দায়িত্ব

দায়িত্ব

ঘুমিয়ে আছি,হঠাৎ করেই শাশুড়ি মায়ের ডাক। ডাকাডাকির সাথে সাথে দরজায় নক করছে।

-কুহু এই কুহু বেলা কত হয়েছে খবর আছে?

তড়িঘড়ি করে উঠে বসে পড়লাম।ওমা এতো দেখছি সকাল নয়টা বেজে গেছে। ৩০ মিনিটে কি করবো আমি। সাড়ে নয়টার মধ্যেই তো সব সারতে হবে।

-উঠছি মা।

-তাড়াতাড়ি।
-আচ্ছা মা।

তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিলাম। রেডি হতে হতেই মা আমার জন্য প্লেটে করে খাবার নিয়ে এসে আমাকে বসিয়ে নিজ হাতে মুখে তুলে খাওয়াতে লাগলেন।

-আজ এত দেরি করে ঘুম ভাঙলো যে? রাতে ঘুম হয়নি বুঝি। নাকি শরীর খারাপ করলো?দেখি দেখি কপাল টা।(কপালে হাত দিয়ে)
-না মা কিচ্ছু হয়নি আমার।ওই একটু লেইট করে ঘুমিয়েছিতো তাই।

-রাত না জেগে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমানো যায়না? কত করে বলি,একটু তাড়াতাড়ি ঘুমাবি।নিজের যত্ন নিবি।তা না।

-আমার যত্ন নেয়ার জন্য এই যে আমার মা আছে না।
-আমি নেই বুঝি?
-ওই যে তোর বাবা এবার ঢং করতে এসে গেছেন।
-কে বলেছে নেই?এই যে আমার বাবা আর মা আছেন আমার যত্ন করার।

আমার আর নিজের কি যত্ন করা লাগে? আজ থেকে তিন বছর আগের কথা। যেদিন প্রথম আমি বিয়ে করি এই বাড়ীতে আসি। একটা অজানা অচেনা এক পরিবারের আমার পা রাখা। একজন ঘটকের মাধ্যমে আমার আর তুহিনের বিয়ে হয়। কেউ কাউকে আগে থেকে চিনতাম না। কয় দিনের মধ্যেই দেখাদেখি তারপর আমার আর তুহিনের বিয়ে।

বিয়ের সময় অদ্ভুত একটা ভয় কাজ করতো মনে। কিজানি,কেমন হবে শশুড়,শাশুড়ি,বর। বান্ধবীদের সবার মুখে শুনি ওদের শশুড় শাশুড়ি নাকি ওদের উপর কি টর্চার টাই না করে।রান্না করতে দেরি হলে নাকি যা তা বলে গালি দেয়। বরও নাকি তাদের সাপোর্টে কথা বলে। বিয়ে করা মানেই নাকি জীবন টা শেষ। সারাজীবন নাকি কাজের বুয়া হয়ে কাটানো। এসব শুনে বাবা মাকে বলতাম,কোন দিন বিয়েই করবোনা আমি। কিন্তু অনার্স শেষ করতে না করতেই এলো বিয়ের চাপ। আশেপাশের সবাই বাবা মায়ের মাথা যেন খারাপ করে দিচ্ছিলো। মেয়ে কত বড় হয়ে গেলো,বিয়ে দাওনা কেন।ঘরে খাম (খুঁটি) দিবে নাকি।আরো কত কি।

বাবা মা ও ছেলে দেখা শুরু করলেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার কোন পছন্দের পাত্র আছে কিনা। আমি না করলাম।কারণ কেউ নেই আমার জীবনে এমন।বাবা মায়ের এক মাত্র মেয়ে হওয়ায় তাদের পছন্দেই বিয়ে করবো বলে ডিসিশন নিয়েছিলাম। তাই আর কারো প্রেমে ট্রেমেও পড়িনি। ভাইয়া কয়েক বারই জিজ্ঞেস করেছে,কেউ থাকলে আমাকে বল।আমি বাবা মাকে বলি। আমি সোজা না করে দিলাম। শেষমেস বাবা মা আর ভাইয়া তুহিনকে পছন্দ করলেন। তুহিন ওর বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান।বাবা মাকে নিয়েই ওর পৃথিবী।

বান্ধবীরা বিয়ের সময় বল্লো,এক ছেলের বউ এর আরো জ্বালা বেশি। বর না পারবে বাবা মায়ের কথা ফেলতে না পারবে বউ এর কথা রাখতে। অশান্তি করলেও ভিন্ন হবার চান্স নেই।এক মাত্র ছেলে যে। বিয়ে করে তুহিনের ঘরে আসলাম। কিছু টা ভয় মনের মধ্যে বাসা বাধলেও। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম,বাবা মা যেমনই হোক,তাদের আমার নিজের বাবা মায়ের মত দেখতে হবে। কেননা তাদের আমি আর তার ছেলে ছাড়া কেই বা আছে। ছেলেতো সারাদিন অফিসের বাইরেই থাকবে। সংসারটাকে আগলে রাখতে হবে আমার।আমি ঠিক তো সব ঠিক।

মা একটু রাগারাগি করলেও আমি চুপ করে সব শুনবো,কেননা বড় রা বকলে ভালোর জন্যই বকবেন। একদিন দু দিন সে রাগারাগি করলে,যখন দেখবে যে আমি মুখে মুখে কোন জবাব দেইনা।তখন তিনিই আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবেন। তাছাড়া আমি এমন কোন কাজ করবোই বা কেন,যেগুলো তে সে রাগ করবেন। একটা সংসারে সুখ শান্তি আসতে পারে একজন বউ এবং একজন শাশুড়ির সুসম্পর্কের মাধ্যমে। এই দুজন মানুষ ই পারে সংসার টাকে আগলে রাখতে। আমি তার সাথে ভালো ব্যবহার করলে, সে কেনই বা আমার সাথে খারাপ করবেন। বান্ধবীদের আমি ভুল প্রমাণ করবো। ওদের বুঝিয়ে দেবো যে শাশুড়ি মা ও নিজের মায়ের মত হয়। আর ঘরের বউ ও নিজের মেয়ের মত হয়। ভাবতে ভাবতে তুহিনের আগমন।

-উহুম উহুম।
-আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম।
-কেমন আছো?
-জ্বী আলহামদুলিল্লাহ্‌।আপনি?
-আমিও আলহামদুলিল্লাহ্‌।
-আচ্ছা,
-আন ইজি ফীল হচ্ছে?
-উঁহু।
-একদম স্বাভাবিক ভাবে নিবে সব কিছু।

আজ থেকে এই পরিবার এই সংসার টা তোমার।এমন কি আমার মা বাবাও আজ থেকে তোমার বাবা মা। উনাদের আমি ছাড়া কেউ ছিলো না এই পৃথিবীতে।আজ তুমি তাদের মেয়ে হয়ে এসেছো।আশা করি তুমি তাদের সব সময় দেখে রাখবে।

-জ্বী অবশ্যই।
-আর আমাকে বন্ধু মনে করবে।

বন্ধুর মত সব কিছু আমার সাথে শেয়ার করবে।যা কিছু প্রয়োজন হবে আমাকে বলবে। আমি জানি,আমরা অপরিচিত। কিন্তু আজ থেকে আমরা সব থেকে পরিচিত।এবং কাছের মানুষ।আপনজন।

-জ্বী।
-তুমি আমাকে তুমি করে বলবে।
-জ্বী আচ্ছা।
-আর নতুন একটা পরিবারে এসেছো বলে যে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে হবে,তা কিন্তু নয়।

নিজের মত করে চলবে। আর আজ থেকে আমার বাবা মা আমার আর এই সংসারের দায়িত্ব তোমার।
আর তোমার দায়িত্ব আমার। তুমি আমাদের এই ছোট্ট পৃথিবীটাকে তোমার আঁচল দিয়ে আগলে রেখো।

-রাখবেনা?
-অবশ্যই রাখবো।আজ থেকে এই পৃথিবীটা যে আমারো।

আর এই পৃথিবী দেখা শোনা করার দায়িত্ব টাও আমার। সেদিনই বুঝে গিয়েছিলাম,আমার ভাগ্য গুণে আমি তুহিনের মত একজন স্বামী পেয়েছি। সেই দিন থেকে শুরু হয় আমার নতুন জীবন। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি কিচেন রুমে যাই। গিয়ে দেখি মা নাস্তা বানিয়ে ফেলেছেন।

-এত তাড়াতাড়ি উঠে গেছো?

যাও একটু রেস্ট করো।কাল সারাদিন কত ধকল গেছে তোমার উপর।আমি নাস্তা বানিয়েছি। কয় দিন ঘুরো ফিরো,তারপর সংসার তো তোমারই।তখন আমাদের সব করে খাওয়াবে। এখন না হয় কিছু দিন আমার মেয়েটাকে আমি আদর যত্ন করে বড় করে নেই। মায়ের কথা গুলো শুনে আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম। মাও আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, পাগলি মেয়ে আমার। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি বাবা আর তুহিনও দাঁড়িয়ে।

আমি আর মা মিলে সংসার টাকে আনন্দে ভরে তুল্লাম। আমার বান্ধবীদের ভুল প্রমাণ করলাম। আমরা চাইলে সব করতে পারি। শুধু একটু চেষ্টার প্রয়োজন,ধৈর্য্যের প্রয়োজন,আর আদর ভালবাসার প্রয়োজন। তাহলেই আমরা শাশুড়িমাকে শুধু মা করে নিতে পারি। আর পুত্র বধূকে মেয়ে করে নিতে পারি। তিনটা বছর কেটে গেছে, আমি এ সংসারে আছি। মা প্রতিদিন সকালে আমার জন্য নাস্তা বানান। আমি না করলেও শোনেন না,আমি অফিস থেকে ফিরে রাতের খাবার তৈরী করি।এক সাথে খাই আমরা। বাবা আমার জন্য বাইরে থেকে ছোট বাচ্চাদের মত চকলেট আইসক্রিম নিয়ে আসেন।

সব আছে আমাদের, আদর,মায়া,মমতা,ভালবাসা, শুধু তুহিন নেই।আমাদের তুহিন নেই। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় ও রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। আব্বু আম্মু ভাইয়া চেয়েছিলো আমাকে নিয়ে যেতে। বাবা মাও বলেছিলেন,আমি চাইলে চলে যেতে পারি তাদের সাথে। কিন্তু আমি যাইনি, কারণ আমার যে দায়িত্ব আছে, বাবা মায়ের উপর,আমার তুহিনের কথার উপর। আর এই যে আমার সংসার টার উপর।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত