বদল

বদল

বাচ্চা মিসকারেজ করে দাও নাকি আসলেই তুমি একজন বন্ধ্যা? কথাটা পাশের বাসার এক ভাবী বলতেই উঠে চলে এলো চারু। বাসায় আসার পর শাশুড়ি মা খোঁচা দিয়ে বললো, ” তোমার মত মেয়ে আমার ঘরের বউ! ভাবতেও ঘেন্না লাগে। ছি:! আমাদের চৌদ্দ গোষ্ঠীতে এমন বন্ধ্যা, অপয়া মেয়ে নেই! নেহাত রায়ান পছন্দ করেছিলো বলেই.. নিজের কপালটা নিজেই খেলো ছেলেটা! ” চারু কান্না থামাতে না পেরে সোজা রুমে চলে গেলো কিছু না বলে।

আজ ৫ বছর হয়ে গিয়েছে একটা বাচ্চা দিতে পারলো না চারু তার স্বামী রায়ানকে। এই কষ্ট নিজের তো আছেই তার উপর রায়ানের মুখের দিকে তাকালেও নিদারুণ কষ্ট লাগে। অনেকবার ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছে তারা দুজন কিন্তু বরাবরই এক কথা শুনে এসেছে, “কোনো সমস্যা নেই তেমন।” কিন্তু এরপরে ও কেন যে হচ্ছেনা এটা তাদের দুজনেরই অজানা। অন্যদিকে রায়ানের মা প্রতিদিন এটা ওটা বলে খোঁটা দিচ্ছে। এতদিন চারুকে বলতো, এখন রায়ানকেও বলে। একদিন নিজ কানে শুনলো চারু তার শাশুড়ি মা রায়ানকে চুপি চুপি বলছে, ” বাবা, কোথ থেকে যে এই মেয়ে ধরে এনেছিস! তোর জীবনটাই বোধ হয় শেষ করে দিলাম। ” অথচ এই শাশুড়ি মাকে চারু কত যুদ্ধ-বিদ্রহ করে তাদের বাসায় ঠাঁই দিয়েছে। চারু সোজা এসে বললো,

– তাই নাকি মা? তা কেন এ কথা বললেন আমাকে বুঝান তো? শাশুড়ি মা আমতা আমতা করে বললো,
– ওমা! কেন আবার। তুমি কি কচি খুকি নাকি যে এটাও তোমাকে বলে-কয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে? চারু বললো,

– মা, আপনিতো পাঁচজন ছেলে, দুজন মেয়ের জন্ম দিয়েছেন। তাইনা? তা এই এত এত ছেলেপুলে হইয়ে আপনার কয় আনা লাভ হয়েছে বলেন তো? এইতো সেদিনই তো আমি আপনাকে আপনার মেজ ছেলের বাড়ি থেকে নিয়ে এলো রায়ান। আপনি কি ভুলে গিয়েছেন কি হয়েছিলো আপনার সাথে? শাশুড়ি মা কাচুমাচু করে বললো,

– বারে..তোমার তো দেখি অনেক তেজ! বাবা রায়ান! তুই না আমার ছোট ছেলে? তোর সামনে তোর বউ আমাকে তোর বাসায় থাকার খোঁটা দিচ্ছে? তুই কিছু বলবি না? রায়ান কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু রায়ানকে থামিয়ে দিয়ে চারুই উত্তর দিলো,

– মা। আপনি একবার ভাবুন তো বাবার মৃত্যুর সময় এবং আগে আপনি কোথায়, কি অবস্থায় ছিলেন আর একি মানুষ বাবার মৃত্যুর পর এতদিন কোথায়, কিভাবে ছিলেন? বাবা থাকাকালীন সব সুখই ছিলো আপনার.. কিন্তু বাবা মারা যাবার পর আপনার থাকার ব্যবস্থা নিয়ে কত কাহিনী হয়েছিলো তা কি আপনি ভুলে গেলেন মা? আপনার বড় ছেলের ভাগে আপনাকে রাখার দায়িত্ব পড়লে সে সটান না করে দিয়ে দিব্যি বউয়ের সাথে সুইজারল্যান্ড চলে যায় বেড়াতে।

দ্বিতীয়জন তো আপনাকে সহ্যই করতে পারেনা। আপনাকে কেন বাবাকেও করতোনা। যে ছেলে সামান্য একটা থাপ্পড়ের জন্য নিজের বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েও আসেনা… সে কিনা নিবে মায়ের দায়িত্ব? যাক তার কথা আর বললামই না। তারপর, আপনার তৃতীয় ছেলে, বড়ই গুণধর ছেলে।তার বাসায় আপনি কিছুদিন ছিলেন। আমরা সব জানি। সে ঠিক কি কি করেছিলো, কতটা অপমান করেছিলো আপনাকে। সে স্বনামধন্য ইঞ্জিনিয়ার, তার গেস্টের সামনে আপনাকে কখনো নিতো না কেন? কারন তার প্রেস্টিজের ব্যাপারে সে ভীষণ সসচেতন। তাই তার প্রেস্টিজের মুখে নাকি চুনকালি লেগে সব ছারখার হয়ে যাবে আপনাকে তার গেস্টের সামনে আনলে। আপনাকে একটা স্টোর হাউজে লুকিয়ে রাখতো ঐ মূর্খটা, যখনি কেউ বাসায় আসতো। বা বা বা মা! আপনিতো ধন্য তাইনা? আপনার অনেক ছেলে মেয়ে আছে।

এবারে আসি চতুর্থ ছেলের প্রসঙ্গে। ভাইতো নিজেই দিন এনে দিন খায় সেখানে আপনাকে কোথায় রাখবে,কিভাবে রাখবে তা আর বললামই না। সেটা মেনে নেওয়া যায়। তবে এটাও মেনে নেওয়া যায় যে, যদি উনাদের দু বেলা দু মুঠো খাবার কপালে জুটতে পারে; তাহলে আপনার বেলায় কেন কাঁচকলা? যাক গে, সেটাও না হয় গণনায় আনলাম না। আর আপনার মেয়েরা তারা তো বিয়ে করে নিয়ে, সম্পত্তির ভাগ পেয়ে এই যে গা ডাকা দিয়েছে… আর তাদের পায় কে! বাবার মৃত্যুর পর এই যে গেছে তো গেছেই আর একটিবারের জন্য ও এলোনা নিজের বলতে শুধু এই একমাত্র মা-ই তো বেঁচে আছে তাদের।

তারপর ও তাদের বিন্দুমাত্র টান নেই। আমি সেদিন আপনার বড় মেয়েকে হালকা কথা ছোঁয়াতেই বেশ বেজে উঠেছিলো। কিন্তু আসল ব্যাপারটা তাদের বাড়ির কাজের লোকের কাছ থেকেই শুনে নিয়েছিলাম। কি জানেন?”এক মায়ের ভার,তেজই নিতে পারিনা এখন আবার পুরোনো মায়ের উপস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়।” ছোট মেয়ে তো বিদেশেই। সে তার স্বামী, সংসার নিয়ে বিদেশে দিব্যি সুখেই আছে। এক কথায়, আপনার যে এত এত ছেলেপুলে কেউইআপনাকে রাখতে চায়নি মা। কেউই! অথচ ঐ মান্দাতার আমলে এত কষ্ট করে, এতগুলো বাচ্চার জন্ম দিয়েছিলেন। কেন? আপনার শাশুড়ির ইচ্ছানুযায়ী.. আপনার কি লাভ হলো এতে মা? কি লাভ? এই এত কষ্টের বাচ্চাগুলো কি আপনার কষ্টের মর্যাদা দিতে পেরেছে? এদের মত বাচ্চা না হলে বরং আপনি সুখীই হতেন। পায়ের উপর পা দিয়ে থাকতে পারতেন।

তাহলে বলুন মা, আল্লাহ আপনাকে সাত বাচ্চার জননী করেও অসুখী রেখেছে আর আমায় একটা বাচ্চা না দিয়েও অসুখী রেখেছে। দুটোতো একি হলো, তাইনা? তবে মা.. আমাকে এটা মানতেই হবে। কষ্টটা আমার চেয়ে আপনারই বেশি কারন আপনি এত কষ্ট করে এতগুলো সন্তানের জননী হয়েও সামান্য মাথা গুজার ঠাঁইটুকুও পাননি। আর আমি.. বন্ধ্যা কিনা জানিনা তবুও আমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলকারন আমার স্বামী থাকবে ইনশাল্লাহ্, আপনার সন্তানদের মত সন্তানতো অন্তত থাকবেনা..যে সন্তান নিজের গর্ভধারিণী মাকে ঘৃণা করবে,দূরে ঢেলে দিবে এমন সন্তানের মা আমি হতে চাইনা মা!

কে জানে হয়তো আমার যদি সন্তান হয় তাহলে হয়তো এমনি হবে, তাইজন্যই হয়তো বিধাতা আমায় সন্তান দিচ্ছেন না ° আর হ্যাঁ। বাকি রইলো আপনার ছোট ছেলে ওরফে আমার স্বামী রায়ান। সে কি করেছে মা? একটিবার ভেবে দেখুন? আমার স্বামীর তো মা আপনার ঐসব ব্যবসায়ী, ইঞ্জিনিয়ারদের মত কাড়ি কাড়ি টাকাকড়িও নেই কিন্তু নিজের বিধবা মাকে নিজের বাসায় শান্তিতে রাখার ক্ষমতাটুকু কিন্তু তার ঠিকই আছে।

আমি আপনার ছেলেকে জোর করে আপনাকে আনতে পাঠিয়েছিলাম। কেন জানেন? কারন কোনো না কোনো দিক দিয়ে আমরা দুজনেই এক.. আমরা অসহায় বড্ড বেশিই অসহায় আপনি সন্তান জন্ম দিয়ে, আর আমি সন্তান জন্ম না দিয়ে। আপনি সন্তান জন্ম দিয়েও অসুখী আর আমি অসুখী সন্তান জন্ম না দিয়ে মা গো, আপনি সান্ত্বনা পাবেন আমাকে দেখে, আর আমি সান্ত্বনা পাই আপনাকে দেখে। তাইজন্যই তো আপনাকে এখানে নিয়ে আসতে বলছিলাম আপনার ছেলেকে.. আমরা দুজনেই যে একি নৌকার মাঝি শুধু গন্তব্য আলাদা!

আপনার কষ্ট আমি বুঝবোনা আবার আমারটাও আপনি বুঝবেন না। কিন্তু শিক্ষা নিয়েছি আমি আপনার থেকে আর আপনি ভবিষ্যৎ _এ হয়তো কোনোদিন একদিন আমাকে দেখে শিক্ষা নিবেন। শুধু আপনিই নয়, গোটা সমাজ শিক্ষা নিবে যারা আমার মত বন্ধ্যা/নি:সন্তান নারীদের নিয়ে কটু কথা বলে, সমালোচনা করে। সেদিন আমার স্বার্থক বাণী হবে একটা, ” আমি হয়তো সন্তান জন্ম দিতে পারিনি কিন্তু কুৎসিত এ সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে শিক্ষা তো দিতে পেরেছি। ” কথাগুলো শেষ করার পর চারু হাত তালির আওয়াজ শুনতে পেলো। পিছনে ঘুরে দেখলো রায়ান হাত তালি দিয়ে এগোচ্ছে চারুর শাশুড়ি মায়ের চোখ থেকে টপ টপ করে চোখের জল পড়ছে চারু শাশুড়ি মায়ের কাছে এগিয়ে এসে বললো,

– একি মা! আমি কি কিছু ভুল বলেছি? আপনি আমাকে মারেন,বকেন। যা ইচ্ছা তাই করেন। তবুও কাঁদবেন না দয়া করে। আমার মা নেই। তাই মায়ের কান্না আমার হৃদপিন্ড, কলিজায় গিয়ে ছেদ সৃষ্টি করে শাশুড়ি মায়ের দুই ঠোঁট কাপঁছে, একটিকে আরেকটির সাথে লাগিয়ে দিয়ে নাক কুঁচকে কাঁদতেছে অনবরত তিনি এগিয়ে এসে চারুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

– মারে.. আমি স্বার্থক তোর মত বউ পেয়ে.. তুই নি:সন্তান থাক, বন্ধ্যা থাক। আমার কোনো আপত্তি নেই। চারু মায়ের গায়ে নিজেকে আরো জড়িয়ে নিলো শক্তভাবে..তারপর বললো,
– কেন মা? নাতি-নাতনি চাইনা? শাশুড়ি মা বললেন,
– না। চারু বললো,
– কেন? শাশুড়ি মা বললেন,
– ওরা আসলে যদি তুই তোর এই মেয়েকে ভুলে যাস? তখন কি হবে আমার?

চারু তৃপ্তির হাসি হাসলো। নিজের শাশুড়ি মায়ের মুখে এরকম ভাষ্য শুনে চারু তৎক্ষণাৎ ঐ রুম থেকে বেরিয়ে নিজ রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। শাশুড়ি আর রায়ান শুনতে পেলো চারু চিৎকার করে কাঁদছে শাশুড়ি মা দরজা ধাক্কা দিতে গেলো ঠিক তখনি রায়ান বললো,

– না মা। থাক। ওকে কাঁদতে দাও। কাঁদুক। আজ ওর কান্নার দরকার আছে। ওর এই কান্না শান্তির কান্না, অর্থবহ কান্না, নিজের মাকে ফিরে পাওয়ার সফল কান্না, একজন নি:সন্তান নারীর ব্যর্থতার কান্না.

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত