১১. কিরীটী আর সুব্রত সেদিন
কিরীটী আর সুব্রত সেদিন যখন উঠবে-উঠবে করছে, বিদ্যুৎ সরকার এলো।
সবাই তখন চলে গিয়েছে।
বিদ্যুৎ ঘরে ঢুকে বললে, সুশীলবাবু, আমি অত্যন্ত দুঃখিত—বিশেষ কাজে আটকা পড়ায় আসতে দেরী হয়ে গেল।
সুশীল নন্দী বললেন, ঠিক আছে, বসুন—আলাপ করিয়ে দিন—ইনি—বিদ্যুৎ সরকার আর বিদ্যুৎবাবু, এঁকে চাক্ষুষ দেখেছেন কিনা জানি না, তবে নিশ্চয়ই এঁর নাম শুনেছেন–কিরীটী রায়।
নমস্কার। ওঁর নাম আমি বহুবার শুনেছি মিত্রানীর মুখে। আজই সকালে মিত্রানীর দাদা প্রণবেশবাবুর সঙ্গে টেলিফোনে যখন কথা হচ্ছিল, উনি বললেন, মিত্রানার মৃত্যুর ব্যাপারটা উনি তদন্ত করছেন।
কিরীটী বললে, মিত্রানীর বাবা অবিনাশবাবুর কাছে একসময় আমি পড়েছি–স্কুলে উনি আমাদের অঙ্কের মাস্টার ছিলেন।
বিদ্যুৎ সরকার কিরীটীর মুখোমুখি একটা খালি চেয়ার টেনে নিয়ে বসল, উঃ, কি প্রচণ্ড গরম–
কিরীটী বললে, আজও সকালবেলায় কাগজে ছিল সন্ধ্যার দিকে বজ্রবিদ্যুৎসহ এক পশলা ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে–
বিদ্যুৎ বললে, ছিল নাকি! আমি দেখিনি। সচরাচর ওদের আবহাওয়ার পূর্বাভাস বড় একটা মেলে না বলে আমি কখনো ও-সব দেখি না বা থাকলেও গুরুত্ব দিই না।
একেবারে যে মেলে না তা নয়, কিরীটী বললে, সেদিন কিন্তু পূর্বাভাস ঠিক মিলে গিয়েছিল—আর তাতেই হত্যাকারীর পূর্ব পরিকল্পনা সাকসেসফুলও হয়েছিল।
চকিতে বিদ্যুৎ সরকার কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
কিরীটী একটা সিগার ধরানোর ব্যাপারে ঐ মুহূর্তে ব্যস্ত থাকায় ব্যাপারটা তার নজরে পড়লেও সুব্রতর দৃষ্টি কিন্তু এড়ায় না।
আরো কিছুক্ষণ পরে কিরীটী ও বিদ্যুৎ সরকারের মধ্যে কথা হচ্ছিল। বিদ্যুৎ সরকার যে অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে, সেটা তার চেহারা ও পোশাকেই কিছুটা যেন ধরা যায়। যেমন গাত্রবর্ণ, তেমনি সুন্দর স্বাস্থ্যবান চেহারা। চেহারার মধ্যে একটা যেন বনেদী ছাপ আছে।
বিদ্যুৎবাবু, আপনার সঙ্গে তো প্রায়ই মিত্রানীর টেলিফোনে কথাবার্তা হতো?
হ্যাঁ–মধ্যে মধ্যে হতো।
কিছুটা আপনাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতাও ছিল ধরে নিতে পারি বোধ হয় কিরীটী বললে।
ঘনিষ্ঠতা বলতে আপনি কি মীন করছেন জানি না কিরীটীবাবু তবে আমাদের পরস্পরের মধ্যে কিছুটা হৃদ্যতা ছিল। আমাদের কলেজ-লাইফে আরো সহপাঠিনী ছিল কিন্তু মিত্রানীকে আমার বরাবরই ভাল লাগতো ওর মিশুঁকে সরল মিষ্টি স্বভাবের জন্য মনের মধ্যে কোন মার পাঁচ ছিল না।
আচ্ছা মিত্রানীর আপনাদের ছেলেদের মধ্যে কারোর প্রতি বিশেষ কোন আকর্ষণ বা · তার প্রতি কারো ছিল বলে আপনার মনে হয়? আপনারা তো পরস্পরের অনেক দিনের পরিচিত।
মিত্রানীর ঠিক সে রকম কারোর প্রতি ছিল বলে কখনো আমার মনে হয়নি। তবে মিত্রানী বরাবর যেমন লেখাপড়ায় ভাল ছিল, আমাদের দলের সুহাসও তাই ছিলকলেজ-লাইফে লাইব্রেরীতে ওদের দুজনকে অনেক দিন বসে গভীর আলোচনারত দেখেছি—আর বিশেষ কিছু তেমন চোখে পড়েছে বলে তো মনে পড়ছে না। তারপর একটু থেমে বিদ্যুৎ বললে, তবে ইদানীং বছর তিনেকের বেশী কলেজ ছাড়বার পর বিশেষ তেমন একটা দেখাশোনা হতো না—ঐ সময়ে যদি কিছু হয়ে থাকে তো বলতে পারবো না।
আচ্ছা বিদ্যুৎবাবু, দুর্ঘটনার দিন হঠাৎ যখন ধূলোর ঝড় উঠে চারিদিক ঢেকে গেল–আপনারা সকলেই পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন কিছু সময়ের জন্য, তখন কারো কোনরকম চিৎকার বা গলার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন কি?
না তো? তবে আমার মনে হচ্ছে, একটা কথা যা সেদিন সুশীলবাবুকে বলিনি, সেটা বোব হয় আমার বলা ভাল
কি কথা?
ঝড় ওঠবার পরই যখন হাতড়াতে হাতড়াতে কোনক্রমে সেই ধুলোর ঘূর্ণির অন্ধকারের মধ্যে এগুচ্ছি, মনে হয়েছিল যেন কে আমাকে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে গেল—আমি কে বলে চেঁচালাম, কিন্তু কারো সাড়া পেলাম না। তারপরই আরো কয়েক পা অন্ধের মত এগুতেই একটা যেন ঝটাপটির শব্দ আমার কানে এসেছিল, কিন্তু চোখে ধুলো ঢাকায় চোখ দুটো এত কর-কর করছিল, এত জ্বালা করছিল যে, নিজেকে নিয়েই তখন আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি
কেউ আপনাকে ধাক্কা দিয়েছিল? একটা ঝটাপটির শব্দ শুনেছিলেন?
হ্যাঁ।
ঝড় ওঠবার মুহূর্তে আপনি মিত্রানীকে দেখতে পেয়েছিলেন, সে কোথায় কত দূরে ঠিক কার পাশে ছিল?
মিত্রানী ঠিক বোধ হয় আমার পাশেই ছিল।
আর কাজল বোস?
সে বোধ হয় সুহাসের কাছাকাছিই ছিল।
আচ্ছা বিদ্যুৎবাবু, আর একটা কথা, সেদিন আপনাদের আশেপাশে মুখে চাপদাড়ি, চোখে রঙিন কাঁচের চশমা, মাথায় বেতের টুপি, হাতে বা গলায় ঝোলানো একটা বায়নাকুলার–এমন কাউকে দেখেছিলেন কি? পরনে কালো প্যান্ট, গায়ে স্ট্রাইপ দেওয়া একটা হাওয়াই শার্ট–
না–সে রকম তো কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। আমরা নিজেদের নিয়ে এত মশগুল ছিলাম যে–
বুঝেছি, আশেপাশে তাকাবার ফুরসুৎ পাননি। তাই না?
হ্যাঁ।
আপনার বায়নাকুলার আছে বিদ্যুৎবাবু?
না।
আপনাদের দলে কারোর আছে?
বলতে পারবো না।
আপনি সিগ্রেট খান?
মাঝে-মধ্যে—
কি ব্রান্ড?
কোন স্পেশ্যাল ব্রান্ড নেই–একটা হলেই হলো, ঠিক নেশায় তো ধূমপান করি না, এমনি শখ করে দু একটা খাই। তারপরই একটু থেমে বিদ্যুৎ সরকার বললে, দেখুন মিঃ রায়, আপনি মিত্রানীর মৃত্যুর ব্যাপারটা একটু আগে বলেছিলেন, হত্যাকারীর পূর্বপরিকল্পিত-সত্যিই কি আপনি তাই মনে করেন?
করি।
ও! আচ্ছা, আপনার কি আমাদের মধ্যে সত্যিই কাউকে সন্দেহ হচ্ছে—
আপনার কাছে মিথ্যা বলবো না বিদ্যুৎবাবু, সেই রকমই আমার সন্দেহ হয়।
মানে অনুমান—
আচ্ছা বিদ্যুৎবাবু, রাত অনেক হলো—এবার আমি উঠবো। চল সুব্রত—
কিরীটী হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। সুব্রতও উঠে দাঁড়ায় সঙ্গে সঙ্গে।
আগের পর্ব :
০১. প্রস্তাবটা তুলেছিল সজলই
০২. সজলের একটা কমপ্লেক্স ছিল
০৩. ঐ ঘটনারই পরের দিন
০৪. সকলেই সজলের অনুপস্থিতিটা
০৫. মিত্রানীকে বেশী খুঁজতে হয়নি
০৬. সে রাত্রে ছাড়া পেতে পেতে
০৭. ঐদিনই দ্বিপ্রহরে লালবাজারে
০৮. ওদের সকলের পৌঁছাবার আগেই
০৯. সুব্রত এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি
১০. সজল চক্রবর্তীর পর এলো সুহাস মিত্র
পরের পর্ব :
১২. ছুটির দিন বলেই হয়ত
১৩. পরের দিন ভোরবেলাতেই
১৪. ডাইরীখানা নিয়ে
১৫. কিরীটী পাতার পর পাতা পড়ে চলে
১৬. দিন দুই আর কিরীটী কোথাও বেরই হলো না
১৭. মিত্রানীর হত্যা-রহস্যের একটা জট
১৮. রবিবার সকালের দিকে
১৯. কিরীটীর ওখান থেকে বের
২০. বাড়িতে ফিরে সারাটা দিন
২১. সজল চক্রবর্তী এলোই না
২২. সুহাস মিত্রকে তার অফিসে পাওয়া গেল না
২৩. চিঠিটা আমার পড়তে বসে
২৪. থানায় বসে সুশীল নন্দী