বললে, কিরীটী, মনে হচ্ছে কাজল বোসের ভূতটা বোধ হয় তোর কাঁধ থেকে নেমে গেছে
কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানাল, না, না—আদৌ নয়—মোক্ষম তিনটি জটের একটি জট যেটা সুহাস মিত্রকে নিয়ে ছিল সেই জটটিই মাত্র খুলেছে, কিন্তু এখনো দুটো জট রয়ে গিয়েছে—
তার মধ্যে একটি বোধ হয় কাজল বোস!
হ্যাঁ—
আর বাকীটা?
সেটা হত্যাকারীকে চিহ্নিত করবার মধ্যে শেষ জট। তোকে বলেছিলাম সেদিন সুশীল নন্দীর ওখান থেকে গাড়িতে আসতে আসতে—একটা কথা নিশ্চয়ই তোর মনে আছে– মিত্রানীকে কেন্দ্র করে একটি জটিল ত্রিকোণের সৃষ্টি হয়েছিল দুটি পুরুষের আকর্ষণ ও বিকর্ষণে–
মনে আছে।
এ আমি বলেছিলাম মিত্রানীর হত্যার মূলে ঐ আকর্ষণ ও বিকর্ষণই—
হ্যাঁ—এবং এও বলেছিলাম, আপাতদৃষ্টিতে ভালবাসা ও ঘৃণা দুটি বিপরীত বস্তু হলেও ভালবাসা থেকে যেমন ঘৃণার জন্ম হতে পারে তেমনি ঘৃণার মূলে অনেক সময় থাকে ভালবাসা।
তুই ঠিক কি বলতে চাস কিরীটী?
বলতে চাই ঐ জটটি এখনো আমার কাছে খুলে যায়নি—আর সেটা যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ হত্যাকারীর চেহারাটাও স্পষ্ট হয়ে উঠবে না।
তবে কি এখনো–
না সুব্রত, হত্যাকারী এখনো কিছুটা ঝাপসা—কিছুটা ধোঁয়া তাই ভাবছিলাম, দেখি যদি কাজল বোসের কাছ থেকে কিছুটা সাহায্য পাই–
কৃষ্ণা ঐ সময় বলে উঠল, কিছুই পাবে না।
কেন?
ভুলো না, সুহাস মিত্রের মতো পুরুষ নয় সে-নারী।
সুব্রত বললে, ঠিকই বলেছে কৃষ্ণা—ওদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, ঠিক—তবে যুধিষ্ঠিরের সেই তার মাকে অভিশাপ, কোন নারীর পেটে কোন কথা থাকবে না। তাছাড়া আমার তূণে আছে মোক্ষম অস্ত্র–
যথা? প্রশ্নটা করে সুব্রত কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
আমাদের সুহাস মিত্র—
সুহাস মিত্র?
হ্যাঁ–ভুলে যাচ্ছিস কেন সুব্রত, সুহাসের জন্য কাজল প্রাণও দিতে পারে—
কিরীটীর কথার সঠিক তাৎপর্যটা ঐদিন সুব্রত ঠিক উপলব্ধি করতে পারেনি পেরেছিল দিন দুই বাদে।
সুহাসের সাহায্যেই কিরীটী কাজল বোসকে তার বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিল। সুব্রত বুঝতে পারেনি কিরীটীর প্ল্যানটা।
কিরীটী পরের দিন দুপুরে নিজেই গিয়েছিল সুহাস মিত্রের অফিসে।
সুহাস মিত্র কিরীটীকে দেখে অবাক।
কিরীটীবাবু আপনি!
একটা কাজ করতে হবে আপনাকে সুহাসবাবু—
বলুন কি কাজ?
আপনাদের বান্ধবী–কাজল বোসের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই–
সে তো আপনিই তাকে ডেকে পাঠিয়ে—মানে সুশীলবাবুকে বললেই তিনি ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন।
তা পারবেন জানি, আমি তা চাই না। আমার ইচ্ছা আপনি তাকে কাল বা পরশু আমার ওখানে একটিবার যদি আসতে বলেন—
আমাকেই বলতে হবে,
হ্যাঁ—কারণ আপনাকে দিয়ে বলানোর মধ্যে আমার একটা উদ্দেশ্য আছে—
সুহাস যেন কি ভাবলো, তারপর বললে, বেশ তাই হবে—তবে আজ তো হবে না— কাল শনিবার আছে, দুটোয় অফিসের ছুটির পর আমি তার ওখানে যাবো—রবিবার আসতে বলবো–
খুব ভাল।
আগের পর্ব :
০১. প্রস্তাবটা তুলেছিল সজলই
০২. সজলের একটা কমপ্লেক্স ছিল
০৩. ঐ ঘটনারই পরের দিন
০৪. সকলেই সজলের অনুপস্থিতিটা
০৫. মিত্রানীকে বেশী খুঁজতে হয়নি
০৬. সে রাত্রে ছাড়া পেতে পেতে
০৭. ঐদিনই দ্বিপ্রহরে লালবাজারে
০৮. ওদের সকলের পৌঁছাবার আগেই
০৯. সুব্রত এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি
১০. সজল চক্রবর্তীর পর এলো সুহাস মিত্র
১১. কিরীটী আর সুব্রত সেদিন
১২. ছুটির দিন বলেই হয়ত
১৩. পরের দিন ভোরবেলাতেই
১৪. ডাইরীখানা নিয়ে
১৫. কিরীটী পাতার পর পাতা পড়ে চলে
১৬. দিন দুই আর কিরীটী কোথাও বেরই হলো না
পরের পর্ব :
১৮. রবিবার সকালের দিকে
১৯. কিরীটীর ওখান থেকে বের
২০. বাড়িতে ফিরে সারাটা দিন
২১. সজল চক্রবর্তী এলোই না
২২. সুহাস মিত্রকে তার অফিসে পাওয়া গেল না
২৩. চিঠিটা আমার পড়তে বসে
২৪. থানায় বসে সুশীল নন্দী