বাঁচতে শিখুন

বাঁচতে শিখুন

–একটা সময় সম্পর্কে জড়াতে আমার ভীষণ ইচ্ছা করতো।একজন প্রিয় মানুষ যত্ন করবে,আগলে রাখবে আরও কত কি ! কিন্তু আমার এখন মনে হয় সম্পর্ক জিনিসটা কেমন যেনো জেল খানার মত বন্ধী জীবন । আমার এখন আর সম্পর্কে জড়াতে একটুও ইচ্ছা করে না।বয়সের সাথে সাথে মানুষের পরিবর্তনটা আবদ্ধ।মানুষ ভীষণ পরিবর্তনশীল।

বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ২৫/২৬ বছর বয়সের লাবীব নামের ছেলেটাকে বললাম।মাস কয়েক হলো ছেলেটা সময় ব্যয় করছে মরীচিকার পিছনে ঘুরে। সময় বড্ড গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের সঠিক ব্যবহার করা সকলের প্রয়োজন।

–মীনাক্ষী, আপনি এভাবে আমায় উপেক্ষা করতে পারেন না ! দেখুন, আমি আপনার মাঝে একজন শুদ্ধ মানুষকে খুঁজে পেয়েছি। ছেলেটা অবলীলায় কথাগুলো বলে যাচ্ছে।

–কিন্তু আমি শুদ্ধতা খুঁজে পাই নি।আপনি একজন অশুদ্ধ মানুষ। ব্যক্তিত্বহীন মানুষকে আমি একদম ই পছন্দ করি না।একটা মেয়ের পিছনে ঘুরে কেন নিজের ব্যক্তিত্ব নষ্ট করছেন ? এই বয়সে আপনি আপনার সংসারের একজন উপযুক্ত উপার্জন করার মত ছেলে যে সংসারের পুরোটা না হোক আংশিক সহায়তা করতে পারেন।সময় পেলে সেই সময়ের কিছুটা মা বাবাকে বা পরিবারের বিশেষ মানুষগুলোকে দিতে পারেন।কিন্তু তা না করে কোথাকার কোন এক মেয়ের জন্য সময় নষ্ট করছেন ! এটা একজন শুদ্ধ ব্যক্তির কাজ নয়।বুঝেছেন? ছেলেটাকে ভীষণভাবে বলছি কথাগুলো। কোথায় যেন পড়েছি,ছেলেরা ২০বছরেও যেটা আয়ত্ব করতে পারে না মেয়েরা ১৬পার হলেই সেটা ভীষণভাবে আয়ত্ব করে।সংসারের কাজে মা’কে সাহায্য করে,পার্সোনালিটি বজায় রেখে ম্যাচিউরিটি অর্জন করে।এই ছেলেটা সেই লেখার সাথেই একদম মিলে যাচ্ছে।বয়স পেরিয়েছে কিন্তু ছেলেমানুষিগুলা যায় নি।

–মীনাক্ষী, আমি যদি আপনার পিছনে ঘুরা ছেড়ে দেই।পাগলামো না করি, সঠিক পার্সোনালিটি বজায় রাখি।তবে কি আপনি আমায় ভালবাসবেন ? তাছাড়া নিজেকে সঠিকভাবে প্রস্তুত করতে যতটা সময় লাগে ততটা সময় কি আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করবেন? ছেলেটা কৌতুহল হয়ে আমায় প্রশ্ন করলো।হয়তো দৃঢ়ভাবে অপেক্ষা করছে একটা পজেটিভ উত্তরের জন্য।সেটা ওর চোখ দেখে দিব্যি বুঝতে পারছি।

–যদি ভালবাসি তাহলে অবশ্যই অপেক্ষা করবো আমি।আর যদি না ভালবাসি তবে অপেক্ষা করাটা বোকামি।সেটা আমার ক্ষেত্রেই হোক বা আপনার ক্ষেত্রে। ছেলেটার চোখে চোখ রেখে উত্তর দিলাম।

–আপনি কি আমাকে ভালবাসেন না ? দেখুন মীনাক্ষী, আমি সুস্থ একটা সম্পর্ক নিয়ে বাঁচতে চাই। বন্ধী জীবনযাপন বা অসুস্থ মস্তিষ্ক নিয়ে আপনাকে ভালবাসিনি।আমি আপনাকে পাওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাবো।কিন্তু আপনি অনুগ্রহ করে আমায় দোটানায় রাখবেন না।একটা সুস্থ উত্তর আপনার কাছ থেকে আমি চাই।

ছেলেটার কথায় ভীষণ যুক্তি আছে।আমি যদি একটা মানুষকে ভালো নাই বাসি তাহলে আমার কোনো অধিকার নেই তাকে অপেক্ষা করার কথা বলে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়ার।তাকে ভালবাসি আবার বাসিনা এর মাঝখানে ফেলে স্টিম রোলারের মত চাপানোর কোনো অধিকারও আমার নাই।বরং আমার উচিৎ তাকে শক্ত একটি জবাব দেওয়ার। হয় হ্যাঁ, না হয়, না।

–আপনি জানেন, তিনবছর আগে আমার একটা সম্পর্ক ছিলো ?

সাইড ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে ফোনের স্ক্রিনের ঝাপসা অবয়বপ্রাপ্ত দাগটা মুছতে মুছতে লাবীব নামের ছেলেটাকে প্রশ্ন করলাম।

–আপনার সম্পর্ক ছিলো এবং ভেঙে গেছে।আমি সবটাই জানি।জেনেশুনে বলছি,আপনাকে বিয়ে করতে চাই। আমায় বিয়ে করবেন ?

–আমায় সময় দিতে হবে।তাছাড়া বিয়েটা হাতের মোয়া না যে বললেন আর হয়ে গেলো।বর্তমান সমাজে আবেগের প্রশ্রয় চলে না।বাস্তবিক চিন্তাধারা প্রকট করুন।দেখুন আমার বা আপনার অর্থাৎ আমাদের নিজের মতামত অবশ্যই আছে।কিন্তু তার আগে আমাদের পরিবারকে বিষয়টা বলতে হবে।তাদের মতামতটাই বিয়ের ক্ষেত্রে একান্ত কাম্য।

–ঠিক আছে।তাহলে আমি আমার বাড়িতে জানাচ্ছি। আপনার বাড়িতে আপনি জানাতে পারবেন তো ?তবে হ্যাঁ আমি আপনাকে ঠিকই বিয়ে করবো যদি আপনি রাজি থাকেন। তাছাড়া আমি বেকার অবস্থায়ও আপনাকে বিয়ে করতে চাই না।তার জন্যই আমি আপনার থেকে সময় পেতে পারি ? করবেন, আমার জন্য অপেক্ষা ?

–জ্বি, অবশ্যই। আমি ভীষণ স্পষ্টবাদী। সেটা এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝেছেন।আপনি আমাকে দুই দিন সময় দিন।দুই দিন পর আপনাকে জানাচ্ছি।

–জ্বি আচ্ছা।তবে তাই হোক। লাবীব কথাটা বলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি আর কিছুই বললাম না।পা বাড়ালাম বাড়ির উদ্দেশ্যে।আমরা মেয়েরা অপেক্ষা করতে পারি সেটা পরিবারের সাপোর্টে।পরিবারের সাপোর্ট না পেলে আমরা মেয়েরা অপেক্ষা নামক শব্দটার কথা বলে কাউকে ওয়াদা করতে পারি না।তার জন্যই লাবীবের কাছ থেকে সময় নিয়ে আসা। বেশ ভেবেচিন্তে মা’কে সবটা খুলে বললাম।মা আমায় কেবল একটা কথাই বলেছেন, “তোর উপর আমাদের সম্পূর্ণ ভরসা আছে।আমরা জানি, তুই এমন কিছু করবি না যাতে করে সমাজে আমাদের মাথানিচু হয়ে যায়।” পরিবার থেকে এতটুকু সাপোর্ট পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার।এখন পুরোটাই আমার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে। দুইদিন পর যথারীতি সেই জায়গাতেই চূড়ান্ত কথা বলার জন্য লাবীবের সামনে আসা।

–আপনি কি সিদ্ধান্ত নিলেন মীনাক্ষী ? দেখুন মীনাক্ষী আপনি না বলতেই পারেন। কারণ আপনি,যেহেতু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ সেহেতু আপনার নিজস্ব মতামতকে আমি যথেষ্ট সম্মান করি।কিন্তু অনুগ্রহ করে এটা বুঝে উত্তরটা দিবেন যে আমি আপনাকে অনেক ভালবাসি ! লাবীবের কথা শুনে আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম।লাবীবের চোখ টলমল করছে।মনে হচ্ছে, এই টুপ করে চোখের পানি পড়ে যাবে !

–আপনি ঠিক তখনি আমায় বিয়ে করতে পারবেন যখন আপনি বুঝতে শিখবেন আপনাকে। আমার চাহিদা সীমিত ! আপনাকে আহামরি কিছু করতে হবে না আমার জন্য। আমার কোটি কোটি টাকা বা অট্টালিকা চাই না।আমি চাই, সাধারণের মাঝে একজন অসাধারণ মানুষকে।যে টাকার ভীড়ে সম্পর্ক না হারিয়ে বরং সৎভাবে উপার্জন করে তার স্ত্রীর পাশে থাকবে।যে তার স্ত্রীকে সোনায় সোহাগা নয় বরং ভালবাসায় সোহাগা করে রাখবে।যেমন করে মধ্যবিত্ত সংসারে আমার বা আপনার মায়ের দিন কেটেছে তাদের স্বামী সন্তান আর সংসারকে ভালবেসে, ঠিক সেই ভাবে আমি চাই আমার একটা সংসার হোক, আমার ঘর আলো করে আল্লাহর রহমত আসুক ,সেই সংসারে একজন আপনি থাকুন, সম্পূর্ণ আমার হয়ে। পারবেন তো ?

–আপনার মত একজন শুদ্ধ মানুষ যার ভাগ্যে থাকবে সেই মানুষটা আল্লাহর রহমতে সবটাই পারবে এবং আমি তা সম্পূর্ণভাবে আশা করি।

বছর কয়েক পেরিয়েছে আমার নতুন সংসারের।আজ ভীষণ প্রাপ্ত দেখাচ্ছে নিজেকে ! পাশে বসেই পাঁচ বছরের মেয়েকে চুল আঁচড়িয়ে জুটি করে দিচ্ছি লাবীব সাহেব ! আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি আর ভাবছি এই ছেলেটা বাচ্চা ভীষণ ক্যারি করতে পারে বাপু ! সত্যিকারের মানুষগুলা একটা সময় আল্লাহ্ জীবনে পাঠানই, কেবল সময়ের অপেক্ষা। আমরা যারা সৌভাগ্যবান কেবল তারাই তাদের আকড়ে ধরে বাঁচতে শিখি।বাকি মানুষগুলা পেয়েও হারায়। পূর্ণভাবে যে সম্পর্ক বা যে মানুষকে পাওয়া যায় না বরং আদতে একটু পাওয়া গিয়ে আমরা ভাবি সম্পর্ক বোধহয় জেলখানা, ব্যাপারটা না সম্পূর্ণ ভুল।সেটা আমি লাবীবকে নিজের করে পেয়ে বুঝেছি।

তাছাড়া ঐসব মাঝপথে হাতছেড়ে দেওয়া মানুষকে জীবনে প্রায়োরিটি দিতে নেই। বরং সেই মানুষকে ভুলে, তাকেই গুরুত্ব দিন, যে আপনাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে, ভালবাসতে শিখিয়েছে। থমকে যাওয়া পথে থেমে যাবেন না।ভুল রাস্তা ধরেও এগিয়ে যাবেন না।রাস্তাতো অনেক আছে কিন্তু সঠিক রাস্তাটা আপনাকেই বেছে নিতে হবে। কারণ আপনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী।যাকে স্বয়ং আল্লাহ বিবেক বুদ্ধি দিয়ে তৈরি করেছেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত